সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য। সালাত ও সালাম নাযিল হোক প্রিয় নবী মুহাম্মাদ ﷺ এবং তাঁর পরিবার-পরিজন ও সাহাবাগণের প্রতি।
মুসলিম ছাত্ররা এই দুনিয়ায় যখন কোনো পরীক্ষার সম্মুখীন হয়, তখন তারা আল্লাহর উপরেই ভরসা রাখে। তারা জানে রাসূল ﷺ বলেছেন,
শক্তিশালী ঈমানদার দুর্বল ঈমানদারের চেয়ে উত্তম আর আল্লাহর নিকট বেশি পছন্দনীয়, যদিও তাঁদের উভয়ের মাঝেই কল্যাণ নিহিত আছে। যা তোমার জন্য ভালো, তা অর্জনের জন্য চেষ্টা করো আর আল্লাহর নিকট সাহায্য চাও। কখনো হতাশ হয়ো না। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-২৬৬৪)
আর তাই সফল ছাত্র তারাই হয়, যারা এই হাদীস অনুযায়ী আল্লাহর নিকট যেকোনো পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য সাহায্য চাইতে থাকে আর লক্ষ্য অর্জনে হালাল পন্থা অবলম্বন করে। তাদের মতো সফল হওয়ার জন্য নিচের টিপসগুলো অনুসরণ করে চলতে হবে। যেমন-
১) আল্লাহর সাথে সম্পর্ক গভীর করতে হবে, যা অন্য সকল কিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে এনে আল্লাহর দিকে রুজু করতে সাহায্য করবে। আর এইজন্য আল্লাহর কাছে বেশি বেশি দোয়া করা চাই। দু’আ হিসেবে মূসা (‘আলাইহিসসালাম) এর দু’আটি করা যায়। সেটি হলো-
رَبِّ اشْرَحْ لِي صَدْرِي
وَيَسِّرْ لِي أَمْرِي
অর্থ: হে আমার রব, আমার বক্ষ প্রশস্ত করে দাও আর আমার জন্য আমার কাজকে সহজ করে দাও।
২) পরীক্ষার আগের রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে হবে আর যথাসময়ে পরীক্ষার হলে উপস্থিত হতে হবে।
৩) সকল অনুমোদিত প্রয়োজনীয় বস্তু যেমন কলম, পেন্সিল, ক্যালকুলেটর, ঘড়ি ইত্যাদি আগে থেকেই গুছিয়ে রাখতে হবে।
৪) ঘর থেকে বের হওয়ার সময় নিচের দু’আটি পড়তে হবে।
بِسْمِ اللهِ تَوَكَّلتُ عَلَى اللهِ لاَ حَـوْلَ وَلاَ قُــوَّةَ اِلاَّ بِـالـلـهِ
اَللهم إِنِّي أعُوذُ بِكَ أنْ أضِلَّ أَوْ أُضَلَّ، أَوْ أَزِلَّ أَوْ أُزَلَّ، أَوْ أظْلِمَ أَوْ أُظْلَمَ، أَوْ أجْهَلَ أَوْ يُجْهَلَ عَلَيَّ
অর্থ: আমি আল্লাহর নামে আল্লাহর উপর ভরসা করছি। আল্লাহর শক্তি ও সামর্থ্য ছাড়া কারো কোনো ক্ষমতা নেই। হে আল্লাহ! নিশ্চয় আমি আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি নিজেকে অথবা অন্যকে ভ্রষ্ট করা থেকে, নিজের পদস্খলন হওয়া থেকে অথবা অন্যের পদস্খলন করানো থেকে, অত্যাচারী হওয়া থেকে অথবা অত্যাচারিত হওয়া থেকে, মূর্খামি করা থেকে অথবা মূর্খামির শিকার হওয়া থেকে।
৫) বের হওয়ার আগে বাবা-মায়ের কাছে দু’আ চাইতে হবে, তাঁদের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে বের হতে হবে। মনে রাখতে হবে যে, সন্তানের জন্য বাবা-মায়ের দু’আ আল্লাহ কবুল করেন।
৬) পরীক্ষায় লেখা শুরু করার আগে অবশ্যই আল্লাহর নাম স্মরণ করতে হবে। তাঁর নামেই লেখা শুরু করতে হবে। কেননা কোনো হালাল কাজ আল্লাহর নাম নিয়ে শুরু করলে ওই কাজে কল্যাণ আর শক্তি বৃদ্ধি পায়।
৭) সহপাঠীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করুন। কোনো সহপাঠী পরীক্ষার আগে পরীক্ষা নিয়ে ভয় পেতে শুরু করলেও নিজের ভয় পাওয়া যাবে না। বরং ঘাবড়ে না গিয়ে তাকে বুঝাতে হবে যে, এখানে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তাকে বিভিন্ন উৎসাহের মাধ্যমে স্বাভাবিক করে তুলতে হবে। এতে সে আশাবাদী হয়ে উঠবে। সবকিছু সহজভাবে নিতে হবে। ফলে ভয় কেটে যাবে। দেখা যায়, রাসূল ﷺ যখন সুহাইল (সহজ) নামটি শুনেছিলেন তখন তিনি বেশ আশাবাদী হয়ে তাকে বলেছিলেন “তোমার জন্য কাজকে সহজ করা হয়েছে।” এছাড়াও ভয় কাটানোর জন্য আল্লাহর যিকর করতে হবে। আল্লাহর যিকর ভয় ও চিন্তাকে দূর করে দেয়।
৮) যদি কোনো প্রশ্ন খুব কঠিন লাগে, তাহলে মনে মনে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে হবে যেন তিনি সেটি সহজ করে দেন। এই ব্যপারে শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়ার (রাহিমাহুল্লাহ) আমল লক্ষ করলে দেখা যায়, যখন কোনোকিছু তাঁর বুঝতে কষ্ট হতো তখন তিনি দু’আ করতেন
“হে আল্লাহ! আপনিই তো সেই সত্তা, যিনি ইব্রাহীমকে (‘আলাইহিসসালাম) শিখিয়েছিলেন। হে আল্লাহ! আপনিই তো সেই সত্তা, যিনি সুলাইমানকে (‘আলাইহিসসালাম) বোঝার ক্ষমতা দিয়েছিলেন। আপনি আমাকেও বুঝার তৌফিক দিন।”
৯) পরীক্ষার হলে সিট নির্দিষ্ট না হলে ভালো একটি পজিশন দেখে সিট পছন্দ করতে হবে। স্বাস্থ্যকর উপায়ে সিটে বসতে হবে এবং পিঠ সর্বদা সোজা রাখতে হবে।
১০) প্রথমেই সম্পূর্ণ প্রশ্নপত্র একবার ভালো করে দেখে নিতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ শব্দগুলো নোট করতে হবে। তারপর টোটাল সময়কে প্রয়োজন অনু্যায়ী ভাগ করে নিতে হবে। এই তিনটি কাজ করতে টোটাল সময়ের দশভাগের একভাগ ব্যয় হলেও সমস্যা নেই।
১১) প্রথমে সহজ প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে হবে। এরপর কঠিন প্রশ্নগুলোর দিকে যেতে হবে। যেই প্রশ্নগুলোর মার্ক বেশি, সেগুলোর উত্তর আগে দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। যেই প্রশ্নগুলো উত্তর দিতে গেলে অনেক বেশি সময় ব্যয় হয় এবং যেই প্রশ্নগুলোর মার্ক কম, সেগুলোর উত্তর পরে দিতে হবে।
১২) যেকোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে ধীরেসুস্থে পূর্ণ মনোযোগের সহিত। কোনো তাড়াহুড়ো করা যাবে না। মনে রাখতে হবে রাসূল ﷺ বলেছেন,
ধীরস্থিরতা আসে আল্লাহর পক্ষ থেকে, আর তাড়াহুড়ো আসে শয়তানের পক্ষ থেকে। (হাসান সহীহ, সহীহ আল-জামি,৩০১১)
১৩) বহুনির্বাচনী প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় সতর্কতার সহিত সঠিক উত্তরটি বাছাই করতে হবে। এক্ষেত্রে সঠিক উত্তরটি জানা থাকলে উত্তরের পূর্ব পর্যন্ত শয়তানের ওয়াসওয়াসার ব্যাপারে বেশ সতর্ক থাকতে হবে। যদি সঠিক উত্তর জানা না থাকে, তাহলে ভুল উত্তর কোনগুলো হবে সেগুলো বের করার চেষ্টা করতে হবে। তারপর সবচেয়ে কম ভুল যেইটাকে মনে হয়, অর্থাৎ সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা যেটির ক্ষেত্রে বেশি মনে হয়, সেটিই সঠিক উত্তর হিসেবে বাছাই করতে হবে।
১৪) যদি কোনো উত্তরকে সঠিক হিসেবে বাছাই করা হয়ে থাকে তাহলে যতক্ষণ পর্যন্ত নিশ্চিত না হওয়া যাবে যে সেটি ভুল হয়েছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সেটি পরিবর্তন করা যাবে না। কেননা গবেষণা থেকে জানা গেছে যে, সাধারণত সঠিক উত্তর সেটিই হয় যেই উত্তরটি ছাত্ররা প্রথমে চিন্তা করে থাকে।
১৫) রচনামূলক প্রশ্ন উত্তরের সময় উত্তর লেখার আগে প্রথমে ওই প্রশ্নের উত্তর সম্পর্কে একটু চিন্তা করতে হবে। কী কী টপিক উত্তরে আলোচনা করলে ভালো হয়, তার একটা আউটলাইন দাঁড় করানোর পরে উত্তর লেখা শুরু করতে হবে।
১৬) কোনো প্রশ্নের উত্তরের প্রধান প্রধান পয়েন্টগুলো উত্তরের শুরুতেই লেখতে হবে। কেননা পরীক্ষক সাধারণত উত্তরের প্রথম কয়েক লাইন ভালো করে পড়েন। সেখানে সঠিক উত্তর না পেলে তাড়াহুড়ো করে উত্তরের নিচের অংশে চলে যান। ফলে কোনো ছাত্র যদি উত্তরের প্রধান পয়েন্টগুলো উত্তরের প্রথম দিকে না লিখে মাঝের দিকে লিখে, তাহলে তা পরীক্ষকের চোখ এড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
১৭) টোটাল সময়ের দশভাগের একভাগ সময় হাতে রেখে সকল প্রশ্নের উত্তর লিখে শেষ করতে হবে। সকল প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার পর বাকি সময়টুকুতে রিভিশন দিতে হবে। বিশেষ করে গাণিতিক সমস্যার উত্তরের রিভিশন তো দিতেই হবে।
১৮) উত্তরপত্র জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে বেশ সংযমী হতে হবে। অন্য কেউ আগে খাতা জমা দিয়ে দিলো কি না দিলো, সেই দিকে খেয়াল দেওয়ারই দরকার নেই।
১৯) যদি এমন হয় পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে আসার পর দেখা গেলো কোনো প্রশ্নের উত্তর জানা সত্ত্বেও তাড়াহুড়ো বা অন্য কোনো কারণে সঠিকভাবে লিখে আসা সম্ভব হয়নি, তাহলে কোনোভাবেই হতাশ হওয়া যাবে না। দৃঢ় বিশ্বাস রাখতে হবে এটাই আল্লাহ তাকদীরে লিখে রেখেছেন আর এটাই আল্লাহর ইচ্ছা। এই ব্যপারে একটি হাদীস সব সময় মনে রাখতে হবে। রাসূল ﷺ বলেছেন
যদি কিছু ঘটে, তখন এমন বোলো না “যদি আমি এমন এমন করতাম, তবে এমন হতো না।” বরং এ কথা বলো যে, “আল্লাহ তা‘আলা যা নিদিষ্ট করেছেন এবং যা চেয়েছেন তা-ই করেছেন।” কেননা যদি শব্দটি শাইতানের কর্মের দুয়ার খুলে দেয়। (সহীহ মুসলিম)
তবে এইরকম ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে হবে যাতে ভবিষ্যতে আর কখনো এমন ভুল না হয়।
২০) মনে রাখতে হবে যে, যেকোনো পরীক্ষাতেই প্রতারণার আশ্রয় নেয়া হারাম। রাসূল ﷺ বলেছেন,
যে প্রতারণা করে, সে আমাদের দলভুক্ত নয়।
তাই পরীক্ষা সংক্রান্ত যেকোনো হারাম কাজের প্রস্তাব পেলে তা প্রত্যাখ্যান করতে হবে। কেননা কেউ যদি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোনো কিছু ত্যাগ করে, তাহলে মহান আল্লাহ তাকে ওই ত্যাগকৃত বস্তুর চেয়ে আরো ভালো কোনোকিছু দান করবেন। পরীক্ষার আগে, পরীক্ষা চলাকালীন বা পরীক্ষার পরে যদি কোনো অবৈধ কাজ হতে দেখা যায়, তাহলে সাথে সাথে কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে। এতে নিষিদ্ধ গীবত হবে না। কেননা এটা খারাপ কাজ সম্পর্কে জানিয়ে দেওয়া, যা ওয়াজিব। কেউ যদি প্রশ্নপত্র ক্রয় করে বা বিক্রি করে বা ইন্টারনেটে পোস্ট করে বা নকল তৈরি করে, তাকে উপদেশ দিতে হবে। তাদেরকে আল্লাহর ভয় দেখাতে হবে এবং তাদের উপার্জিত টাকা যে হারাম হচ্ছে, সেই ব্যপারে সতর্ক করতে হবে। তাদেরকে বুঝাতে হবে যে, তারা যা করছে তার চেয়ে বিগত সালের প্রশ্ন সল্ভ করা, অন্যকে উত্তর বুঝতে সাহায্য করা অনেক অনেক ভালো কাজ।
সর্বোপরি আখিরাতের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ, কবরে জিজ্ঞাসিত প্রশ্নের উত্তর আর হাশরের দিন মুক্তি কীভাবে পাওয়া যাবে, সেই ব্যপারে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে।
সর্বশ্রোতা আল্লাহর নিকট আমরা সাহায্য প্রার্থনা করি, তিনি যাতে আমাদের এই দুনিয়াতেও সফলতা দান করেন আর বিচারদিবসেও মুক্তিপ্রাপ্তদের দলে শামিল করেন।
উৎস: কালামুল্লাহ ডট কম (মূল আর্টিকেল লিংক)
অনুবাদক: মেহেদি হাসান, মুসলিম মিডিয়া প্রতিনিধি
অনুবাদ কপিরাইট © মুসলিম মিডিয়া
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।