উপলব্ধির সময়

হাজ্জ হলো এমন এক সফর, যেখানে আমরা প্রতি মুহূর্তে আল্লাহ্‌র নিকট আত্মসমর্পণ করার ও বিনয়ী হবার শিক্ষা পাই। নম্র এখানে হতেই হবে, তা না হলে হাজ্জ কীসের? হাজ্জে ধনী, গরীব, সাদা, কালো নির্বিশেষে লাখ লাখ মানুষ একত্রিত হয়, এক নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে, আল্লাহ্‌র বিধান মানার জন্য। হাশরের ময়দানে যেমন সব মানুষ এক কাতারে দাঁড়াবে, কারো কোন অর্থ-সম্পদ সেই দিন কোনো কাজে আসবে না, ঠিক তেমনি এখানে কোনো বিত্তবান মানুষ যত অর্থই ব্যয় করুক না কেন, তাকে কিছু না কিছু কষ্ট অবশ্যই ভোগ করতে হবে এবং সর্ব অবস্থায় সহিষ্ণুতার পরিচয় দিতে হবে। হাজ্জ যাত্রায় পদে পদে ধৈর্যের যে কত রকম পরীক্ষা দিতে হয়, তার ইয়ত্তা নেই!

স্বদেশে যার ঘরে খাবারের অভাব নেই, যে কখনো ক্ষুধার অনুভূতির সাথে পরিচিত নয়, দেখা যায় তাকেও এখানে এসে খাবারের কষ্ট করতে। দীর্ঘ সময়ের জন্য হারাম শরীফের মসজিদে গেলে ক্ষুধা লাগলেই দোকানে যাওয়া বা খাবার কেনা সম্ভব না। এমনকি সাথে প্রচুর পয়সা থাকলেও না। এই বিশাল মসজিদের বাইরে গিয়ে খাবার আনতে গেলে জামাত ছুটে যাবার সম্ভাবনা অনস্বীকার্য। এছাড়াও নিজের দখলকৃত আরামদায়ক বসার জায়গা হারানোর সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেবার মত নয়।

IIRT Arabic Intensive

এখানে ওয়াক্তের ঘণ্টাখানেক আগে থেকে সালাতের জায়গা দখল করে বসে থাকতে হয়। হাজ্জের সময়, বিশেষত জুমার দিন সকাল ৮ টার মাঝে মসজিদে চলে না গেলে তিল ধারণের স্থান পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে। তখন হয়তো হারাম শরীফ থেকে ১ কি.মি. দূরে প্রখর রোদের নিচে উত্তপ্ত পিচ ঢালা রাস্তার উপর সালাত আদায় করতে হয়। হাজ্জের মৌসুমে এমনও রেকর্ড আছে যে, জুমার জামাত প্রায় ১ কি.মি. পর্যন্ত লম্বা হয়েছে!!

অনেক সময় দেখা যায় পেটে ছুঁচো বুকডন দিচ্ছে, সাথে কোনো খাবার নেই আর আশেপাশে অনেকে নিজেদের ব্যাগ থেকে খাবার বের করে পেট পুরে খাচ্ছে। তখন আশা করি ধনীগণ উপলব্ধি করতে পারে যে, গরীব অথবা গৃহ ভৃত্যদের সামনে তাদেরকে না দিয়ে ভালো খাবার খেলে ওদের অনুভূতি কেমন হয়। নিশ্চয় সে সময় সবাই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, দেশে ফিরে এসে আর কখনো এমন করবে না। কিন্তু এই প্রতিজ্ঞা কয়জন স্মরণে রাখতে পারে আল্লাহ্‌ই জানেন।

খাবারের ব্যাপারে আমার এবং আমার রুমমেট রওশন আপার অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ বিপরীত। উনাকে প্রায় সময় দেখা যায় হাত ভরে খাবার নিয়ে মসজিদ থেকে ঘরে ফিরতে। হারাম শরীফে প্রতি সোম এবং বৃহস্পতিবার মাগরিবের সময় মুসল্লীদের সামনে চাদর বিছিয়ে হাজার হাজার খেজুর স্তূপাকৃতিতে ঢেলে দেওয়া হয় ইফতারির নিমিত্তে। সেখান থেকে যত খুশি খাওয়া যায় আবার ব্যাগ ভরে নেওয়াও যায়। সোম ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখা সুন্নাত হওয়াতে অনেকে এই দুদিন রোজা রাখেন। অনেক সময় দেখা যায়, লোকজন ঘর থেকে নিজেদের সামর্থ্য মতো খাবার নিয়ে এসে আল্লাহ্‌র ঘরের মেহমানদের খাওয়াচ্ছেন। কেউবা আনেন খেজুর আবার কেউ আনেন চা, রুটি অথবা অন্য কোনো স্ন্যাক্স। আল্লাহ্‌র মেহমানদের অল্প কিছু খাওয়ানোর সৌভাগ্যও কেউ হাত ছাড়া করতে চান না। খাবার দিয়ে আপ্যায়িত না করতে পারলে অন্য কিছু নিয়ে আসেন।

একদিন তওয়াফের সময় দেখলাম, এক ভদ্রলোক আতরের বোতল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। যারা তওয়াফ করতে যাচ্ছে, তাদের হাতে অল্প করে আতর ছুঁইয়ে দিচ্ছেন (অবশ্যই পুরুষদের হাতে, যেহেতু উনি নিজে একজন পুরুষ মানুষ)। সে কী অপূর্ব মোহনীয় সুবাস ছিলো সেই আতরের!! আল্লাহ্‌র ঘরের পাশে যেন সবাই সুগন্ধি দেহে যেতে পারে, তার জন্য কী অপূর্ব প্রয়াস! কত সুন্দর এক সাদাকা! কত অল্প কিছু দিয়েও, সৎ নিয়ত থাকলে সাদাকা করা যায়, মানুষের মনে আনন্দ দেওয়া যায়, সর্বোপরি সওয়াব অর্জন করা যায়, তার প্রমাণ এই ভদ্রলোক। এছাড়া পানির বোতল নিয়েও লোকে দাঁড়িয়ে থাকে বিভিন্ন জায়গায়। হুজ্জাজদের জন্য কিছু করতে পারলে কৃতার্থ হয়ে যায় সকলে।

রওশন আপার গল্পে আবার ফেরত আসি। বেশিরভাগ সময় দেখা যায় এ ধরণের খাবার বিতরণ উনার সম্মুখে হয় আর আমি কীভাবে যেন এসবের সময় অন্য কোথাও থাকি। যেমন যখন দোতালায় খাবার দিচ্ছে, আমি তখন নিচতলায় থাকবো। অথবা নিচতলায় যখন খাবার দিচ্ছে, আমি তখন উপর তলায়! আর রওশন আপা থাকেন সর্বদা সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায়!! একদিন দেখি উনি বাক্স ভরে খেজুর নিয়ে এসেছেন। সে খেজুর নিজে খেয়ে আমাদের খাইয়ে ঘোষণা দিলেন বাকিগুলো দেশে নিয়ে যাবেন। মুফতে পেতে পেতে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে, উনাকে দেশে নেবার জন্য পয়সা খরচ করে বেশি খেজুর কিনতে হবে না। এগুলো ফ্রিজে রেখে রেখে জমালেই হবে। আর আমার ক্ষেত্রে হয় উল্টো ঘটনা।

উদাহারণস্বরুপ বলা যায়, একবার কোনো এক সহৃদয় ব্যক্তি ঘর থেকে ব্যাগ ভরে খাবার নিয়ে এসেছেন। জামাতের কাতারের পিছন থেকে খাবার দেওয়া শুরু করেছেন এবং ঠিক আমার নিকটে আসার আগে আগে উনার ব্যাগ খালি হয়ে গেলো। অর্থাৎ, আমি পর্যন্ত আসার সুযোগ তাঁর আর হলো না। অথবা অন্য কোনো এক ব্যক্তি খাবার নিয়ে এসেছেন এবং আমার ঠিক পরের মানুষ থেকে খাবার দেওয়া শুরু করলেন, এক্ষেত্রেও আমি বাদ পড়লাম। কী আশ্চর্য ঘটনা!

আমার ক্ষেত্রে এ ধরণের ঘটনা একাধিকবার ঘটেছে। তবে কখনোই যে কিছু পাই নি, তা নয়। মাঝে মাঝে একটা চকোলেট অথবা অল্প খেজুর, এ ধরণের জিনিসপত্র পেয়েছি। এখন কেউ আবার ভেবে বসবেন না, হাজ্জ করতে যেয়ে এত কাঙালিপনা কেন?

তাহলে বলবো প্রথমত, আশেপাশের সবাই যখন কোনো কিছু পায়, তখন তা নিজেরও পেতে ইচ্ছা করে। দ্বিতীয়ত, এখানে আমরা মুসাফির, পকেটে পয়সা থাকলেও হাতে সবসময় খাবার থাকে না আর ক্ষুধার অনুভূতি সবার জন্যই এক সমান। আমার একদিন এত দুঃখ হলো সে আর বলার নয়, বারবার মনে হচ্ছিলো আমার সাথেই সব সময় এমন কেন হয়!

শেষে আমি চিন্তা করলাম আল্লাহ্‌ এর মাঝেও নিশ্চয় কোনো মেসেজ রেখেছেন। হয়তো আল্লাহ্‌ চাচ্ছেন আমি দাতা হই, গ্রহীতা নয়। কিংবা এটিও একধরণের ধৈর্যের পরীক্ষা, কিংবা অন্য কিছু। তখন এমন কাঙালের মতো চিন্তা ভাবনা কীভাবে করতাম, সে কথা মনে হলে এখন লজ্জায় আরক্ত হয়ে পড়ি। দেশে আসার পর পেছনের দিনগুলোর দিকে তাকালে দেখতে পাই, আমি হাজ্জে গিয়ে যত খাবার আর নানারকমের উপহার পেয়েছি, আমার পরিচিত কেউ এতকিছু হাজ্জে গিয়ে কখনো পেয়েছি কি না জানি না। তাছাড়া বিপদের সময় মানুষের এত ভালোবাসা পেয়েছি, আল্লাহ্‌র কাছে তার শুকরিয়া আদায় করে শেষ করতে পারবো না। আল্লাহ্‌ চাহেন তো এসব গল্প সামনে বলবো।

যে প্রসঙ্গে ছিলাম, সেখানেই থাকি। রওশন আপার খাদ্য ভাগ্যের আরো একটি গল্প বলে খাবার প্রসঙ্গ শেষ করি। একদিন সন্ধ্যায় উনি অতি সুস্বাদু কিমা ভরা রুটি নিয়ে রুমে ফেরত এলেন। আমরা উৎসুক দৃষ্টি নিক্ষেপ করার আগে নিজে থেকেই বলে দিলেন রুটির উৎস! আপা ও তাঁর স্বামী দুজনে হারাম শরীফ থেকে বাসায় ফিরছিলেন। এমন সময় তাঁদের সামনে এক গাড়ি থেমে যায়। গাড়ি থেকে একজন নেমে তাঁদের হাতে মজাদার এই খাবারগুলো দিয়ে আবার গাড়িতে উঠে যায়। এক কথায় উনার রিযিক গাড়িতে করে এসে একেবারে হাতের মাঝে ধরা দিলো!! কী তাজ্জব ঘটনা!

দেশে যাদের আল্লাহ্‌র রহমতে খাবারের অভাব নেই তাঁরাও এখানে যেহেতু মুসাফির, তাই অন্যদের হতে কিছু পেলে কতই না আনন্দ সহকারে এই সাদাকা গ্রহণ করছেন। নিজের দেশে যদি এমন কিছু হতো, তাহলে অনেকেই হয়তো অপমানে অস্থির হয়ে যেতেন আর ভাবতেন, “কী ভয়াবহ কথা! আমাকে কি দেখতে মিসকিন লাগে যে, রাস্তার মাঝে আমাকে খাবার হাতে ধরিয়ে দেবে?” অথবা ভাবতেন, “আমি কি এতই দরিদ্র যে, অচেনা কারো দান করা খাবার গ্রহণ করবো!!” যারা অনেক ভদ্র, তাঁরা হয়তো এসব অহমিকাপূর্ণ চিন্তা করবেন না এভাবে দান-সাদাকা পেলে। তবে পাশের গরীব কোনো মানুষকে দিয়ে দেবেন, তাও নিজে খাবেন না!

স্বদেশে এবং প্রবাসে আমাদের আচরণের এই বৈপরীত্যের হেতু কী? এর মাঝে শিক্ষণীয় কিছু আছে কি আমাদের জন্য? হাজ্জ শুধু কোনো ‘ভ্রমণ’ নয়, বরঞ্চ আত্মিক উন্নতি সাধনের ও উপলব্ধি অর্জনের এক অসামান্য সুযোগ! এসময় আমাদের ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় সকল অহমিকা ত্যাগ করতে হয়। বাইতুল্লাহতে এসে আমরা আত্ম-অহমিকায় ভুগবো, তা কী করে সম্ভব! মক্কায় এসে শুধুমাত্র কিতাবে লেখা কিছু নিয়ম কানুন যন্ত্রের মতো পালন করে দেশে ফেরত যাবো, ব্যাস! হাজ্জ হয়ে গেলো? এতই সহজ! এখানে যদি আত্মোপলবব্ধি না হলো, অহংকার ধূলোয় মিশে না গেলো, আল্লাহ্‌র সামনে সত্যিকারের মাথা নত না হলো, তবে তা আর কেমন হাজ্জ হলো!!

তাহলে এত দূর দেশে এসে মুসাফিরের মতো জীবন যাপন করার দরকার কী ছিলো? নিজের দেশে বসেই এই হাজ্জের অর্থ গরীবদের দান করে ফেললেই হতো। কিন্তু তার দ্বারা দরিদ্রদের কষ্ট, আনন্দ, তৃপ্তি অনুভব করার ‘সৌভাগ্য’ আমাদের হতো না। ‘সৌভাগ্য’ বলছি এ কারণে, যারা এই অনুভূতিগুলো মনে রাখতে পারবেন এবং দেশে ফেরত যাবার পর গরীব-দুঃখী ও মুসাফিরদের প্রতি সঠিক ব্যবহার করতে পারবেন, তাঁরাই হবেন খাঁটি সৌভাগ্যবান। কারণ তখন তিনি অনুভব করতে পারবেন যে, প্রয়োজনের সময় কোনো ব্যক্তিকে কিছু দান করতে পারলে সেই গ্রহীতার মনে কী পরিমাণ আনন্দের উদ্রেক হয়, কী পরিমাণ তৃপ্তিতে তাদের হৃদয় কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠে। হাজ্জের সময় অন্যের কাছ থেকে দান নিয়ে একজন গ্রহীতার দৃষ্টিকোণ বোঝার এবং সেই ভিনদেশী দাতাদের অমায়িক ব্যবহার শেখার সুযোগ আল্লাহ্‌ আমাদের দেন। হাজ্জযাত্রীরা যেহেতু আল্লাহ্‌র অতিথি, তাই তাঁদের কোনো কিছু দিতে পারলে লোকে ধন্য হয়ে যায়। দানশীলদের সৌজন্য বলে দেয়, তাঁদের দেশে আল্লাহ্‌র পাঠানো এই অতিথিদের খেদমত করতে পেরে তাঁরা কতটা ভাগ্যবান বোধ করছেন।

এবার আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটের দিকে নজর দেই। আমাদের দরজার সামনে যারা হাত পাততে আসে, তারাও কি আল্লাহ্‌র পাঠানো নয়? অবশ্যই তারাও আল্লাহ্‌র তরফ থেকে আসে, আর আমাদের কেউ যখন এদের কিছু দান করে, তখন কজনের ব্যবহারে সেই সৌজন্য বা কৃতার্থ ভাব থাকে যতটুকু থাকা উচিত আল্লাহ্‌র পাঠানো মানুষদের প্রতি? আমাদের এমন ভাবখানা হয়, যেন নিজের সম্পত্তি থেকে আমরা দান করে গরীবদের ধন্য করে দিচ্ছি। আমরা ভুলে যাই, কোনো কিছুই আমাদের নয়। এই বিত্ত- বৈভব সবকিছুর আসল মালিক হচ্ছেন বিশ্ব জাহানের প্রতিপালক। তিনি আমাদের সাময়িক এক ‘কালের’ জন্য এই ধন- সম্পদ দিয়েছেন, শুধুমাত্র পরীক্ষা করে দেখার জন্য, আমরা কী করি এসব দিয়ে, কীভাবে খরচ করি অথবা কীভাবে দান করি।

আমি নিজের দিকে তাকালে মরমে মারা যাই, কেন আমরা নিজেদের ব্যবহারকে আরো অধিকতর অমায়িক ও ভদ্র করতে পারি না! কেন আমরাও নিজেদের সেই সৌভাগ্যবানদের অংশ মনে করি না, যাদের আল্লাহ্‌ একে তো দাতার ভূমিকা দিয়েছেন, শুধু তাই না, আল্লাহ্‌ আমাদের কাছে নিজের তরফ থেকে মেহমান পাঠাচ্ছেন, তাদের সাথে কেমন ব্যবহার করি, দেখার জন্য? হাজ্জের এই উপলব্ধি লাভ করার তৌফিক যেন আল্লাহ্‌ আমাদের সবাইকে দেন এবং সারাজীবন যেন তিনি এই বোধ আমাদের অন্তরে সংরক্ষণ করেন। কেন যেন মনে হয়, শুধুমাত্র বড়লোকদের উপর হাজ্জ ফরজ হবার এটিও একটি কারণ, যেন তারা অভাবী, দুঃখীদের কষ্ট অনুধাবন করতে পারে।

এবার অন্য এক উপলব্ধির কথা বলি। আচ্ছা, কোনো মানুষকে যদি বলা হয়, তাকে কোনো কাজের শাস্তিস্বরূপ মাথা ন্যাড়া করে দেওয়া হবে, তখন সেই ব্যক্তির অনুভূতি কেমন হবে? নিশ্চয় সে অপমানে দিকবিদিগ জ্ঞানশূন্য হয়ে, রাগে, আত্মগরিমায় জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে। কিংবা যদি বলা হয় ভরা মজলিসে সকলের সামনে মাথা নিচু করে মাটিতে নাক লাগিয়ে নাকে খত দিতে, তখন কেমন লাগবে? আমাদের অহংবোধ কি তখন এক লাফে পর্বতশৃঙ্গে আসন নেবে? নাকি এমন ঘটনা ঘটলে বহুদিন লোকালয় থেকে দূরে গিয়ে আত্মগোপন করবো? এত অপমানের পর কারো সম্মুখে দর্শন দেওয়াও তো ভয়াবহ লজ্জার ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে!

কিন্তু আল্লাহ্‌র সামনে আমাদের এসব তুচ্ছ আত্মাভিমান মাকড়সার জালের মতো এক ফুৎকারে উড়ে যায়। কারণ সকল অহংকারের একমাত্র দাবিদার তো সুমহান আল্লাহ তা’আলা। উনি ভিন্ন বাকি সকলের গরিমা, গর্ববোধ তো প্রচণ্ড দুঃসাহস বৈ আর কিছু নয়। হাজ্জ বা উমরাহ্‌ করার পর যখন পুরুষরা মাথা ন্যাড়া করে ফেলে, লাখ লাখ মানুষ যখন ভূমিতে উপবিষ্ট হয়ে, নাক ও কপাল ঠেকিয়ে সিজদায় পড়ে, তখন বিনয়, ভীতি অথবা আল্লাহ্‌কে ভালোবাসার উচ্ছ্বাস ছাড়া অন্য কিছুই তো মনে আসে না!!

এ সকল কর্মকাণ্ডই যখন অন্য মানুষের হুকুমে করতে হয়, তখন তা হয় শাস্তি আর অপমানের বিষয়। কারণ আমাদের সৃষ্টিকর্তা রব্ব আমাদের অন্তরের ভেতর গেঁথে দিয়েছেন, তিনি ছাড়া আর কারো সম্মুখে মাথা নত করা ভয়াবহ অসম্মানের ব্যাপার। মুশরিকরা মূর্তির কাছে নিচু হয়ে যে নিজেকেই ছোট করে, তা তারা হয় অনুধাবন করে না, না হয় অনুধাবন করতে চায় না। আল্লাহ্‌র ঘরে এসে সবার আগে আমাদের মিথ্যা অহংবোধের সকল উপকরণ চূর্ণ করে, নিজের ক্ষুদ্রত্ব অনুভব করতে হয়। চুল কেটে, মাথা ন্যাড়া করে, মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে সর্বশক্তিমান প্রভুর কাছে বিনয়াবনত হয়ে নিজের সমগ্র স্বত্ত্বাকে সমর্পিত করতে হয়। কারণ, কেবলমাত্র তাঁর সামনে আত্মসমর্পণ করার ভেতরই লুক্কায়িত আছে খাঁটি আনন্দ।

এই আনন্দের, উপলব্ধির লোভে, প্রতিনিয়ত লাখ লাখ মুসলমান বিশ্বের সকল প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন মক্কার পবিত্র ভূমিতে। হাজ্জে এলে আল্লাহ্‌র প্রতি অন্তরের গহীনে বাস করা এক সুপ্ত ভালোবাসা যেন ডালপালা মেলে এক দিনেই বটবৃক্ষের আকার ধারণ করে। যাকে অন্য সময় ঠেলেও মসজিদে পাঠানো যায় না, সালাতের ওয়াক্ত যখন যাই যাই করে তখন যে ব্যক্তি সালাত পড়তে ওঠে, সেও এখানে আসলে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত মসজিদে পড়ার জন্য হুড়াহুড়ি লাগিয়ে দেয়। সারাদিনের সকল কার্যাবলী এখানে আবর্তিত হয় সালাতের সময়কে কেন্দ্র করে। আচমকা মানব মন এতটা কীভাবে বদলে যেতে পারে?

আমি বিশ্বাস করি আল্লাহ্‌কে ভালোবাসার এই তীব্র অনুভূতি চারাগাছের মতো আমাদের সবার অন্তরেই প্রোথিত আছে। পৃথিবীর মোহের জালে আবিষ্ট হয়ে ধূলা বিজড়িত হয়ে ঢাকা পড়ে যায় এ ভালোবাসা। পরম করুণাময়ের রহমতপূর্ণ এ স্থানে দুনিয়াবি আকর্ষণ যেন মলিন হয়ে যায়। তখন হঠাৎ করে উপযুক্ত পরিবেশে আবেগ উচ্ছ্বসিত হয়ে বাঁধ ভেঙে আছড়ে পড়ে হৃদয়ের মণিকোঠায়। হাজ্জ শেষে যারা দুনিয়ার মোহে পা দেন না, তাঁদের
আল্লাহ্‌র প্রতি নবযৌবন প্রাপ্ত এ ভালোবাসা অটুট থাকে। কিন্তু যারা মোহের জালে ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়ে, তাদের আবেগে আবার ধূলো জমতে থাকে। মাঝে মাঝে ধূলা না ঝাড়লে ধূসর আস্তরে একেবারে ঢাকা পড়ে যায় ভালোবাসা … আবেগের জোয়ারে আবার ভাটার টান এসে কড়া নাড়ে। এই দুর্ভাগ্য থেকে আল্লাহ্‌ যেন রক্ষা করেন আমাদের।

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive