বেশ ক’ বছর আগে একটি হিন্দি মুভি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল, বিশেষত ছাত্র সমাজের মাঝে। মুভির একজন চরিত্র একটি মূলনীতি অনুসরণ করেন। পুত্র সন্তান হলে তাকে ইঞ্জিনিয়ার বানাবেন, কন্যা সন্তান হলে বানাবেন ডাক্তার। তাঁর ইচ্ছে অনুযায়ী দুই মেয়ে ডাক্তার হয়, আর এক ছেলে আত্মহত্যা করে বা কোনো এক ধরনের মানসিক চাপে মারা যায়। মুভির ফলিং অ্যাকশানে জানা যায় যে, ছেলেটি কবি-লেখক হতে চেয়েছিল। ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার জন্য বাবার কড়াকড়ি শাসন সহ্য করতে না পারাই তার মৃত্যুর কারণ।

এই বাবা একটি ইঞ্জিনিয়ারিং  ইউনিভার্সিটিরও আচার্য (অথবা ওই দেশে ইউনিভার্সিটির প্রধানকে যেটা বলে, সেটা)। ছাত্রদের সৃজনশীলতাকেও তিনি কাঠামোবদ্ধ পড়াশোনা-ক্লাস-পরীক্ষার জালে আটকে রাখেন। তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ছাত্রটি গড়্গড় করে বই থেকে বড় বড়, কঠিন কঠিন সংজ্ঞা মুখস্থ বলে দিতে পারে। সৃজনশীলতায় বাধা পাওয়া বা এরকম কোনো একটা কারণে এক আবাসিক ছাত্র তার রুমের ভেতর গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে। পেছনে দেয়ালে লেখা থাকে ‘I quit’. পুত্র ও ছাত্রদের সাথে করা আচরণগুলোর ভুল বুঝতে পারেন তিনি মুভির শেষের দিকে গিয়ে।

IIRT Arabic Intensive

এখানে ছেলের মৃত্যুর জন্য দায়ী প্যারেন্টিং, আর ছাত্রের মৃত্যুর জন্য দায়ী সিস্টেম। এই লেখায় আমি সিস্টেমের প্রসঙ্গ আনব কম, প্যারেন্টিং বা মোটা দাগে ফ্যামিলির বিষয়টিই আনব বেশি।

সন্তানের পালস বুঝতে না পারা পিতা-মাতার একটা ব্যর্থতা বটে। আলাদা আলাদা প্রজন্মের মানুষ হওয়ার কারণে একে অপরের চাহিদা, পরিস্থিতি, মানসিকতা পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারাটাও অসম্ভব। কিন্তু তাই বলে গণহারে যে আমরা ওই মুভির নায়কদের সাথে নিজেদের তুলনা করতে শুরু করি, এটাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে পুরোপুরি সমর্থন করতে পারি না। কেন পারি না, তা বোঝার জন্য একদম শুরু থেকে শুরু করতে হবে। জীবনটাকে আমরা কোন লেন্স দিয়ে দেখি, সেখান থেকে।

নিরীশ্বরবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে আপনি, আপনার বাবা-মা, সকলেই অণু-পরমাণুর ধাক্কাধাক্কিতে তৈরী হওয়া কিছু অর্গানিজম। কিছু রাসায়নিক আবর্জনার সমষ্টি। তো এক রাসায়নিক আবর্জনা সমষ্টির যেহেতু কোনো অধিকার নেই আরেক রাসায়নিক আবর্জনা সমষ্টির উপর খবরদারি করার, তাই বাবা-মারও কোনো অধিকার থাকে না আপনি কোন ক্যারিয়ার বেছে নেবেন তা হুকুম করার।

কিন্তু যদি আপনি মনে করেন আল্লাহর ইচ্ছায় আপনার পিতামাতার ঔরস-গর্ভ থেকে আপনি দুনিয়ায় এসেছেন, তাহলে বিষয়টা একটু অন্যরকম হয়ে যায়। এখানেও ঠিক পিতা-মাতা ‘হুকুম’ করতে পারবেন না “এই ক্যারিয়ার বেছে নাও।” আপনি আপনার পছন্দমতো যেকোনো হালাল ক্যারিয়ারই পছন্দ করতে পারেন। পিতা-মাতা যদি আপনাকে হারাম কোনো জব নিতে চাপাচাপি করে, আপনাকে তা অমান্য করেই আল্লাহকে মান্য করতে হবে। কিন্তু ফরয আর হারামের বাইরের জগতটা তো অনেক বড়।

পিতামাতা, বড় ভাইবোন বা অন্য কোনো আত্মীয় আপনার উপর অনেক অনুগ্রহ করেছেন, যখন আপনি ছোট ছিলেন। ধমক খেয়ে কখনও অভিমান করলেও পরে ঠিকই মিটমাট করে নিয়েছেন, কারণ আপনি তাঁদের উপর নির্ভরশীল। পরের কয়েক বছরে আপনি দৈর্ঘ্য-প্রস্থে বাড়লেন, জ্ঞান-বুদ্ধি-ক্ষমতায় বাড়লেন। এখন আপনি ওই মানুষগুলোকে ছেড়ে চলে গেলেও আপনার কোনো ক্ষতি হবে না। কিন্তু ছোটবেলার আদর-অনুগ্রহের জোরে এই বয়সেও কি আপনার উপর তাঁদের একটা আবদার থাকতে পারে না?

এটাই মোক্ষম সময় আপনার পেশীশক্তি আর ক্ষমতার দাপটে লাগাম পরানোর। বাবা-মা যদি আবদার করেন আপনি বিশেষ কোনো একটা জব করবেন (অবশ্যই হালাল), কিন্তু আপনার ইচ্ছে অন্য আরেকটা জব – এই অবস্থায় খুব একটা ক্ষতি হবে না, যদি আপনি বাবা-মায়ের ইচ্ছেটাকেই প্রাধান্য দেন। বরং আমি মনে করি, এতেই আল্লাহ বারাকাহ ঢেলে দেবেন, দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণের ফায়সালা করবেন।

অনেক ছেলেকে দেখেছি বিসিএস কোচিং-এ ভর্তি হয়েছে “বাবা-মা চেয়েছেন” বলে, তাদের প্যাশান ভিন্ন ধরনের ক্যারিয়ারে। এখানে বাবা-মা অবশ্যই সঠিক কাজ করেননি। কিন্তু সিস্টেমের যেই ত্রুটির কারণে চাকরির বাজারের এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তা তো আর আপনার বাবা-মা তৈরি করেননি। অনিবার্য অনেক কারণেই এখন অদ্ভুত অদ্ভুত সাধারণ জ্ঞান মুখস্থ করা লাগে। তিন ধাপে পরীক্ষা শেষ করে ‘চাকরি’ করতে হয় আপনার চেয়ে কম শিক্ষিত, অশিক্ষিত নেতা-নেত্রীদের অধীনে। এটা সিস্টেমের ত্রুটি, আপনার বাবা-মায়ের না।

ধরুন, আপনার পরিবার আপনাকে হারাম কোনো চাকরিতে ঢোকার জন্যই চাপাচাপি করছে। সমবয়সী বন্ধুদের সাথে এ বিষয়টি যেভাবে সামাল দেন, এখানে সেভাবে সামাল দিলে হবে না। বন্ধুদের মুখের উপর আপনি ফাতওয়া ছুঁড়ে মারতে পারেন, শাহাদাহ আঙুল উঁচিয়ে খুতবা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলতে পারেন, “ইউনুস আলাইহিসসালামকে মাছের পেটের ভেতর জীবিত রেখেছেন যেই রব, আমি আমার রিযিকের জন্য তাঁর উপরই আস্থা রাখলাম!” পরিবারের সাথে এমন করা যাবে না।

শিশুকালে পরিবার যেভাবে আপনাকে নরম তোয়ালেতে জড়িয়ে রাখতেন, আপনার পে-ব্যাক অনেকটা এমনই হওয়া চাই। মনে রাখবেন, বয়সের ভারে আপনার মুরুব্বিরা এখন শিশু, আপনি তাগড়া জোয়ান। আপনি যেভাবে হালাল-হারামের পার্থক্য শিখেছেন, তাঁদের অনেকের সে সুযোগ হয়নি। তাই তাঁদেরকে ভোলাতেও হবে শিশুদের মতো এই এটা-সেটা বলে। এর অর্থ হারামের সাথে কম্প্রোমাইজ করা নয়। আপনি আপনার আদর্শে ঠিক থেকেই শুধু দাওয়াহর পদ্ধতিটি পরিবর্তন করলেন।

ফিরে যাই ওই মুভি প্রসঙ্গে। একটি বিখ্যাত দৃশ্যের কথা অনেক শুনেছি। আচার্য সাহেব একদিন ক্লাসে একটি কলম দেখিয়ে বলেন, সেটি বিশেষ এক ধরনের কলম। মহাশূন্যে অভিযানের সময় মাধ্যাকর্ষণের অভাবে সাধারণ কলমের কালি বের হয় না। মিলিয়ন ডলারে তৈরি ওই বিশেষ কলমটি দিয়ে ঠিকই মহাশূন্যে বসেও কাগজে লেখা যায়। নায়ক এটা শুনে বলল এত খরচ না করে পেন্সিল দিয়ে লিখলেই তো হয়। সারা ক্লাস হো হো করে হেসে উঠল।

কিন্তু পরে জানলাম আরেক দৃশ্যে নায়কের ভুল ধরিয়ে দেন শিক্ষক। মাধ্যাকর্ষণের অভাবে পেন্সিলের কার্বন উড়ে এসে নাকে-মুখে ঢুকে মৃত্যুর কারণ হতে পারে। তাই কলমই সমাধান। নায়ক ভুল স্বীকার করে নেয়। এই দৃশ্যের কথা কেউ বলে না। কারণ এটা বলে দিলে কৌতুকটা ধোপে টেকে না। সবকিছু যে দুই যোগ দুই সমান চারের মতো সিম্পল না, তা সামনে চলে আসে।

মুভিটিতে সিস্টেমের বিরুদ্ধে আর সৃজনশীলতার পক্ষে সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে এই প্রধান নায়ক। কিন্তু প্রতিবাদ দেখানোর পাশাপাশি সে ছিল ক্লাসের টপার। পার্থিব এই অর্জনটা না থাকলে আদর্শিক যুদ্ধের নেতৃত্বের দায়িত্ব সে নিতে পারত না। আমাদের মধ্যে যারা গিটার নিয়ে গান গায় ‘গিভ মি সাম সানশাইন’ অথবা ফেইসবুকে স্টেটাস দেয় ‘I quit’, তাদের অনেকে এই দায়িত্ব নেবার যোগ্যতা অর্জনে আগ্রহীই না।

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive