Listen to ভাষা: আল্লাহ্ প্রদত্ত এক অনন্য উপহার | www.muslimmedia.info byMuslim Media on hearthis.at
ছোটবেলায় বাংলা ব্যাকরণ শিখতে গিয়ে বিভিন্ন মনিষীদের দেওয়া ভাষার সংজ্ঞা মুখস্থ করতে হতো। সেইসব গুরুগম্ভীর সংজ্ঞা মুখস্থ করা মোটেও সুখকর ব্যাপার ছিল না আমার কাছে। অনেক বছর পর যখন কুরআনের অর্থ নিয়ে পড়া শুরু করলাম, ভাবা শুরু করলাম, তখন কুরআনের মাধ্যমে এমন কিছু ব্যাপার নিয়ে জানা শুরু করলাম, যেটা আমার জন্য ছিল ভীষণরকম এক চমকপ্রদ ব্যাপার। তেমন একটা ব্যাপার হচ্ছে কুরআনে ভাষার আলোচনা।
ভাষা আল্লাহ’র দেওয়া একটা অপূর্ব নিয়ামত। ভাষা ছাড়া মানবসভ্যতা অচল। যদি ভাষা না থাকতো , তাহলে কি অবস্থা হতো আমাদের একবার চিন্তা করে দেখুন। সূরা বাকারার ৩১ নাম্বার আয়াত থেকে জানা যায় যে, মহান আল্লাহ্ আদম আলাইহে ওয়া সাল্লামকে সমস্ত জিনিসের নাম, তাদের গুণাবলী এবং তাদের কার্যক্রম শিখিয়ে দিয়েছিলেন। অর্থাৎ সবার আগে উনাকে ভাষা শিক্ষা দিয়েছিলেন। এভাবেই তিনি আদম আলাইহে ওয়া সাল্লামকে ফেরেশতাগণের ওপর মর্যাদা দান করেছেন।
কল্পনা করুন যদি বস্তু এবং ধারণাগুলিতে নাম দেওয়ার বিষয়ে আমাদের ভাষার এই জ্ঞানের অভাব থাকতো, তাহলে আমাদের হয়তো গরুর বর্ণনা দিতে হতো এভাবে, ‘এমন প্রাণী যার চারটি পা আছে, যা ঘাস খায়, দুধ উৎপাদন করে এবং শিং আছে ইত্যাদি’। যদি কোনো ভাষাই না থাকতো, তাহলে কি হতো? আর তখন যদি ‘ভয়’, ‘লজ্জা’, ‘সাহস’, অথবা ‘ক্ষুধার’ মত অদৃশ্য ধারণাগুলো বর্ণনা করতে চাইতাম, চিন্তা করে দেখুন যে আমাদের জন্য কাজটা কত জটিল হতো। এটা তো আল্লাহ’র রহমত যে, তিনি আমাদেরকে বিশাল বিপদ থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন এবং আমরা ‘গরু’, ‘ঘোড়া’, ‘ভয়’, ‘লজ্জা’, ‘প্লেট’ ‘গ্লাস’ ইত্যাদি একেকটা শব্দ দিয়ে মনের অবস্থার কথা বা কোনো বস্তুর কথা বুঝাতে পারি এবং বুঝতে পারি।
বিবর্তনবাদ অনুসারে প্রাইমেট থেকে মানুষের সৃষ্টি । এই বিশ্বাস নিয়ে যারা জীবন যাপন করে থাকে, তাদের জন্য একটা চিন্তার খোরাক দেই। ভাষা কিন্তু একটা জটিল পদ্ধতি। এর সাথে জড়িত আছে শব্দ ভাণ্ডার, বাক্য গঠন, বাচনভঙ্গি, বিভিন্ন অঙ্গের মাধ্যমে ভাষার উচ্চারণ, শব্দের প্রয়োগ, গ্রহণযোগ্য বাক্য উৎপাদন করার জন্য পারস্পরিক যোগাযোগ ইত্যাদি। ব্যাপারটা একইসাথে শরীরবৃত্তীয়, স্নায়বিক এবং মানসিক অবস্থার সাথে জড়িত। এটি সমাজে টিকে থাকার অস্তিত্ব। এতকিছু মিলেই কিন্তু মানুষের ভাষা তৈরী হয়। মহান আল্লাহ্’র অবদান ছাড়া এই জটিল ব্যাপার মানুষ রপ্ত করতে পারে না। তাই ভাষা জিনিসটা স্রষ্টার অস্তিত্বের নির্দেশক।
এই পৃথিবীতে একটা মানবশিশু সবচেয়ে বেশী অসহায় । জন্মের পর তাকে পিতামাতার উপর নির্ভরশীল হতে হয়। অথচ একটা প্রাণী জন্মের কিছুক্ষণ পরেই হাটতে শুরু করে, খুব অল্প সময়ের মাঝেই নিজের খাবার নিজে খুঁজে নিয়ে খেতে পারে। কিন্তু মানবশিশু তা পারে না। তার পরিবার লাগে। আর পরিবার মানেই হচ্ছে ভাবের আদান প্রদানের মাধ্যমে সকল কার্য সম্পাদনের স্থান এবং ভাষার মাধ্যমেই তা করা হয়ে থাকে। পরিবার থেকেই হয় সমাজ। যেখানে কোনো ভাষা নেই, সেখানে কোনো পরিবার নেই, সমাজ নেই। সমাজ না থাকলে কোনো সভ্যতাও থাকতো না। আর সভ্যতা না থাকলে থাকতো না কোনো উৎপাদন। আর উৎপাদন না থাকলে আজকে আপনি এই লেখাটাও পড়তে পারতেন না।
ভাষা এমন এক বিশিষ্ট গুন যা মানুষকে জীবজন্তু এবং অন্যান্য সৃষ্টি থেকে পৃথক করে। হ্যাঁ, প্রাণীদেরও ভাষা আছে, কিন্তু সেটা মানুষের মত ভাষা নয়। যদি তাদের ভাষা মানুষের মত হতো, তাহলে তারা মানুষের মত উন্নত জীবন যাপন করতো। মানুষ চোখ দিয়ে যা দেখে, কান দিয়ে যা শুনে, মন মগজ দিয়ে যা চিন্তা করে , মুখ দিয়ে তা প্রকাশ করে , হাত দিয়ে লিখেও তা প্রকাশ করে। ভাষা প্রকাশের জন্য মানুষের শরীরকে আল্লাহ্ সেভাবেই তৈরি করে দিয়েছেন। আল্লাহ্ আমাদের যে ভাষার নেয়ামত দিয়েছেন, সেটার জন্য আমাদের সর্বদা শুকরিয়া আদায় করা উচিৎ।
আল্লাহ্ যেমন বিভিন্ন ধরণের জাতি সৃষ্টি করেছেন, বিভিন্ন রঙের মানুষ সৃষ্টি করেছেন, ঠিক তেমনি তাদের জন্য বিভিন্ন ভাষাও সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ বলেন-
আকাশমালা ও যমীনের সৃষ্টি, তোমাদের পারষ্পরিক ভাষা ও বর্ণ বৈচিত্র নি:সন্দেহে তার কুদরতের নিদর্শন সমূহের মাঝে এক একটি বড় নিদর্শন। অবশ্যই জ্ঞানবান মানুষদের জন্য এত অনেক নিদর্শন রয়েছে। [সূরা রূম: (২২)]
আরবি, ফার্সি, হিন্দি, বাংলা, ইংরেজি, তুর্কি ইত্যাদি কত ধরণের ভাষা পৃথিবীতে আছে। এসব ভাষায় কথা বলার সময় লক্ষ্য করা যায় যে, সবার ঠোঁট, জিহ্বা, কণ্ঠনালী থাকার পরেও একেককজন মানুষের গলার স্বর আর উচ্চারণভংগিও একেক রকমের হয়ে থাকে। এই যে এত বৈচিত্র্য, এর মাঝেই আছে সৌন্দর্য। না হলে তো সব একঘেয়েমি হয়ে যেত।
আল্লাহ্ বিভিন্ন জাতির কাছে বিভিন্ন নবী রসূল পাঠিয়েছেন। উনারা সেই জাতির ভাষাতেই কথা বলেছেন এবং তাঁদের উপর সেই জাতির ভাষাতেই কিতাব নাযিল হয়েছিল। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেছেন-
আমি কোনো নবীই এমন পাঠাইনি, যে তার জাতির ভাষায় আমার বাণী তাদের কাছে পৌাঁছায়নি, যেন সে তাদের কাছে আমার আয়াত পরিস্কার করে বুঝিয়ে বলতে পারে। [সূরা ইবরাহীম : (৪)]
অর্থ্যাৎ মানুষ যেন সহজেই আল্লাহর দেওয়া বিধি বিধানগুলো অনুধাবন করে নিজের জীবনে তা বাস্তবায়ন করতে পারে এজন্য যার যার মাতৃভাষায় কিতাব নাজিল করা হয়েছে। আরেকটা কারণ হচ্ছে যে মানুষ যেনো কোনো ওজর পেশ না করতে পারে যে, তারা কিছুই বুঝতে পারেনি।
আল্লাহ্ প্রত্যেক নবীকে তার জাতির কাছে পাঠিয়েছেন, কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাললাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামকে সমগ্র বিশ্বের সকল ভাষাভাষীর জন্য রাসুল রূপে পাঠিয়েছেন। কোনো জাতির জন্য সুনির্দিষ্ট করে নয়। সূরা আরাফের ১৫৮ নাম্বার আয়াতে, সূরা ফুরকানের ০১ নাম্বার আয়াতে ও সূরা সাবার ২৮ নাম্বার আয়াতে এ ব্যাপারে বলা আছে। তাই আরবী ভাষাটা জানা উত্তম। অন্তত ততটুকু জানা দরকার, যতটুকু জানলে আল্লাহ্র কালাম ও রাসুলের সুন্নত জানা যাবে। আল্লাহ্ কুরআনে অনেকবার বলেছেন যে, কুরআনকে তিনি বুঝার জন্য সহজ করে দিয়েছেন। আর সে কারণে দেখা যায় যে, সারা পৃথিবী জুড়ে আরব বা অনারব কুরআন সহজে বুঝতে পারে, মুখস্থ করতে পারে এবং সেই অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করতে পারে।
ভাষার প্রকাশভঙ্গি সুন্দর ও অসুন্দর দুই ভাবেই করা যায়। ভাষার মাধ্যমে আমরা যেহেতু আমাদের মনের আনন্দ, খুশী, ক্ষোভ, রাগ, দুঃখ, হতাশা ইত্যাদি প্রকাশ করে থাকি, সেই প্রকাশভঙ্গি যেন সুন্দর হয়। আল্লাহ্ মূসা আলাইহে ওয়া সাল্লামকে নম্র ভাষায় ফেরাউনের সাথে কথা বলার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন-
হেদায়েত করার সময় তোমরা তার সাথে নম্র কথা বলবে, হতে পারে সে তোমাদের উপদেশ কবুল করবে অথবা সে আমাকে ভয করবে। [ সূরা ত্বোহা: (৪৪)]
আমাদের ভাষার প্রয়োগ আমাদের চরিত্রের কুরুচি অথবা সুরুচির পরিচয়কে ফুটিয়ে তুলে। নোংরা ভাষায় কথা না বলে, ভাষার অপব্যবহার না করে আল্লাহ’র দেওয়া নেয়ামতকে সম্মান দেখানোটাই বুদ্ধিমান মানুষের কাজ।
(আবদুল বাকি’র Language: a divine gift আর্টিকেলটা পড়ে উদ্বুদ্ধ হয়ে লেখা)
লেখক: তাহ্নিয়া ইসলাম খান
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।