যদিও বর্তমান সময়ের বহুল আলোচিত-সমালোচিত ও বিতর্কিত বিষয়; তবু মনে হয়েছে এই বিষয়টিই সবচেয়ে অস্পষ্ট। বোনদের কাছে যতটা অপ্রীতিকর, ভাইদের কাছে ততোধিক কাঙ্ক্ষিত!
পশ্চিমা মিডিয়া ও ইসলাম বিদ্বেষীদের সমালোচনার প্রিয় বিষয়গুলোর একটিও বটে। প্রকৃত অর্থে চোরের হাত কাটা, বহুবিবাহ, বিবাহিত যেনার শাস্তি হিসেবে রজম (পাথর মেরে হত্যা) – ইসলামের এই বিষয়গুলি নিয়ে মিডিয়ার বেশ আগ্রহ। ফলশ্রুতিতে, মিডিয়া নির্ভর পশ্চিমের সাধারণ জনগণের ধারণায়, মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে হাত কাটা, চার বৌ নিয়ে ঘুরে বেড়ানো লোকের দেখা মেলা যেন ঢাকা শহরে কাক দেখার মতন- যেদিকেই তাকাবেন, দেখতে পাবেন! তবে বাস্তবতার সাথে এর মিল কম। বরং, এই বহুবিবাহের ধারণাটা আধুনিক মুসলিমদের কাছেও যেন স্পষ্ট নয়।
এর কারণ হল, আমরা আমাদের দ্বীনের ব্যাপারে জ্ঞানার্জন ছেড়ে দিয়েছি। আল্লাহর বিধানের ব্যাপারে সঠিক ধারণা অর্জন যেমন ঈমান বৃদ্ধি করে, তেমনি আমলকেও সুন্দর করে।
কোরআনে সূরা নিসার ৩ নং আয়াতে আমরা বহুবিবাহের হুকুম পাই।
আল্লাহ বলেন,
“….তাহলে নারীদের মধ্য হতে তোমাদের পছন্দ মত দুটি, তিনটি কিংবা চারটিকে বিয়ে করে নাও; কিন্তু যদি তোমরা আশংকা কর যে, তাদের সাথে ন্যায় সঙ্গত আচরণ করতে পারবেনা, তাহলে মাত্র একটি অথবা তোমাদের ডান হাত যার অধিকারী (ক্রীতদাসী); এটা আরো উত্তম; এটা অবিচার না করার নিকটবর্তী।” (সূরা নিসা (৪):৩)
আবার একই সূরার ১২৯ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,
“তোমরা কখনও স্ত্রীগণের মধ্যে সুবিচার করতে পারবেনা যদিও তোমরা তা কামনা কর।” (সূরা নিসা (৪):১২৯)
প্রথমত, বুঝতে হবে যে এই আয়াত দ্বারা পূর্ববর্তী আয়াত বা হুকুমকে রহিত করা হয়নি অর্থাৎ বহুবিবাহের হুকুম এখনও জারি আছে এবং থাকবে। তাহলে মনে প্রশ্ন আসাটাই স্বাভাবিক যে, আল্লাহ পরবর্তী আয়াত দ্বারা কী বুঝাতে চাইছেন? সেটাই বোঝার বিষয় ইন শা আল্লাহ। কুরআনের নির্ভরযোগ্য তাফসীর বর্তমান আছে, কেউ চাইলে বিস্তারিত পড়াশোনা করতে পারেন। ইন শা আল্লাহ।
বিয়ে একটা চুক্তি। যার মাধ্যমে একজন নারী এবং একজন পুরুষের মধ্যে একটি বৈধ সম্পর্ক স্থাপিত হয়। আর প্রত্যেকটা সম্পর্কের মত এই সম্পর্কও কিছু দায়িত্বের জন্ম দেয়। স্বামীর প্রতি স্ত্রীর যেরকম দায়িত্ব ও কর্তব্য আছে, তেমনি স্ত্রীর প্রতিও স্বামীর দায়িত্ব ও কর্তব্য বর্তমান। বিয়ের মাধ্যমে একটি পরিবারও গঠন হয়। পরিবারে স্বামী-স্ত্রী যেমন একটা অংশ; সন্তান ও তাদের লালন-পালনও এমন আরেকটি অংশ। পরিবারের কোন দায়িত্ব ও কর্তব্যই স্বামী বা স্ত্রীর একার নয়; বরং এটা একটা যৌথ প্রচেষ্টায় নির্মিত সুনিয়ন্ত্রিত সামাজিক প্রতিষ্ঠান। তবে ক্ষেত্র বিশেষে কিছু কাজ explicitly স্ত্রীকে করতে হয় আর কিছু কাজ স্বামীকে। একটু ব্যাখ্যা করেই বলি- যেমন ধরুন বাচ্চাদের দেখাশোনা, রান্না, ঘর পরিষ্কার, কাপড় চোপড় ধোয়া, পরিবারের সদস্যের দেখাশোনা ইত্যাদি স্ত্রীকে দেখতে হয়। এক্ষেত্রে স্বামীর সামর্থ্য থাকলে সাহায্যকারীর ব্যবস্থাও করা যেতে পারে। এতে দোষের কিছু নেই। এক্ষেত্রে স্ত্রী কাজ তদারকি করবেন। নিজে কাজ করার থেকে কিন্তু লোক চালানো কঠিন। স্ত্রীকে সেই ম্যানেজমেন্টের কাজটাই করতে হবে।
আবার স্বামীকে উপার্জনের জন্য বাইরে কাজ করতে যেতে হবে। তাকে পরিবারের সবার জন্য যেমন আর্থিক দিকটা খেয়াল রাখতে হয়, তেমনি সবার শারীরিক, মানসিক সুস্থতা, বিনোদনের ব্যবস্থা (ছোটখাট ঘুরতে যাওয়া), বাজার সদাই এবং ক্ষেত্রবিশেষে সন্তানদের লেখাপড়ার ব্যাপারে স্ত্রীকে সাহায্য এরকম অনেক ভারী ভারী কাজ করতে হয়।
তাহলে বোঝা যাচ্ছে, বিয়ে , শুধুই একটা সম্পর্ক স্থাপন নয়- সাথে আছে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।
বিয়ের মাধ্যমে স্ত্রী যেমন স্বামীর অভিভাবকত্ব মেনে নিয়ে তার প্রতি আনুগত্য, সৌহার্দ ও বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করবে- এটাই কাম্য।
আনুগত্য ব্যাপারটা কিন্তু অত সহজ নয়! এটা অনেক ক্ষেত্রেই মুসলিমা স্ত্রীকে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা থেকেই মেনে নিতে হয়। আর এর জন্য অবশ্য পুরস্কারটাও সেই মাপের।
একই ভাবে স্বামীকে নিশ্চয়তা দিতে হবে তার বিবাহিতা স্ত্রীকে একটা সৌহার্দ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের। যেহেতু পরিবার একটা যৌথ প্রতিষ্ঠান, একে অপরের সহযোগিতা ছাড়া এটার সফলতা আনয়ন সম্ভব নয়। স্বামীর পারিবারিক, ব্যক্তিগত, সামাজিক মান রক্ষা করা যেমন স্ত্রীর কর্তব্য তেমনি স্ত্রীর সামাজিক, পারিবারিক নিরাপত্তা ও শারীরিক, মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করার দায়িত্বও স্বামীর। এমনকি স্ত্রীর দ্বীনের বিষয়ে জ্ঞানার্জন করার সুযোগ, উৎসাহ প্রদান ও আমল করার স্পৃহা যোগানও স্বামীর কর্তব্য। কারণ স্ত্রীর দ্বীন ও তার কর্মকান্ড সম্পর্কে স্বামী বেচারাকে জবাবদিহি করতে হবে আখিরাতে।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, বিয়ে মানে নেহায়েত খাদ্যানুষ্ঠান ও নাচগানের অনুষ্ঠান সর্বস্ব আনুষ্ঠানিকতা নয়; বরং এটি একজন দায়িত্ববান পুরুষ ও কর্তব্যপরায়ণ নারীর একসাথে পথচলার বৈধতা। অতএব ২য়, ৩য় বা ৪র্থ বিবাহ কেবল আরেকটা স্ত্রী বা আরেকটি অনুষ্ঠান নয়; বরং এক একটি অতিরিক্ত দায়িত্ব, যেটা আল্লাহ দায়িত্ববান এবং শারীরিক, আর্থিক, মানসিক সক্ষমতা সম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য জায়েজ করেছেন। যারা এই দায়িত্বগুলো সুন্দর করে পালন করতে পারবে তাদের জন্য রয়েছে অবারিত পুরষ্কার।
অতএব সূরা নিসার ১২৯ নং আয়াত, আমাদের সৃষ্টিকর্তা থেকে সতর্কবাণী রূপে নাজিল হয়েছে। আল্লাহ আমাদের সৃষ্টিকর্তা। তিনি জানেন তাঁর সৃষ্টি কেমন; তাই হুকুমের সাথে সাথে সতর্ক করেছেন। সূরা নিসার ১২৯ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন , ” তোমরা কখনো স্ত্রীদের মধ্যে সুবিচার করতে পারবেনা যদিও তোমরা তা কামনা কর , সুতরাং তোমরা কোন একজনের প্রতি সম্পূর্ণ ঝুঁকে পরোনা ও অপরজনকে ঝুলন্ত অবস্থায় রেখোনা…….)”
আর ন্যায়বিচারের কথা ৩নং আয়াতে বলেছেন। এখন প্রশ্ন হলো, ন্যায়বিচার অর্থ কী? ন্যায়বিচার অর্থ কি শুধু ভরণ-পোষণ আর জৈবিক চাহিদা পূরণ, নাকি আরো কিছু? ন্যায়বিচার হলো আর্থিকভাবে যেমন স্ত্রীকে সাপোর্ট দেওয়া, তেমনি তার জৈবিক, মানসিক, সামাজিক ও পারিবারিক চাহিদা গুলো পূরণ করা। স্ত্রী যদি একাধিক হয়; তাহলে প্রত্যেকের এই অধিকারগুলো নিশ্চিত করা স্বামীর কর্তব্য। ১২৯ নং আয়াতে আল্লাহ যে সুবিচার করতে না পারার অক্ষমতার কথা বলেছেন; সেটা হলো কোন স্ত্রীর প্রতি আন্তরিক ভালোবাসার বিষয়টি। অন্তরের দিক থেকে কারো দিকে বেশি ঝুঁকে পড়লে আল্লাহ ধরবেন না; কারণ এটা মানুষ চাইলেও নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম নয়।
তবে সুবিচারপূর্ণ আচরণ করতে হবে সবার সাথেই। একজনের প্রতি বেশি ঝুঁকে পরে, অপরজনের প্রতি আসক্তিহীন হওয়াতে আল্লাহ সতর্ক করছেন। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন,
“যার দুই স্ত্রী রয়েছে, কিন্তু একজনের দিকেই সম্পূর্ণরূপে ঝুঁকে পড়েছে, সে কিয়ামতের দিন এমন অবস্থায় উঠবে যে তার শরীরের অর্ধেক অংশের গোশত খসে পড়বে। ” (আবু দাউদ ৩২২)
সুতরাং অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বহুবিবাহ আল্লাহ জায়েজ করেছেন, কিন্তু এর সাথে জড়িত আছে অতিরিক্ত দায়িত্ব। আর সেই সাথে দায়িত্ব গ্রহণ করার আগে সতর্কবাণী। সুতরাং যার পক্ষে সম্ভব, সে এই দায়িত্ব নিবে আর যার পক্ষে সম্ভব নয়, সে বিরত থাকবে।
অপরপক্ষে, বোনদের খেয়াল রাখা উচিত যে, কারো স্বামী এই ব্যাপারে অগ্রগামী হলে, তাকে সাহায্য করতে হবে। স্বামীর চরিত্র বিশ্লেষণ এ নেমে পড়বেন না যেন! স্ত্রীদের মধ্যে যে পারস্পরিক হিংসা বর্তমান সেটা থাকাই স্বাভাবিক। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জীবনী পড়লেও আমরা উম্মুল মুমেনীন দের মধ্যে পারস্পরিক এই বৈধ হিংসা দেখতে পাই। এটাই মানুষের সাইকোলজি। মেয়েদের আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা এভাবে বানিয়েছেন। তাই তার এই সৃষ্টিগত ব্যাপারটা স্বামীর বোঝা উচিত, সম্মান করা উচিত।
স্বামীর কোন অবস্থাতেই উচিত নয়, স্ত্রী যদি এই ব্যাপারে মন খারাপ করে বা কষ্ট পায়, তাকে ভর্ৎসনা করা বা তার ঈমানের পোস্ট মর্টেম করা। বরং এক্ষেত্রে স্বামীকে ধৈর্য ও সহমর্মিতার পরিচয় দিতে হবে। আর স্ত্রী দের মনে রাখা প্রয়োজন, সকল কর্মকান্ড আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হওয়া উচিত। আর আল্লাহর সন্তুষ্টির কাজ করতে গিয়ে সাময়িক কষ্টের শিকার হলেও, আল্লাহ সেটা সহজ করার মালিক; পুরুস্কারও আল্লাহর কাছেই কাম্য ইনশা আল্লাহ। তাদের স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে করার ইচ্ছা তাদের কোনো ব্যর্থতার জন্য নয়। তার অনেক কারণ থাকতে পারে। কিন্তু স্ত্রী ব্যর্থ এই ব্যাপারটা যেন তাকে বোঝানো না হয়। কারণ মেয়েরা প্রথমেই এটা ভাবে যে তার কোনো কমতির জন্য স্বামী এটা করতে চাইছেন।
ক্ষেত্রবিশেষে হয়তো ঘটনা তাই হতে পারে। তবে বোনদের অনুরোধ একটু চিন্তা করবেন, উম্মুল মুমেনীন আইশা (রা) এর কোন কমতি এর জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওনার পর আরো বিয়ে করলেন! অনেকে বলতে পারেন সন্তান ছিল না তাঁর! কিন্তু এটা সাধারণ মুসলিমদের বহুবিবাহের জায়েজ কারণ হলেও, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্য কারণ ছিল না। আর সেই জায়গায়, স্ত্রী অসুন্দর হয়ে গেছে মর্মে, তার সেই কমতি তাকে জানিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করতে চাওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত?
আমাদের সকলের চিন্তা করা প্রয়োজন মুসলিম হিসেবে আমরা আমাদের হাত ও মুখ দিয়ে কতটা নির্মমভাবে আরেকজন মুসলিম কে কষ্ট দেই! চিন্তা করার সময় এখনো ফুরিয়ে যায় নি। তাই বোনদের পরামর্শের পাশাপাশি ভাইদের কাছে অনুরোধ, কুরআন ও সুন্নাহের নির্দেশনা অনুযায়ী নিজের অবস্থান বিবেচনা পূর্বক বহুবিবাহের সিদ্ধান্ত নিবেন। এতে আপনার দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ নিহিত। নিজের পূর্ব বিবাহিতা স্ত্রীর প্রতি অভিযোগের লিস্ট তৈরি না করে তার প্রতি সহমর্মী হবেন, তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু হবেন; প্রতিযোগী নয়, সহযোগী হবেন – তাহলেই শান্তি প্রতিষ্ঠিত থাকবে ইনশা আল্লাহ্।
এবার কিছু বাস্তব কেস স্টাডির মাধ্যমে একটু বোঝার চেষ্টা করব যে, কোন ভাইদের এ ব্যাপারে অগ্রগামী হওয়া উচিত এবং কাদের ভেবে কাজ করা উচিত ইনশাআল্লাহ।
কেস স্টাডি ১:
ভাইদের সাথে বসলেই শুধু বহুবিবাহের সুন্নাহ প্রতিষ্ঠা করার কথা বলা হয় অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রায় প্রত্যহ করা সুন্নাহ যেমন- নিজের কাজ নিজে করা, তাহাজ্জুদ সালাত নিয়মিত পড়া, হাসিমুখে সালাম দেওয়া, চক্ষু অবনমিত রাখা, সুন্নাহ সালাতের ব্যাপারে মনোযোগী হওয়া ইত্যাদি ব্যাপারে মোটামুটি গা ছাড়া- এমন একজন ভাই, বিয়ের জন্য (১ম বিয়ে) বৌ দেখতে গিয়ে খোঁজেন সুন্দরী (ফর্সা অবশ্যই), শিক্ষিতা, ভাল ঘরের (সম্ভ্রান্ত, ধনী), সাংসারিক, দ্বীনি মেয়ে!!
অনেক কষ্টের পর একজন পাত্রীর সন্ধান পাওয়া যায়। আলহামদুলিল্লাহ, বিয়েও হয়। তবে কয়েকদিনের মধ্যেই নতুন বৌ কে তার “সুন্নাহ প্রতিষ্ঠা” করার ইচ্ছা জানায়। শুরু হয়ে যায় অশান্তি।
কেস স্টাডি ২:
সুখী পরিবার। স্বামী-স্ত্রী দুইজনই দ্বীনদার। অল্প আয়ের হলেও অল্পে তুষ্টির কারণে সুখের কোন অভাব নেই। সুখী দম্পতি, সন্তানদের নিয়ে ভালোই দিন কাটাচ্ছিল। তবে কিছু অতি উৎসাহী দ্বীনি ভাইদের মনে হল, ঐ স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করলে, আরো একটা সুখী পরিবার রচনা করা সম্ভব। উল্লেখ্য স্বামীর আয়ে তার বাবা মা এর দেখাশোনা, চিকিৎসা সব চলে। আর মাসের শেষে টানাপোড়েন চলে। তবে স্ত্রী দ্বীন বোঝেন, স্বামীর প্রতি অনুগত। তার দায়িত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
দ্বীনি ভাই হিসেবে অনেক স্বামী তাদের কাছ থেকে পূর্বে অনেক ভালো পরামর্শই পেয়েছেন, তবে এবার প্রতিটা সমস্যার সমাধান এই একটা ব্যাপারে এসে আটকে যেতে থাকে। এমনকি এমন একটা পর্যায় তৈরি হয় যে, তার স্ত্রী সংসারের কাজে কতটা পটিয়সী, সেটারও বিচার বিশ্লেষণ করা হয়!
দ্বীনিভাইদের পরামর্শ থেকে দারুণ উৎসাহী হয়ে ওঠেন স্বামী। কিন্তু বাঁধ সাধে তার এতকালের ভালবাসার স্ত্রী। কান্নাকাটি করে একাকার অবস্থা। এত পরহেজগার স্ত্রীর এই রকম ভগ্ন ঈমান দেখে ব্যথিত স্বামী, তার রাগ চেপে রাখতে পারলেন না। খারাপ আচরণ এর সাথে সাথে অল্পে তুষ্ট তার ভালোবাসার বৌ এর কোন ভাল গুনই আর চোখে পরে না তার। স্বামী-স্ত্রীর কান্নাকাটি, মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে তালাক উচ্চারণ করে ৫ মিনিট পর আবার ফিরিয়ে নিলেন। স্বামীর নির্মম ব্যবহারে ব্যথিত, কিন্তু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই তালাক এর এত বড় ঘটনাকে ছোট করে ফেলা স্বামীকে ক্ষমা করেন। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য স্ত্রী রাজি হন।
কিন্তু সীমিত আয়ের সংসারে, আরেকটা বাসায় নতুন বৌকে রাখা, স্বামীর সাধ্যের বাইরে। অতএব, স্ত্রী কে বলা হয় একই বাসায় দুই স্ত্রী বসবাস করবে, কারণ এতে করে নাকি বহুবিবাহের সুফল পাওয়া যাবে!! স্ত্রী এবার স্বামীর এই অন্যায় আবদার মানতে রাজি হন না। সুখের সংসার কথাটাও হারিয়ে যায়।
কেস স্টাডি ৩:
বহুবছর অনেক চেষ্টার পরও সন্তান হচ্ছেনা। অনেক টাকা পয়সা খরচ করার পর যখন ডাক্তার বলে দিলেন আর কোনোদিন স্ত্রী মা হতে পারবেন না; স্বামী তখন চিন্তা করেন আবার বিয়ে করবেন। স্ত্রী রাজি হন না। স্বামীকে হুমকি দেন, যদি বিয়ে করেন তাহলে তাকে ছেড়ে চলে যাবেন। স্বামী, তার স্ত্রীকে ভালোবাসেন কিন্তু বাবা হওয়ার প্রবল ইচ্ছাও বর্তমান। স্বামী স্ত্রীকে ছাড়তে চান না।
কেস স্টাডি ৪:
ব্যবসা ভালোই যাচ্ছে ৩ সন্তানের জনকের। স্ত্রী তার খুবই ভাল, পরহেজগার নারী। বাবা-মা, বিধবা বোনটাও থাকেন তাদের সাথে। ব্যবসায়িক কাজে প্রায় বাইরে থাকতে হয়। ভদ্রলোক দায়িত্বশীল মানুষ; আল্লাহ ভীরুও। স্ত্রীকে অনেক শ্রদ্ধা করেন, ভালোবাসেন। একবার ব্যবসায়িক কাজে থাকার সময় এক বিধবা বোনের খবর জানতে পারেন। সেই বোনের কষ্টে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। সিদ্ধান্ত নেন তাকে বিয়ে করবেন। প্রথমা স্ত্রীকে না জানিয়েই বিয়ে করে ফেলেন। যখন তার প্রথম স্ত্রী জানতে পারেন, মেনে নিতে পারেন না, কান্নাকাটি করেন, নিজেকে ব্যর্থ ভাবেন! কোথায় ভুল হয়েছে, কোন দায়িত্বে কমতি করেছেন খুঁজে ফেরেন!
আলহামদুলিল্লাহ স্বামী তার মর্মপীড়া বুঝে তাকে আশ্বস্ত করেন যে, এটা তার কোনো ব্যর্থতা নয়, বরং সে একটা মহৎ কাজে তার সহযোগী! আল্লাহ্ তার স্বামীকে পছন্দ করেছেন এই অতিরিক্ত দায়িত্ব গ্রহণের জন্য আর তাকে করেছেন তার সহযোগী। হ্যাঁ, হয়তো কিছুটা বেশি ত্যাগ, বেশি ধৈর্যের প্রয়োজন পড়বে; কিন্তু তাকে যদি তার স্ত্রী সাহায্য না করেন তাহলে আল্লাহর জন্য কাঁধে তুলে নেওয়া এই দায়িত্ব তিনি ঠিকমত পালন করতে পারবেন না।
স্বামীর সুন্দর করে বুঝিয়ে বলার কারণে হঠাৎ তার বিশ্বস্ত স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ের কথা শোনা স্ত্রী, সাময়িক কষ্ট পেলেও, স্বামী ও শ্বশুর-শাশুড়ির ভালো আচরণে ও সহমর্মিতায় মুগ্ধ হয়ে মেনে নেন। তারা এখন সুখেই আছেন। দুই স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক ভালো আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ বারাকাহ দিক ইনশা আল্লাহ।
উপরোল্লিখিত ঘটনা গুলো সত্য ঘটনা অবলম্বনেই লিখিত। এই ঘটনাগুলো থেকে আমরা কিছু শিক্ষণীয় বিষয় পাই, যা নিম্নে পয়েন্ট আকারে দেওয়া হল :
১. সুন্নাহ পালন করার আগে সুন্নাহ সম্পর্কে জ্ঞান প্রয়োজন।
২. বিয়ের সময় দ্বীনদারীকে প্রাধান্য দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন রাসূলুল্লাহ (সা)।
৩. নিজের অবস্থা বিবেচনা করা উচিত। বিয়ের সাথে সাথে শুধু “সুন্নাহ প্রতিষ্ঠা” শব্দটা ব্যবহার করে, নববিবাহিত স্ত্রীর মনে স্থায়ী ভীতি ও অনাস্থা প্রবেশ করানো উচিত নয়।
৪. চক্ষু অবনমিত করে চলা হিজাবের হুকুমে প্রথম এসেছে। আর সেটা ভাইদের সম্বোধন করেই প্রথমে বলা হয়েছে।
৫. স্ত্রীদের মানসিকভাবে কষ্টে রাখা বা কথার দ্বারা কষ্ট দেওয়াও জুলম। মাজলুমের দুয়ার কথা ভুলে গেলে চলবে না। এটা স্ত্রীদেরও খেয়াল রাখা প্রয়োজন।
৬. রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর স্ত্রীদের সাথে কেমন আচরণ করতেন, সেটা জানার চেষ্টা করা উচিত। স্বামীর প্রতি আচরণের ক্ষেত্রে রাসূলের দিক নির্দেশনা ও স্ত্রীদের মনে রাখা উচিত।
৭. অতি উৎসাহে আরেকজনের অবস্থা না বুঝেই পরিস্থিতি ঘোলাটে করছি না তো? ভেবে দেখা দরকার। নাহলে আল্লাহের কাজ করার নামে, সুন্নাহ প্রতিষ্ঠা এর নামে- শয়তানের সবচেয়ে প্রিয় কাজ, স্বামী – স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক নষ্ট করতে নেমে পড়তে পারি। শয়তান যে কতভাবে আমাদের পথভ্রষ্ট করতে পারে!
৮. বহুবিবাহের জন্য সামর্থ থাকা প্রয়োজন। আর্থিকভাবে একাধিক পরিবারকে চালানোর সামর্থ্য থাকতে হবে। এই সামর্থ্যের ব্যাপারে যদিও অনেকে অনেক কথা বলে। তাই কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে জেনে বলাটা প্রয়োজন। সামর্থ্যের বাইরে কোনো কিছু ইসলামে কখনোই কাম্য নয়। হজের জন্য আর্থিক সংগতি এর পাশাপাশি, শারীরিক সক্ষমতার কথা বলা। তাই সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে নিজের জন্য কঠিন করা। অনেকে এক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর একটা হাদিস উল্লেখ করেন যে, কোনো এক সাহাবী দারিদ্রের অভিযোগ করায় তাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পরামর্শ দিয়েছেন বিয়ে করার। এভাবে ৩ টা বিয়ের পর তার অবস্থার পরিবর্তন হয়।
উল্লেখ্য, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বিভিন্ন হাদীস পাঠ করলে আপনারা দেখবেন, তিনি সবার ক্ষেত্রে একই কথা বলেন নি। পরিস্থিতি বুঝেই ওনার পরামর্শ গুলো হোত এবং তিনি কোনো কথা নিজের মন মত বলতেন না। সব আল্লাহ্ কর্তৃক অনুমোদিত থাকত। তাই ব্যক্তি বিশেষে পরামর্শ accurately কী হওয়া উচিত শুধু মাত্র তিনিই বলতে পারতেন। এখন প্রশ্ন হলো হাদীস পড়েই কোনো একটা সিদ্ধান্ত, এ বিশেষ করে এরকম সিদ্ধান্ত কি নিয়ে ফেলা যায়? কয় জন এব্যাপারে কোনো আলেমের শরণাপন্ন হন? তারাই তো হাদীসের ব্যাখ্যাটা ভালো বলতে পারেন তাই না?
৯. অন্যের জন্য পরামর্শ দেওয়ার আগে নিজের জীবনে সেটার উপস্থিতি থাকা বা কেন নাই সেটা বোঝার চেষ্টা করা উচিত। নিজের জীবনের কোনো সমস্যা আরেকজনের জীবনেও বর্তমান, এই জাতীয় ধারণা থেকে বের হয়ে আসা প্রয়োজন।
নিজের সামর্থ্য থাকলে নিজের জীবনে বহুবিবাহ প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে দ্বীনের কাজ করেন। যার সামর্থ্য নাই তাকে উৎসাহ দিয়ে ঝামেলা করে আল্লাহর কাছে অপরাধী হয়ে লাভ কী?
১০. ন্যায়সঙ্গতভাবে কোন পুরুষ বহুবিবাহ করতে চাইলে তাকে সমর্থন করা উচিত। আর একাধিক বিয়ের জন্য প্রথম স্ত্রীর অনুমতি এর কোনো বিধান নেই। এটাও একটু বুঝার ব্যাপার। এখানেও ভাইদের কারণটা চিন্তা করা প্রয়োজন। অনুমতি নেওয়ার বিধান নেই ঠিক আছে, কিন্তু জানিয়ে দিলে সেটা ভালো। তাকে এহসান করা। তাকে বুঝিয়ে তার মনের কষ্টটা কিছুটা লাঘবের চেষ্টা। কষ্ট যদি নাই পাবে, বা ব্যাপারটা যদি এমনি হবে তাহলে অনুমতি না নেওয়ার অপশন টা আসলো কোত্থেকে! সেটার হিকমাহ বোঝার চেষ্টা করেন। খুশি মনে প্রথম স্ত্রী মেনে নিবে – এটা আশা করা, না মেনে নিতে পারলে, কান্নাকাটি করলে তার ঈমানের পারদ মাপা- কতটা যুক্তি যুক্ত? একটু চিন্তা করার আহ্বান। ভাইদের ধৈর্য অনুশীলনের অনুরোধ রইলো।
বোনদের বলছি, সাময়িক কষ্ট হলেও আল্লাহ সহজ করার মালিক ইনশা আল্লাহ। ধৈর্যের থেকে বড় নিয়ামত হলো হিদায়াত। হিদায়াতের পর ধৈর্য্যের কোনো বিকল্প নেই। আল্লাহের জন্য যে ধৈর্য সেটা হলো সর্বোত্তম ইনশা আল্লাহ্। তাই বোনদের বলছি, স্বামী যদি এরকম পদক্ষেপ গ্রহণ করেন আপনি আল্লাহের জন্য মেনে নিন, সহযোগিতা করার চেষ্টা করেন। তবে নিজেকে কোনো ভাবেই ব্যর্থ ভাববেন না। কারন আপনি যদি ব্যর্থ হন তাহলে আল্লাহ্ আপনাকে এই পরীক্ষায় ফেলতেন না। আল্লাহ্ আপনার সম্মানকে উন্নত করতে চান, আপনাকে জান্নাতে উচ্চ অবস্থান দিতে চান ইনশা আল্লাহ্ এর কারণেই হয় তো এই পরীক্ষার জন্য আপনাকে মনোনীত করা হয়েছে। আল্লাহ্ ভালো জানেন।
১১. সুন্দর আচরণ, ধৈর্য ও সহমর্মিতার কোন বিকল্প নেই।
পরিশেষে বলতে চাই, বর্তমান পৃথিবীর যে পরিস্থিতি, সেখানে ছেলেদের অনুপাতে মেয়েদের সংখ্যা দিনদিন বেড়েই চলেছে। আবার বিয়ে না করার প্রবণতাও প্রচুর দেখা যায়। এই পরিস্থিতিতে, সমাজে বিশৃঙ্খলা রোধের লক্ষ্যে, বিয়েকে যেভাবে উৎসাহিত করা উচিত তেমনি যার সামর্থ্য আছে তাকে বহুবিবাহে উৎসাহ প্রদানেও কোন দোষ নাই।
কিন্তু, বিলবোর্ডগুলো নগ্ন মেয়েতে ঠাসা, কর্মক্ষেত্রে নারী, চারিদিকে নারীদের ফিতনা; তাই এসব ফিতনা থেকে বাঁচতে বহুবিবাহ করতেই হবে- এই জাতীয় প্রচারণার বিরুদ্ধে আমার অবস্থান থাকবে আমৃত্যু।
নগ্ন নারী, বিলবোর্ড, ইন্টারনেট সবকিছু ফিতনা- মানলাম; কিন্তু মুসলিম হিসেবে তো চক্ষু অবনমিত থাকার কথা ছিল!! যে লোকের ঐসকল নারীদের দিকে চোখ পড়ে, তার কি ৪ বিয়েতেও ফিতনা কমবে বলে মনে হয়? পতিতালয়ে যারা যায়, তাদের ধরে ধরে বহুবিবাহের পথ দেখিয়ে দিলে কি সমাজে অনাচার কমবে? না কি বাড়বে? ঐলোক গুলো নিশ্চয়ই ন্যায়বিচার কী, অধিকার কী জিনিস তাই জানে না!!
তাই অনুরোধ করছি, যারা এই সকল নোংরা যুক্তি প্রচার করে, তাদের প্রতিহত করুন- কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে ইনশাআল্লাহ।
আল্লাহর দ্বীনকে তার আপন সৌন্দর্যে প্রচার করুন ইনশাআল্লাহ।
سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَبِحَمْدِكَ أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتُوبُ إِلَيْكَ
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।