কুরআন আমাদের মুসলিমদের জন্য মহান পথনির্দেশক। যাতে উল্লেখিত জান্নাতিদের বৈশিষ্ট্য পড়ে আমরা তাঁদের মতোই হতে চাই। চেষ্টা করি তাঁদের পথ অনুসরণের; খুশি করতে মহান আল্লাহকে। যিনি আমাদের কাছে কেবলমাত্র তাঁর নির্দেশ পালন ছাড়া আর কিছুই চান না। আর সেটা করার জন্য আমাদের সুযোগ তো এই এক জীবনই।
মুমিনদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা আয়াতসমূহের মধ্যে আমার সবচাইতে প্রিয় হলো সূরাহ আল-ফুরক্বানের সেই আয়াতগুলো, যেখানে আল্লাহ তা’আলা তাঁর প্রকৃত দাসদের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন। আর আল্লাহর প্রকৃত বান্দা তো তাঁরাই, যাদের তিনি ভালোবাসেন। তাই যত কষ্টই হোক না কেন, আমাদের সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে যেন আমরাও তাঁদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারি।
এই লেখাটা সর্বপ্রথম আমার নিজের জন্যই রিমাইন্ডার স্বরূপ। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের তাওফীক দান করুন। আমীন।
আল্লাহর পছন্দের বান্দাদের কিছু বৈশিষ্ট্য দেখা যাক:
১। আর রহমানের বান্দা তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং অজ্ঞ লোকেরা যখন তাদেরকে সম্বোধন করে, তারা বলে “সালাম।” [সূরাহ আল-ফুরক্বান (২৫):৬৩]
এই আয়াত থেকে আমরা জানতে পারি, নম্রতা একজন সত্যিকার মুমিনের অন্যতম একটি মহৎ গুণ। নম্রতার একটি উদাহরণ হতে পারে ‘আমার মধ্যে ভালো যা কিছু, তার সবই মহান আল্লাহ আমাকে দয়া করে দিয়েছেন। সুতরাং সেসব নিয়ে গর্ব করার কিছুই নেই’, এই বোধটা মনে থাকা। মুমিনদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, তাঁদের হাঁটাচলায়ও নম্রতা প্রকাশ পায়। তাঁরা সমালোচনার জবাবও দেন শান্তভাবে এবং বুদ্ধিদীপ্ততার সাথে। এবং খেয়াল করলে আমরা দেখবো, এভাবে জবাব দেওয়াটাই আসলে অধিক ফলদায়ক।
২। আর যারা তাদের রবের জন্য সিজদানত এবং দণ্ডায়মান হয়ে রাত্রিযাপন করে। [সূরাহ আল-ফুরক্বান (২৫):৬৪]
এখানে মূলত তাহাজ্জুদ সালাতের কথা বলা হয়েছে। আল্লাহর নিকট সবচাইতে পছন্দনীয় ইবাদাতগুলোর মধ্যে তাহাজ্জুদের সালাত অন্যতম। বিশ্বচরাচরের মহান অধিপতির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য এই সালাত তুলনাহীন। একবার চিন্তা করে বলুন তো কেন। দেখুন, আপনার আশপাশের পৃথিবী যখন গভীর ঘুমে মগ্ন, সে সময় আপনি সিজদানত হয়েছেন আপনার রবের সামনে!
আবু হুরায়রা (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
ফরজ সালাত ছাড়া নফল সালাতের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম সালাত হচ্ছে-রাতের (তাহাজ্জুদ-এর) সালাত। (মুসলিম: ১১৬৩)
এভাবে আরামের ঘুম ছেড়ে নফসের বিরুদ্ধে জিহাদে নামা তো নিঃসন্দেহে প্রকৃত ঈমানদার হবারই লক্ষণ।
৩। আর যারা বলে, “হে আমাদের রব, তুমি আমাদের থেকে জাহান্নামের আযাব ফিরিয়ে নাও। নিশ্চয় এর আযাব হলো অবিচ্ছিন্ন।”
“নিশ্চয় তা অবস্থানস্থল এবং আবাসস্থল হিসেবে অত্যন্ত নিকৃষ্ট।” [সূরাহ আল-ফুরক্বান (২৫):৬৫-৬৬]
আল্লাহর ক্ষমা লাভ করা যে কত বড় নিয়ামতপূর্ণ, তা তো ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। শুধু এটুকু জানলেই গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাবার মতো অবস্থা হয় যে, প্রত্যেক ভালো কাজ ফিরিশতারা লেখেন দশগুণ থেকে শুরু করে আরও বাড়িয়ে আর প্রতিটি গুনাহের কথা লেখা হয় একটি করেই। তার ওপর কাতরভাবে ক্ষমা চাইলে সেই একটিও আল্লাহ মাফ করে দেবেন, ইনশাআল্লাহ। সুবহানআল্লাহ! সুবহানআল্লাহ!! মুমিনগণ সবসময়ই জাহান্নামের আগুনে দগ্ধ হওয়া থেকে রক্ষা পেতে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চান। সেই শাস্তি এক মুহূর্তের জন্য হলেও তাঁরা সেটা থেকেও আশ্রয় চান। তাই তাঁদের মতো হতে হলে আমাদেরও এই দু’আর ওপর ‘আমল করতে হবে, সর্বক্ষণ। আল্লাহ সহায় হোন। আমীন।
৪। আর তারা যখন ব্যয় করে, তখন অপব্যয় করে না এবং কার্পণ্যও করে না। বরং মাঝামাঝি অবস্থানে থাকে। [সূরাহ আল-ফুরক্বান (২৫): ৬৭]
এটা দৃঢ় ঈমানদারের আরেকটি বৈশিষ্ট্য যে, তাঁরা অযথা টাকা ওড়ান না। এমনকি দুনিয়া বা আখিরাতে কল্যাণ নেই, এমন কোথাও সামান্যতম ব্যয় থেকেও বেঁচে থাকেন। আবার এ কারণে তাঁদেরকে কৃপণ ভাবলেও চলবে না। তাঁরা খরচ করেন যেখানে যতটুকু প্রয়োজন, কেবল ততটুকুই। জীবনের যেকোনো ক্ষেত্রে সফলতা লাভের জন্য পরিমিতিবোধের এই গুণ অর্জন করা উচিৎ। আর অর্থব্যয়ের সময় এ বোধ থাকাটা রীতিমতো দায়িত্বের পর্যায়ে পড়ে।
৫। আর যারা আল্লাহর সাথে অন্য ইলাহকে ডাকে না এবং যারা আল্লাহ যে নাফসকে হত্যা করা নিষেধ করেছেন, যথার্থ কারণ ছাড়া তাকে হত্যা করে না। আর যারা ব্যভিচার করে না। এবং যে তা করবে, সে আযাবপ্রাপ্ত হবে। [সূরাহ আল-ফুরক্বান (২৫):৬৮]
একজন সত্যিকারের মুসলিম কখনোই শির্কে লিপ্ত হন না। তিনি একমাত্র আল্লাহরই ইবাদাত করেন, আল্লাহর ওপর নির্ভর করে কেবলমাত্র তাঁর কাছেই সাহায্য চান; যে কোনো কাজের বেলায়, তা সে যত কঠিনই হোক। এ কথা নিশ্চয়ই আমরা সবাই জানি – সর্বশক্তিমান আল্লাহ তা’আলার সাথে কাউকে শরীক করার মতো পাপ আর নেই।
‘আবদুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
আমি নবী ﷺ- কে জিজ্ঞেস করলাম, “কোন গুনাহ আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বড়?” তিনি বললেন, “আল্লাহর জন্য অংশীদার দাঁড় করানো। অথচ তিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।” আমি বললাম, “এ তো সত্যিই বড় গুনাহ।…” (বুখারি: ৬০০১)
আর একজন প্রকৃত মুমিন অবৈধ শারীরিক সম্পর্কে জড়ানো থেকেও নিজেকে বাঁচিয়ে রাখেন। সতীত্ব রক্ষার ব্যাপারটাকে ইসলামে ভীষণ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, একে হালকাভাবে নেয়ার কোনো সুযোগই নেই।
এই বৈশিষ্ট্যগুলো আসলে বান্দার কাছ থেকে আল্লাহ যা যা চান, সেসবের খুব অল্প ক’টাকেই তুলে ধরে। কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় মুমিনদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কিত আরও বহু আয়াত আছে। উলামা ও ত্বলিবুল ইল্মগণ এই বিষয়ের ওপর প্রচুর লেখালেখি করেছেন, করছেন।
এটা ভাবার অবকাশ নেই যে, আমার এ লেখাটা আমি এখানে উল্লেখিত আয়াতসমূহের তাফসীর (ব্যাখ্যা) হিসেবে লিখেছি। এখানে আসলে আয়াতগুলো নিয়ে আমার ব্যক্তিগত ভাবনা তুলে ধরা ছাড়া আর কিছুই করিনি।
একটা কথা আবারো বলি। আমাদের সবারই কিন্তু আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের দারুণ সুযোগ আছে। শয়তান সদা তৎপর আমাদেরকে সীরাত্বাল মুস্তাক্বীম (সরল পথ) থেকে সরানোর জন্য। আর আমরা কোনো পাপকাজ করলে যেন আল্লাহর ক্ষমার ব্যাপারে নিরাশ হয়ে পড়ি, সেই চেষ্টাও সে চালিয়ে থাকে। শয়তানের এই ষড়যন্ত্রের বিপরীতে আমাদের সাহায্যের জন্য আছেন অসীম ক্ষমতার অধিকারী, পরম দয়ালু আল্লাহ তা’আলা। সুতরাং আমাদের একমাত্র কর্তব্য হলো তাঁর দিকে ফিরে আসা। আল্লাহ কারো ওপর তার সাধ্যের অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দেন না। সুতরাং তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করা আসলে অসম্ভব কিছু নয়। তাই আসুন নেমে পড়ি: লেগে থাকবো, উন্নতি ঘটাবো, বিজয় ছিনিয়ে আনবো – এই মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে। ইনশাআল্লাহ সফল হবোই। আল্লাহ তাওফীক দিন, আমীন।
উৎস: Islamic Online University Blog (মূল আর্টিকেল লিংক)
অনুবাদক: মাহমুদ বিন আমান, মুসলিম মিডিয়া প্রতিনিধি
অনুবাদ কপিরাইট © মুসলিম মিডিয়া
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।