বেডরুমে শুয়ে বই পড়ছিলাম। কিন্তু কিছুতেই বইতে মন দিতে পারছিলাম না। আজ ফাতিমা আমাকে নিয়ে যাবে হেপাটাইটিস বি ভ্যাক্সিন দিতে। ছোটবেলা থেকেই ইঞ্জেকশন দেখলেই জ্বর চলে আসতো। এবারো এসেছে কিনা দেখার জন্য ডান হাত কপালে রাখলাম। নাহ! এবার জ্বর আসেনি। কিন্তু একটু ঠাণ্ডা লেগেছে। তাই বারবার নাক টানতে হচ্ছে। আজীবন ভ্যাক্সিন দেবার সময় বাড়ি থেকে পালিয়েছি। কিন্তু এখন তো পালানোর বয়সও নেই। ওদিকে ড্রয়িং রুম থেকে খুব হাসাহাসির শব্দ শোনা যাচ্ছিলো। কাজিনরা এসেছে বাসায়। বিছানা থেকে উঠে দেখতে গেলাম ওরা কীসের জন্য এত হাসাহাসি করছে। ড্রয়িং রুমে গিয়ে দেখি বড়দের মধ্যে আছে ফাতিমা, নাবিলা, প্রাচী। আর ছোটদের মধ্যে আছে পারশিয়া, অরিশা, জান্নাত, রুহি। ফাতিমা আর নাবিলা ছোটদের নিয়ে মজা করছে। আর প্রাচী একপাশে বসে মোবাইল টিপছে। আর মাঝে মাঝে আড়চোখে ওদের দিকে দিকে তাকাচ্ছে। আমি গিয়ে সোফায় বসলাম। তারপর প্রাচীকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কীরে? সবাই মজা করছে। আর তুই এক কোণায় বসে মোবাইল টিপছিস কেন? যন্ত্র হয়ে গিয়েছিস নাকি?”

প্রাচী উত্তর দিলো, “আগে বলো, তোমার এই অবস্থা কেন।”

IIRT Arabic Intensive

-“কী অবস্থা?”

-“এই যে চোখ লাল। বারবার নাক টানছো যে!”

-“ও হ্যাঁ, আজ হেপাটাইটিস বি ভ্যাক্সিন দিতে যাবো।”

-“ও! এজন্য ভয়ে এই অবস্থা। হা হা। মামী প্রায়ই বলে সুঁই দেখলে তোমার বারোটা বেজে যায়!”

ফাতিমাকে দেখলাম আমার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে। হাতি কাদায় পরলে ব্যাঙও লাথি মারে। এখন আমার সেই অবস্থা। হাত নাকে রেখে এক টান দিতেই প্রাচী বললো, “আচ্ছা ভাইয়া, ভ্যাক্সিন দেবার কী দরকার? তোমাদের ধর্মে তো ভ্যাক্সিন দেওয়াই নিষেধ। তাহলে নাকি ভাগ্যের উপর বিশ্বাস উঠে যায়! আর মোহাম্মদ তো বিশ্বাসই করতো না যে, রোগ সংক্রামক হতে পারে। সে বলেছে যে, সংক্রামক রোগ বলতে নাকি কিছু নেই। মোহাম্মদ প্রায়ই এমন আজগুবি কথা বলতো। আর তোমরা তার বোকা ফলোয়ার!”

আমি বললাম, “ধর্ম নিয়ে খোঁটা মারার অভ্যাস তোর গেলো না। এটা ভালোভাবেও তো বলা যায়। নাকি? যা-ই হোক, তাহলে তো আমি বেঁচেই গেলাম। ওহ! এখনি সুস্থ হয়ে গিয়েছি মনে হচ্ছে। সুখবর দেওয়ার জন্য চকলেট খেয়ে নিস। কিন্তু তোর একটি কথায় খটকা লাগছে। সংক্রামক রোগ তো আছে। কিন্তু তুই বলছিস যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ এটি অস্বীকার করেছেন! রাসূলুল্লাহ’র ﷺ এমন কথা বলার তো কথা না! আচ্ছা, হাদীসটা কি সহিহ?”

“কেন? কোনো সন্দেহ? আচ্ছা ফাতিমা, তুমিই বলো তো এই হাদীস সহি না?” প্রাচী প্রশ্ন করলো।

-“হাদীস তো সহিহ। কিন্তু তোমার ইন্টারপ্রিটেশান সহিহ নয়।”

-“মানে?”

-“মানে হলো, এই হাদীস থেকে তুমি যে ফতোয়া দিলে, সেটা ঠিক নয়। ইসলামে ভ্যাক্সিন দেওয়া হারাম – এটা তোমাকে কে বলেছে?”

-“আমি পড়েছি।”

-“সেটা তো বুঝেছি। তো কোন ব্লগে পড়েছো?”

প্রাচী আর কোনো কথা বলছে না। একবার ফাতিমার দিকে আরেকবার আমার দিকে তাকাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর প্রাচী উত্তর না দেওয়ায় ফাতিমা নিজ থেকেই বললো,

“ইসলামে ভ্যাক্সিনেশন হারাম নয়, যদি ভ্যাক্সিনে হারাম কিছু না থাকে। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, কুষ্ঠ রোগী থেকে সেভাবে পালাও, যেভাবে তোমরা সিংহ দেখলে পালাও।[১] তিনি আরো বলেন, যদি কেউ প্রতিদিন সকালে আযওয়া বা মদিনার খেজুর খায়, তাহলে রাত পর্যন্ত কোনো বিষক্রিয়া বা যাদু তার উপর কাজ করবে না।[২] এটাও তো এক ধরনের প্রতিরোধ। কারণ, রোগ হবার আগেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। সুতরাং, এই হাদীসগুলো থেকেই বোঝা যায়, রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেবার অনুমতি ইসলামে আছে। ইবনুল কায়্যিম (রহঃ) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করার অনুমতি দিয়েছেন।[৩] হ্যাঁ, তবে যদি ভ্যাক্সিনে হারাম কিছু থাকে তাহলে সেটা হারাম। কিন্তু যদি কোনো হালাল ভ্যাক্সিন পাওয়া না যায়, এবং সেই ভ্যাক্সিন না নিলে বিরাট ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে, তখন ভ্যাক্সিনে হারাম জিনিস থাকলেও একজন মুসলিম দ্বীনদার ডাক্তারের সাথে পরামর্শ সাপেক্ষে সেটা ব্যবহারের অনুমতি আছে।[৪] সুতরাং, যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই, সে বিষয়ে চুপ থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ।”

প্রাচীর কথা শুনে অন্তরে যে প্রশান্তি এসেছিলো, সেটা এখন আর নেই! তাহলে আমাকে ভ্যাক্সিন দিতেই হবে! চিন্তা বাদ দিয়ে এখন বিতর্কে মনোযোগ দিলাম। প্রাচীও চুপ থাকার মেয়ে নয়। সাথে সাথেই পাল্টা প্রশ্ন করলো, “সেটা নাহয় হলো। কিন্তু সংক্রামক রোগ তো আছে। পৃথিবীতে প্রচুর সংক্রামক ব্যাধি রয়েছে, যা গুনে শেষ করা যাবে না। কিন্তু মোহাম্মদ বলেছে, সংক্রামক রোগ নেই! এবার কি বলবে যে, সব ডাক্তাররা ভুল বলেন?”

ফাতিমা বললো, “না, আমি বলবো না যে ডাক্তাররা ভুল বলে। কিন্তু এটাও সত্য যে আল্লাহ্‌র রাসূলও ﷺ ভুল বলেননি।”

ফাতিমার কথা আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। এ কেমন কথা? হয় সংক্রামক রোগ আছে, অথবা নেই। দুটি কথার একটি ঠিক। পরস্পর দুটি বিপরীতমুখী কথা তো একই সাথে ঠিক হতে পারে না। তাই প্রশ্ন করবো, ঠিক এমন সময় প্রাচী বললো, “ভাইয়া, ভাবীর মাথা মনে হয় গিয়েছে! কী বলছে নিজেই বুঝছে না। সংক্রামক রোগ নেই, আবার আছে – দুটিই নাকি সঠিক। হা হা।”

“আচ্ছা প্রাচী তুমি তো ইন্টারমেডিয়েটে হাজার বছর ধরে উপন্যাস পড়েছো। তাই না?” প্রাচীর কথায় কান না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো ফাতিমা।

-“হ্যাঁ, পড়েছি।”

-“সেখানে ওলা বিবি, যক্ষ্মা বিবি, কলেরা বিবি ইত্যাদি দেব-দেবী সম্পর্কে কিছু তোমার মনে আছে?”

-“হ্যাঁ, মনে আছে।”

-“কী কী মনে আছে? একটু বলো তো।”

-“প্রাচীনকালে কুসংস্কারপূর্ণ গ্রামগুলোতে,কলেরা, বসন্ত, যক্ষ্মা ইত্যাদি রোগকে বিভিন্ন দেব-দেবী বা খারাপ কোনো কিছুর দৃষ্টিপাত হিসেবে মনে করা হতো। সঠিক চিকিৎসা না থাকায় ঐ সময়ে বিভিন্ন পানি বাহিত রোগ মহামারি আকারে দেখা দিতো। আর মূর্খ গ্রামবাসী মনে করতো,ওলা বিবি, যক্ষ্মা বিবি,বা ওই টাইপের কোনো কিছুর নজর লেগেছে।”

-“যাক, ভালোই মনে আছে তোমার।”

আমিও প্রাচীর সাথে একমত। প্রাচীনকালের অধিকাংশ মানুষ এমন কুসংস্কারে লিপ্ত ছিলো। কিন্তু প্রাচীর প্রশ্নের সাথে এর সম্পর্ক কী – সেটা মাথায় এলো না। উৎসুক মনে ফাতিমাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কিন্তু ওলা বিবির সাথে সংক্রামক ব্যাধির কী সম্পর্ক?”

ফাতিমা বললো, “সম্পর্ক না থাকলে তো আর আমি জিজ্ঞাসা করতাম না! শোনো, রাসূলের ﷺ আগমনের আগে প্রাচীন আরব ছিলো কুসংস্কারপূর্ণ। তারা বিশ্বাস করতো যে, রোগ-ব্যাধি ওদের কিছু দেব-দেবীর তৈরি এবং অন্যের দেহে রোগ ব্যাধি ছড়ানোর মতো নিজস্ব ক্ষমতা তাদের আছে। এবং, এভাবে কলেরা বা অন্য কিছু হলে তারা মনে করতো যে, তার কাছে গেলেই সবাই সেই রোগে আক্রান্ত হবে। তাদের মধ্যে সংক্রামক ব্যাধি সম্পর্কে এমন ভ্রান্ত ধারণা ছিলো। রাসূলুল্লাহ তাদের সেই ভ্রান্ত ধারণা উৎখাত করতেই বলেছেন, ‘সংক্রামক ব্যাধি বলতে কিছু নেই’।[৫] বুঝেছো?”

প্রাচী এমন একটি ভাব করলো, যেন ফাতিমা ওকে ভুলভাল বুঝাচ্ছে। তাচ্ছিল্যের স্বরে বললো, “নাহ, বুঝিনাই। সংক্রামক রোগ আছে তো। সেটা দেব-দেবীর কারণে না হোক, ব্যাক্টেরিয়া বা ভাইরাস দিয়ে তো হয়। তাহলে কি তোমার যুক্তি খাটলো?”

-“এটা বুঝতে হলে তোমাকে আগে তাহলে রোগ-ব্যাধি সম্পর্কে ইসলামী আক্বিদা বা বিশ্বাস কেমন সেটা জানতে হবে।”

-“বলো, শুনে দেখি।”

আমাদের কথাবার্তায় নাবিলার সমস্যা হচ্ছিলো মনে হয়। তাই বাচ্চাদের নিয়ে আস্তে সেখান থেকে উঠে অন্য রুমে চলে গেলো। এখন আমি, ফাতিমা আর প্রাচী ছাড়া ড্রয়িং রুমে কেউ নেই। বিতর্ক ভালোই জমেছে। যুক্তির বিপরীতে পাল্টা যুক্তি চলছে। ফাতিমা আস্তে করে গলা ঝেড়ে নিয়ে বলা শুরু করলো,

“বিজ্ঞানের ভাষায় যেকোনো রোগ সাধারণত তিনটি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত ফ্যাক্টরের কারণে হয়। জীবাণু, আশেপাশের পরিবেশ এবং যার রোগ হবে সেই প্রাণীর রোগাক্রান্ত হবার উপযোগিতা। এই তিন জিনিসের সমন্বিত ক্রিয়ায় রোগের উদ্ভব হয়।[৬] কিন্তু ইসলাম এসব বিষয়ের সাথে একটি শর্ত জুড়ে দিয়েছে। আর সেটি হলো, আল্লাহ্‌র হুকুম বা ইচ্ছা বা সৃষ্টি। অর্থাৎ, কোনো রোগ তখনই কোনো জীবে প্রকাশ পাবে, যখন আল্লাহ তা’আলা ঐ জীবে রোগ সৃষ্টি করবেন। এছাড়াও এর সাথে যেকোনো জাগতিক জিনিসের সংযুক্তি থাকাকে ইসলাম অস্বীকার করে না। যেমন ধরো, রোগ সৃষ্টিতে ব্যাক্টেরিয়া, ভাইরাসের কিংবা পরিবেশের অবদান। এগুলো সব উসিলা বা উপাদান মাত্র। কারণ আল্লাহ তা’আলা পৃথিবীতে একটি নিয়ম তৈরি করেছেন। তাই সব কিছু নিয়মের মধ্যেই চলবে। কিন্তু সেটা আল্লাহ্‌র ইচ্ছায়। সুতরাং, সংক্রামক ব্যাধি সম্পর্কেও ইসলাম একই আক্বিদা রাখার নির্দেশ দেয়। আর সেটি হলো, আল্লাহ তা’আলা এগুলোর মধ্যে সংক্রমণের নিয়ম রেখেছেন। কিন্তু আল্লাহ তা’আলা রোগ সৃষ্টি করলেই রোগ সংক্রমিত হবে, নতুবা নয়।[৭] এ ব্যপারটি সংক্রামক রোগ সম্পর্কিত আরও কিছু হাদীস থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়।”

আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি চারটা দশ বাজে। বাঁকা চোখে ফাতিমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “কী সেই হাদীস? একটু বলো তো শুনি।”

ফাতিমা চুপ করে থাকলো। মনে হয়, হাদীসগুলো মনে আসছিলো না। কিছুক্ষণ পরে বললো, “হুম, মনে পড়েছে। একদিন এক বেদুঈন বললো, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমার উটের পাল অনেক সময় মরুভূমির চারণ ভূমিতে থাকে, মনে হয় যেন নাদুস-নুদুস জংলী হরিণ। তারপর সেখানে কোনো একটি চর্মরোগ আক্রান্ত উট এসে আমার সুস্থ উটগুলোর সাথে থেকে এদেরকেও চর্মরোগী বানিয়ে দেয়।’ তিনি ﷺ বললেন, ‘প্রথম উটটির রোগ সৃষ্টি করলো কে?’[৮] এখান থেকেই বোঝা যায় যে, এসব রোগের সৃষ্টিকে তিনি আল্লাহ তা’আলার ইচ্ছার বা সৃষ্টির সাথে সম্পর্কযুক্ত করেছেন। আবার অন্য একটি হাদীসে আছে, ‘রোগাক্রান্ত উটকে যেন সুস্থ উটের সাথে একত্রে পানি পানের জায়গায় না আনা হয়।’[৯] তাহলে এখান থেকেও বোঝা যাচ্ছে যে, রোগ সংক্রমণের বাস্তবতাকে রাসূলুল্লাহও ﷺ অস্বীকার করেননি।”

আমার বুঝতে কিছু সমস্যা হচ্ছিলো। সমীকরণ ঠিক মেলাতে পারছিলাম না। উৎসুক কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলাম, “আবার একটু ক্লিয়ার করে বলো তো। আমার কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।”

ফাতিমা হেসে দিয়ে বললো, “আচ্ছা, ক্লিয়ার করে বলছি। এসমস্ত বাহ্যিক কারণকে ইসলামের পরিভাষায় ‘আসবাব’ বলা হয়। সকল রকম ‘আসবাব’ বা ‘কারণ’ আল্লাহ তা’আলাই সৃষ্টি করেছেন এবং এসব দিয়ে যে সমস্ত জিনিস ঘটবে, সেটাও আল্লাহ তা’আলা সৃষ্টি করলেই সৃষ্টি হতে পারে নতুবা নয়। এজন্য আল্লাহ তা’আলাকে ‘মুসাব্বিবুল আসবাব’ বা ‘সকল কারণের সৃষ্টিকর্তা’ বলা হয়। সুতরাং, সাধারণ রোগ বলো, আর সংক্রামক রোগ বলো; সবকিছুই আল্লাহ তা’আলার সৃষ্টির কারণেই হয়। এখানে কোনো আসবাব বা কারণের প্রভাব থাকা অথবা না থাকা, আল্লাহ তা’আলার রোগ সৃষ্টির ইচ্ছার সাথে সাংঘর্ষিক নয়। এজন্যই দেখো, আমরা যেগুলোকে সংক্রামক রোগ বলে জানি, সেসব রোগীর সংস্পর্শে কোনো সুস্থ লোক গেলেই কিন্তু সবসময় সে আক্রান্ত হয় না। সুতরাং, সংক্রামক রোগে আক্রান্ত রোগীর কাছে গেলে ঐ ব্যক্তি আক্রান্ত হলেও হতে পারে, আবার না-ও হতে পারে। রোগীর কাছ থেকে সুস্থ ব্যক্তিতে জীবাণু আসতেও পারে, কিংবা না-ও আসতে পারে। জীবাণু আসলেও সেটা রোগ সৃষ্টি করবে কি না – সেটা আল্লাহ তা’আলার ইচ্ছা বা সৃষ্টির উপর নির্ভর করবে।[১০] এবার বুঝেছো?”

ফাতিমার উত্তরে আমি আশ্বস্ত হলেও প্রাচী আশ্বস্ত হতে পারলো না। ফাতিমার উত্তরে প্রাচী হো হো করে হাসা শুরু করলো। তারপর বললো, “ফাতিমা, তুমি কি শাক দিয়ে মাছ ঢাকবে? জীবাণু ঢুকে রোগ হওয়া বা না হওয়ার কারণ হলো, আমাদের দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। এর সাথে স্রষ্টার ইচ্ছার সম্পর্ক কী?”

ফাতিমা বিরক্তির সুরে বললো, “প্রাচী, সহজ জিনিস বুঝতে তোমাদের এত সমস্যা কেন হয়, আমি বুঝি না। দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও তো আল্লাহ তা’আলার সৃষ্টি। সুতরাং, এটিও একটি ‘আসবাব’ অর্থাৎ, কারণ। সুতরাং, জীবাণু সংক্রমণের পরে আমাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থার কার্যক্রমের প্রভাব থাকাকে বিশ্বাস করাও ইসলামী আক্বিদার সাথে সাংঘর্ষিক নয়। কিন্তু প্রতিরোধ ব্যবস্থা প্রতিরোধ করতে সক্ষম হবে কি হবে না, সেটা আল্লাহ তা’আলার ইচ্ছা বা হুকুমের উপর নির্ভর করে। এটাই আমাদের আক্বিদা বা বিশ্বাস। আশা করি, আর কোনো প্রশ্ন নেই তোমার।”

প্রাচী মুখ কালো করে বসে আছে। কিছুক্ষণ ভেবে আবার প্রশ্ন করলো, “তাহলে যারা আল্লাকে বিশ্বাস করে না, তাদের ক্ষেত্রে কী হবে?”

ফাতিমা উত্তর দিতে চাইলে আমি থামিয়ে দিলাম। কারণ এটার উত্তর আমিই দিতে পারবো। বুক টান টান করে বললাম, “শোন প্রাচী, পৃথিবীর সমস্ত সৃষ্টিই আল্লাহ তা’আলার তৈরি। আর আল্লাহ তা’আলার ইচ্ছা ছাড়া কিছুই হয় না।[১১] সুতরাং, নন-মুসলিমদের ক্ষেত্রেও একই সিস্টেম, যদিও তারা আল্লাহ তা’আলাকে অস্বীকার করে। বুঝেছিস?”

পাশে রাখা মোবাইলটি হাতে নিয়ে সোফা থেকে উঠে চলে গেলো প্রাচী। যাওয়ার সময় বলে গেলো, “আমি আজ তোমাদের বাসায় থাকবো। কাল তোমার সাথে আবার কথা হবে।”

“আচ্ছা, ঠিকাছে। আফসোস হয় এদের জন্য! নিজের দুর্বলতা এরা কখনো স্বীকার করবে না!” বলেই ঘড়ির দিকে তাকালো ফাতিমা। ঘড়িতে তখন সাড়ে চারটা বাজে। ভ্যাক্সিন দিতে যাবার কথা ছিলো তিনটা থেকে চারটার মধ্যে। ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ফাতিমা বললো, “এই, ভ্যাক্সিন দিতে যাবার কথা ছিলো না? তোমার খেয়াল ছিলো না? সময়মতো বলতে পারলে না?”

আমি বললাম, “আমার কী দোষ? আমি তো তোমাদের বিতর্ক শুনছিলাম। তুমি তো লেকচার শুরু করলে আর শেষ হয় না। এখন কী হবে?”

“দেখি, তাদের ফোন দেই। সামনের সপ্তাহে ভ্যাক্সিনেশানের ব্যবস্থা করতে পারে কি না।” বলে উঠে চলে গেলো ফাতিমা।

আহ! অন্তত এক সপ্তাহ তো নিশ্চিন্তে থাকা গেলো। সাধে কি আর ভালোভাবে বোঝার পরেও এতক্ষণ প্যাঁচাই? হা হা হা।


[ইসলামিক শরী’য়াহ অনুযায়ী কোনো মুসলিমের জন্য তার ফুফাতো বোন এবং কোনো মুসলিমাহ’র জন্য তার ফুফাতো ভাই মাহরাম নয়। এদের প্রত্যেকের সাথে প্রত্যেকের পর্দা করা ফরজ। এবং কথা বলার সময় হিজাব মেইন্টেইন করা জরুরী। এখানে এগুলো কিছুই হয়নি। এক্ষেত্রেও গল্পটি শুধুমাত্র একটি গল্প হিসেবেই পড়ার অনুরোধ রইলো। সমস্ত জ্ঞান তো আল্লাহ তা’আলার কাছেই। লেখাটিতে যা কিছু ভুল, তা আমার ও শয়তানের পক্ষ হতে এবং যা কিছু কল্যাণ, তার সবটুকুই আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে।]

তথ্যসূত্র এবং গ্রন্থাবলি

[১] Sahih al-Bukhari (Dar As-Salam Publication); Hadith No: 5707

[২] Fath Al-Baari (Explannation of Sahih Bukhari); Part: 10; Page: 249

[৩] http://www.islamweb.net/en/article/154489/

[৪] https://islamqa.info/en/20276

[৫] Umdat al-Qari (Explannation of Sahih Bukhari); Part: 04; Page: 289

[৬] https://www.apsnet.org/edcenter/instcomm/TeachingArticles/Pages/DiseaseTriangle.aspx

[৭] ইসলামী আকিদা ও ভ্রান্ত মতবাদ (মাওলানা মুহাম্মদ হেমায়েত উদ্দিন); অধ্যায়: রোগ সংক্রামণ সম্পর্কে আকিদা; পৃষ্ঠা: ১৭৮-১৮১

[৮] সুনানে আবু দাউদ; অধ্যায়: ভবিষ্যৎ কথন ও কুলক্ষন-সুলক্ষণ; হাদীস নং- ৩৯১১ (ihadis.com)

[৯] সুনানে আবু দাউদ; অধ্যায়: ভবিষ্যৎ কথন ও কুলক্ষন-সুলক্ষণ; হাদীস নং- ৩৯১১ (ihadis.com)

[১০] সহিহ বুখারি (বাংলা অর্থ এবং ব্যাখ্যা: মাওলানা আজিজুল হক); ১৩ম সংস্করণ; হামিদিয়া লাইব্রেরী লিমিটেড; খণ্ড: ০৬; পৃষ্ঠা: ২২৩-২২৬

[১১] Surah Tawba, Verse- 51; Surah Hadid, Verse- 23 22

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive