এক আল্লাহ্ আযযা ওয়া জাল্লা পবিত্র কুরআনে সূরাহ আল-বুরুজে আরাফাতের দিনের নামে শপথ করেছেন। এই দিনে তিনি সবচেয়ে বেশি মানুষকে জাহান্নামের আগুন থেকে মাফ করে দেন। বদরের যুদ্ধের দিন শয়তান সবচাইতে লাঞ্ছিত হয়েছিলো, সেই দিনের পর সারা বছরের কেবল মাত্র এই দিন শয়তান সবচেয়ে লাঞ্ছিত অবস্থায় থাকে।
কিয়ামাতের আগ পর্যন্ত যত মানব পৃথিবীতে আসবে, তাদের আরাফাতের দিন আদমের (‘আলাইহিসসালাম) ভেতর থেকে বের করা হয়েছিলো (মানবজাতিকে পৃথিবীতে প্রেরণের পূর্বে)। এরপর এ দিনেই সব রূহ থেকে শপথ নেয়া হয়েছিলো, তাদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, “কে তোমাদের রব?” তারা সকলে সাক্ষ্য দিয়েছিলো যে, আল্লাহ্ তাদের রব। অর্থাৎ, পৃথিবীতে আসার হাজার হাজার বছর পূর্বে আমরা এদিন সাক্ষ্য দিয়েছিলাম যে, আল্লাহ্ আমাদের রব।
[বিভিন্ন সত্য ঘটনার সাথে এই স্থান নিয়ে একটি কাহিনীও প্রচলিত আছে। সেখানে বলা হয়, আদম ও হাওয়া এই পৃথিবীতে দীর্ঘ সময় একা থাকার পর আল্লাহ্ যেদিন তাঁদের মাফ করে দেন, সেদিন তাঁরা দু জন আরাফাতের ময়দানে একত্রিত হন। এই কাহিনী সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, কারণ উনারা জান্নাত থেকে আল্লাহ্র ক্ষমা পাবার পরই পৃথিবীতে নেমে আসেন।]
সর্বোপরি আরাফাতের দিনের মর্যাদা যে কতখানি, তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। নির্ধারিত সময়ে আরাফাতে অবস্থান না করতে পারলে হাজ্জই বাতিল হয়ে যাবে। নবিজীকে ﷺ আরাফাতের দিনে সিয়াম রাখা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করাতে, তিনি বলেছেন,
এটি পূর্ববর্তী ও পরবর্তী বছরের পাপসমূহ স্খলন করে। (মুসলিম)
এখানে যারা হাজ্জ করতে পারছেন না, শুধু তাঁদের আরাফাতের দিনে সিয়াম রাখতে বলা হয়েছে। কারণ তিনি ﷺ যে বছর হাজ্জ করেছেন, সে বছর এ সিয়াম রাখেননি।
উম্মু ফাযল (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) বলেছেন, “আরাফার দিনে নবীর ﷺ সওমের ব্যাপারে লোকজন সন্দেহ করতে লাগলেন। তাই আমি নবীর ﷺ নিকট শরবত পাঠিয়ে দিলাম। তিনি তা পান করলেন।” [সহিহ বুখারি, ১৬৫৮]
আরাফাতের দিন সম্পর্কে আরো একটি সুন্দর হাদীস উল্লেখ করছি। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
এমন কোনো দিন নেই যেদিন আল্লাহ্ সবচেয়ে বেশি মানুষকে আগুন (জাহান্নামের) থেকে মুক্তি দেন, আরাফাতের দিন ব্যতীত। আল্লাহ্ নিকটে আসেন এবং ফেরেশতাদের কাছে গর্ব প্রকাশ করেন, বলেন, “এই মানুষরা কী চায়?”
দুই যিলহাজ্জ মাসের নয় তারিখ, পবিত্র আরাফাতের দিন। হাজ্জের ২য় দিন। কত দিন ধরে অপেক্ষা করেছি এ দিনের জন্য … কত দিন! বুদ্ধি হবার পর থেকে টেলিভিশনে যখন সরাসরি হাজ্জ দেখাতো, নিজের অজান্তেই অশ্রুসজল হয়ে উঠতো দু চোখ। “লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক” কানে আসলে অদ্ভুত সুন্দর, ব্যাখ্যার অযোগ্য এক আবেগে আপ্লুত হয়ে যেতাম। কিন্তু কখনো হাজ্জে আসতে পারবো কল্পনা করিনি, আল্লাহ্র কাছে এত বড় জিনিস চাওয়ার কথা কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি। ঝাপসা চোখ মুছে বারবার তাকাতাম টিভি পর্দার দিকে আর পর্দায় লাখো হাজীকে আরাফাতের ময়দানে দেখে, তালবিয়া পড়ার শব্দ শুনে অসম্ভব এক ভালো লাগায় ভেসে যেতাম।
সকালে ঘুম ভাঙার পর দেখি মোয়াল্লেমের লোকেরা নাস্তা দিয়ে গেছে। নাস্তা খেয়ে ফ্রেশ হয়ে পরিষ্কার কাপড় পরে নিলাম। ইহরাম বাঁধার পর থেকে তালবিয়া পড়ার নিয়ম। আজ আরাফাতের দিনে সবাই আরো বেশি বেশি তালবিয়া পড়বে। আরাফাতের ময়দানের এক প্রান্তে মাসজিদ নামিরা অবস্থিত, সেখানে গ্র্যান্ড মুফতি সুদাইসি হাজ্জের খুতবা দেবেন। শুনেছি আমাদের তাঁবু থেকে মাসজিদ অনেক দূরে। আফসোস লাগছিলো আমাদের পুরানা আমলের ফোনে রেডিও নেই, তা না হলে রেডিওতে হলেও খুতবা শুনতে পারতাম।
আরবী খুতবা হয়তো বুঝতে পারবো না। তবু হাজ্জে আসলাম আর খুতবা যদি শুনতে না পারি, মাসজিদে সবার সাথে জামাতে সালাত পড়তে না পারি, তাহলে সারা জীবন আফসোস রাখার আর জায়গা থাকবে না। অধিকাংশ মানুষের দিকজ্ঞান তেমন টনটনে থাকে না, তাই মাসজিদে যেতে গিয়ে হারিয়ে যান ও বিশাল সমস্যা সৃষ্টি করেন। তাই যাদের তাঁবু দূরে, সেসব গাইডরা মুসল্লিদের মাসজিদে যেতে নিষেধ করেন।
এদিকে আমাদের তাঁবু থেকে নামিরা কিছুটা দূরে হলেও সাফির আমাকে দেখালো, মাসজিদের মিনার এখান থেকে দেখা যাচ্ছে, তাহলে মসজিদ আর কতইবা দূরে হবে! চলো, আমরা নামিরা মাসজিদ খুঁজে বের করি। সুতরাং যেমন ভাবনা, তেমন কাজ। আমরা দু জন সোয়া এগারটার দিকে আমাদের হাত ব্যাগে পানির বোতল, মোবাইল ফোন, মাদুর, ছাতা, দু প্যাকেট বিস্কিট ইত্যাদি নিয়ে নামিরার খোঁজে বেরিয়ে পড়লাম।
বিস্কিট নিলাম, কারণ দুপুরে খাবারের জন্য তাঁবুতে ফেরত আসার কোনো ইচ্ছা আমাদের নেই। নিজ ভাষাভাষীদের সাথে আজকের দিনে একত্রে থাকতে চাই না। পরিচিত মানুষের মাঝে থাকলে না চাইলেও কথা বলতে হয়, তার উপর বাঙালি আলাপ প্রিয় জাতি। আমি যেহেতু বাঙালি, তাই নিজের উপরও আমার বিশ্বাস নেই। এমন লোকেদের মাঝে আরাফাতের দিন কাটাতে চাই, যাদের ভাষা আমার পক্ষে কোনোভাবে বোঝা সম্ভব না। তাহলে গল্পগুজবে সময় নষ্টের আর কোনো সম্ভাবনা থাকবে না।
এখন সাফির হুইল চেয়ার নিলো না, দু দিন ধরে ও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটার চেষ্টা করছে। আমিও আমার কম্পাস সাহেবের সাথে মিনারের দিকে মুখ করে হাঁটতে শুরু করলাম। আস্তে আস্তে হাঁটার পরও আমাদের বেশিক্ষণ লাগলো না নামিরা খুঁজে পেতে!!
তিন যখন এসে পৌঁছলাম, যুহরের ওয়াক্ত হতে অল্প কিছুক্ষণ বাকি আছে। নানা দেশের নানা বর্ণের হাজীতে লোকে লোকারণ্য হয়ে আছে চারদিক। মাসজিদের ভেতর অনেকক্ষণ আগেই পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। সকাল আটটার আগে না আসলে মনে হয় মাসজিদে জায়গা পাওয়া সম্ভব না। আমাদের মতো দেরিতে যারা আসছে, তারা নামিরার বাইরে যার যার মাদুর, চাদর ইত্যাদি বিছিয়ে জামাতে শরিক হবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমরা মালয়েশিয়ান এক পরিবারের পাশে মাদুর বিছিয়ে বসে পড়লাম।
আমাদের আশেপাশে আরো বিভিন্ন নাম না জানা দেশের মানুষেরা এসে বসে গেলেন। কারো গায়ের রঙ, সামাজিক অবস্থান অথবা কে কোন দেশের নাগরিক, তা আজ মূল্যহীন। আজ আমাদের সবার এক পরিচয়, আমরা আমাদের মালিকের অতিথি। আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য এবং কেবল মাত্র তাঁকে ভালোবেসে লক্ষ লক্ষ মানুষ এখানে জড়ো হয়েছে।
খুৎবা শুরু হলো। সবাই উৎকর্ণ হয়ে শোনার চেষ্টা করছি। চারদিকে নীরবতা, খুৎবার ভাবগম্ভীর আবহে সবাই মূহ্যমান। খুৎবা শেষে আযান হলো। এখন এক আযানে, দুই ইকামাতে যুহর ও আসর একসাথে আদায় করা হবে। সফরের সময় সালাত কসর করার পাশাপাশি প্রয়োজনে যুহর-আসর এবং মাগরিব-ঈশা জোড়া করে পড়ার বিধান আছে। হাজ্জের দিন আল্লাহ্র রাসূল ﷺ সালাত এভাবে কসর করে ও জোড়া করে পড়েছিলেন।
আমাদের দেশের অনেকে এ নিয়ম মানতে চান না। দেখা যায় যারা নামিরা মাসজিদে জামাতে শরীক হন না, তাঁরা অনেকে নিজেদের তাঁবুতে যুহর ও আসর আলাদা করে পড়েন। যেখানে নবী ﷺ নিজে বলেছেন, আমরা যেন তাঁর থেকে হাজ্জের নিয়ম শিখে নেই, সেখানে উনার শেখানো নিয়মের ব্যত্যয় ঘটানো অবশ্যই অনুচিত।
আজ মনে হয় আমার জীবনের সংক্ষিপ্ততম সালাত পড়লাম। স্বল্পতম সময়ে যুহরের দু রাকাত কসর করে জামাত হলো। সালাম ফেরানোর সাথে সাথে আসরের ইকামাত দেওয়া হলো। অতঃপর দু রাকাত আসরের সালাত কসর করে আবার জামাত হলো। সব মিলিয়ে দশ মিনিটের অল্প সময়ে দু ওয়াক্তের সালাত শেষ হয়ে গেলো। এখন সূর্যাস্ত পর্যন্ত আর কোনো সালাত নেই, আযান নেই, কিচ্ছু নেই।
চার আরাফাতের দিনের সবচেয়ে বড় ইবাদাত হলো আল্লাহ্র দরবারে কাকুতি মিনতি করে কান্নাকাটি করে দু’আ করা, একান্ত অন্তঃকরণে ক্ষমা ভিক্ষা চাওয়া। আল্লাহ্ যেন সবাইকে ক্ষমা করে দেন, আমীন। আমরা যেন প্রাণ ভরে আল্লাহ্র কাছে আমাদের পূর্বের কৃত যাবতীয় গুনাহের ক্ষমা চাইতে পারি, সে জন্য আল্লাহ্ আজকের দিনে যুহরের ওয়াক্ত থেকে মাগরিব পর্যন্ত সময় দিয়েছেন। এই সময়ে কোনো ফরয/নির্দিষ্ট ইবাদাত/সালাত রাখা হয়নি। আমাদের জীবনের সকল চাওয়া, বাসনা তাঁর নিকট ব্যক্ত করার জন্য আজকের মতো শ্রেষ্ঠ সময় আর কী হতে পারে!!
আরাফাতের দিন একটি দু’আ অধিক হারে পাঠ করার কথা বলা হয়েছে। সেটি হলো, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকালাহু, লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল্ হামদু, ওয়া হুয়া ‘আলা কুল্লি শাইয়্যিন কাদীর।”
সবাই আজ তাঁবুতে, খোলা আকাশের নিচে, নতুবা নিম গাছের ছায়ায় বসে আকুল হয়ে আল্লাহ্র কাছে দু’আ করবেন। এ ময়দানে প্রচুর নিম গাছ ছায়া দিচ্ছে সবাইকে। গাছের ডালের সাথে বেঁধে অনেকে ছোট ছোট তাঁবু খাটিয়ে তার নিচে বসে আছে। আমাদের পাশের মালয়েশিয়ানরাও ছোট এক তাঁবু বেঁধেছে। রোদের তাপ থেকে বাঁচার জন্য আমরাও সেই তাঁবুর তলে আশ্রয় নিলাম। এই নিম গাছ কিন্তু আজ থেকে একশ বছর আগেও এখানে ছিলো না। পুরো আরাফাত তখন ছিলো ছায়াহীন ধু ধু বিরান ভূমি। বাংলাদেশের এক প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট উপহারস্বরূপ কিছু নিম গাছের চারা দেন সৌদি সরকারকে, আরাফাতের ময়দানে লাগানোর জন্য। তখন থেকে প্রতি বছর এই নিম গাছের ছায়ায় বসে প্রখর রৌদ্র থেকে রক্ষা পাচ্ছেন হাজীগণ। নিম গাছের তাঁবুর ছায়া ছাড়া বাকি আরাফাতের ময়দানে এখনো খুব কমই ছায়া ঘেরা স্থান আছে। আলহামদুলিল্লাহ্, সাদাকায়ে জারিয়ার কী অনন্য উদাহরণ এ গাছসমূহ!!!
আমি আর সাফির আমাদের ফোন বন্ধ করে দিলাম। আজ প্রতিটি মুহূর্ত অমূল্য!! দুনিয়াবি কোনোকিছু দিয়ে আরাফাতের দিনের যুহর–মাগরিবের, অর্থাৎ দ্বিপ্রহরে সূর্য ঢলে পড়া থেকে শুরু করে সূর্য অস্ত যাবার মধ্যকার সময়ের মূল্য নিরূপণ করা যাবে না। কিয়ামাতের দিন পাপী বান্দারা তাদের সব সম্পদের বিনিময়ে আল্লাহ্র ক্ষমা পেতে চাইবে। কিন্তু সমগ্র দুনিয়ার সকল ধন সম্পদও তখন বিনিময় হিসেবে গৃহীত হবে না। আর এই আরাফাতের দিনে ভয়ানক পাপী বান্দাও যদি খাঁটি অন্তরে তাওবাহ করে, আল্লাহ্ ইচ্ছা করলে তাকে মাফ করে দেবেন। আরাফাতের দিন গাফুরুর রাহীম, রাহমানুর রাহীম, সর্ব শক্তিমান সুমহান মালিক তাঁর অজস্র বান্দাকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করবেন ও ফেরেশতাদের কাছে আমাদের নিয়ে গর্ব করবেন।
রাসুল ﷺ বলেছেন,
আরাফাতের দিন ঈশার সময় আল্লাহ্ ফেরেশতাদের নিকট, আরাফাতের মানুষদের নিয়ে গর্ব প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “দেখো আমার বান্দাদের, যারা অগোছালো ও ধূলো-মলিন হয়ে এসেছে।” (আহমেদ হতে বর্ণিত। আলবানি সহীহ বলেছেন।)
আসলেই আমরা আজ ধূলো-মলিন হয়ে গেছি। ধূলার ওপর বসে আছে অনেকে, কারো কোনো বিকার নেই। এসব দিকে খেয়াল করাও আজ সময় নষ্ট করা। কেউ কেউ এখন আল্লাহ্র কাছে মুনাজাত করছেন, এক মনে দু’আ করছেন। আজ যেন হাশরের ময়দানের প্রতিচ্ছবি। সকলে আজ ক্ষমা পাবার নেশায় মগ্ন! হাশরের ময়দানে যেমন দলে দলে সবাই হাজির হবে, আরাফাতের ময়দানেও তেমন দলে দলে সবাই হাজির হয়েছি। ইব্রাহীমকে (‘আলাইহিসসালাম) দিয়ে আল্লাহ্ যে আহ্বান করিয়েছিলেন, সে আহ্বানে সাড়া দিতে এসেছি আমরা। লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক বলে আমরা হাজিরা দিচ্ছি আজ।
পাঁচ মুহাম্মাদ ﷺ তাঁর জীবনের শেষের দিকে, দশম হিজরিতে/৬২৩ খ্রিষ্টাব্দে হাজ্জ করার সুযোগ পান। আরাফাতের জাবালে রহমতের উপর দাঁড়িয়ে তিনি তাঁর বিখ্যাত বিদায়ী হাজ্জের ভাষণ দেন। যে কারণে প্রচুর হাজী বিশেষ বরকত হাসিলের জন্য হুড়াহুড়ি, ধাক্কাধাক্কি করে এ পাহাড়ে ওঠার চেষ্টা করেন। ফলে অনেক সময় নিজেরা জখমি হবার সম্ভাবনার সাথে সাথে অন্য হাজীদের কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ান। এক্ষেত্রে, আমাদের জানা উচিৎ সমগ্র আরাফাতের ময়দান সমানভাবে রহমত ও বরকতপূর্ণ।
রাসূলের ﷺ সাথে সেদিন প্রায় লক্ষাধিক সাহাবী তাঁর সাথে হাজ্জ করেন। বিদায়ী হাজ্জের ভাষণে তিনি মুসলিম উম্মাহর জন্য প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এ পৃথিবীতে তাঁর কাজ শেষ হয়ে আসছে। তিনি বলেছিলেন,
আমি জানি না, আগামী বছর এ সময়ে, এ স্থানে, এ নগরীতে সম্ভবত তোমাদের সাথে আমার সাক্ষাত আর হবে কি না।
এই ভাষণে তিনি সুদ বর্জন করা, আমানতদারী, নারীর অধিকার, আত্মীয়তার বন্ধনের গুরুত্ব, জুলুম হতে বিরত থাকা, উত্তরাধিকার আইন, স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক অধিকার, কুফরি হতে বিরত থাকা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি সংক্ষিপ্তভাবে বিবৃত করেছেন।
ভাষণ শেষে তিনি উপস্থিত জনমণ্ডলীকে জিজ্ঞেস করেন,
আমি কি তোমাদের নিকট আল্লাহ্র দ্বীন পৌঁছে দিয়েছি?
উপস্থিত সাহাবিয়ে কেরাম উত্তর দিলেন, “আমরা সাক্ষ্য দেবো যে, আপনি আপনার দায়িত্ব পৌঁছে দিয়েছেন। হিত কামনা করেছেন।” অতঃপর রাসূল ﷺ আকাশের দিকে তাকিয়ে হাত তুলে তিনবার বললেন,
আল্লাহ্ আপনি সাক্ষী থাকুন।
তারপর বললেন,
তোমরা এখানে যারা উপস্থিত আছো, তারা অনুপস্থিতদের কাছে কথাগুলো পৌঁছে দেবে।
এই ভাষণ প্রদানকালে কুরআনের সূরাহ মায়িদাহ্, ৩ নম্বর আয়াত নাযিল হয়েছিলো। আয়াতটির কিয়দংশ নিম্নে দেওয়া হলো:
আজ আমি তোমাদের ধর্মকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের উপর আমার নিয়ামাত সুসম্পন্ন করলাম, আর ইসলামকে তোমাদের ধর্ম হিসেবে মনোনীত করলাম।
বিদায়ী এ ভাষণ কোনো সাধারণ বক্তব্য ছিলো না। এর মাধ্যমে আল্লাহ্র প্রেরিত শেষ নবী মুহাম্মাদ ﷺ দ্বীন ইসলাম সম্পর্কে তাঁর উম্মাহর জন্য চূড়ান্ত দিক নির্দেশনা প্রদান করেন। ইসলাম ধর্মের প্রকৃত মর্মবাণী তাঁর ভাষণে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।
বেলা সাড়ে চারটার দিকে আমরা আমাদের তাঁবুর দিকে রওনা হলাম। আমাদের ইচ্ছা, সূর্য যখন ডুবে যাবে, এই বরকতময় সময় যখন শেষ হয়ে যাবে, তখন আমরা তাঁবুতে প্রবেশ করবো। তার আগ পর্যন্ত বাইরে বাইরে থাকবো। যদিও সেদিনের কথা মনে হলে আফসোস হয়, কেন আরো সুন্দর করে এই মূল্যবান সময়ের সদ্ব্যবহার করতে পারলাম না। দিনের শেষ দিকে এখন হুজ্জাজগণ ক্লান্ত হয়ে হাঁটছেব, কেউ আবার পথের ধারে বসে আছেন, অনেকে শেষ মুহূর্তের দু’আয় লিপ্ত।
নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা সুচারুরূপে সম্পাদনার জন্য সরকার থেকে দলে দলে কর্মী বাহিনী সবকিছু দেখাশোনা করছে। বিশাল ক্যারাভান থেকে ঠাণ্ডা পানির বোতল সরবরাহ করা হচ্ছে। কোনো কোনো গাড়ি থেকে লাবাং বা ফলের জুস দেওয়া হচ্ছে। সর্বত্র খাবারের ছড়াছড়ি। সরকারের সাথে সাথে ব্যক্তিগত পর্যায়ে অনেকে আরাফাতে উপস্থিতগণদের বিভিন্ন পানীয়, খাবার ইত্যাদি সরবরাহ করছে। আল্লাহ্র মেহমানদের খাতিরদারি করে সাওয়াবের ভাগীদার হবার জন্য সকলে উন্মুখ হয়ে আছে। যার যার সামর্থ্য মতো সবাই চেষ্টা করছে কীভাবে হাজ্জ যাত্রীদের সেবায় কিছু অন্তত করা যায়। আজ সত্যিকার অর্থে সকলে হিংসা, বিভেদ ভুলে গেছে। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলাকে সন্তুষ্ট করার জন্য সবাই মাতোয়ারা হয়ে আছে।
কিছুদূর হাঁটার পর খুব সুন্দর একটি দৃশ্য দেখলাম। এক আরব পরিবারের স্বামী-স্ত্রী রাস্তার পাশে বাক্স ভরে ফলের জুস নিয়ে বসে আছেন, দু শিশু পুত্র নিয়ে তাঁরাও হাজ্জে এসেছেন। শিশু দুটির হাতে মা-বাবা জুসের বাক্স তুলে দিচ্ছেন হাজীদের উপহার দেবার জন্য। বাচ্চা দুটোর বয়স ছয় থেকে আট বছরের হবে। তারা মহা উৎসাহে সবার হাতে জুসের প্যাকেট দিয়ে যাচ্ছে। হাতেরগুলো শেষ হয়ে গেলে দৌড়ে মা-বাবার কাছে ফেরত যাচ্ছে, পুনরায় হাত ভরে জুস নিয়ে এসে সবাইকে বিলিয়ে দিচ্ছে। এত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পেয়ে তাদের চোখে মুখে উত্তেজনা আর আনন্দের ছাপ স্পষ্ট। ওদিকে সন্তানদের কাণ্ড দেখে মা বাবার মুখেও পরিতৃপ্তির হাসি ফুটে উঠেছে। আলহামদুলিল্লাহ্ …
আমরা আমাদের তাঁবুর কাছাকাছি এসে ইচ্ছা করেই অন্য একটি তাঁবুতে ঢুকে পড়লাম, সূর্যাস্ত পর্যন্ত এখানেই থাকবো। এ তাঁবুতে সকলে বাঙালি। আমাদের হাতে এখন সময় খুব কম। সূর্যাস্ত একদম নিকটে এসে গেছে। সূর্যের আলো ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যাচ্ছে, রৌদ্রের তীব্রতা যেন ম্রিয়মাণ হয়ে গেছে। আজকের দিনের প্রতিটি মুহূর্ত মহামূল্যবান, আর এখন শেষ মুহূর্তগুলো চলে এসেছে। এর এক সেকেন্ড অপচয় করার অর্থ নিরেট বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়।
আরাফাতের দিনে যেকোনো দু’আ একাধারে তিনবার করে বলা সুন্নাত। এছাড়া আরো একটি সুন্নাত হলো, সূর্যাস্তের আগে আগে কা’বার দিকে মুখ করে দাঁড়ানো ও আল্লাহ্র কাছে আকুলভাবে দু’আ করা। লক্ষ লক্ষ মানুষ এখন এই সুন্নাতে রত হয়ে আছেন। কা’বার দিকে মুখ ফিরিয়ে প্রাণপণে আল্লাহ্র কাছে গুনাহর খাতা মোচন করে দেবার জন্য কাকুতি মিনতি করছেন হাজীগণ। ফেলে আসা আত্মীয়-পরিজন, প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব, দেশবাসী ও সর্বোপরি মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ কামনায় দু’আ করা হচ্ছে। পৃথিবীর যে প্রান্তে যত মুসলিম কষ্ট পাচ্ছেন, স্বৈরাচারীর দুঃশাসনে নিপীড়িত হচ্ছেন, তাঁদের জন্যও আল্লাহ্র কাছে নাজাত চাচ্ছেন অনেকে।
জাহান্নামের আগুন থেকে পরিত্রাণের, হাশরের ময়দানে শেষ বিচারে ক্ষমা পাওয়ার জন্য আল্লাহ্র দরবারে আবেদন করছে সবাই। ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণ কামনার এমন সুবর্ণ স্থান ও সুযোগ আর কোথায় পাওয়া যাবে! অঝোর ধারায় অশ্রু বর্ষণ করছেন অসংখ্য হাজী। আজকের দিনে যেন ক্ষমা পাবার, নেক দু’আ কবুল হবার সৌভাগ্য সবার হয়। আমীন। সুম্মা আমীন।
তবে হাজ্জে এসে কেবল পার্থিব উন্নতির জন্য দু’আ করতে হয় না। শুধু “রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানাতাও” বলতে হয় না, বরং ইহকাল ও পরকাল উভয় কালের জন্য মঙ্গল চাইতে হয়।
“রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানাতাও ওয়া ফিল আখিরাতি হাসানাতাও ওয়া কিনা ‘আযাবান্নার” বলতে হয়। অর্থাৎ দু’আ কবুলকারী রবের কাছে দুনিয়ার কল্যাণের সাথে সাথে আখিরাতের কল্যাণ এবং জাহান্নামের ভয়াবহ আগুন থেকে পরিত্রাণ চাইতে হয়। কারণ যে শুধু মাত্র দুনিয়ার জন্য চায়, তার জন্য আখিরাতে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না।
হাজীদের ক্রন্দনের শব্দে আর দু’আর মূর্ছনায় ধীরে ধীরে সূর্যাস্ত হয়ে গেলো। এত দিন ধরে যে আরাফাত দিবসের অপেক্ষায় ছিলাম, শেষ হয়ে গেলো সেই স্বর্ণালী দিনটি। আল্লাহ্র রহমতের ফেরেশতারা নিশ্চয় ঢেকে রেখেছিলেন আমাদের। এত বিপুল সংখ্যক মুসলিম আজ আল্লাহ্র দরবারে সারাদিন কতই না দু’আ করেছে! আল্লাহ্র কাছে শুকরিয়া, এমন মর্যাদাসম্পন্ন সময় প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য দেবার জন্য। সূর্য ডুবে যাবার পর হঠাৎ কেমন নিষ্প্রাণ হয়ে গেলো সবকিছু, সারাদিনের আবেগ ও ক্লান্তির মিলনে কেমন এক মিশ্র অনুভূতি তৈরি হলো সবার মাঝে।
অন্যান্য দিন এ সময় মাগরিবের প্রস্তুতি গ্রহণ করে মুসলিমেরা। কিন্তু আজ সালাতের জন্য কোথাও কোনো তাড়া নেই। যুহর আর আসর এক সাথে পড়ার পর আর কোনো সালাত পড়তে হয়নি আমাদের। কেমন অদ্ভুত লাগছে এমন সালাতের তাগাদাবিহীন সন্ধ্যাকে!!! আজ সবাই মুযদালিফায় পৌঁছানোর পর একত্রে মাগরিব ও ঈশার সালাত আদায় করবেন, কসর করে ও জোড়া করে।
যদি সেখানে পৌঁছতে গভীর রাত হয়ে যায়, তারপরও অন্য কোথাও মাগরিব বা ঈশা পড়া যাবে না। (তবে কোনো কারণে যদি যাত্রাপথে ফজরের ওয়াক্ত শুরু হয়ে যাবার আশঙ্কা থাকে, তবে মুযদালিফা পৌঁছানোর আগেই পথে মাগরিব ও ঈশা পড়ে নিতে হবে)।
আমরা সালাত আল্লাহ্র জন্য পড়ি। উনার দেওয়া বিধান, উনি যেভাবে খুশি অদল বদল করতে পারেন। এটি সম্পূর্ণ তাঁর এখতিয়ারে। এখানে আমাদের কর্তব্য হলো, তাঁর যেকোনো বিধান বিনা বাক্যব্যয়ে, বিনয়াবনত হয়ে পালন করা ও সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করা। আল্লাহ্ যেন আমাদের মন তাঁর দিকে ঘুরিয়ে দেন।
সূর্যাস্তের পর আমাদের তাঁবুতে ফেরত আসলাম। দেখলাম আমাদের জন্য বিরানির প্যাকেট রেখে দেওয়া হয়েছে। আমরা পেট পুরে খেয়ে নিলাম, কারণ আগামীকালের আগে মনে হয় না পেটে ভারী কিছু পড়বে। সূর্যাস্তের পর দলে দলে হাজীরা মুযদালিফায় রওনা হওয়া শুরু করেছেন, আমাদের গ্রুপ আরো ঘণ্টাখানেক পর ভীড় কমলে রওনা হবে। এখন বের হলে লম্বা সময় ভীড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। এসময় তাড়াহুড়া না করে ধীরে সুস্থে রওনা হওয়া ভালো।
তাঁবুর পাশে হাজীদের ফলমূল দেওয়া হচ্ছিলো, আমি ভাবলাম একটা কমলা নিয়ে আসি। আমাকে দেখে তারা পুরো ক্রেট ভর্তি যত কমলা আছে, সব দিয়ে দিলো। কারণ এখন সবাই চলে যাচ্ছে আরাফাত ছেড়ে, তাদের কাছে অনেক ফল রয়ে গেছে। তাই যাকে পাচ্ছে, দিয়ে দিচ্ছে। আমি ভয়ে একটাও না নিয়ে ফেরত আসলাম। কী সাংঘাতিক ব্যাপার, নিজের মাল-সামান বহন করেই কুল পাচ্ছি না, আমার খেয়েদেয়ে কাজ নেই এক ক্রেট কমলা কাঁধে নিয়ে বয়ে বেড়াবো!!
আমাদের তাঁবুর অধিবাসীরা যখন শুনলেন আল্লাহ্ আমাদের হাজ্জের খুৎবা শোনার এবং মাসজিদে নামিরায় জামাতের সাথে সালাত আদায় করার সৌভাগ্য দিয়েছেন, তখন তাঁরা আফসোস করে উঠলেন, মাসজিদ এত কাছে জানলে তাঁরাও যাবার চেষ্টা করতেন। আমরা নামিরাতে গেলেও প্রকৃতপক্ষে হাজ্জের কার্যাবলী সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করাটাই যথেষ্ট। খুৎবা না শুনলে, জামাতে সালাত না পড়লে অথবা সারাদিন তাঁবুতে থাকলে তাতে হাজ্জ নষ্ট হয় না। বরং আল্লাহ্ আমাদের হৃদয়ের ইখলাস দেখবেন, আমাদের নিয়্যাতের পরিচ্ছন্নতা দেখবেন। আমরা কতটুকু সুন্নাত মেনে উনার ইবাদাত করছি, তা দেখবেন।
তবে একটি কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। তা হলো, হাজ্জের সৌন্দর্য উপভোগ করতে, আরাফাতের ময়দানের মূল আবহের স্বাদ পেতে, বিশ্বের নানা প্রান্ত হতে আগত মুসলিম উম্মাহর সব চেয়ে বড় এই মিলন মেলার সাথে নিজেকে মিশিয়ে দেবার কোনো বিকল্প নেই। তাঁবু থেকে অল্পক্ষণের জন্যও যদি বের হওয়া যায়, তাহলে মুসলিম উম্মাহর এই অভাবনীয় সম্মেলন চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করা যায়।
কিছুক্ষণ পর আমরা সকলে মুযদালিফার পথে রওনা হবার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।
পরবর্তী পর্ব- মুযদালিফায় রাত্রি যাপন
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।