ডাবল স্ট্যান্ডার্ড
লেখক: ডা. শামসুল আরেফীন
শারঈ নিরীক্ষণ: মুফতি আবু সালেহ মোহাম্মদউল্লাহ
প্রকাশনী: মাকতাবাতুল আযহার
বাংলাদেশের নাস্তিকতাবিরোধী বই বিপ্লবে ডাবল স্ট্যান্ডার্ড সম্ভবত দ্বিতীয় সংযোজন। বইয়ে আলোচিত বিষয়গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো গায়েবে বিশ্বাস নিয়ে আলোচনা; ইসলামের দাসপ্রথা, সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস, দণ্ডবিধি; সংস্কৃতি; তাওহীদের সার্বজনীনতা ইত্যাদি। টিপিক্যাল আস্তিক-নাস্তিক বিতর্ক থেকে একটুখানি সরে এসে স্বতন্ত্র একটি পদ্ধতি অবলম্বন করা এই বইটির অনন্য বৈশিষ্ট্য। লেখক ইসলামী বিধানগুলোর ‘যৌক্তিকতা’ আলোচনার চেয়ে ‘কল্যাণময়তা’র আলোচনাকে প্রাধান্য দিয়েছেন, প্রচলিত অনৈসলামী বিকল্পগুলোর সাথে এগুলোর তুলনা দেখিয়েছেন, এবং নতুন ও অধিক কল্যাণকর বিকল্প সৃষ্টি করার চ্যালেঞ্জ রেখেছেন। ‘যুক্তি’ সংক্রান্ত আলোচনায় ২+২=৪ এর মতো নৈর্ব্যক্তিক উত্তর আশা করা হয়। অথচ মানবজীবন গাণিতিক সমীকরণের মতো সরল নয় যে, অংক কষে কোনো পারিবারিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাষ্ট্রীয় বিধানের ‘যৌক্তিকতা’ বের করে ফেলা যাবে। এ জন্যই একই টপিক আলোচনা করা অন্যান্য বইয়ের চেয়ে ডাবল স্ট্যান্ডার্ড বইটি আমি বেশি সাজেস্ট করবো; বিশেষত দাসপ্রথা, জিযিয়া ও দণ্ডবিধি সংক্রান্ত বিষয়ে।
লেখকের ভাষাশৈলীর কারণে বইটি বিশেষ সুখপাঠ্য হয়েছে। আরোপিত সাহিত্যিকতা ছাড়াই লেখক বইয়ের প্রাঞ্জলতা ধরে রেখেছেন। মলাট ওল্টাতেই চোখে পড়া ‘লেখকচরিত’ থেকে শুরু হয় লেখকের সাহিত্যিক দক্ষতার প্রমাণ। ছোট ছোট বাক্য, সুন্দর শব্দচয়ন, কবিতার চরণ বা গানের কলিকে সাবলীলভাবে গদ্যের মাঝে স্থাপন করা – এসব ক্ষেত্রে লেখকের মুন্সিয়ানার ছাপ রয়েছে। এ ছাড়া অর্ণবের একটি গানকে রি-ইন্টারপ্রেট করে নাস্তিকমানসের অস্থিরতা ব্যাখ্যা করার বিষয়টি খুবই সুন্দর ছিলো। ব্যক্তিগতভাবে আমি সঙ্গীত, কবিতা, প্রবাদ সহ বিভিন্ন জাহিলি ডিসকোর্সের এমন ইসলামিক ডিকন্সট্রাকশান উৎসাহিত করার পক্ষে।
তবে লেখকের গল্প লেখার হাতে অনেক অনেক উন্নতি করার জায়গা রয়েছে। থার্ড পার্সন ন্যারেটর হিসেবে গল্পের ভেতর এত মন্তব্য সংযুক্ত করা গল্পের স্বাভাবিক গতিকে রোধ করে। আস্তিক-নাস্তিক তর্ক সংক্রান্ত গল্পগুলোতে স্বভাবতই বিপুল পরিমাণ তথ্যের মহাসমাবেশ ঘটে। তাই গল্পের ভেতর অনেক কথা জায়গা না হওয়ায় সেগুলো চলে গেছে টীকা বিভাগে, ফলে তার আকৃতিও হয়েছে দৃষ্টিকটু রকমের বড়। ব্র্যাকেট কিংবা বুলেট পয়েন্ট হলো লিখিত প্রবন্ধের বৈশিষ্ট্য। গল্পের সংলাপে এই উপাদানগুলোর অস্তিত্ব শোভনীয় নয়। এই বইয়ের বিভিন্ন গল্পে বিভিন্ন চরিত্র। তাই বিভিন্ন চরিত্রের মুখে একই কথার হুবহু পুনরাবৃত্তি কৃত্রিম শোনাচ্ছিলো, সাজিদ বা ফারিসের ক্ষেত্রে এই ত্রুটি ছিলো না। যেসব গল্পে উদ্ধত নাস্তিক ভিলেন রয়েছে, সেখানে সংলাপগুলো কিছুটা আবু ফুলান-ইবনে ফুলানের গল্পের মতো কার্টুনধর্মী হয়ে গেছে। আবার যেসব গল্পে ভদ্র নাস্তিক রয়েছে, সেখানে তারা এমনভাবে আস্তিক নায়ককে কথা যুগিয়ে দিচ্ছে যে বোঝা যাচ্ছে না কোন বক্তা আস্তিক আর কোন বক্তা নাস্তিক। সায়েন্স ফিকশানের প্রতি আমি খুব কম লেখককেই সুবিচার করতে দেখেছি। অনেকগুলো কাল্পনিক বিষয়কে এক করতে হয় বলে সেগুলোর মাঝে ইন্টেগ্রিটি রক্ষা করা কঠিন। জ্রাকিল, ভ্রিডাল, রিশিনা, জোহেবের মতো এত কাল্পনিক নামের পাশে একটি ‘আব্দুল্লাহ’ নাম বেমানান ঠেকেছে। পুরো বইটি জুড়েই আফসোস হয়েছে লেখক কেন প্রবন্ধ না লিখে গল্প লিখতে গেলেন।
শারঈ কিছু বিষয় পুনর্বিবেচনার দাবি রাখতে পারে। “[জিহাদ] দরকার হলে তো আলেমরাই আগে যেত।” কথাটি বেশি সরলীকৃত, যা বাস্তব পরিস্থিতির অনেক জটিলতাকে অস্বীকার করছে। তাহলে কি ফিলিস্তিন-কাশ্মীর-আরাকানে কোনো আলেমই নেই? নাকি সেখানকার মুক্তিযুদ্ধগুলোর সবই ‘অ-দরকারী’? মদীনা ইসলামী রাষ্ট্রের নামে ‘প্রজাতন্ত্র’ শব্দটির ব্যবহারে একটু খটকা লেগেছে। আধুনিক প্রজাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় তাত্ত্বিকভাবে হলেও কুরআনের বিধানের চেয়ে মানুষের রায় অগ্রগণ্য। এ ছাড়া টাইম ট্র্যাভেল করে অতীতের মানুষদের সাথে যোগাযোগ করে আসাটা, অর্থাৎ অতীতকে একরকম পাল্টে দিয়ে আসাটা ইসলামিক অন্টোলজিতে সংস্থানযোগ্য মনে হয়নি। বিশেষত তাকদীরের ধারণার সাথে এটা একেবারেই যায় না। সত্যজিৎ রায়ের প্রফেসর শঙ্কু চরিত্রের একটি গল্পে এরকম টাইম মেশিনের ধারণা ছিলো, যেখানে মানুষ অতীতে তো যাচ্ছে ঠিকই। কিন্তু বর্তমানের মানুষেরা সেখানে শারীরিকভাবে উপস্থিত হতে পারছে না। একটা অস্পষ্ট পর্দার আড়াল থেকে অতীতে ঘটা ঘটনাগুলো দেখছে, কিন্তু নিজেরা কোনো ঘটনায় অংশগ্রহণ করতে পারছে না। অতীতের মানুষেরাও তাদের দেখতে বা শুনতে পাচ্ছে না। টাইম মেশিন নিয়ে গল্প যদি লিখতেই হয়, তাহলে অন্তত এই সীমার মধ্যে থাকা উচিৎ।
তবে স্টাইলিস্টিক কিছু বিষয় বাদ দিলে ইসলামি বই বসন্তের এই মৌসুমে ডাবল স্ট্যান্ডার্ড হলো সুমিষ্ট এক ফল, যার স্বাদ আস্বাদন করা থেকে নতুন প্রজন্মের মুসলিমদের বঞ্চিত হওয়া ও অমুসলিমদের বঞ্চিত করা ঠিক নয়।
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।