এই উপমহাদেশের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী হাজ্জে যারা আসবেন তাঁদের চল্লিশ ওয়াক্ত সালাত মদীনাতে পড়তে হবে। যদিও এই বিশ্বাসের শক্ত কোনো দলিল নেই, কিছু দুর্বল অথবা জাল হাদিস ব্যতীত। বাংলাদেশ ও এর প্রতিবেশী দেশসমূহ ছাড়া আর কোথাও সম্ভবত এধরনের কোনো আমল করা হয় না। সৌদি থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহ, পাশ্চাত্যের মুসলিমগণ এবং বিশ্বের অন্যান্য কোনো দেশের মানুষ চল্লিশ ওয়াক্ত সালাত পড়ার জন্য মদীনাতে আসেন না।

মদীনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করা আলেমদের মুখেও শুনেছি যে, এ প্রসঙ্গে উপযুক্ত প্রমাণাদির বড্ড অভাব। তাই অন্যান্য দেশের মুসলিমরা ২/৩ দিন থেকে শুরু করে ৫/৬ দিন বা যত দিন মন চায় মদীনাতে অবস্থান করেন। এক্ষেত্রে কোনো বাঁধা ধরা নিয়ম মানেন না। মজার ব্যাপার হলো, পৃথিবীর অন্য কোনো দেশ থেকে যখন বাঙালিরা হাজ্জ করতে আসেন, তখন তাঁরাও এই চল্লিশ ওয়াক্ত সালাতের প্রচলিত গৎবাঁধা রীতির উপর আমল করেন না। এখন বিশ্বের অধিকাংশ মুসলিম সঠিক কাজ করছে, নাকি কেবল উপমহাদেশের জনগণ সঠিক সেটি নিয়ে এক বিশাল তর্কের সূচনা হতে পারে। তাই সেদিকে না যাওয়াই উত্তম মনে করছি।

IIRT Arabic Intensive

মদীনায় অবস্থান করা বা না করার উপর হাজ্জ কবুল হওয়া নির্ভর করে না। বরং মদীনায় মানুষ এজন্য আসেন, যেন মসজিদে নববীর মতো বরকতময় মসজিদে সালাত আদায় করতে পারেন। এ মসজিদে এক রাকাত সালাতে এক হাজার গুণ বেশি সওয়াব পাওয়া যায়। তাই মদীনা আগমনের কোনো নিয়ত যদি মনে থাকে, সে নিয়ত হতে হবে মসজিদ নববীতে সালাত আদায়ের নিয়ত, কোনো কবর যিয়ারতের নিয়তে ভ্রমণ করা ইসলামে জায়েয নয়।

যেহেতু আমরা বাংলাদেশ থেকে হাজ্জ করতে এসেছি, তাই আমাদের প্যাকেজ অনুযায়ী ৪০ ওয়াক্ত সালাত আদায় করার জন্য মোট ৯ দিন থাকার কথা নবীজী ﷺ এর শহরে। যদিও আমরা মনে মনে ঠিক করে নিলাম যে আমরা এখানে ৪০ ওয়াক্ত সালাতের নিয়তে নয়, সাধারণভাবে মসজিদে নববীতে সালাতের উদ্দেশ্যে যাচ্ছি।

মক্কায় দু’দিন থেকে সবার উমরাহ্‌ শেষ করার পর একদিন খুব ভোরে আমরা বাসে করে মদীনা রওনা হলাম। মক্কা ছেড়ে যেতে কিছুটা মন খারাপ লাগছে। আসলাম মাত্র দুদিন হয়েছে, আর ক’টা দিন থেকে যাওয়া যেত। পুরো সফরের প্রথমেই যদি মদীনাতে এসে কিছু দিন অবস্থান করে তারপর মক্কা যেতাম অথবা হাজ্জ শেষে একেবারে মদীনা হয়ে দেশে ফেরত আসতাম, তাহলে অর্থ সাশ্রয়ের পাশাপাশি যাত্রার ধকল কম হতো।

রওনা হবার সময় ব্যাগ ভরে কয়েক বোতল জুস ও এক প্যাকেট পাউরুটি নিয়ে নিলাম। অসম্ভব আর্দ্র মরুর দেশে কিছুক্ষণ পরপর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। এখানে ঘামও শুকিয়ে সারা দেহে পানির জন্য হাহাকার লেগে যায়। তাই প্রচুর পরিমাণে জুস, লাবাং, দই, দুধ ও বিভিন্ন কোমল পানীয় না কিনে উপায় থাকে না।

বাসে করে যাবার সময় এক পর্যায়ে মোয়াল্লেমের লোক আমাদের মাথা গুনে গেলো, তালিকা অনুযায়ী সবাই আছি কি না দেখার জন্য। যেকোনো স্থানে যাবার সময় বার কয়েক আমাদের এমন মাথা গোনা হয়। তালিকা দেখে নাম ধরে ডাকে, আর সবাই স্কুলের বাচ্চাদের মতো হাত তুলে, গলা খাঁকারি দিয়ে নানাভাবে নিজেদের অস্তিত্ব জাহির করে। ভাড়া করা ট্যাক্সিতে করে গেলে মদীনাতে সাড়ে তিন থেকে চার ঘণ্টায় পৌঁছানো যায়। বাসে করে গেলে সারাদিন লেগে যায়। কারণ সালাতের জন্য, ফ্রেশ হবার জন্য, খাবার জন্য বহুবার গাড়ি থামানো হয়।

মদীনার উদ্দেশ্যে যথারীতি অনেক দেরীতে বাস ছাড়লো। এদেশে এসে অপেক্ষা করতে করতে আমাদের মোটামুটি অভ্যাস হয়ে গেছে। এখন আর সময় মতো কিছু না হলে তেমন আশ্চর্য হই না। কারণ হাজ্জের সময় লাখ লাখ মানুষের সার্বিক ব্যবস্থাপনা সুচারুরূপে সম্পন্ন করতে গেলে সময়ের কিছুটা রদবদল হতেই পারে।

লোকালয় থেকে বহু দূরে শত শত কিলোমিটার বিস্তৃত এই মরু রাস্তায় মদীনাগামী পথিকদের যাত্রা বিরতির ও প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয়ের সুবিধার্থে বহু কিলোমিটার পর পর হঠাৎ করে হোটেল বা দোকান চোখে পড়ে। তেমন এক হোটেলে আমরা দুপুরের খাবার ও সালাতের জন্য নামলাম। এমন জনবিবর্জিত স্থানের দোকানে বাঙালি কর্মচারী দেখে বিস্মিত হলাম। খুব মায়া হলো এই ভেবে যে, দেশে তার স্ত্রী-সন্তানরা কি জানে কী ভয়াবহ একাকীত্বের ভেতর বসবাস করে তাদের স্বামী/বাবা অর্থ উপার্জন করছেন? দিনের পর দিন, বছরের পর বছর এভাবে নির্জনবাসে থাকলে মানুষের মস্তিষ্ক বিকৃতি হয়ে যাওয়াও অস্বাভাবিক নয়। কতটা দরিদ্রতা আর কষ্টে পড়লে কেউ এমন স্থানে বসবাস করতে পারে, সারা জীবন কাটিয়ে দিতে পারে, তা ভেবে কূল কিনারা পেলাম না। আর দেশে সকলে মনে করে তাদের ঘরের মানুষটি ‘বিদেশে’ থাকেন। তাও আবার যে-সে দেশে নয়, একেবারে রাজ-রাজড়াদের দেশে!! মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসী বাঙালিদের দুঃখ নিয়ে লিখতে গেলে হাজার পাতায়ও লেখা শেষ হবে না।

খাওয়া দাওয়ার পাঠ চুকিয়ে আবার বাস রওনা হলো। আসর ও মাগরিবের জন্য আরো দুবার বাস থামলো। সারাদিন এই তপ্ত মরুর মধ্য দিয়ে বাস চলতে চলতে সন্ধ্যার পর মদীনার প্রবেশ পথে এসে পৌঁছলাম। এখানে আরো একদফা “মাথা গোনা” হলো। Pilgrim অর্থাৎ হাজ্জ যাত্রীদের জন্য আলাদা প্রবেশ দ্বার রয়েছে, যা দিয়ে আমরা শহরে প্রবেশ করলাম। রাতের অন্ধকারেও বেশ বোঝা গেলো যে, মক্কার মতো রুক্ষ নয় মদীনা। বরং কোথায় যেন কিছুটা লালিত্য রয়েছে। মক্কায় যেমন যে যেখানে যেভাবে পেরেছে, সরু, ছড়ানো, চ্যাপ্টা, চারকোণা, তিনকোণা নানা আকৃতির দালান বানিয়ে হোটেল খুলে ফেলেছে, মদীনায় ঠিক এর বিপরীত চিত্র। সুনিয়ন্ত্রিত প্রশস্ত রাস্তা-ঘাট, মসজিদে নববীর চতুর্দিক ঘিরে সম-উচ্চতার দালানে চকচকে আধুনিক হোটেল, বিশেষত মসজিদ সংলগ্ন সব পথ-ঘাট বাড়ি ঘর যেন একেবারে গজ ফিতা দিয়ে মেপে এক মাপে তৈরি করা!!

আমরা রাত প্রায় ৯টার দিকে আমাদের হোটেলের সামনে এসে দাঁড়ালাম। বাস থেকে নামার আগে প্রত্যেককে হোটেলে যার যার রুম নাম্বার দিয়ে দেওয়া হলো। আমি আর রওশন আপা বাসে কাছাকাছি বসেছিলাম বিধায় মদীনাতেও আমরা এক রুম পেলাম। আমাদের দুজনের মনে মনে আশা ছিলো মক্কায় যেহেতু রুমমেটদের মাঝে পরিচিতি ও একধরনের সৌহার্দ্য তৈরি হয়েছে, তাই মদীনাতেও সবাই একসাথে থাকবো। নাহলে নতুন করে আবার নতুন লোকের সাথে adjustment করতে হবে, সে ইচ্ছে আর হচ্ছিলো না।

মক্কায় আমার তৃতীয় রুমমেট রুকসানা আন্টি অভিজাত এক বয়স্কা মহিলা এবং এক আকর্ষণীয় চরিত্র। তাঁর গল্প আপাতত থাক, মক্কাতে ফেরত গেলে তখন বলবো। মদীনাতে তাঁকে আমরা আমাদের রুমে পেলাম না, কারণ ঘটনাচক্রে এবার অন্য তলায় আলাদা কামরায় উনি জায়গা পেয়েছেন।

মদীনাতে ৯ তলায় আমি আর আমার স্বামী প্রায় মুখোমুখি কামরা পেলাম। মক্কায় আমাদের রুম ছিলো এক ফ্লোরে কিন্তু সম্পূর্ণ দু প্রান্তে। এখানে বের হবার সময় বা যেকোনো দরকারে সহজে যোগাযোগ করা যাবে, এটা একটা ভালো ব্যাপার। আধুনিক সুযোগ সুবিধা সমৃদ্ধ এ হোটেলটি সম্ভবত চার তারা হোটেল। মক্কার হোটেল যে “কয় তারা” ছিলো, জানি না। প্রাচীন আমলের সেই বাড়ি থেকে এই হোটেলে এসে মনে হচ্ছে যেন রাজবাড়িতে পদার্পণ করলাম!!

এখানে আমাদের কামরায় পুরু ফোমে ঢাকা ধবধবে সাদা চাদর বিছানো চারটি বিছানা। প্রতিটি বিছানার উপর নরম ফোলা ফোলা বালিশ ও সাদা পরিষ্কার তোয়ালে পরিপাটি করে সাজানো। যদিও এই আকৃতির রুমে সাধারণত একটি ডাবল বেড থাকে। কিন্তু আমাদের থেকে সরকার বাড়িভাড়া যাবত যে অর্থ নিয়েছে, তা দ্বারা ডাবল বেডের হোটেল স্যুট দেওয়া সম্ভব নয়। এমনিতেই হাজ্জের মৌসুমে সব হোটেলের ভাড়া বেড়ে গিয়ে গগণচুম্বী হয়, তাই এক রুমে চারটি বিছানা দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া আমরা কেউ আয়েশি ভ্রমণ করতে এই দেশে আসিনি। গোসল, বিশ্রাম আর রাতে ঘুমানোর জন্য শুধু মাথা গোঁজার একটি ঠাঁই প্রয়োজন। তাই রুম ঘিঞ্জি হয়ে গেলো কি না, তা নিয়ে কারো কোনো অভিযোগ ছিলো না।

তবে ছোটখাটো এক সমস্যা দেখা দিলো। এতগুলো খাট বেছানোর কারণে রুমে অন্তত একটি জায়নামাজ ফেলার স্থানও অবশিষ্ট ছিলো না। প্রতিটি বিছানার মাঝে কয়েক ইঞ্চি ফাঁকা, এই ফাঁকা দিয়ে সালাত পড়া তো দূরের কথা, হাঁটাও সম্ভব নয়। বিছানাগুলোর পায়ের কাছে আমাদের সুটকেস আর ব্যাগ রাখা হয়েছে। হোটেলে কর্তৃপক্ষের এখানে কোনো দোষ নেই, কারণ মদীনাতে এসে কেউ ঘরে সালাত পড়ে না। সবাই মসজিদে যেয়ে জামাতে যোগ দেয়। কিন্তু এখন রাত নটা দশটার দিকে নিশ্চয় কোনো জামাত পাওয়া যাবে না। সারাদিন ধকলের পর সবাই পরিশ্রান্ত। একটু বিশ্রাম না নিয়ে আমার রুমের বাসিন্দারা মসজিদে যাবে না। শেষে সবগুলো খাট একসাথে জোড়া লাগিয়ে দেওয়া হলো, যার ফলে আমরা কিছুটা হাঁটার ও একটি জায়নামাজ ফেলার স্থান পেলাম। পাশাপাশি শুলে personal space নষ্ট হবে, এধরনের বড়লোকি ঢং করার মানসিকতা আমাদের কারো মাঝে ছিলো না। প্রতিদিন হাঁটাহাঁটি আর ধকলের পর বিছানায় শোবার আগেই যেখানে ঘুম এসে যায়, সেখানে এসব চিন্তা করা অবান্তর।

মদীনা আসার আগে একটি ব্যাপার নিয়ে বেশ চিন্তিত ছিলাম। তা হলো, আমার রুমের অন্যান্যরা কেমন হবে। কারণ সবার সাথে সহাবস্থান সহজ ব্যাপার নয়। হাজ্জে এলে নানারকম ধৈর্য পরীক্ষার একটি হলো, বিভিন্ন মানসিকতা ও রুচির মানুষের সাথে হাসিমুখে একত্রে বসবাস করা। ভাগ্য ভালো হলে রুচিতে মেলে, নতুবা নয়। তবে সবাই যেহেতু আল্লাহ্‌কে খুশি করার এক অভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে আসেন, তাই শেষ পর্যন্ত সবাই মিলেমিশে থাকা শিখে যান। আল্লাহ্‌র রহমতে সৌদিতে যতদিন ছিলাম, কমবেশি সবার সাথে আমার ভালো সম্পর্ক ছিলো। আমার ভাগ্য এক্ষেত্রে ভালোই ছিলো। যাদের সাথে অন্যদের ঝগড়া বিবাদ লেগে গেছে, তাদের কাছ থেকেও আমি কীভাবে যেন প্রচুর ভালবাসা পেয়েছি।

কামরার চারটি বিছানার দুটিতে আমি আর রওশন আপা এবং বাকি দুটোর একটিতে দেখলাম পারুল নামের অতি মাত্রায় ভদ্র একজন মহিলা এসেছেন, বয়স পঞ্চাশের কিছু বেশি হবে। ছেলেরা বড় হয়ে গেছে, মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন, স্বামী অবসর গ্রহণ করেছেন, জীবন একরকম গোছানো হয়ে গেছে। অবসরপ্রাপ্ত স্বামীর সাথে হাজ্জে এসেছেন। চতুর্থ খাটে এসেছেন একজন জয়েন্ট সেক্রেটারির স্ত্রী! ডিফেন্সে একটি কথা প্রচলিত আছে। তা হলো স্বামী যদি লেফটেন্যান্ট কম্যান্ডার হয়, স্ত্রী তবে কম্যান্ডার। অর্থাৎ স্বামী যে পদধারী হবে, তার স্ত্রী সর্বদা এক র‍্যাংক উপরে থাকবে। সাধারণত দেখা যায় যেকোনো ক্ষেত্রেই স্বামীর চেয়ে স্ত্রীদের দাপট এক কাঠি বেশি হয়।

আমাদের এই সেক্রেটারির ‘মিসেস’ও তাঁর ব্যতিক্রম নন। তাঁর ভাব দেখে মনে হচ্ছে, স্বামী জয়েন্ট সেক্রেটারি হলেও তিনি হলেন ফুল সেক্রেটারি!! তিনি কিছুতেই এই রুমে থাকবেন না। মক্কায় তাঁর পরিচিত যারা ছিলো, তাদের সাথে তিনি থাকবেন। যেভাবেই হোক রুম পাল্টাতেই হবে। একবার রুম নির্বাচিত হয়ে গেলে পরে তা বদলানো মুশকিল। অনেকে পুরো পরিবার নিয়ে এসেছেন, তাঁরা তাদের রুমের কোনো সদস্যকে অন্য রুমে দেবেন না। আবার অন্য রুম থেকে কোনো মহিলাকে নিয়ে আসলে তার মাহরামকেও আমাদের পাশের রুমে আনতে হবে। অর্থাৎ, পাশের রুমেও রদবদল করতে হবে। এক কথায় বিনা ঝামেলায় এই কাজ সম্ভব নয়। তার ওপর এতক্ষণে সবাই যার যার রুমে সেটল হয়ে সুটকেস থেকে কাপড়চোপড় বের করে ফেলেছে, তাই কোনো জয়েন্ট সেক্রেটারির স্ত্রী লম্ফ ঝম্প করলেই বাকিরা শুনবে কেন? তবে ইনি ছাড়ার পাত্রী নন। স্বামীকে হয়তোবা লাগিয়ে দিলেন তাঁর এই ‘বিশাল’ সমস্যার সমাধান কল্পে।

এত কাহিনী দেখে বেচারি পারুল আন্টি একেবারে কাঁচুমাচু হয়ে গেছেন, তেমন একটা কথা বলছেন না। সঙ্কুচিত হয়ে নিজের কাজ করতে লাগলেন। এদিকে সেক্রেটারি আন্টি, থুক্কু জয়েন্ট সেক্রেটারি আন্টি আমাকে দেখে ভেবে নিলেন আমি রওশন আপার মেয়ে। আমার দিকে ইশারা করে বলে উঠলেন, “এ কার মেয়ে?” রওশন আপা তো হেসেই খুন। আমি রওশন আপার মেয়ে না, এই বিষয়টি ঐ মহিলা কোনোমতে হজম করতে পারলেও, আমি আলহামদুলিল্লাহ্‌ স্বামীর সাথে হাজ্জ করতে এসেছি অর্থাৎ বিবাহিতা এই কথা শুনে বিস্ময়ে চোখ ছানাবড়া করে ফেললেন। আমি বাবা-মার সাথে আসিনি, কিন্তু বরের সাথে এসেছি এতে এত আশ্চর্য হবার কী আছে জানি না।

মিসেস জয়েন্ট সেক্রেটারির হতবাক ভাব নিয়ে বেশি হাসতেও পারছি না। কারণ হাজ্জে আসার পর থেকে আমাকে অনবরত এ ধরনের হাস্যকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে সাধারণত কিছুটা বয়স হলে হাজ্জ করতে আসে, আর আমার বয়সীরা বাবা-মা বা পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে আসে। তাই যেখানেই কেউ শোনে, মা বাবার সাথে নয়, বরং আমি আর আমার বর আল্লাহ্‌র রহমতে একা একা হাজ্জে চলে এসেছি, তখন তাদের অবাক দৃষ্টি দেখার মতো হয়। এত কথার ভিড়ে পারুল আন্টি মিনমিন করে মুচকি হেসে বললেন, “তোমার সাথের ছেলেটা তোমার বর? প্লেনে ওঠার পর থেকে তোমাদের দেখছিলাম, আমি তো ভেবেছিলাম তোমরা দুই ভাইবোন একসাথে হাজ্জে এসেছো!!!” বাহ! এবার আমার তাজ্জব হবার পালা শেষ পর্যন্ত আমাদের দুজনকে ভাই-বোন ভেবে বসলো (নাউযুবিল্লাহ)! হায়রে সবে তো এদেশে আসলাম, মাত্র তিন/চারদিন হলো, এর মাঝে এত কিছু শুনে ফেললাম, না জানি বাকি দিনগুলোতে আরো কত কী শুনতে হবে!

জয়েন্ট সেক্রেটারির স্ত্রী অনেক লম্ফঝম্ফ দিলেও তাঁকে আমাদের ভালোই লাগলো। মহিলার ভেতর রসবোধ আছে আর মনটা ভালো। তাঁর সাথে থাকতে আমাদের খারাপ লাগবে না। শুধু আমাদের ভালো লাগলেই তো হবে না, উনি উনার মক্কার বান্ধবীদের কাছে যাবার জন্য অস্থির হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণের মাঝে খবর আসলো যে, তাঁর রুম বদল করা সম্ভব হয়েছে। উনি নাচতে নাচতে ব্যাগ নিয়ে বান্ধবীদের উদ্দেশ্যে হাওয়া হয়ে গেলেন। এবার আমরা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। পারুল আন্টিকে যথেষ্ট পছন্দ হয়েছে আমাদের। এই নাম না জানা মহিলাটিও খারাপ ছিলো না। কিন্তু এখন নতুন যে আসবে না জানি কেমন হবে! ভাগ্য যদি এবার ভালো না হয়?

এর মাঝে ছোট কিন্তু এক মজার তথ্য জানলাম, তা হলো আমাদের পারুল আন্টির স্বামী একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি সেক্রেটারি। একজন সেক্রেটারির পদমর্যাদা মন্ত্রীর সমান। এই কথা শুনে আমরা হাসবো না কাশবো বুঝতে পারলাম না। অতি বিনয়ী এই ভদ্রমহিলা এতক্ষণ জয়েন্ট সেক্রেটারির বিবির দাপাদাপিতে ভালোমানুষের মতো চুপ হয়ে ছিলেন, মনে মনে নিশ্চয় দারুণ মজা পাচ্ছিলেন। উনার কাছ থেকে শিখলাম, পদমর্যাদার আসল মর্যাদা তখনই প্রকাশ পায়, যখন উচ্চপদ মানুষকে বিনয়ী করে। দাপট করলে সাময়িক সমীহ পাওয়া গেলেও তা পরবর্তীতে হাস্যরসের উপাদানে রূপান্তরিত হয়।

কামরায় সেটল হবার পর আমরা রাতে খাবার জন্য নিচে ডাইনিং হলে আসলাম। এখানে প্রতি বেলা খাবার কিনে খেতে হয় বুফে সিস্টেমে। অনেক বাঙালি নতুন বুদ্ধি করলো। একজনের বুফের বিল দিয়ে যে খাবার পাওয়া যায়, দুজনে মিলে ভাগ করে খেতো। আমার স্বামী এ ধরণের কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করলো না। হাজ্জে এসে কোনো দুর্নীতি করতে সে রাজি নয়। অথচ যারা এ ধরনের কাজ করছে, তাদের চেহারা দেখলে তাদের আর দোষ দিতে মন চাইবে না। এদের মাঝে অনেকেই আছেন, জীবনে হয়ত কখনো বড় হোটেলে খাননি। পোশাক দেখে বোঝা যাচ্ছে নিতান্ত সংগ্রাম করে সারা জীবন কাটিয়েছেন এবং সারাজীবনের সঞ্চয় নিয়ে শেষ বয়সে হাজ্জ করতে এসেছেন। তাঁদের পক্ষে হঠাৎ করে একদিনে স্বামী-স্ত্রী দুজনের খাবারের পেছনে সহস্রাধিক টাকা খরচ করে ফেলা স্বাভাবিকভাবেই কষ্টের। অবশ্য বাঙালিদের চেয়ে হোটেলে মালিক পক্ষ আরো বেশি বুদ্ধিমান। তারা দু-এক দিনের ভেতর এ কাহিনী ধরে ফেললো। এরপর এমন শক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করলো, যেন এমন চালাকি আর কেউ করতে না পারে।

খাবার শেষে রুমে ফেরত আসলাম, এসে দেখি আমাদের রুমের চতুর্থ সঙ্গী চলে এসেছেন। খাটের ওপর চকচকে মেজেন্টা রঙের বোরকা পরিহিতা এক মহিলা ঘুমোচ্ছেন। তিনি যে গ্রুপের সাথে এসেছেন, সে গ্রুপ থেকে সবাইকে এই উদ্ভট রঙের বোরকা দেওয়া হয়েছে, যেন দূর থেকে চেনা যায়। তাদের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে নিঃসন্দেহে। এই রঙ দশ মাইল দূর থেকেও চোখে এসে ধাক্কা দিয়ে যবে। মহিলা অতীব ক্লান্তির কারণে বোরকা বদল করার সময় পাননি। তার আগেই ঘুমিয়ে গেছেন। মনে মনে ভয়ে রইলাম উনি না জানি কেমনতর মহিলা হবেন! কারণ, প্রায় দশ দিন এক কামরায় কারো সাথে বাস করা চাট্টিখানি কথা নয়!

রাতে সালাত পড়ে রওশন আপা আর পারুল আন্টি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর কবর যিয়ারত করতে ও সালাম দিতে গেলেন। ততক্ষণে টের পেলাম বিগত কয়েকদিনের ধকল আমার শরীরে সহ্য হয়নি, গায়ে জ্বর চলে এসেছে। উনাদের বিদায় দিয়ে আমার নরম বিছানাতে গা এলিয়ে দিলাম। দেরী না করে জ্বরের ঔষধের সাথে সাথে অ্যান্টিবায়োটিকও খেয়ে নিলাম। অন্য সময় তিনদিন জ্বর-ঠাণ্ডা থাকলে তবে অ্যান্টিবায়োটিক খেতে হয়, কিন্তু আমি কোনো রিস্ক নিতে চাইলাম না। মদীনাতে এসে জ্বর নিয়ে শুয়ে শুয়ে সময় নষ্ট করার খায়েশ আমার নেই। আল্লাহ্‌ আমাকে এমন এক জায়গায় নিয়ে এসেছেন, এখানে এসে যদি মসজিদে নববীতে ঠিকমতো যেতে না পারি, তাহলে এত দূর আসার আর সার্থকতা কোথায়?

এদিকে রাত গভীর হয়েছে। আমার রুমের সঙ্গী দুজন এখনো ফেরত আসেননি। আমি জানালা দিয়ে জ্বরের ঘোরে বাইরে তাকিয়ে আছি। মক্কার হোটেলের মতো ‘গর্ত’ ধরণের জানালা নয় এখানে। দুটো জানালা রয়েছে এ কামরায়। এর মাঝে একটি জানালা একদিকের দেয়াল জুড়ে, স্বচ্ছ কাঁচে ঢাকা। আমার বিছানাটি সৌভাগ্যক্রমে জানালার সাথে একেবারে লাগানো। ন’তলার ওপর এই জানালার এক পাশে আমার কামরা, মাঝে কেবল দুই লেনের এক রাস্তা আর তার অন্য পাশে বিখ্যাত ‘বাকি’ গোরস্থান। যাকে আমাদের দেশে “জান্নাতুল বাকি” বলা হয়। এদেশে অত্র গোরস্থানকে কেউ আমাদের পরিচিত নামে ডাকে না, বরং “বাকি আল গারকা” এ গোরস্থানের আসল নাম।

অন্যসময় কবরস্থানের পাশে রুম হলে আতঙ্কে সারা রাত ঘুমোতে পারতাম না। কিন্তু “বাকি আল গারকা”র কথা ভিন্ন। ইসলামের ইতিহাসের অসংখ্য সাহাবী, তাবেই, তাবেঈন, রাসূল ﷺ এর অনেক স্ত্রী, সন্তানদের কবর রয়েছে এখানে। বিশ্বের বহু শ্রেষ্ঠ মুমিন, মুসলিম শুয়ে আছেন এই কবরস্থানে। এ কথা চিন্তা করলেই এক অসম্ভব ভালো লাগায় হৃদয় ভরে যায়।

জানালার ঠিক বিপরীত দিকে যেমন বাকি গোরস্থান, তেমনি কোণাকুণি তাকালে দেখা যায় আলো ঝলমলে মসজিদে নববী। যেন আকাশের চাঁদ মাটিতে নেমে এসে এ ধরণীকে আলোকিত করেছে! সফেদ রঙে রাঙানো এ মসজিদকে মধ্যরাতে দেখলে মনে হবে, পূর্ণ চাঁদের ন্যায় রূপালী আলোয় জ্বল জ্বল করছে। আমার কামরা থেকে মসজিদের মূল অংশ দেখা না গেলেও মসজিদের বিশাল ছাতাগুলো দেখা যায়। বৈদ্যুতিকভাবে নিয়ন্ত্রিত এসব ছাতা এখন রাতের অন্ধকারে গুটিয়ে আছে, ভোর হলেই প্রস্ফুটিত পদ্মের ন্যায় ছড়িয়ে পড়বে এবং তীব্র রোদের আলো থেকে রক্ষায় ছত্রছায়ায় ঢেকে দেবে হাজারো মুসুল্লিকে।

ক্লান্ত শরীরে জানালার বাইরে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেলাম।

(ইন শা আল্লাহ্‌ চলবে…)

আগামী পর্ব: মসজিদে নববী

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive