এক দুপুরে জেদ্দায় পৌঁছে শুনলাম যথারীতি আমাদের প্লেন লেট! বাংলাদেশ বিমানের এই এক সমস্যা। টাইম টেবিলের কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। বিমানের অবস্থা দেখলে “নয়টার ট্রেন কয়টায় ছাড়ে” বাগধারাটি পরিবর্তিত করে “নয়টার প্লেন কয়টায় ছাড়ে” বলতে ইচ্ছে করে। হাজ্জে আসার আগে আমার কাছ থেকে কোনো পরামর্শ চাওয়া হলে আমি সবার আগে বলবো একান্ত বাধ্য না হলে যেন বিমানের টিকেট দেবে, এমন হাজ্জ প্যাকেজ কেউ না নেয়। কারণ পুরো হাজ্জে যতটুকু কষ্ট হয়, তার চেয়ে বেশি কষ্ট হয় আসা আর যাবার সময় বিমানের ফ্লাইট বিড়ম্বনাতে।
দুটো ব্যাপার চিন্তা করে মনকে শান্তি দেওয়া যায়। হাজ্জের পুরো সময়টা যেহেতু ইবাদাত তুল্য এবং মুমিনের প্রতিটি কষ্টের জন্য তার পাপ মোচন করা হয়, সেহেতু আশা করা যায় হাজ্জ যাত্রায় আমাদের সবাইকে আল্লাহ্ মুমিন হিসেবে গ্রহণ করবেন এবং সকল ভোগান্তির জন্য আমাদের কিছুটা হলেও গুনাহ মাফ করে দেবেন।
ইমিগ্রেশনের গেট খুঁজে না পাওয়া, নানা রকম লাইনে দাঁড়ানো সহ সারাদিনে অনাকাঙ্ক্ষিত নানা রকমের ঝামেলা পার করে যখন ভেতর প্রবেশ করলাম, তখন সন্ধ্যা বেলা। সৌদি সরকারের তরফ থেকে প্রত্যেক হাজীকে ইমিগ্রেশনে প্রবেশ করার সময় সুন্দর গাঢ় নীল মলাটে বাঁধানো একটি করে কুরআন মাজীদ উপহার দেওয়া হলো। জেদ্দায় হাজ্জের জন্য এয়ারপোর্টের নির্দিষ্ট করে দেওয়া অংশে শুরু হলো অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য আমদের নতুন প্রতীক্ষা। কারণ প্লেন আদৌ কখন আসবে, তা কেউ বলতে পারছিলো না।
দুই রাত গভীর হয়ে গেছে। সবাই লাউঞ্জে বসে আছি। চেয়ারের অপ্রতুলতার জন্য বিমানবন্দরেও চাদর বিছিয়ে মাটিতে বসে থাকতে হচ্ছে। অনেকেরই দুপুররে পর ভারী কিছু খাওয়া হয়নি। সবাই ক্ষুধায় অস্থির হয়ে গেছে। কোনো এক রহস্যময় কারণে সব খাবার দোকানগুলো রাত হওয়ার পর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অথচ বিমানবন্দরে চব্বিশ ঘণ্টা সব দোকান খোলা থাকার কথা! আমাদের বিয়াল্লিশ দিনের লম্বা সফরের সমাপ্তির সময়ে সবার ধৈর্যচ্যুতির সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে, কখন প্লেন আসবে, দেশের মাটিতে পা দেবো।
সবাই যখন ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে, তখন আমাদের খাবার দেওয়া হলো এবং প্রায় একই সময়ে জানানো হলো প্লেন চলে এসেছে। তখন ঘড়ির কাঁটা বারোটার কাছাকাছি!! প্লেন আসার খবর শুনে আনন্দে সবার ক্ষুধা পালিয়ে গেলো। কে কার আগে প্লেনে উঠবে, তা নিয়ে হুড়াহুড়ি পড়ে গেলো। ভাবখানা এমন, যে আগে উঠবে সে আগে পৌঁছে যাবে!!
আসার সময় আমাদের পুরানা আমলের এমন এক প্লেন দিয়েছিলো বিমান, যে প্লেন পৃথিবীর অন্যান্য দেশে পরিত্যক্ত ঘোষণা হওয়ায় আর ব্যবহৃত হয় না। কিন্তু এবার আর এমন হলো না। হাজ্জ যাত্রীদের আনা নেয়ার জন্য বিদেশি এক এয়ারলাইন থেকে বিশাল এক দোতালা এয়ার বাস ভাড়া করেছে বিমান। ছোট গাড়িতে করে দলে দলে সবাইকে প্লেনের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো।
মহিলাদের আগে গাড়িতে উঠিয়ে দেওয়া হলো। কিংবা মহিলাদের ধৈর্য কম ছিলো, তারা আগেই গাড়িতে উঠে পড়লো। এক মহিলা এত দিন নিজের দেশে রেখে আসা শিশু সন্তানকে ফেলে থাকার ফলে তাকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে গেছেন। প্লেন এসেছে এই খবর শুনে তিনি দুই হাত দুই দিকে ছড়িয়ে এমন দৌড় দিলেন গাড়ির দিকে, যেন এ গাড়িতে করেই তিনি তাঁর ছেলের কাছে পৌঁছে যাবেন। হায়রে মায়েদের ভালোবাসা, সন্তান ছাড়া তাদের মাথায় আর কিছুই থাকে না।
সাফির আমাকে বলে রাখলো, ভালো দেখে সিট দখল করে যেন বসে থাকি। বেচারা বুঝতে পারেনি ওর কাছে ভালো আসনের সংজ্ঞা আর আমার কাছে ভালো আসনের সংজ্ঞা আলাদা আলাদা হতে পারে। আমি সামনের দিকে ভিড় দেখে প্লেনের অনেক ভিতরের দিকের একটা কোনায় গিয়ে চুপ করে বসে রইলাম। আমার আরো আধা ঘণ্টা পর সাফির এসে মহা বিরক্ত হয়ে গেলো। এই চিপার মধ্যে আমি কী ভালো পেয়েছি, তা তার মাথায় ঢুকলো না। সে ভেবেছে আমি সামনের দিকে সুন্দর মতো কোনো সিট বেছে রাখবো।
তিন স্থানীয় সময় বেলা সাড়ে এগারোটার দিকে প্লেন বাংলাদেশে অবতরণ করলো। গতকাল পৌঁছানোর কথা ছিলো, আর আমরা আজ এসে পৌঁছলাম। আল্লাহ্ সহিসালামতে দেশে নিয়ে এসেছেন, এটাই বড় কথা। লাগেজের সাথে দশ লিটারের দুই জার জমজমের পানি নিলাম। পরে শুনেছি জমজমের পানি নিয়ে অনেক হৈ হট্টগোল হয়েছে। অনেকে পেয়েছে, আবার অনেকে পায়নি।
সবার আত্মীয়স্বজন বাইরে উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করছে, যার যার হাজ্জ ফেরত আত্মীয়দের বরণ করে নেবার জন্য। কেউ হাজ্জ করে ফেরত আসলে তার প্রতি সবার আবেগের মাত্রা ভিন্ন রকমের থাকে। আল্লাহ্র ঘরের মেহমানদের ফিরে পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে যান অনেকে। হাজ্জে যাবার সময় কান্নাকাটির মাঝে বিদায় পর্ব হয়, আবার দেশে আসার পর অনেকের আরেক দফা কান্নার পালা শুরু হয়। তবে এবারের অশ্রু হয় আনন্দের। বাইরে বের হয়ে দেখি আমার শ্বশুর শাশুড়ি উদগ্রীব হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আমাদের রিসিভ করার জন্য।
ঘরে ফিরে এসে নিজের বিছানায় শুয়ে খুব আশ্চর্য অনুভূতি হলো। নিজেদের জীবনকে খুব প্রাচুর্যপূর্ণ মনে হলো হঠাৎ। নিজের ব্যক্তিগত কামরা, আলাদা বাথরুম যেসব আমি এতদিন taken for granted হিসেবে নিয়েছি, আজ তার সব কিছুকেই বিশেষ দৃষ্টিতে দেখতে লাগলাম। আমাদের জীবন যে এতটা রহমতে পরিপূর্ণ ও আরামদায়ক, তা কি আগে কখনো উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম?
হাজ্জে যাবার আগের দিনের মতো আজও বিকেল থেকে শুরু হলো আত্মীয়দের ঢল, সবাই দেখতে আসছে আমাদের। সবার ভালোবাসার প্লাবনে প্লাবিত হতে থাকলাম। শুধু নিজেকে এসবের মাঝে বড় বেখাপ্পা লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো, কোথায় যেন এক সুর কেটে গেছে। কিছুতেই সবার আনন্দের সাথে নিজেকে মিশিয়ে দিতে পারছিলাম না। বিশ্বাস হচ্ছিলো না সত্যি আমি চলে এসেছি আল্লাহ্র ঘর থেকে! না কি সত্যি কখনো ছিলাম ধরণীর বুকের পবিত্রতম স্থানে! সবার মাঝে থেকেও মনে হচ্ছিলো, আমি সবার মাঝে নেই।
কেমন এক অন্যরকম কষ্টে থেকে থেকে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠছিলো। ভালোবাসার মানুষদের এত দিন পর ফিরে পেয়েও আমার কোনো ভাবান্তর ঘটছিলো না। হৃদয়ের অবিরত রক্তক্ষরণে নিজের সমগ্র অস্তিত্ব যেন কেঁপে কেঁপে উঠছিলো। বাইতুল্লাহ হতে বিচ্ছেদের বেদনা এতটা সুতীব্র হবে, তা কখনো কল্পনা করতে পারিনি। সশরীরে দেশে চলে এলেও আত্মার একটি অংশ যেন ফেলে এসেছিলাম সম্মানিত গৃহ, কাবার সামনে। পরম করুণাময় রাব্বুল ‘আলামীনের প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই তাঁর ইবাদাতের সুপ্রাচীন এই গৃহে আমাদের হাজ্জ করার রহমত ও তৌফিক দেয়ার জন্য।
পুনশ্চ: হাজ্জ করেছি বেশ কয়েক বছর হয়ে গেছে। টিভিতে মক্কা চ্যানেল দেখলে আশ্চর্য হয়ে ভাবি, একদিন আমিও ছিলাম এই রহমতপূর্ণ স্থানে!! প্রতিবছর যখন হাজ্জের মৌসুম এগিয়ে আসে, তখন সমগ্র অস্তিত্ব জুড়ে এক অদ্ভুত উন্মাদনা শুরু হয়। কেবলই ইচ্ছে হয় ছুটে গিয়ে হাজীদের ভিড়ে নিজেকে বিলীন করে দিতে! আইয়ামে তাশরিকের দিনগুলোতে মনে হতে থাকে, অমুক দিন আমরা মুযদালিফায় ছিলাম, তমুক দিন আমরা মীনাতে ছিলাম।
আল্লাহ্ আযযা ওয়া জাল্লা পবিত্র এই নগরীকে কী অদ্ভুত এক ভালোবাসার আকর্ষণে আবৃত করে রেখেছেন, তা হাজ্জে না গেলে কখনোই অনুভব করতে পারতাম না। এখন বুঝতে পারি, কেন লোকে একবার এই ভালো লাগার স্বাদ পেলে বারবার সেখানে ফিরে যাবার জন্য অস্থির হয়ে থাকে!
আল্লাহ্ যেন সবাইকে তাঁর গৃহে পুনঃ পুনঃ হাজ্জ ও উমরাহ্ করার তৌফীক দেন। আমীন।
পরিশিষ্ট:
হাজ্জের সময় দৈনন্দিন অভ্যস্ত জীবনের বাইরে অপরিচিত এক জীবন কাটাতে হয়। ভিন্ন পরিবেশে খাপ খাওয়াতে হয়, শারীরিক কিছুটা পরিশ্রমও যুক্ত হয় এ সবকিছুর সাথে। হাজ্জের বর্ণনা শুনলে অনেকের মনে হবে, না জানি কত কষ্ট হয় সেখানে!! কিন্তু যে ব্যক্তি সশরীরে এই পুণ্যময় সফরে গিয়েছেন, শুধু তিনিই বলতে পারবেন আল্লাহ্ যাবতীয় কর্মকাণ্ড কত সহজ করে দেন সবার জন্য। এবং প্রতিটি পরিশ্রমের সাথে কী তীব্র পরিতৃপ্তি ও ভালোলাগা মিশে থাকে।
হাজ্জের সকল কাজ যখন শেষ হয়, আল্লাহ্ অপার্থিব এক স্বস্তিতে হৃদয় কানায় কানায় পূর্ণ করে দেন। সূরাহ ইনশিরাহতে আল্লাহ্ পর পর দুটো আয়াতে উল্লেখ করেছেন,
নিশ্চয় কষ্টের সাথে স্বস্তি রয়েছে।
হাজ্জের সময় আমি প্রকৃত অর্থে অনুধাবন করতে পেরেছি এই আয়াতের মর্মার্থ। বিগত দিনগুলোতে আমাদের সবাইকে তিনি তাঁর বিশেষ নেয়ামতের যে স্বাদ ও যে অনাবিল প্রশান্তি অনুভব করার সুযোগ দিয়েছেন, সেগুলো যেন তিনি আমাদের আমৃত্যু মনে রাখার ও সেই অনুযায়ী জীবনযাপন করার তৌফীক দেন।
হাজ্জ থেকে আসার পর অনেকদিন সবার অন্তর খুব নরম থাকে। পৃথিবীর যেসব পাপ-পঙ্কিলতাকে এতদিন স্বাভাবিক মনে হতো, সে সবকিছুই রাতারাতি চরম অস্বাভাবিক বোধ হয়। যেমন টেলিভিশন পর্দার সাধারণ ভদ্র কোনো অনুষ্ঠানের দিকেও চোখ উঠতে চায় না। নিজের অজান্তে চোখ মাটির দিকে নেমে যায়। দুনিয়ার প্রতি মোহ কোথায় যেন গায়েব হয়ে যায়। হঠাৎ করে ভালো মানুষ হয়ে যাওয়াটা অনেক সহজ মনে হয়।
কিন্তু শয়তান বড় ধুরন্ধর। সে ধীরে ধীরে আমাদের পুরনো জীবনে ফিরিয়ে নেবার যাবতীয় প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে, যেন আমরা আবার গা ভাসিয়ে দেই কলুষিত সমাজের গড্ডালিকা প্রবাহে। আল্লাহ্ আমাদের পাপ মুক্তির এবং নতুন করে নবজাতকের মতো নিষ্পাপ হিসেবে জীবন শুরু করার বিশাল এক সুযোগ দেন হাজ্জের মাধ্যমে। তাই ফিরে এসে সচেষ্ট থাকা উচিৎ নিজের জীবনকে ইসলামের দিকে ধাবিত করার, হাজ্জের অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধিগুলো মনে রেখে সেই অনুযায়ী মানুষের সাথে ব্যবহার করার।
হাজ্জে যখন ইহরামরত থাকি, তখন ঝগড়া- বিবাদ, হিংসা-বিদ্বেষ ও বিবিধ পাপ হতে দূরে থাকার ব্যাপারে আমরা সদা সতর্ক থাকি। আমরা তখন নিজেদের খারাপ রিপুকে দমন করে, বিনম্র হয়ে সর্বশক্তিমান অসীম দয়ালু পালনকর্তার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সব নিয়ম কানুন শক্ত ভাবে মানার চেষ্টা করি। তখন নিজের অজান্তেই আমরা আমাদের নিজেদের কাছেই প্রমাণ করে ফেলি যে, আমাদের ভেতরেও ভালো হবার সম্ভাবনা আছে! আমরাও পারি পাঁচ ওয়াক্ত সালাত মাসজিদে গিয়ে পড়তে, কেউ কষ্ট দিলেও হাসি মুখে তার সাথে কথা বলতে, নিজের কাছে জোরালো যুক্তি থাকলেও চিৎকার- চ্যাঁচামেচি, বিবাদ-বিসম্বাদ হতে দূরে থাকতে! তখন জলবৎ তরলং হয়ে প্রমাণ হয়ে যায়, “আমরা পারি না/পারবো না” কথাটি কত বড় মিথ্যে আর শয়তানের প্রতারণা ছাড়া কিছুই নয়।
ঈমানের স্তর সব সময় এক থাকে না, ওঠা নামা করে। সমগ্র জীবনে হয়তো কখনোই আমরা পরিপূর্ণ ভালো মানুষ হতে পারবো না। কিন্তু এই আখিরাতের শস্য ক্ষেত্রে যত দিন আয়ু আছে, তত দিন আল্লাহ্ চাইলে চেষ্টা তো করতে পারবো সত্যিকারের মুসলিম হবার। পরম করুণাময় আমাদের একান্ত অন্তঃকরণের চেষ্টাগুলোই দেখবেন। পা হড়কে নিচের দিকে নেমে গেলে আল্লাহ্ যেন আমাদের পুনরোদ্যমে উঠে দাঁড়াবার শক্তি দেন। আল্লাহ্ যেন সবাইকে পূর্ণ ঈমানের সাথে প্রকৃত মুসলিমের মৃত্যু দেন। আমীন।
[সমাপ্ত]
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।