একটা সময় ধারণা ছিলো মুমিন যেহেতু হয়েছি, একদিন না একদিন তো জান্নাতে যাবোই (যদিও প্রকাশ করা যায় না, তবুও শয়তানের প্রচ্ছন্ন ওয়াস-ওয়াসায় ধোঁকা একটা আছেই)! আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুক! কীভাবে এই চিন্তা করা সম্ভব? এমন না যে মৃত্যুর পরপরই জাহান্নাম আর তারপর কিছুদিন আযাব ভোগ করে এসে জান্নাত। কক্ষণও না। এমন নয়। ধরুন কেউ যদি জাহান্নামে কিছুক্ষণ থেকে আল্লাহর দয়ায় জান্নাতে ফিরেও আসে, তবুও তো তাকে এমন কয়েকটি ধাপ পেরোতে হবে যার একটি অন্যটি থেকে ভয়ংকর।
প্রথমেই মৃত্যু, যার ভয়াবহতাই জাহান্নামীদের জন্য যথেষ্ঠ। উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) বলেন, “যিনি ছাড়া কোনো রব নেই সেই আল্লাহর কসম, যদি আমার কাছে দুনিয়ার সকল স্বর্ণ এবং রৌপ্য থাকতো, আমি সেগুলোর বিনিময়ে হলেও মৃত্যুর পরে যে ভয়াবহতা রয়েছে তা থেকে বাঁচার চেষ্টা করতাম।”[১]
পাপাচারী ব্যক্তি বা অবিশ্বাসী যখন দুনিয়ার জীবন ত্যাগ করে আখিরাতের দিকে যেতে থাকবে, তখন মৃত্যুর অন্ধকার ফেরেশতা খসখসে কফিন নিয়ে আগমন করবে যেটা আমদানি হয়েছে জাহান্নাম থেকে। তার পাশে এসে বসে মৃত্যুর ফেরেশতা বলবেন, “হে পাপী আত্মা! আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার ক্রোধ এবং রোষের দিকে ছুটে আসো।” তাকে বলা হবে যে, তোমাকে এখনই আসতে হবে এবং তোমার জন্য আল্লাহর ক্রোধ অপেক্ষা করছে। যখন মৃত্যুর ফেরেশতা এই ঘোষণা করবে, তখন তার আত্মা দেহের মধ্যে ছুটে বেড়াবে আর সে বের হয়ে আসতে চাইবে না। মৃত্যুর ফেরেশতারা তখন তার আত্মাকে খপ করে ধরে টানতে টানতে নিয়ে যাবে, ভেজা পশমের মধ্য থেকে কাটাঁযুক্ত কিছুকে টেনে আনতে যেমন অবস্থা হয় তেমন।[২]
মৃত্যুর ভয়াবহতা শেষ না হতেই কবরের নিঃসঙ্গতা ও ভয়ানক দুর্দশাগ্রস্ত জীবন। আপনার সাথে কেউ নাই, একা। কী দিন, কী রাত! সেখানে কেবল যন্ত্রণা আর যন্ত্রণা। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “আমি কবরের দৃশ্য থেকে অধিক ভয়ানক দৃশ্য কখনো দেখিনি।” [তিরমিযী, ২৩০৮ (হাসান)]
যখন তাকে কবরস্থ করা হয় তখন কবর তাকে বলে, তোমার আগমন খারাপ আগমন। আর জেনে রাখো, তুমি খারাপ জায়গায়ই এসেছো, আমার উপর চলাফেরাকারীদের মধ্যে তুমিই আমার সবচেয়ে বড় দুশমন ছিলে। আজ তোমাকে আমার কাছে অর্পণ করা হয়েছে, তুমি আমার আয়ত্তে এসে গেছো, এখন তোমার সাথে আমি কীরূপ ব্যবহার করি দেখে নাও। তারপর কবর তাকে এমনভাবে চাপ দেয় যে, তার ডান পাশের হাড় বাম পাশের হাড়ের ভিতর ঢুকে যায়। আল্লাহ তা’আলা তার জন্য সত্তরটি এমন অজগর সাপ নিযুক্ত করে দেন, যার একটিও যদি জমিনের বুকে শ্বাস ফেলে তাহলে কেয়ামত পর্যন্ত জমিনে কোনো কিছু উৎপন্ন হবে না। হিসাবের জন্য তাকে নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত সাপগুলো তাকে কামড়াতে ও দংশন করতে থাকবে। [তিরমিযী, ২৪৬০ (যয়ীফ)]
এই দীর্ঘ যন্ত্রণাময় জীবন শেষ হবে শিঙ্গার বিকট শব্দে। রূহসমূহ মৌমাছির মতো বের হয়ে আসমান ও জমিনের মধ্যবর্তী স্থান পূর্ণ করে দেবে। অতঃপর রুহসমূহ দেহে প্রবেশ করবে। কিয়ামত! মহান আল্লাহ বলেন,
“শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়া হবে, ফলে আসমান ও যমীনে যারা আছে সবাই বেহুঁশ হয়ে যাবে, তবে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন। অতঃপর আবার শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়া হবে, তৎক্ষণাৎ তারা দণ্ডায়মান হয়ে দেখতে থাকবে।” [সূরা যুমার (৩৯):৬৮]
অতঃপর হিসাবের জন্য হাশরের মাঠে অপমান আর লাঞ্চনার অপেক্ষা। “ইয়াওমুদ্দিন” অপরাধীদের দাঁড়ানোর কোনো জায়গা থাকবে না, উপুড় মুখে…আপনি চিন্তা করতে পারেন!
“আর আমি কিয়ামতের দিনে তাদেরকে একত্র করবো উপুড় করে, অন্ধ, মূক ও বধির অবস্থায়। তাদের আশ্রয়স্থল জাহান্নাম; যখনই তা নিস্তেজ হবে তখনই আমি তাদের জন্য আগুন বাড়িয়ে দেবো।” [সূরা বনী ইসরাঈল (১৭):৯৭]
এই ভীতিকর ও ভয়াবহ পরিস্থিতিতে পাপাচারী, জালেম, মুনাফিকদের দেখা যাবে অবনত মস্তকে, অপলক নেত্রে। আর তাদের অন্তর থাকবে শূন্য। সেদিন আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কেউ কোনো কথা বলতে পারবে না। সেদিন মানুষের হৃদয় থাকবে ওষ্ঠাগত, বিষণ্ণ। কিয়ামতের সে দিনটির দৈর্ঘ্য হবে পঞ্চাশ হাজার বছর। মহান আল্লাহ বলেন,
“হে মানুষ, তোমরা তোমাদের রবকে ভয় কর। নিশ্চয় কিয়ামতের প্রকম্পন এক ভয়ঙ্কর ব্যাপার। যেদিন তোমরা তা দেখবে সেদিন প্রত্যেক স্তন্যদানকারিণী আপন দুগ্ধপোষ্য শিশুকে ভুলে যাবে এবং প্রত্যেক গর্ভধারিণী তার গর্ভপাত করে ফেলবে, তুমি দেখবে মানুষকে মাতাল সদৃশ, অথচ তারা মাতাল নয়। তবে আল্লাহর আযাবই কঠিন।” [সূরা হাজ্জ (২২): ১-২]
আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, “কিয়ামতের দিন মানুষ ঘামতে থাকবে। এমনকি তাদের ঘাম জমিনের সত্তর গজ নিচ পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। আর তা তাদেরকে বাকরুদ্ধ করে দেবে এবং তাদের কান পর্যন্ত পৌঁছে যাবে।” [বুখারী, ৬৫৩২]
অতঃপর মহান আল্লাহ ন্যায়বিচারের মানদণ্ড স্থাপন করবেন। ছোট বড় কিছুই সেদিন বাদ যাবে না, মহান আল্লাহ বলেন,
“আমি কেয়ামতের দিন ন্যায়বিচারের মানদণ্ড স্থাপন করবো। সুতরাং কারও প্রতি জুলুম হবে না। যদি কোনো আমল সরিষার দানা পরিমাণও হয়, আমি তা উপস্থিত করবো এবং হিসাব গ্রহণের জন্যে আমিই যথেষ্ট।” [সূরা আম্বিয়া (২১): ৪৭]
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, “তোমাদের প্রত্যেক ব্যক্তির সাথে আল্লাহ তা’আলা সরাসরি কথা বলবেন, মাঝখানে কোনো দোভাষী থাকবে না। তখন সে তার ডান দিকে তাকাবে এবং সেখানে সে তার কৃত আমল ছাড়া আর কিছুই দেখবে না। সে বাম দিকে তাকাবে, সেখানেও সে তার কৃত আমল ছাড়া অন্যকিছু দেখবে না। সে তার সামনের দিকে তাকাবে এবং আগুন ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাবে না। সুতরাং আগুন থেকে বাঁচো যদিও শুকনো খেজুরের এক টুকরো অথবা একটি ভালো কথা ব্যয় করে হয়।” [মুসলিম, ১০১৬]
সেখানে মানুষের আমলনামা প্রকাশ করা হবে লিখিত আকারে, আড় চোখের দৃষ্টিও যে সেদিন ফিরে আসবে মহা দুঃসংবাদ হয়ে..
আর আমলনামা সামনে রাখা হবে। তাতে যা আছে, তার কারণে আপনি অপরাধীদেরকে ভীত-সন্ত্রস্ত দেখবেন। তারা বলবে, হায় আফসোস, এ কেমন আমলনামা! এ যে ছোট বড় কোনো কিছুই বাদ দেয়নি, সবই এতে রয়েছে। তারা তাদের কৃতকর্মকে সামনে উপস্থিত পাবে। আপনার পালনকর্তা কারও প্রতি জুলুম করবেন না।” [সূরা কাহফ (১৮):৪৯]
হিসাবের পর আপনাকে মুখোমুখি করা হবে পুলসিরাতের। পুলসিরাতের উপর দিয়ে সকলকেই অতিক্রম করতে হবে। নেককার বিদ্যুৎ, বাতাস ও দ্রুতগামী ঘোড়ার গতিতে তা পার হয়ে যাবে। কেউ পার হবে সম্পূর্ণ নিরাপদভাবে। কেউ সামান্য আঁচড় খেয়ে। কেউ আহত হয়ে। আর কেউ হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাবে জাহান্নামে। এমনকি সর্বশেষ ব্যক্তিকে টেনে টেনে নেওয়া হবে। সাহাবী আবু সাঈদ (রাঃ) বলেন, “পুলসিরাত হবে চুলের চেয়েও চিকন, তরবারির চেয়েও ধারালো।”
এরপর সেই জাহান্নাম যেখানে ঘুরে আসার প্লান নিয়ে দিনের পর দিন পার হয়ে যাচ্ছে!
“যার আমলনামা তার বাম হাতে দেওয়া হবে সে বলবে, ‘হায়, আমাকে যদি আমার আমলনামা দেওয়া না হতো! আর যদি আমি না জানতাম আমার হিসাব! হায়, মৃত্যুই যদি আমার চূড়ান্ত ফায়সালা হতো! আমার সম্পদ আমার কোনো কাজেই আসলো না! আমার ক্ষমতাও আমার থেকে চলে গেলো!’ (বলা হবে) ‘তাকে ধরো, অতঃপর তাকে বেড়ি পরিয়ে দাও। তারপর তাকে তোমরা নিক্ষেপ কর জাহান্নামে।'” [সূরা হাক্বক্বাহ (৬৯): ১৯-৩১]
এখনও কি জাহান্নামের ঝুঁকি নিয়ে আগামীকাল থেকে প্লান? কক্ষণো নয়। আল্লাহ আমাদের সকল প্রকার সীমালঙ্ঘন থেকে হেফাজত করুক। আমিন।
[১] সাহীহ আত-তাওতিক ফি সীরাত ওয়া হায়াত আল-ফারুক, পৃ ৩৮৩
[২] আর-রুহ, ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।