এক আজ আপনাদের জাপানিদের সাকসেস স্টোরি শুনাবো। জাপানিরা কীভাবে এমন দুনিয়াবি সাকসেস পেলো? কারণ কী?

জাপানের মধ্যেও ইসলাম!! হুজুর হয়ে জাপান নিয়ে কথা!!!!—এসব কথা বলবেন না যেন।

IIRT Arabic Intensive

জাপানের অবস্থা তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বর্তমান বাংলাদেশের মতোই খারাপ। খারাপ হইছে, তাই বলে তো বসে থাকা যায় না! ওরা দেশ ডেভেলপ করা শুরু করলো। ওরা ম্যানুফ্যাকচার করার দিকে মনোযোগ দিলো। আজকের হিস্ট্রি বলবো ওদের কার (Auto) ম্যানুফ্যাকচারার কোম্পানি টয়োটা নিয়ে। কারণ আপনারা সবাই টয়োটা কার কোম্পানিকে চিনেন।

সেই ১৯৬০-৭০-৮০’র দশক। টয়োটার মার্কেট তখন ভালো না। ইউরোপিয়ান-আমেরিকান কার (auto) ইন্ডাস্ট্রির সাথে জাপানি টয়োটা পেরে উঠতেছে না।

তো, টয়োটা কোম্পানি এটা নিয়ে গবেষণা শুরু করলো যে, তাদের প্রডাকশনে সমস্যা কী। কী করলে তারা অল্প পরিশ্রমে কম খরচে সবচেয়ে রিলায়্যাবল কার বানাতে পারবে?

তো তারা এটা নিয়ে গবেষণা করে ‘লীন সিক্স সিগমা’ ডেভেলপ করলো। এটা কোনো পিওর ম্যাথ না, এটা আসলে বিভিন্ন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের কম্বিনেশন। এই ‘লীন সিক্স সিগমা’ ইমপ্লিমেন্ট করে টয়োটা হয়ে গেলো দুনিয়ার সেরা Auto ম্যানুফ্যাকচারার। ইভেন আমেরিকান-রাশান-ইউরোপিয়ানরাও টয়োটার সমতুল্য অটো বানাতে পারে না। টয়োটার মার্কেট ক্যাপ এখন ২০০ বিলিয়ন ডলারের উপরে, পৃথিবীতে সর্বোচ্চ। আমেরিকান অটোগুলো যদি ৫ বছর টিকে, টয়োটা টিকে ১৫-২০ বছর। এমন অবস্থা। অথচ দেখেন টেকনোলজি তো সবাই সমান জানে। টয়োটা খালি নতুন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম অ্যাপ্লাই করে ২০০ বিলিয়ন কামায়, আর অন্যরা ভাত পায় না।

টয়োটা, হোন্ডা, নিসান—তিনটা জাপানি কোম্পানি পৃথিবীর সেরা দশটি অটো কোম্পানির তিনটা। অন্যরা কিন্তু টয়োটার লীন সিক্স সিগমাকে কপি করে।

হাঁ, মনোযোগ দিয়ে শুনেন : “লীন সিক্স সিগমা”।

এর দুটো পার্ট : এক. ‘লীন’, দুই. ‘সিক্স সিগমা’।

প্রথমে আসেন শুরু করি : ‘লীন’ নিয়ে। লীন কথাটার মানে হলো যেকোনো সিস্টেম মোটা থেকে চিকন হওয়া বা সরু হওয়া। মনে করেন আপনার ভুড়ি আছে, তাহলে আপনি মোটা। এখন আপনেরে লীন করলে আপনি চিকন হয়ে নরমাল হবেন, এই আরকি। মানে এক্ষেত্রে লীন করা মানে অপ্রয়োজনীয় চর্বিকে ঝরিয়ে চিকন হওয়া।

তো, যেকোনো সিস্টেমকে এফিশিয়েন্ট করতে হলে আসলে এটাকে লীন করতে হয়। মানে এর অপ্রয়োজনীয় অপচয় (যা চর্বির মতোন) কমিয়ে একে এফিশিয়েন্ট করতে হয়।

এখানে অপচয়টা হলো মূলত সময়ের অপচয়। মানে যেকোনো সিস্টেমের সময়ের অপচয় যদি আপনি সিগনিফিক্যান্টলি কমাতে পারেন (মানে লীন করতে পারেন), তাহলে আপনি একই রিসোর্স ব্যবহার করে বেশি প্রডাকশন পাবেন। তাই অল্প রিসোর্স ব্যবহার করে বেশি প্রডাকশন করতে হলে আসলে আপনাকে সময়ের অপচয়কে লীন করতে হবে।

অপচয়কৃত সময়কে জাপানিরা নাম দিছে নন-ভ্যাল্যু অ্যাডেড টাইম। মানে যেই সময়ের কাজটা আপনার সিস্টেমে কোন ভ্যাল্যু অ্যাড করে না, বা জাস্ট অপচয়।

আর ‘কাজের সময়’কে জাপানিরা নাম দিছে ‘ভ্যাল্যু অ্যাডেড টাইম’। মানে যেই সময়ের কাজটা আপনার সিস্টেমে ‘কোনো না কোনো’ ভ্যাল্যু অ্যাড করে। এখানে সিস্টেমটা হলো ‘কার ম্যানুফ্যাকচারিং’। তবে এই কনসেপ্টটা অন্য সিস্টেম বা ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

তো জাপানিদের বুদ্ধি হলো যে, “দেখো, টেকনোলজি তো সবই সমান। কিন্তু অন্যদের সিস্টেমে তো নন-ভ্যাল্যু অ্যাডেড টাইম বেশি। আমরা যদি নন-ভ্যাল্যু অ্যাডেড টাইম কমিয়ে তাকে ভ্যাল্যু অ্যাডেড টাইম বানাতে পারি, আমরা কম রিসোর্সে বেশি প্রডাকশনে যাবো এবং অন্যদের থেকে কার ম্যানুফ্যাকচারিং মার্কেট নিয়ে নিবো, তাই না?”

তো, টয়োটা এই কনসেপ্টের উপর ভিত্তি করে বেশ কিছু টুল (মানে কনসেপ্ট) বানালো, যা দ্বারা সিস্টেম থেকে তারা নন-ভ্যাল্যু অ্যাডেড টাইম বাদ দিতে পারে এবং ভ্যাল্যু অ্যাডেড টাইম বৃদ্ধি করতে পারে। ব্যস, কেল্লা ফতেহ। ইউরোপ আম্রিকা ধপাস … জাপানের কাছে।

কিছু এক্সাম্পল না দিলে কি হয়? আসলে কিন্তু খুব সিম্পল। যেমন মনে করেন,

লীন সিক্স সিগমা টুল

ফাইভ এস (5S: Sort, Set in order, Shine, Standardize, Sustain)

মনে করেন দশজন শ্রমিক মিলে ২টা মেশিনে ছোট ছোট কিছু টুল বানায়, যা গাড়ির অংশ। তো তারা তাদের প্রায় ১০০ টা গ্যাজেট এখানে ওখানে (ওয়ার্কিং প্লেসে) ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখে। হঠাৎ একটা গ্যাজেট খুঁজে পেতে দেরি হয়, এবং তাতে কাজের দেরি হয়। এর সমাধান হলো প্রতিটা গ্যাজেটকে সর্ট করতে হবে এবং সর্ট করে নির্দিষ্ট জায়গায় রাখতে হবে এবং সেখানে থেকে নিয়ে আবার ঠিক সেখানেই ফিরত রাখতে হবে। প্রতিটা গ্যাজেটকে ভিন্ন ভিন্ন কালার করে রাখতে হবে, অর্গানাইজড ওয়েতে।

তাহলে গ্যাজেট খোঁজাখুঁজিতে দিনে যে একজন শ্রমিকের ৩০ মিনিট সময় নষ্ট হতো, তা আর নষ্ট হলো না। তাহলে সময় বাঁচলো কত? দিনে ৩০ মিনিট, একজন শ্রমিকের। মনে রাখবেন।

সোজা বাংলায় এটা হলো ‘ফাইভ এস’।

স্প্যাগেতি চার্ট

কোম্পানিগুলো তাদের পণ্য আনা নেয়া এক স্টেশন থেকে আরেক স্টেশনে মালবাহী ছোট ছোট ট্রলির মাধ্যমে করে। তো তারা যেটা করে, ইতস্তস্ত বিক্ষিপ্তভাবে যায়। তাতে তার শর্টেস্ট দূরত্ব অতিক্রম করে না। এতে বিশাল ইন্ডাস্ট্রিতে শত শত শ্রমিক কাজ করার সময় এক ট্রলির জন্য আরেক ট্রলি আটকে থাকে। সময় নষ্ট হয়। স্প্যাগেতি চার্ট করে এগুলো দেখা হয় এবং প্রতিটা ট্রলির সময় ও রাস্তা ঠিক করে দেওয়া হয়। তাতে প্রচুর সময় সেইভ হয়। মনে করেন প্রত্যেক শ্রমিকের ৫০ মিনিট সেইভ হলো এটা করে।

ভ্যাল্যু স্ট্রীম ম্যাপিং

পুরো সিস্টেমকে ম্যাপ করে ড্র করা হয়। এরপর দেখা হয় কীভাবে অর্গানাইজ করলে সবচে কম সময় কাজ আউটপুট দেওয়া যায়। অনেকটা ক্রিটিকাল পথের মতোন।

পিউ ম্যাট্রিক্স

এটা একটা ডিসিশন মেকিং টুল। মনে করেন অনেকগুলো অলটারনেটিভ আছে কাঁচামাল সংগ্রহের জন্য। কোন জায়গা থেকে আপনি ইঞ্জিন বানানোর কাঁচামাল কিনবেন? একেক দেশ একেকটা অফার করতেছে। পিউম্যাট্রিক্স তৈরি করে আপনি বেস্ট অলটারনেটিভকে বের করতে পারবেন।

পোকা-ইয়োকা

কাজ করতে গিয়ে শ্রমিকরা ভুল করে? ভুল যাতে না করে, তার জন্য আছে: পোকা ইয়োকা এই টুল। পোকা ইয়োকা যেকোনো ভুলের আগে শ্রমিককে ওয়ার্নিং দেয়।

কাজেই শ্রমিকরা ভুল করে না এবং কাজের এফিশিয়েন্সি বাড়ে। অনেক সময় ভুল করলে কাজ রিপীট করা লাগে, তখন সময় নষ্ট হয়। এই সময়টা পোকা-ইয়োকা বাঁচিয়ে দিচ্ছে।

চেক লিস্ট

একটা কাজে অনেকগুলো স্টেপ, খুব কমপ্লিকেটেড। শ্রমিকরা অনেক সময় ভুল করে ফেলে। একটা স্টেপ মিস হইলেই শেষ, আবার রিপীট বা ইমার্জেন্সি হতে পারে। সমাধান সহজ। একটা লিখিত চেকলিস্ট বানাবেন, তাতে প্রতিটা স্টেপ লেখা থাকবে। শ্রমিকটা প্রতিটা স্টেপ শেষ করে চেকলিস্টে টিক চিহ্ন দিবে। তাহলে ভুল হবে না। এয়ার লাইন ইন্ডাস্ট্রি এবং মেডিকেলে এটা খুব ব্যবহৃত হয়।

সব তো লিখে শেষ করা সম্ভব না। আরও কিছু লীন সিক্স সিগমা টুলের নাম বলি: সাইপোক, টি পি এম, ডামাইক, ডামাডিভি, ইশিকাওয়া (ফিশবোন), বেঞ্চমার্কিং, পেয়ারওয়াইজ র‍্যাংকিং, ফেইলিওর মুড অ্যান্ড ইফেক্ট এনালিসিস, লাইফ সাইকেল কস্ট এনালিসিস … হাজার হাজার আছে। বললে শেষ হবে না। একেক ম্যানুফ্যাকচারার কোম্পানির জন্য ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির টুল ব্যবহৃত হয়।

মূল কথা হলো, আপনার সিস্টেম থেকে নন-ভ্যাল্যু অ্যাডেড টাইমকে দূর করা এবং সকল সময়কে ভ্যাল্যু অ্যাডেড টাইমে পরিণত করা। ১০০ ভাগ সম্ভব না, কিছু অপচয় হবেই। কিন্তু ৮০-৯০ ভাগ সম্ভব।

মনে করেন, টয়োটার ১০টা প্রডাকশন সেল আছে। তাতে মোট ১০,০০০ শ্রমিক কাজ করে। যথাসম্ভব লীন সিক্স সিগমা টুল অ্যাপ্লাই করে প্রত্যেক শ্রমিক দিনে ৩ ঘণ্টা সময়কে সেইভ করলো (আসলে আরো বেশি সময় সেইভ হয়)। মানে আগে দিনে ১০ ঘণ্টা কাজ করতো, তার ৫ ঘণ্টা হতো অপচয়। এফিশিয়েন্ট কাজ হতো মাত্র বাকি ৫ ঘণ্টা। এখন ১০ ঘণ্টাই কাজ করে, কিন্তু এফিশিয়েন্ট কাজ বেড়ে ৮ ঘণ্টা হয়েছে। তার মানে আপনার এফিশিয়েন্সি ৫০% থেকে ৮০% হয়ে গেছে। যদিও আপনি সেই ১০ ঘণ্টা সময়ই অফিস করছেন।

তাহলে উপরের হিসেবে দিনে ৩ ঘণ্টা করে তাদের সেইভ হলো দশ হাজার শ্রমিক*৩ ঘণ্টা = ৩০ হাজার সময় কর্মঘণ্টা। মজাটা এখানেই। আপনি হয়তো ৩০ মিনিট সময়কে কোনো সময়ই মনে করেন না। অথচ আপনি যদি ৩০ মিনিট করে করে সময় বাঁচিয়ে মোট ৩ ঘণ্টা সময় দিনে সেইভ করতে পারেন এবং তা কাজে লাগাতে পারেন, আপনি ৩০ হাজার ঘণ্টা সেইভ করতে পারেন।

মনে করেন একটা গাড়ি করতে গড়পড়তায় মোট ১০০ ঘণ্টা ভ্যাল্যু অ্যাডেড শ্রম দিতে হয়।

তাহলে একই পরিমাণ কাজ করে টয়োটা দিনে প্রায় ৩০০ গাড়ি বেশি উৎপাদন করতে পারলো। অথচ তাকে শ্রমিকদের বেতন বাড়াতে হচ্ছে না, কাজ তো একই করতেছে।

তার মানে অন্য কোম্পানি যে পরিমাণ শ্রমিক দ্বারা ৬ মাসে ৫০০ গাড়ি বানাতে পারে, টয়োটা সেখানে ৮০০ গাড়ি বানাতে পারলো। তাহলে একই কোয়ালিটি জিনিস সে বেশি প্রডাকশন করলো, তাই দাম কমাতে পারবে, বেশি লাভ করবে এবং মার্কেটে চলবে বেশি। পুরো মার্কেট টয়োটা দখল করবে, অন্য কোম্পানি মার খেয়ে যাবে। যদিও টেকনোলজিতে অন্য কোম্পানি কোনো অংশেই কম না।

বোঝা গেলো, যেকোনো সিস্টেম থেকে নন-ভ্যাল্যু অ্যাডেড টাইম কমিয়ে তাকে লীন করতে পারলে ব্যাপক উন্নতি আল্লাহ চাহে তো গ্যারান্টেড। কারণ আপনি অন্যদের থেকে এগিয়ে গেলেন। শুধু সায়েন্স-ম্যাথ-ইন্জিনিয়ারিং শিখলে হবে না। কীভাবে বিশাল নেটওয়ার্ক এফিশিয়েন্টলি ম্যানেজ করতে পারবেন, সেটা শিখতে হবে। তাহলে আপনার ইন্ডাস্ট্রি ম্যাক্সিমাম আউটপুট দিবে।

তবে ‘সিক্স সিগমা’ নিয়ে কিছু বলিনি। কারণ এটা সিস্টেমের প্রতিটা এলিমেন্টের পারফরমেন্স মেজার করে প্রতিটা এলিমেন্টকে অপটিমাইজ করে, কোয়ালিটি কন্ট্রোল করে। এর টুলগুলো হলো এরকম: রান চার্ট, কন্ট্রোল চার্ট, টি-টেস্ট, এক্সবার চার্ট, আর চার্ট, এনোভা, (অনেক স্ট্যাটিসটিকস আছে এর মধ্যে, তাই এখানে আলোচনা করা ঝামেলা হবে। বাদ দিলাম) … টয়োটা কোম্পানি ‘লীন’ এবং ‘সিক্স সিগমা’ দুটোই অ্যাপ্লাই করেছে।

লীন আর সিক্স সিগমা দুটা আলাদা বিষয় হলেও দুটো এমন ভাবে মিশে গেছে যে, দুটোর টুলগুলোকে একসাথে বলা হয়। এটা বুঝে নিবেন আশা করি।

তো যা-ই হোক, এই লীন সিক্স সিগমা ডেভেলপ এবং ইমপ্লিমেন্ট করে জাপানি কোম্পানিগুলো সেই ৮০-৯০ এর দশকেই ব্যাপক সাকসেস পায়। প্রতিটা ইউরোপিয়ান ইকোনমিকে ক্রস করে ১৯৯৫ সালেই জাপানের জিডিপি পৌঁছে যায় ৫ ট্রিলিয়ন ডলারে। অথচ সমান পপুলেশন নিয়েও এখনও ব্রিটেন ফ্রান্স জার্মানি ২-৩-৪ ট্রিলিয়ন ডলারে আছে। চিন্তা করতে পারেন? ইউরোপ থেকেও জাপান কত উন্নত? কোনো ডলার নাই, তেলও নাই। খালি বুদ্ধি আছে যে, কীভাবে সময় বাঁচিয়ে চলবে। টেকনোলজিতে অনেক উন্নত হয়েও ইউরোপ-আম্রিকা-রাশিয়া কেউ জাপানের সাথে পারে না, কারণ জাপান ‘সময়’কে সর্বোচ্চ লীন করতে পেরেছে। চিন্তা করেন, সময়ের অপচয় দূর করতে পারলে কী হয়।

আজ আমেরিকান-ইউরোপিয়ানরা জাপানি লীন সিক্স সিগমা অ্যাপ্রৌচ ফলো করে। জাপানিদের কাছে শিখেছে, শিখে এখন নিজেরা অ্যাপ্লাই করতে চেষ্টা করতেছে। কিন্তু জাপানিদের সাথে পারা কঠিন, ওরা ডেভেলপ করছে তো।

এ জন্য জাপানি কিছু কিনলে এটা বছরের পর বছর ধরে সার্ভিস দেয়, দামও কম, আবার নষ্টও হয় না, কোয়ালিটি হাইয়েস্ট। কারণ তারা লীন এবং সিক্স সিগমা দুইটাই ব্যবহার করে।

এখন এয়ার লাইন ইন্ডাস্ট্রি, মেডিকেল ইন্ডাস্ট্রি , যেকোনো ম্যানুফ্যাকচারার, গার্মেন্টস—সবাই লীন সিক্স সিগমা এপ্লাই করে। প্রতিটা ইন্ডাস্ট্রি চলে একে দিয়ে। সারা দুনিয়ায় চালু হয়ে গেছে। এটাই উন্নতির গোপন রহস্য।

নর্থ আমেরিকান ইউনিভার্সিটিগুলোতে লীন সিক্স সিগমাকে মাস্টার্স এবং পিএইচ ডি পর্যায়ে পড়ানো হয়। অনেক জায়গায় বাধ্যতামূলক, এটা ছাড়া হবে না। আমার ভার্সিটিতে বাধ্যতামূলক, তাই আমাকে জোর করে পড়াইছে। কারণ ম্যাথ-সায়েন্স জাইনা লাভ নাই, যদি ম্যানেজমেন্ট করতে না পারেন।

দুই এতক্ষণ ওয়ার্ম আপ হলো। এবার আসি মূল কথায়। সবকিছুর মধ্যে ইসলাম না হলে কি হয়?

আল্লাহ আমাদের জাপানিদের মাধ্যমে যা শিক্ষা দিছেন, তা হলো ‘সময়ের মর্যাদা’। নন-ভ্যাল্যু অ্যাডেড টাইমকে জীবন থেকে দূর করার প্রয়োজনীয়তা। শুধু ইন্ডাস্ট্রি না, প্রতিটা মানুষ বা রাষ্ট্র জীবনে উন্নতি করবে, যদি সে তার থেকে নন-ভ্যাল্যু অ্যাডেড টাইমকে দূর করতে পারে। যে রাষ্ট্র/ব্যক্তি যত বেশি নন-ভ্যাল্যু অ্যাডেড টাইমকে কমাতে পারবে, সে রাষ্ট্র/ব্যক্তি তত উন্নত হবে।

তাই ইসলাম এই নন-ভ্যাল্যু অ্যাডেড টাইমের একটা সুন্দর নাম দিয়েছে। সেটা হলো ‘বেহুদা কাজ’। যদিও ঠিক হারাম না (তবে হতেও পারে), কিন্তু এই কাজগুলো সময়ের অপচয়।

খুব খেয়াল করে দেখবেন, আমরা দিনে ১৬ ঘণ্টা জেগে থাকলেও এর প্রায় ৮০ ভাগই বেহুদা কাজ করি। এফিশিয়েন্টলি কাজ করি হয়তো ২-৩ ঘণ্টা দিনে। তাই ডেডলাইন আসলে খুব তাড়াহুড়া করে দিনে ২০ ঘণ্টা খেটে কাজ জমা দিই। তার মানে আমাদেরকে ‘সময় নষ্ট’ করা অনেক কমাতে হবে।

রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ, উম্মাহ হিসেবে মুসলিম আর ব্যক্তি হিসেব আমি বা আপনি অনেক পিছিয়ে যাচ্ছি শুধুমাত্র নন-ভ্যাল্যু অ্যাডেড কাজ করে সময় নষ্ট করার মাধ্যমে, মানে বেহুদা কাজ করে। আর অন্যরা সময়কে যথাযথভাবে ব্যবহার করে অনেকটুকু এগুচ্ছে।

একজন যদি দিনে ৬ ঘণ্টা নষ্ট করি (বেহুদা কাজে), তাতে আমরা ১৬ কোটি মানুষ দিনে ১৬*৬ কোটি ঘণ্টা = 96 কোটি ঘণ্টা নষ্ট করছি। তাহলে বছরে প্রায় ৯৬ কোটি*৩৬৫ =? চিন্তা করেন! অন্যরা কেন এগিয়ে যাচ্ছে, বুঝতে পারছেন? কারণ তারা দিনে এত সময় নষ্ট করে না। ইউরোপ আমেরিকা তো পরের কথা, ইভেন ইন্ডিয়ান-শ্রীলংকানরাও না।

এ সময়টা ব্যবহার করলে আমরা কত এগিয়ে যেতাম চিন্তা করেন! এজন্যই বাংলাদেশে বসে ইন্ডিয়ানরা চাকরি করে, বাংলাদেশিরা চাকরি পায় না।

মুসলিম উম্মাহর প্রতিটি মানুষ, মনে করেন দিনে ৫ ঘণ্টা সময় নন-ভ্যাল্যু অ্যাডেড কাজ করে নষ্ট করে। তাহলে আমরা দিনে প্রায় ৫*১.২ বিলিয়ন = ৭ বিলিয়ন ঘণ্টা নষ্ট করতেছি, শুধু এক দিনে। তাহলে বছরে কত সময় নষ্ট করতেছি? ওই সময়টা কাজে লাগাইলে মিডল ইস্টে এত প্রবলেম থাকতো?

তাহলে বুঝেছেন, জাপানিরা এত উন্নত কেন হয়েছে? খ্রিস্টান কান্ট্রিগুলো এত উন্নত কেন হয়েছে?

কিছুই না, সময়ের যথাযথ ব্যবহার করে। (আরও অনেক কারণ আছে। কাফিরদের দুনিয়াবি উন্নতি এক ধরনের আযাবও বটে, যাতে তারা আখিরাতের ব্যাপারে আরো বিমুখ হয়। কিন্তু আজকের আলোচনার হাইলাইটস হলো সময়ের যথাযথ ব্যবহার।)

আমরা বিনোদন আর সংস্কৃতির নামে সময় নষ্ট করতেছি, আর তারা কাজ করে এগিয়ে যাচ্ছে।

দেখুন, সরকার-পৃথিবী কোনোকিছুই আপনি ওভারনাইট চেঞ্জ করতে পারবেন না। কিন্তু একটা জিনিস পারবেন, নিজেকে। নিজের সময় নষ্ট বন্ধ করলে দুনিয়া এবং আখিরাতে ব্যাপক উন্নতি করতে পারবেন। কারণ অন্যরা কিন্তু সময় নষ্ট করছে, আপনি এগিয়ে গেলেন।

তাহলে দেখি কী কী করে আমরা সময় নষ্ট করছি: সিম্পল হয়েও সিম্পল না:

১. টিভি-নাটক দেখা। জাস্ট সময় নষ্ট। দিনে ১-২-৩ ঘণ্টা নষ্ট। ধরেন বছরে ৭০০ ঘণ্টা।

২. ক্রিকেট দেখা। ৩-৯ ঘণ্টা সময় নষ্ট একটা খেলা দেখায়। মনে করেন বছরে ক্রিকেটের পিছে ৫০০ ঘণ্টা।

৩. ফুটবল দেখা। যদিও একটা দেখতে দেড় ঘণ্টা লাগে, কিন্তু ওইটার টেনশনে কাজ হয় না আরও এক ঘণ্টা, তর্ক বিতর্ক করতে আরও দেড় ঘণ্টা, প্রিয় দল হেরে গেলে মন খারাপ হয়ে কাজ নষ্ট আরও দেড় ঘণ্টা। তাই শেষমেশ ফুটবলের পিছে দিনে গড়ে ৩ ঘণ্টা ধরলাম। বছরে ১০০০ ঘণ্টা।

৪. অপ্রয়োজনীয় সামাজিক অনুষ্ঠান – বছরে ৫০০ ঘণ্টা।

৫. মাত্রাতিরিক্ত মোবাইল-বন্ধু বান্ধব – বছরে ৫০০ ঘণ্টা।

(৬. বিনোদন-সংস্কৃতির নামে যা হয় : সবকিছু। বছরে – আনডিফাইনড। বাদ দিলাম।

৭. সারাদিন স্মার্ট ফোন দিয়ে Busy থাকা : পুরা বছরই নষ্ট। – শুধু যারা করে তাদের জন্য)

চিন্তা করেন উপরের কাজগুলো বাদ দিয়ে দিলে বা খুব সংকুচিত করলে আপনি বছরে ৭০০+৫০০+১০০০+৫০০+৫০০ = ৩২০০ ঘণ্টা সময় সেইভ করতে পারেন। আচ্ছা, মনে করেন এত পারলেন না। ২৫০০ ঘণ্টা তো সেইভ করতে পারলেন। দশ বছর এভাবে চললে ২৫০০০ (পঁচিশ হাজার ঘণ্টা) টাইম আপনি নিজের জন্য সেইভ করে ক্যারিয়ার-আখিরাত উভয়ের পিছনে দিতে পারেন। আপনার যে বন্ধুটি দশ বছরে আপনার থেকে পঁচিশ হাজার ঘণ্টা সময় কম কাজ করেছে, সে আপনার সমান/বেশি মেধাবী হয়েও আপনাকে কিন্তু ধরতে পারবে না। আপনি অনেক উপরে উঠে যাবেন।

এটা বুঝতে পারাটাই উন্নতির গোপন রহস্য, কি দুনিয়ায়, কি আখিরাতে।

আপনি খুব ব্রিলিয়ান্ট, খুব মেধাবী হয়েও জীবনে ব্যর্থ হবেন যদি সময় নষ্ট করেন। আর মাঝারি মেধার হয়েও সময়ের অপচয় রোধ করে, সময়কে কাজ লাগিয়ে বিলিয়নেয়ার হয়ে যেতে পারবেন।

মেধা আসল না। সময়কে কে কীভাবে কাজে লাগালো, কত অর্গানাইজড ভাবে, সেটাই হলো আসল।

এই সময়ের এফিশিয়েন্সি নিয়ে কুরআন থেকে কিছু উদ্ধৃতি:

নিশ্চয়ই কল্যাণ লাভ করেছে ইমানগ্রহণকারী, নিজেদের সালাতে ভীতি ও বিনয় অবলম্বনকারী, বেহুদা কাজ পরিত্যাগকারী, যাকাতের পন্থায় কর্মতৎপর … । [সূরাহ আল-মুমিনুন (২৩): ১-৪)

আর মানুষের মধ্য থেকে কেউ কেউ না জেনে আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য বেহুদা কথা খরিদ করে আর তারা ঐগুলোকে হাসি-ঠাট্টা হিসেবে গ্রহণ করে। [সূরাহ লুকমান (৩১): ৬]

তোমরা আহার এবং পান কর, আর অপচয় করো না; তিনি (আল্লাহ্‌) অপচয়কারীদের ভালোবাসেন না। [সূরাহ আল-আ’রাফ (৭): ৩২]

হাদীস থেকে কিছু উদ্ধৃতি:

দুটো অনুগ্রহ আছে, যাকে অধিকাংশ মানুষ ব্যবহার করে না এবং তারা চলে যায়। ১. সুস্বাস্থ্য, ২. সময়। (বুখারী, ৬৪১২)

পাঁচটি বস্তু থেকে সর্বোচ্চ নিয়ে নাও : ১. জীবন, মৃত্যুর আগেই; ২. সুস্থতা, অসুস্থ হবার আগেই; ৩. অবসর সময়, ব্যস্ত হবার আগেই; ৪. যৌবন, বৃদ্ধ হবার আগেই; ৫. সম্পদ, গরীব হবার আগেই।

ছোটকালে বুঝতাম না, ‘বেহুদা কথা/কাজ’ নিয়ে ইভেন কুরআনে এত কথা কেন। আই মীন, এটা কি এতই ইম্পর্টেন্ট?

কুরআনে সকল বিষয়ের মূলনীতি থাকলেও অনেক ডিটেইলস বিষয়ই তো আল্লাহ্‌ কুরআনে উল্লেখ করেননি। ইসলামের অনেক বিধান কিন্তু শুধু সহীহ হাদীস থেকে আসা।

অথচ এই ‘বেহুদা কাজ-কথা’ নিয়ে এত কুরআনের আয়াত, এত হাদীস? ক্যান ইউ ইম্যাজিন?

তার মানে এটা জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ বুঝিয়ে দিলেন। কত উত্তমভাবে।

আসুন, নিজ জীবন থেকে নন-ভ্যাল্যু অ্যাডেড টাইমগুলোকে বাদ দিয়ে দিই। অপ্রয়োজনে সময়কে নষ্ট না করি। ক্রিকেট-ফুটবল-নাটক-টিভি এই তিনটা বাদ দিলেই দেখবেন নিজের উন্নতি, নিজের চোখে।

সামনেই ওয়ার্ল্ড কাপ: আসল টেস্ট, আসল। আসুন চেষ্টা করি, সর্বোচ্চ।

সময় চলে যাবে, শুধু রয়ে যাবে অসফল আপনি/আমি, বুড়া বয়সে আফসোস হবে: হায়রে যদি ওই সময়গুলো নষ্ট না করে ব্যবহার করতাম, আজ অন্য অবস্থায় থাকতাম। আর মরে গেলে যে কী হবে, আল্লাহ ভালো জানেন।

এখনই সময়, নিজ জীবন থেকে ‘বেহুদা কথা-কাজ’কে সম্পূর্ণ ডিলিট করে দেবার। শিফট+ডিলিট।

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive