ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান হলো হিসবাহ। অর্থাৎ, ভালো কাজের আদেশ ও মন্দ কাজের নিষেধ (আল-আমর বিল মা’রুফ ওয়াল নাহি ‘আনিল মুনকার)। হিসবাহ করার এই কাজটিকে বলে ইহতিসাব। আর যিনি এই দায়িত্ব পালন করেন, তাঁকে বলা হয় মুহতাসিব। সেক্যুলার ধর্মের একটি বহুল পঠিত মন্ত্র হলো, “অন্যের ক্ষতি না করে যার যা ইচ্ছা, তা-ই করার অধিকার রয়েছে। অন্য কেউ এতে বাধা দিতে পারবে না।” বংশপরিচয়ে মুসলিম হয়েও কার্যত সেক্যুলার ধর্মের কর্তৃত্ব মেনে নেওয়ায় আমাদের মাঝ থেকে হিসবাহ ও ইহতিসাবের ধারণাগুলো হারিয়ে গেছে। মৃত্যু হয়েছে মুহতাসিবের।

অনেকে ভাবে যে, ইসলামে হিসবাহ’র দায়িত্ব পালন করার অধিকার ও ক্ষমতা শুধু রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষেরই আছে। আমরা যেহেতু ইসলামী রাষ্ট্রে নেই, তাহলে হিসবাহ’রও কোনো প্রয়োজন নেই। অথচ মুহতাসিব মাত্রই রাষ্ট্রের অনুমোদিত প্রতিনিধি হতে হবে, এমন মতকে বহু প্রসিদ্ধ আলিম যথাযথভাবে খণ্ডন করেছেন। যেমন- ইবনে তাইমিয়্যা, আল গাযালী, আন-নববী (রাহিমাহুমুল্লাহ)।

IIRT Arabic Intensive

তবে তার চেয়ে বড় কথা হলো, আধুনিক জাতি-রাষ্ট্র উত্থানের পূর্বেকার ইসলামী সমাজগুলোর মৌলিক প্রকৃতির সাথেও এই মত অসামঞ্জস্যপূর্ণ। আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রগুলোতে নৈতিকতা নির্ধারণ ও প্রয়োগের অধিকার থাকে শুধুই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে। এসব কেন্দ্রীভূত আমলাতন্ত্রী রাষ্ট্রগুলোর নজরদারী ও পুলিশ ব্যবস্থা অনেক শক্তিশালী। কিন্তু এ ধরনের রাষ্ট্রের উত্থানের আগে নৈতিকতা কায়েম করার দায়িত্ব বিভিন্ন শ্রেণীর হাতে ভাগ করে দেওয়া ছিলো। যেমন- আলিম সমাজ, তাঁদের শিক্ষার্থী, গোত্রীয় নেতা, সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ, এমনকি সমাজ নিজেও।

এ সকল ব্যক্তিবর্গ এবং ক্ষেত্রবিশেষে পুরো সমাজটাই সক্রিয়ভাবে ভালো কাজের আদেশ এবং মন্দ কাজের নিষেধের দায়িত্ব পালন করতো। অর্থাৎ, ইসলামী রাষ্ট্র যখন ছিলো, তখনও রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ ছাড়াও অন্য অনেক শ্রেণী হিসবাহ’র দায়িত্ব পালন করতো। “আল-মা’রুফ” কথাটির আক্ষরিক অর্থ “সাধারণভাবে পরিচিত”। এ থেকেই বোঝা যায় যে, ইসলামী সম্প্রদায়ের সকলকেই ত্বাত্ত্বিকভাবে জানতে হবে ভালো কী এবং মন্দ কী। নিজেও যেমন তা মেনে চলতে হবে, তেমনি নিজস্ব ক্ষমতাগত পরিধিতে তা অধীনস্থদের উপর প্রয়োগও করতে হবে। এসব ক্ষেত্রে ইজতিহাদ করে বের করা লাগবে না কোনটা ভালো, আর কোনটা মন্দ। ইমাম আল-গাযালি স্পষ্ট করে বলেই দিয়েছেন যে, ইজতিহাদ করা মুহতাসিবের দায়িত্ব না। কারণ যেসব ভালো-মন্দ ইজতিহাদ করে বুঝতে হয়, তা সাধারণ মানুষ বুঝবেও না, তাদের সে দায়িত্বও নেই। এটি কেবলই আলিম সমাজের দায়িত্ব।

পক্ষান্তরে, একটি কেন্দ্রীভূত সরকারের পক্ষ থেকে শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ কিংবা প্রতিনিধিরাই ইসলামিক আদর্শ কায়েম করতে পারবে – এ ধারণা ইসলামী ইতিহাসে কখনোই ছিলো না। আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রগুলোতে কেন্দ্রীভূত আমলাতন্ত্রী প্রতিষ্ঠানগুলো আইন প্রণয়ন করে এবং পুলিশ এবং বিচারিক প্রতিষ্ঠানগুলি তা প্রয়োগ করে। কিন্তু আধুনিক এসব রাষ্ট্র গঠনগত ও কাঠামোগত দিক থেকে হুবহু প্রাক-আধুনিক রাষ্ট্রগুলোর মতোই – এমনটা ভাবা একেবারেই ভুল।

তাহলে আজকের যুগে মুহতাসিব হওয়া বলতে কী বোঝায়?

যেখানে বৈধ কোনো ইসলামী রাষ্ট্র নেই, সেখানে কোনো ইহতিসাব থাকবে না – এমন দাবি করাটা ইসলামী শাস্ত্রের মৌলিক জ্ঞানের অভাবেরই পরিচায়ক।

যেমন এই হাদীসটির কথাই ধরুন:

“সতর্ক হও, তোমাদের প্রত্যেকেই একজন রাখাল (দায়িত্বপ্রাপ্ত, দেখাশোনাকারী) এবং তোমাদের প্রত্যেককেই তোমাদের পালের ব্যাপারে (আল্লাহ্‌র কাছে) জবাবদিহি করতে হবে। আমির (নেতা) হচ্ছে জনগণের রাখাল এবং তাকে তাদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হবে। একজন পুরুষ তার পরিবারের জন্যে রাখাল এবং তাকে সেই ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হবে। একজন নারী তার স্বামীর সংসার এবং সন্তানদের জন্যে রাখাল এবং তাকে তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। একজন দাস তার মালিকের সম্পত্তির উপর রাখাল এবং তাকে সেই ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হবে। সতর্ক হও, তোমাদের প্রত্যেকেই একেকজন রাখাল এবং তোমাদের প্রত্যেকেই তোমাদের দায়িত্বের হিসাব দিতে হবে। ”

ইমাম মুসলিম, ইমাম আবু দাউদ ও অন্য সকলেই (রাহিমাহুমুল্লাহ) এই হাদীসটিকে কিতাবুল ইমারাহ-তে (রাষ্ট্রীয় বিষয় সংক্রান্ত অধ্যায়) অন্তর্ভুক্ত করেছেন এবং এর যথেষ্ট কারণও রয়েছে।

এর ব্যাখ্যা হলো যে, একজন স্বামী তার পরিবারকে ভালো কাজের আদেশ করবে এবং খারাপ কাজের নিষেধ করবে। সেই হিসেবে, সে একজন আল-মুহতাসিব। একইভাবে পরিবারের মাতাও। একইভাবে দাসটিও। রাসূলুল্লাহ ﷺ এই সকল ভূমিকা এবং একজন আমিরের ভূমিকা একই সাথে উল্লেখ করার মাধ্যমে এদের মাঝে সাদৃশ্য দেখিয়েছেন।

এখন কে বলবে যে পিতা তাঁর পরিবারে ভালো কাজের আদেশ ও মন্দ কাজের নিষেধ করার জন্য দায়ী নন? এতটুকু কর্তৃত্ব আর ক্ষমতাই যদি তাঁর না থাকে, তাহলে কী করে তিনি তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের ওয়ালি (অভিভাবক) হবেন? ইহতিসাবের ক্ষমতাবিহীন একজন বাবা আর হোস্টেলের একজন রুমমেটের মধ্যে তাহলে পার্থক্য কী? (অবশ্য আধুনিকতাবাদী ও নারীবাদীরা এরকমের পিতৃত্বই কামনা করে, যেখানে পিতা হবে একজন হীনবীর্য এবং অক্ষম পুরুষ।)

কে বলবে যে মা তাঁর সন্তানদের ভালো কাজের আদেশ ও মন্দ কাজের নিষেধ করার জন্য দায়ী নন? সন্তানদের নিয়মানুবর্তী করা এবং তাদেরকে ভালো কাজের আদেশ ও খারাপ কাজ থেকে দূরে থাকার কথা বলা কি তাঁর অধিকার ও কর্তব্য নয়? এমন ক্ষমতা ছাড়া একজন মা একজন গৃহপরিচারিকা ছাড়া কিছুই নন। (আবারো বলতে হয়, এরকমের মাতৃত্বই আধুনিকতাবাদী এবং নারীবাদীরা কামনা করে। তারা চায় একজন অথর্ব মা, যে তার কর্মক্ষমতা এবং শক্তিকে কেবলই তার ক্যারিয়ার এবং কর্পোরেট স্বার্থের জন্য সংরক্ষণ করে।)

তাহলে কি মুহতাসিব হবার মানেই হচ্ছে একজন কর্কশ অত্যাচারী হওয়া? না, অবশ্যই না। একজন জ্ঞানী শিক্ষক যেমন জানেন যে কখন কঠোর হতে হবে এবং কখন সদয় হতে হবে, একজন মুহতাসিবও তেমনি প্রজ্ঞা ও যত্ন সহকারে কাজ করেন। তবুও, তিনি কিন্তু তাঁর কর্তৃত্ব ও গণ্ডির ভেতর একজন আইন প্রয়োগকারী। এবং এই প্রয়োগের কাজটি বিভিন্ন উপায়ে করা যেতে পারে। বিখ্যাত একটি হাদীসে বলা হয়েছে অন্যায়কে হাত (কাজ), জিহ্বা (কথা) ও অন্তর দিয়ে প্রতিরোধ করতে। একইভাবে, মুহতাসিবও সঠিক ফলাফলটি বের করে আনবার জন্যে বিভিন্ন উপায় অনুসরণ করতে পারেন। এমনকি জোরও করতে পারেন (ওহ হো, “জোর করা” কথাটা বলে উদারপন্থীদের ক্ষেপিয়ে দিলাম না তো?)। এবং এই সবই তাঁর ইসলামী কর্তব্য।

এই আলোচনায় উত্থাপিত আরেকটি সাধারণ আপত্তি: কর্তৃপক্ষ (বাবা, মা, শিক্ষক ইত্যাদি) কি তার ক্ষমতার অপব্যবহার করতে পারে না? হ্যাঁ, অবশ্যই পারে। কিন্তু তাই বলে তো বাবা-মা এবং শিক্ষকদের নিজ নিজ ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার কেড়ে নেওয়া সম্ভব না। এমনকি জাতি-রাষ্ট্রের পুলিশ কর্তৃপক্ষ এবং আইন প্রণেতারা প্রায়ই তাদের ক্ষমতাকে অপব্যবহার করে এবং অন্যায় আচরণ করে। কেউই দাবি করে না যে, পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিলুপ্ত করা উচিত অথবা তাদের কর্তৃত্ব থেকে তাদের সরিয়ে ফেলা উচিত!

আবারও বলছি। হিসবাহ’র যেসব শর্তাবলি ও নীতিমালা রয়েছে, সেগুলো মোটেও অস্বীকার করা হচ্ছে না। এসকল শর্তাবলির কিছু হচ্ছে সাধারণ জ্ঞান। যেমন, যেখানে তার কোনো কর্তৃত্ব নেই, সেখানে সে ইহতিসাব করতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ, রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলা একজন সাধারণ মুসলিম হঠাৎ করে একটি মুদি দোকানে ঢুকেই মদের বোতল ভাঙা শুরু করতে পারেন না। কিন্তু এতে এই বাস্তবতা পরিবর্তিত হয়ে যায় না যে, সেই মুসলিমকে তাঁর নিজের প্রভাব ও প্রতিপত্তির অঞ্চলে ঠিকই মুহতাসিব হিসেবে কাজ করতে হবে। আর সেসময়ও তাঁকে প্রজ্ঞা ও সহনশীলতার সাথে কাজ করতে হবে।

বর্তমান বিশ্বের অনেক সমস্যার একটি স্বতন্ত্র উৎস হলো এই ইহতিসাবের অভাব। এটিকে পুনরুজ্জীবিত করতে হলে আমাদের সবাইকেই এই লক্ষ্যে নিজ নিজ দায়িত্ব পূর্ণ করতে হবে।


উৎস: দ্য মুসলিম স্কেপ্টিক (মূল আর্টিকেল লিংক)

অনুবাদক: মোহাম্মদ আল-মাহী ইবনে আতিক, মুসলিম মিডিয়া প্রতিনিধি

অনুবাদ কপিরাইট © মুসলিম মিডিয়া

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive