ফাতিমাকে নিয়ে গিয়েছিলাম রেস্টুরেন্টে। অনেকদিন বাইরে খাওয়া হয় না। তাই ভাবলাম একটু পেটকে সান্ত্বনা দিয়ে আসি। আমি কোথাও খেতে গেলে বোনটাকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। আমার একমাত্র ছোটবোন নাবিলা। ওকে রেখে খেতে ইচ্ছা করে না। ক্লাসে আর টিচারের কাছে যাওয়া ছাড়া বাড়ির বাইরে ও তেমন কোথাও যায় না। তাই আমি আমার সাথে মাঝে মাঝে ওকে এদিক সেদিক নিয়ে যাই। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। নাবিলাকে আর ফাতিমাকে রেডি হতে বলে আমি গাড়ি বের করতে নিচে নেমে গেলাম। গাড়ি বের করে ওদের জন্য ওয়েট করতে লাগলাম।
কিছুক্ষণ পরে ওরা নেমে এলো। আমি ওদের গাড়িতে উঠিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “কোথায় খেতে চাও তোমরা?”
নাবিলা উত্তর দিলো, “ভাইয়া, লেক টেরান্সে চলো। ওখানের কম্বো আমার খুব পছন্দের!”
আমি ফাতিমাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “তোমার মত কী?”
“ওখানেই চলো। নাবিলার প্রিয় কম্বো আমিও খেয়ে দেখি কেমন লাগে।” ফাতিমা উত্তর দিলো।
সন্ধ্যায় রাস্তায় প্রচুর জ্যাম থাকে। গাড়ি চালানোই তখন কষ্টকর হয়ে যায়। তবুও অনেক কষ্টে গিয়ে পৌঁছলাম। আর যা-ই হোক, উত্তরায় রেস্টুরেন্টগুলোর মধ্যে লেক টেরান্সের পরিবেশ তুলনামূলক সুন্দর। গাড়ি রেখে ভিতরে গিয়ে একটি টেবিলে ৩ জন বসলাম। অর্ডার সব নাবিলা আর ফাতিমা দিলো। আমি শুধু ফালুদা অ্যাড করলাম। অর্ডার দিয়ে সামনে তাকাতেই দেখি একটি ছেলে আমার দিকে চোখ বড় করে তাকিয়ে আছে। আমি প্রথম দেখাতেই চিনে ফেললাম। ওর নাম সানিন। বিদেশে পড়তে যাবার আগে ওর সাথেই দিনের বেশিরভাগ সময় থাকতাম। আমার হৃদয়ে সংশয়ের যে বীজ আমি বুনেছিলাম, সেটার কিছুটা ওর জন্যেই। ঈমান আনার পরে ওর সাথে আমার চলাফেরা কম হয়। প্রায় ৫ মাস আগে একটি প্রোগ্রামে দেখা হয়েছিল। তারপরে আর যোগাযোগ হয়নি। কিন্তু দেখা হলেই সানিন আমাকে বিভিন্নভাবে খোঁটা মারে। তাই ফাতিমার সামনে ওর সাথে কথা বলতেও ইচ্ছা হলো না। এজন্য আমি চোখ নামিয়ে নাবিলা আর ফাতিমার সাথে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলতে লাগলাম।
আমি ভেবেছিলাম দাড়ি রেখে এখন তো আমার চেহারায় কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। হয়তো সানিন আমাকে না-ও চিনতে পারে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে সানিন আমাদের টেবিলের পাশে এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, “কীরে আদনান, দেখেও না দেখার ভান করলি?”
আমি তো পড়লাম বিপদে! উত্তর দিলাম, “তুই কি মাইন্ড রিডার নাকি?”
সানিন বললো, “না, তা-ই মনে হলো।”
আমি বললাম, “তোর মনে হলে আমার কী করার? যা-ই হোক, বোস!”
সানিন বললো, “হ্যাঁ, বসতেই তো এসেছি।”
সানিন আমার পাশে এসে বসলো। আমি বললাম, “তোদের পার্টি আছে মনে হয়। তাই না?”
“হ্যাঁ। আসিফের জন্মদিন। তাই ও আমাদের ট্রিট দিচ্ছে। আর আমরা আমাদের পক্ষ থেকে কেক কাটবো। এই আরকি!” উত্তর দিলো সানিন।
আমি ফাতিমা আর নাবিলার সাথে ওকে পরিচয় করিয়ে দিলাম। ওরা চুপ করে শুনলো কিন্তু কোনো কথা বললো না। সানিন জিজ্ঞাসা করলো, “কেমন আছো তোমরা?”
নাবিলা উত্তর দিলো, “আলহামদুলিল্লাহ্। ভালো আছি, ভাইয়া।”
সানিন বললো, “হ্যাঁ, ভালো থাকলেই ভালো। পৃথিবীর সকল মানুষ ভালো থাকুক। সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।”
তারপরে সানিন আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “আদনান, তোর নানা বাড়ি তো আমাদের বাসার প্রায় পাশেই। আম্মুর কাছে শুনলাম তোর নানাকে নাকি ক্যান্সারের ট্রিটমেন্টের জন্যে লন্ডন নিয়ে গিয়েছে? কয়েকদিন আগে তো শুনলাম হার্টে রিং বসিয়েছিলো। তো এখন কী অবস্থা তার?
আমি বললাম, “হ্যাঁ, মামারা নিয়ে গিয়েছেন। আছে ভালোই, আলহামদুলিল্লাহ্। ট্রিটমেন্ট হিসেবে কেমোথেরাপি দিচ্ছে। দেখা যাক, কী হয়!”
“সানিন ভাই, কেক তো এনেছো। কিন্তু কেক কাটার জন্য ছুরি তো নিয়ে আসোনাই। এখন কেক কাটবে কী দিয়ে?” সামনের টেবিল থেকে একটি ছেলে এসে সানিনকে বললো।
সানিন পিছনের দিকে ফিরে উত্তর দিলো, “আরে এটার জন্যও আমার কাছে আসা লাগে? যা, নিচে গিয়ে নিলুর দোকান থেকে আমার কথা বলে নিয়ে আয়।”
ছেলেটি বললো, “ভাই, নিলুর দোকানে এমনি ছুরি আছে। কিন্তু কেকের জন্য স্পেশাল ছুরি নেই।”
সানিন বললো, “তুই আগে যাবি তো! তাই না? নিলুর দোকানে সবকিছু পাওয়া যায়।”
সানিনের কথা শুনে ছেলেটি চলে গেলো। তারপরে সানিন আবার আমার দিকে ফিরে বসলো। তারপর জিজ্ঞাসা করলো, “আদনান, কী যেন বলছিলাম?”
আমি উত্তর দিলাম, “আমার নানার অসুস্থতার কথা জিজ্ঞাসা করেছিলি!”
সানিন ব্যাঙ্গ করে বললো, “ও হ্যাঁ। তো এতগুলো টাকা খরচ করে লন্ডন নিয়ে গেলি কেন? ঘরে বসিয়ে কালোজিরা খাওয়ালেই তো হতো। তাহলেই তো সব রোগ ভালো হয়ে যেত!”
সানিনের কথা শুনে আমার এত রাগ হলো যে, মুখে উষ্ণতা অনুভব করছিলাম। আমি ওর এখানে আসাতেই ধারণা করেছিলাম যে, আজও নিশ্চয়ই কোনো বিষয়ে খোঁটা দিবে। আমি বললাম, “বুঝলাম না। কী বলতে চাচ্ছিস তুই?”
সানিন বললো, “আরে রাগছিস কেন? তোরাই তো তোদের নবীর সুন্নত মানিস। মোহাম্মাদ তো বলেছেই যে, কালোজিরা মৃত্যু ব্যতীত সকল রোগের ঔষধ। তোর নানার যেহেতু ক্যান্সার এবং সাথে হার্টের রোগ আছে, সেহেতু কালোজিরা খেলেই তো আর কোনো চিকিৎসার দরকার হয় না।”
আমি বললাম, “ইসলাম তো চিকিৎসা করাতে নিষেধ করে না। বরং আরও উদ্বুদ্ধ করে। আধুনিক চিকিৎসা করাতেও নিষেধ নেই।[১] তাহলে ক্যান্সারের চিকিৎসা করাতে কী সমস্যা?”
সানিন বললো, “আহা! আমি তো চিকিৎসা করাতে নিষেধ করিনি। আমি কালোজিরা দিয়ে চিকিৎসা করাতে বলেছি। ডাক্তারের কাছে গেলে ডাক্তার ঔষধই দিবে। কালোজিরা যেহেতু সকল রোগের ঔষধ, তাই কালোজিরাতেও ক্যান্সার ঠিক হবার কথা। তাই না? হা হা। আমি এখন এখানে মোহাম্মদের ভুলগুলো বলছি। মনোযোগ দিয়ে শোন। কিছু বিপরীতধর্মী রোগ আছে। যেমন, উচ্চ-রক্তচাপ এবং নিম্ন-রক্তচাপ। এরা একে অপরের বিপরীত অবস্থা। উচ্চ-রক্তচাপে এমন ঔষধ দেওয়া হয় যা ব্লাড প্রেশার কমায়। এদের বলা হয় অ্যান্টি-হাইপারটেনসিভ ড্রাগ। উল্টোদিকে নিম্ন-রক্তচাপে এমন ঔষধ দেওয়া হয় যা ব্লাড প্রেশার বাড়ায়। এদের বলা হয় অ্যান্টি-হাইপোটেনসিভ ড্রাগ। উচ্চ-রক্তচাপ আছে, এমন ব্যক্তিকে যদি অ্যান্টি-হাইপোটেনসিভ ড্রাগ দেওয়া হয়, তাহলে তার প্রেশার আরও বৃদ্ধি পেয়ে হাইপারটেনসিভ ক্রাইসিসে ভুগবে। একইভাবে নিম্ন-রক্তচাপ আছে, এমন ব্যক্তিকে যদি অ্যান্টি-হাইপারটেনসিভ ড্রাগ দেওয়া হয়, তবে তার প্রেশার ক্রমশ নেমে Shock-এ চলে যেতে পারে। এভাবে ডায়রিয়া-কোষ্ঠকাঠিন্য, হাইপোথাইরয়ডিজম-হাইপারথাইরয়ডিজম ইত্যাদি সহ পরস্পর বিপরীতধর্মী সকল অসুখের ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য। সুতরাং, একই ঔষধ কখনো পরস্পর বিপরীতধর্মী উভয় অসুখে ব্যবহার করা যাবে না। এই সূত্র অনুযায়ী, কালোজিরাসহ যেকোনো কিছুই একই সাথে পরস্পর বিপরীতধর্মী দুটো অসুখে ব্যবহার করা যাবে না। সুতরাং ‘মৃত্যু ব্যতীত সকল রোগের ঔষধ কালোজিরা’ – নবী মোহাম্মদের এমন দাবি সম্পূর্ণই ভুয়া।”
ফাতিমা আমাকে বললো, “আদনান, আমি কি এই ব্যাপারে কিছু বলতে পারি?”
আমি বললাম, “অবশ্যই পারো। আমি আর কী বলবো? তুমিই বলো।”
ফাতিমা সানিনকে জিজ্ঞাসা করলো, “আচ্ছা ভাইয়া, আপনি একটু আগে একটা ছেলেকে কেকের জন্য ছুরি কেনার জন্য নিচে একটি দোকানে পাঠাতে গিয়ে বলেছেন – ‘ঐ দোকানে সব কিছু পাওয়া যায়।’ তাই না?
“হ্যাঁ, বলেছি।” সানিন উত্তর দিলো।
ফাতিমা বললো, “আমি যদি এই দোকানে স্ট্রবেরি কিনতে যাই, তাহলে কি পাবো?”
“না। কারণ, এটা মুদি দোকান। এখানে প্রায় অনেক কিছুই পাওয়া যায়। কিন্তু স্ট্রবেরি তো রেয়ার ফল। তাই পাবে না। কিন্তু আপেল, কমলা, আঙুর সহ আরও কিছু ফল পেতে পারো। কেন? কিনবে নাকি? কিনলে বলো। আমি কম দামে এনে দিতে পারবো।” সানিনের উত্তর।
ফাতিমা হেসে দিয়ে বললো, “না, কিনবো না। ধন্যবাদ। কিন্তু তাহলে ভাইয়া, আপনি একটু আগে কেন বললেন যে, ঐ দোকানে সব কিছু পাওয়া যায়?”
“নীলুর দোকানে হরেক রকমের জিনিস পাওয়া যায়। এটা বোঝাতেই তখন বলেছি যে, ওর দোকানে সব পাওয়া যায়। কিন্তু এই কথাকে এভাবে ধরে বসার কারণ কী?” সানিন উত্তর দিলো।
ফাতিমা বললো, “ধরার কারণ আছে। আচ্ছা আপনি কি কখনো হকারের কাছ থেকে লাল লাল ট্যাবলেট কিনেছেন? যেটা ওরা সব রোগের ঔষধ বলে বিক্রি করে!”
সানিন বললো, “হ্যাঁ, ডাক্তারের কাছে যাওয়ার থেকে ওদের থেকে ঔষধ নিলেই ভালো। ভিজিটও লাগে না। আর ঐ ট্যাবলেট খেলেই সর্দি, কাশি, মাথাব্যথা সব জাদুর মতো ঠিক হয়ে যায়।”
আমি সানিনের কথায় হেসে দিলাম। এমন মানুষ এখনো ঢাকা শহরে বাস করে যে, হকার থেকে ঔষধ নিয়ে খায় – এটা মানতে কষ্ট হচ্ছিলো।
ফাতিমাও হেসে দিয়ে বললো, “হ্যাঁ, একদিক থেকে ভালোই হয়। ডাক্তারের ভিজিট লাগে না। কিন্তু অন্যদিকে দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে আপনার দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যায়। আমাদের শরীরে যখন কোনো জীবাণু প্রবেশ করে, তখন আমাদের দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সেটাকে ধ্বংস করার চেষ্টা করে। তখন সর্দি, কাশি বা জ্বর আসতে পারে। আপনি যে লাল ট্যাবলেটগুলো মেডিসিন হিসেবে ব্যবহার করেন, সেগুলোতে স্টেরয়েড নামক একটি পদার্থ থাকে। এটি আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বিভিন্ন ঘটনাগুলো বন্ধ করে দেয়। এজন্য আপনার সর্দি, কাশি হয় না। আর এটি ব্যথা সৃষ্টিকারী একটি কেমিক্যাল বা প্রোস্টাগ্লান্ডিনের উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। এজন্য আপনি ব্যথাও অনুভব করেন না। জীবাণুর প্রতি আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার এমন প্রতিক্রিয়ার কারণে অনেক উপসর্গ দেখা দেয়। তখন স্টেরয়েড দিয়ে এই প্রতিক্রিয়া বন্ধ করে দিলে অনেক সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এজন্য ডাক্তাররা অনেক রোগের লাস্ট লাইন ট্রিটমেন্ট হিসেবে স্টেরয়েড ব্যবহার করেন। প্রথমে ব্যবহার করেন না। কারণ স্টেরয়েড বহুদিন ব্যবহারে আমাদের দেহের প্রচুর ক্ষতি হয়। যেহেতু এটি প্রচুর রোগের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়, তাই একেও সকল রোগের ঔষধ বলে চালানো হয়।[২] কিন্তু তাই বলে পৃথিবীতে যত রোগ আছে, স্টেরয়েড যে সব ঠিক করে দিবে এমন নয়। স্টেরয়েডের কার্যক্ষমতার আধিক্যের কারণেই এমন বলা হয়। বুঝেছেন?”
সানিন বললো, “ওসব বুঝে আমি কী করবো?”
ফাতিমা বললো, “এগুলো না বুঝলে পরে যা বলবো, সেটাও বুঝবেন না। মনোযোগ দিয়ে শুনুন। আপনাকে আমি ‘সব’ শব্দটি ব্যবহারের ক্ষেত্র সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছি। আমি স্কুলে পড়ার সময় ক্লাসের একটি মেয়ে ম্যাথ ভাল পারতো। আরেকটি মেয়ে আমার কাছে যখন আসতো ম্যাথ বুঝতে, তখন আমি ওই মেয়ের কাছে পাঠিয়ে দিতাম এই বলে যে, ‘ওর কাছে যা, ও সব পারে।’ এর মানে এটা না যে ওই মেয়েটা সব ক্লাসের সব ম্যাথ পারে। আমরা ‘সব’ শব্দটি দিয়ে সবসময় ‘সকল’ বুঝাই না। অনেকসময় ‘অধিকাংশ’ বা ‘আধিক্য’ বুঝাতেও ব্যবহার করি। বুঝেছেন?”
“হ্যাঁ। এখানে তো আমার কোনো সমস্যা নেই।” সানিন বললো।
ফাতিমা বললো, “আমি তো বলিনি এখানে আপনার সমস্যা আছে। আপনার যেখানে সমস্যা আছে, সেটা আমি এখন বলছি। আপনি একটু আগে আদনানকে ওর নানার চিকিৎসা করতে কালোজিরা সাজেস্ট করেছেন। কারণ রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, কালোজিরা সকল রোগের ঔষধ, মৃত্যু ব্যতীত।[৩] এখানে ‘সকল’ শব্দটি আরবি যে শব্দের অনুবাদ, সেটি হলো কুল্লুন (كُلٌّ)। প্রখ্যাত অ্যারাবিক ডিকশনারি লিসান আল আরব-এ আছে যে, ‘কুল্লুন (كُلٌّ)’ শব্দটির অর্থ ‘সকল’ বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ‘কিছু’ অর্থাৎ ‘مَعَنَى الْبَعَضْ’।[৪] আবার আল-ফিকহ ওয়াল মুতাফাক্কিহ নামক একটি গ্রন্থে বলা হয়েছে, এখানে ‘কুল্লুন’ শব্দটি ‘আধিক্য’ বোঝাতে ব্যবহার করা হয়েছে। সহিহ বুখারির এই হাদীসের টীকায় বলা আছে, যদিও এই হাদীসে ‘ْ مِن كُلِّ دَاءٍ’ বা ‘সকল রোগের ঔষধ’ কথাটি ‘ব্যাপক’ কিন্তু এর দ্বারা উদ্দেশ্য ‘খাস’ বা ‘নির্দিষ্ট’।[৫] তাহলে বোঝা যাচ্ছে যে, এই হাদীসে ‘সকল রোগের ঔষধ’ বলতে একদম পৃথিবীতে যত রোগ আছে, সকল রোগের ঔষধের কথা বলা হয়নি বরং নির্দিষ্ট প্রকারের বিভিন্ন রোগের কথা বলা হয়েছে। এটাই ইবনে আল-আরাবী, ইমাম খাত্তাবি আর ইবনুল কায়্যিম প্রমুখ আলিমদের মত।[৫.১] আর কুরআন এবং হাদীসের আমি বা আপনি নিজের মতো করে পড়ে অর্থ বুঝলে হবে না। আমাদের পূর্ববর্তী ‘আলিমগণ বা সালাফরা যেভাবে বুঝেছেন সেভাবেই বুঝতে হবে। কিন্তু এই কালোজিরা যেহেতু অনেক ধরনের রোগের ঔষধ বা নিরাময়,[৬] সেহেতু জোর দিয়ে বুঝাতে ‘মৃত্যু ব্যতীত’ কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ আপনি জানেন যে, মৃত্যু কোনো রোগ নয়।”
আমি ফাতিমার কথায় সায় দিয়ে বললাম, “সানিন, আমাদের বাপ্পি নামের এক ফ্রেন্ড ছিলো। মনে আছে তোর? ও এত পরিমাণ খেতো যে আমরা বলতাম, ‘বাপ্পি পলিথিন বাদে সব খায়।’ কিন্তু আসলে কিন্তু ও লোহা বা খাবারের মধ্যেই অনেক কিছুই খেতো না। কিন্তু তবুও আমরা বলতাম। সুতরাং, আমরা ‘সব’ শব্দটি অনেকসময় আধিক্য বুঝাতে ব্যবহার করি। এই হাদীসেও ‘কুল্লুন’ শব্দটির অর্থ একদম ডেফিনেটলি ‘সকল’ মনে হয় বুঝায়নি। বুঝলি?”
আমার কথা সানিন মনে হয় কিছু শোনেনি। নিচের দিকে তাকিয়ে মোবাইলে কী যেন দেখছিলো। কিছুক্ষণ পরে ঘাড় উঠিয়ে সানিন বললো, “আচ্ছা, সেটা মানলাম। কিন্তু ইবনে হাজার নামে একজন আলেম আছে শুনেছি। সে বলেছে যে, এখানে সকল রোগের কথাই বলা হয়েছে। আর এটাই নাকি বেশি গ্রহণযোগ্য মত। আমাকে ভুলভাল বুঝালে আমি বুঝে চুপ থাকবো-এমন মানুষ আমি না!”
ফাতিমা বলল, “হ্যাঁ, আপনার কথাও ভুল নয়। এই ব্যাপারে দুই ধরনের মত আছে। একটি আমি একটু আগে বলেছি। আরেকটি হল, এই হাদীসে ‘مِن كُلِّ دَاءٍ’ বা ‘সকল রোগের ঔষধ’ বলতে সকল রোগই উদ্দেশ্য। এক্ষেত্রে শুধু কালোজিরা বা এর সাথে অন্য কোন বস্তু মিশিয়ে খাওয়ালে যেকোন রোগই ভালো হয়। কালোজিরার মধ্যে এই গুন আছে। কিন্তু আমরা যেহেতু সেই ঔষধগুলো সম্পর্কেই জানি, যেগুলো বিভিন্ন পরীক্ষা ও বাস্তব অভিজ্ঞতা কেন্দ্রিক। আমরা ব্যবহার করি, এমন অনেক জিনিসের উপকারই আমরা জানি না। এজন্য কি সেসব জিনিসের উপকার নেই? অবশ্যই আছে। তাই কালোজিরার মধ্যেও সকল রোগের নিরাময় রয়েছে। শুধু কীসের সাথে ব্যবহার করতে হবে, কতটুকু কীভাবে ব্যবহার করতে হবে, এগুলো জানতে হবে। এই হাদীসের এমন ব্যাখ্যার পক্ষে ইবনে হাজার আসকালানি (রহ:), বদরুদ্দিন আল-আঈনী (রহ:), এবং ইবনে তাইমিয়া (রহ:) প্রমুখ আলেমগন।[৫.১] কোনো অবস্থানকেই নিরেটভাবে ভুল বলা যায় না। বুঝলেন?”
সানিন হাতে তুড়ি মেরে বললো, “এটাই শুনতে চাচ্ছিলাম। এবার বলো যে, কালোজিরা এমন কী জিনিস যে বিপুল পরিমাণ রোগ ভালো হবে? সর্দি-কাশি ছাড়া আর কিছুতো ভালো হয় না।”
ফাতিমা বললো, “আপনি প্রথমেই এই প্রশ্ন করতে পারতেন। তাহলে শুধু শুধু একজন অসুস্থ ব্যক্তিকে নিয়ে কটু কথা বলা লাগতো না। আর আমার এতগুলো কথা খরচ করাও লাগতো না। আপনি একটু আগে ক্যান্সারের ট্রিটমেন্ট কালোজিরা দিয়ে দিতে বলেছেন। তাই প্রথমে ক্যান্সারের ট্রিটমেন্টে কালোজিরার উপকারিতা আলোচনা করি। ক্যান্সার বলতে সাধারণত একটি কোষের অনিয়ন্ত্রিত বিভাজন, অন্য কোষে ঢুকে যাওয়া এবং অন্যত্র ছড়িয়ে পড়া বা মেটাস্ট্যাসিসকে বুঝায়। যদি কোনো উপাদান কোষের অনিয়ন্ত্রিত বিভাজন এবং মেটাস্ট্যাসিস বন্ধ করে দিতে পারে, তাহলে সেটাই ক্যান্সারের জন্য উপকারী ঔষধ। গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, কালোজিরাতে থাইমোকুইনোন নামক একটি উপাদান রয়েছে, যেটি একটি ক্যান্সার কোষের অনিয়ন্ত্রিত বিভাজন এবং মেটাস্ট্যাসিস বন্ধ করে। সাথে সাথে এটি এপোপটোসিস প্রক্রিয়ার ক্যান্সার কোষটিকে নষ্ট করতেও সাহায্য করে।[৭] বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন যে, এই থাইমোকুইনোন এবং এর অনুরূপ কেমিক্যাল ভবিষ্যতে অন্যান্য কেমোথেরাপিক ড্রাগের সাথে তাঁরা ব্যবহার করতে পারবেন।[৮] রাসূলুল্লাহ ﷺ কি তাহলে কালোজিরা খেতে বলে ভুল করেছেন?”
সানিনের চেহারাটা আর আগে মতো উজ্জ্বল নেই। কেমন যেন ফ্যাকাসে ফ্যাকাসে লাগছে। সানিন কিছু বলার আগে ফাতিমা বললো, “গবেষণায় আরও দেখা গিয়েছে যে, কালোজিরার থাইমোকুইনোন উপাদানটি ব্লাড প্রেশার কমায়। আবার বিভিন্ন হার্টের রোগেও থাইমোকুইনোনের কার্যকারিতা রয়েছে।[৯] আপনি কি জানেন যে, পৃথিবীতে প্রায় ৩৪৭ মিলিয়ন মানুষের ডায়াবেটিস আছে এবং এই সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে? আমাদের দেহে ‘অগ্নাশয়’ নামক একটি অঙ্গ আছে। অগ্নাশয়ে ‘বিটা কোষ’ নামক কিছু কোষ আছে। এই কোষ থেকে ‘ইনসুলিন’ নামক হরমোন নিঃসৃত হয়। এই হরমোন রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। ডায়াবেটিস দুই ধরনের। টাইপ ১ এবং টাইপ ২। টাইপ ১ ডায়াবেটিস হয় বিটা কোষ নষ্ট হয়ে গেলে। এক্ষেত্রে বিটা কোষ ইনসুলিন নিঃসরণ করতে পারে না। তখন রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায়। আবার টাইপ ২ ডায়াবেটিস হলে বিটা কোষ থেকে ইনসুলিন নিঃসরণ ঠিক থাকে, কিন্তু কোষে ইনসুলিন ঠিকমতো ঢুকতে পারে না। এজন্য রক্তে গ্লুকোজের মাত্রাও কমে না। ধারণা করা হয়, অনেক কারণের মধ্যে এটিও একটি কারণ যে, অক্সিডেটিভ স্ট্রেসের কারণে অগ্নাশয়ের বিটা কোষ থেকে ইনসুলিন নিঃসরণ কমে যেতে পারে বা বিটা কোষ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তখন টাইপ ১ ডায়াবেটিস হয়। এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, কালোজিরায় উপস্থিত থাইমোকুইনোন অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের কার্যক্ষমতা বাড়িয়ে কোষের অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমায়। এতে টাইপ ১ ডায়াবেটিসের আশংকা কমে যায়।[১০] আবার টাইপ ২ ডায়াবেটিস এর ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে যে, সাধারণ ঔষধ থেকে কালোজিরার কর্মক্ষমতা বেশি।[১১] তাহলে ভাইয়া, রাসূলুল্লাহ ﷺ কি কালোজিরা খেতে বলে ভুল করেছিলেন?”
আমি সানিনের দিকে তাকিয়ে বললাম, “এখন চুপ করে আছিস কেন? কিছু তো বল! এতক্ষণ তো ভালোই টিটকিরি মারলি!”
সানিন বললো, “তুই তো কিছু বলছিস না। তুই এত খুশি কেন?”
কথাটা সানিন খারাপ বলেনি। তবে ফাতিমার তথ্যগুলো খুব সুন্দর গোছালো এবং সহজ লাগে। এজন্য শুনেও ভালো লাগে। তাই সবসময় একটা এক্সাইটমেন্ট কাজ করে। আমি রেগে গিয়ে সানিনকে বললাম, “না পারলে তো এমন কথাই বলবি!”
সানিন আমার কথাতে কান না দিয়ে ফাতিমার দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করলো, “এখানে তো মাত্র তুমি ৩ টা রোগের কথা বললে। পৃথিবীতে রোগ তো হাজার হাজার।”
ফাতিমা বললো, “আমার বলা শেষ হয়নি। পৃথিবীতে বর্তমানে ভাইরাস, ছত্রাক, ইস্ট বা ব্যাক্টেরিয়া দিয়ে ঘটে, এমন রোগের সংখ্যা অসংখ্য। গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, কালোজিরায় উপস্থিত উপাদান গ্রাম পজিটিভ ব্যাক্টেরিয়া, ছত্রাক, ইস্ট ও ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। অনিয়ন্ত্রিত অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের ফলে খুব দ্রুত অ্যান্টিবায়োটিক তার কার্যকারিতা হারাচ্ছে। তাই বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন যে, কালোজিরার থাইমোকুইনোন পরবর্তীতে অ্যান্টিবায়োটিক হিসেবে তাঁরা ব্যবহার করতে পারবেন।[১২] আবার কিডনির বিভিন্ন সমস্যায় থাইমোকুইনোনের উপকারিতা পাওয়া গিয়েছে।[১৩] এছাড়াও প্রদাহজনিত প্রচুর সমস্যায় থাইমোকুইনোন উপকারী, যেটা কালোজিরায় থাকে।[১৪] অধিক পরিমাণ প্যারাসিট্যামল একবারে খেলে এর নেফ্রো-টক্সিসিটি হয়। কালোজিরায় উপস্থিত উপাদান থাইমোকুইনোনের নেফ্রো-টক্সিসিটির উপরে থেরাপিউটিক ইফেক্ট আছে।[১৫] এবার ধরেন, আপনার স্ত্রী আপনার সাথে রাগ করে অনেকগুলো প্যারাসিট্যামল খেয়েছে। এবং আপনি জানেন যে, কালোজিরা খেলে উপকার হবে। তাহলে আপনি তাকে হাসপাতালে আনবেন নাকি কালোজিরা খাওয়াবেন?”
সানিন উত্তর দিলো, বিনা টাকায় কাজ হলে শুধু শুধু হাসপাতালে কেন নিব? “কালোজিরা খাওয়াবো!”
আমি আর নাবিলা সানিনের বাচ্চাসুলভ উত্তরে হেসে দিলাম। ফাতিমাও হেসে দিলে বললো, “ভাইয়া, কালোজিরা খাওয়ালে খাওয়াবেন। কিন্তু আগে হাসপাতাল নিয়ে যাবেন। কারণ এগুলো আমি আপনাকে কালোজিরার উপর করা কিছু গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফলাফলের কথা বলছি। এখনো এগুলো দিয়ে ট্রিটমেন্ট প্ল্যান তৈরি হয়নি। এগুলোর উপকার আছে। কিন্তু কোথাও কতটুকু ব্যবহার করতে হবে, সেটা এখনো গবেষণার বিষয়। হয়তো আমরা ভবিষ্যতে দেখতে পাবো।”
“ও!” বলে ভ্রূ উঁচিয়ে মাথা নাড়াল সানিন।
এরপরে সানিন প্রশ্ন করলো, “আচ্ছা, কালোজিরা খেলে কি হাঁপানি রোগ ভালো হয়?”
সানিন এবার একটি ইয়োর্কার বল ছাড়লো। আমি ভাবলাম ফাতিমা এবার ‘ক্লিন বোল্ড’। কারণ শুনেছি হাঁপানি রোগ ভালো হয় না। তাই ঠোঁটের ব্যাসার্ধ্য কমিয়ে চোখ বড় করে ফাতিমার দিকে তাকালাম।
ফাতিমা বললো, “ভাইয়া, আপনি সুন্দর প্রশ্ন করেছেন। হাঁপানি রোগকে মেডিকেল সাইন্সের ভাষায় ‘অ্যাজমা’ বলে। এটি এমন একটি রোগ যা ডায়াবেটিস বা প্রেশারের মতোই, নিরাময় সম্ভব নয়। এই রোগগুলো কন্ট্রোল করতে হয়। যে কন্ডিশানে অ্যাজমাটিক অ্যাটাক হয়, সেই কন্ডিশান অ্যাভয়েড করলেই অ্যাজমা কন্ট্রোলে থাকে। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানও অ্যাজমার নিরাময় বের করতে পারেনি। আসলে এটা নরমালি সম্ভবও নয়। কারণ এটি ইমিউন মেডিয়েটেড হাইপারসেন্সিটিভিটির কারণে হয়। যা-ই হোক, অ্যাজমার রোগীদের শ্বাসনালীর পেশী সঙ্কুচিত হয়ে যায়। এজন্য শ্বাসপ্রশ্বাসে কষ্ট হয়। আমরা মেডিসিনের মাধ্যমে শ্বাসনালীর পেশীর সঙ্কোচন কমিয়ে দেই। এটাই আপাতত এই রোগের ট্রিটমেন্ট। এক গবেষণায় দেখা গেছে কালোজিরার নির্যাস শ্বাসনালীর পেশীর সঙ্কোচন কমায়।[১৬] আরেক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, অ্যাজমায় ব্যবহৃত স্টেরয়েড থেকে কালোজিরায় উপস্থিত থাইমোকুইনোন বেশি উপযোগী। কারণ, এর অ্যান্টি-ইনফ্লামেটরি ইফেক্ট আছে।[১৭] এছাড়াও মস্তিষ্কের রক্তাল্পতা, ব্যথা, খিঁচুনি, ইনফ্লামেটরি বাওয়েল ডিজিজ ইত্যাদিতে কালোজিরা উপকারী।[১৮] ভাইয়া, আর কিছু জানার আছে?”
“উম…” চিন্তা করতে লাগল সানিন।
সানিনের উত্তরের আগেই ফাতিমা বলে বসলো, “আচ্ছা আপনি ভাবতে থাকুন। আমি আপনাকে এবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি বলবো। কালোজিরা আমাদের দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা উন্নত করতে সহায়তা করে। এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ কালোজিরা সেবনে প্রতিরক্ষার জন্য নির্ধারিত কোষগুলোর পরিমাণ বাড়ে।[১৯] সুতরাং, কালোজিরার উপাদান আমাদের দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। আমাদের ইমিউনিটি যদি বৃদ্ধি পায়, তাহলে আমরা আল্লাহ’র ইচ্ছায় তেমন আর রোগাক্রান্ত হবো না। ভাইয়া, কালোজিরার একটিমাত্র উপাদান কত কাজ করে দেখেছেন? আরো তো উপাদান আছে, সেগুলো নিয়ে গবেষণা করলে আরো কিছু হয়ত পাওয়া যাবে। সুতরাং, কালোজিরাকে ‘সকল রোগের ঔষধ মৃত্যু ব্যতীত’ – বলাটা কি ভুল?[২০]”
সানিন বললো, “কিন্তু একই ড্রাগের যদি বিপরীতধর্মী কাজ থাকে, তাহলে তো সেখান থেকে উপকার পাওয়া সম্ভব নয়। তাহলে কীভাবে কাজ করবে?”
ফাতিমা বললো, “একটি ড্রাগের বিপরীতধর্মী ইফেক্ট থাকলেই যে সেটা ক্ষতিকর – ব্যাপারটা এমন নয়। বিপরীতধর্মী ইফেক্ট উপকারী বা অপকারী দুই ধরনেরই হতে পারে।[২০.১] ধরেন, এক ব্যক্তির উচ্চ রক্তচাপ আছে। তাকে আপনি একটি প্রাকৃতিক মেডিসিন দিলেন। যাতে ‘A’ এবং ‘B’ দুইটি উপাদান আছে। ‘A’ উপাদানের কাজ রক্তনালীর প্রসারণ। এবং‘B’ উপাদানের কাজ কিডনি থেকে সোডিয়ামসহ পানি পুনঃশোষন করা। তাহলে কিন্তু ‘A’ উপাদানের কারনে রক্তচাপ কমবে। এবং ‘B’ উপাদানের কারণে রক্তচাপ বাড়বে। এখন, ধরুণ ‘A’ উপাদানের পরিমান এবং কার্যকারিতা প্রাকৃতিক মেডিসিনে বেশি। আর ‘B’ উপাদানের পরিমান ও কার্যকারিতা কম। তাহলে আল্টিমেটলি রক্তচাপ কিন্তু ‘A’ উপাদানের কারণে কমছে । এখন এই প্রাকৃতিক মেডিসিন থেকে যদি আমি ‘B’ উপাদানটিকে আলাদা করে নিয়ে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করি এবং একটি নির্দিষ্ট ডোজে রক্তচাপ বাড়ানোর কাজে ব্যবহার করি তাহলে কি একই প্রাকৃতিক উপাদানে দুটি বিপরীতধর্মী রোগের ঔষধ পাওয়া যাচ্ছে না?
আমি ফাঁকতালে বললাম, “হুম! দ্যাট মেইক সেন্স।”
সানিন কিছুক্ষণ চুপ থেকে জিজ্ঞাসা করলো, “তাহলে এটা দিয়ে ফার্মাসিউটিকাল কোম্পানিগুলো কেন ঔষধ তৈরি করে না?”
ফাতিমা উত্তর দিলো, “ভাইয়া, আপনার হয়তো জানা নেই একটি মেডিসিন কীভাবে বাজারে আসে। প্রথমে কোনো ড্রাগ কম্পোনেন্ট আবিষ্কৃত হলে ড্রাগটি কীভাবে কাজ করে, কোথায় কী কাজ করে, কীভাবে কাজ করে তার তথ্য একত্র করা হয়। এরপরে এটা বিভিন্ন প্রাণীতে পরীক্ষা করা হয়। প্রাণীতে ব্যবহারে কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া থাকলে সেটা নোট করা হয়। একে বলা হয় প্রি-ক্লিনিক্যাল ডেভেলপমেন্ট। এরপরে ড্রাগটি ‘ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল’-এর জন্য প্রস্তুত হয়, যদি ড্রাগের প্রচুর ক্ষতিকর কোনো সাইড ইফেক্ট না থাকে।[২১] ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চারটি ধাপে সম্পন্ন হয়। প্রথম ধাপে, ড্রাগটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে একজন ফার্মাসিস্টের তত্ত্বাবধায়নে কিছু মানুষের উপর টেস্ট করা হয়। দ্বিতীয় ধাপে, ডাক্তারের তত্ত্বাবধায়নে একটি প্রতিষ্ঠানে কিছু মানুষের উপর টেস্ট করা হয়। তৃতীয় ধাপে, কিছু ডাক্তারের তত্ত্বাবধায়নে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে আরও বেশি সংখ্যক মানুষের উপর টেস্ট করা হয়। ড্রাগটি এতগুলো ধাপ অতিক্রম করে যদি বাজারজাতকরণের উপযুক্ত হয়, তখন ড্রাগটি মেডিসিন হিসেবে পরীক্ষামূলকভাবে বাজারে ছাড়া হয়। দীর্ঘ সময় অবজার্ভেশনের পরে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া বিবেচনা করে ড্রাগটি মেডিসিন হিসেবে স্বীকৃতি পায়।[২২] আর এই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে ৪-৬ বছর লেগে যায়।[২৩]
“কালোজিরা থেকে প্রাপ্ত ড্রাগ থাইমোকুইনোন বর্তমানে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে আছে। আপনি চাইলে PubMed Journal -এ থাইমোকুইনোনের কেমিক্যাল ডেটাবেস দেখতে পারেন।[২৪] Journal Of Pharmacopuncture নামক একটি সাময়িকীতে প্রকাশিত একটি আর্টিকেল অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফল সন্তোষজনক। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আরও বড় পরিসরে স্টাডি করা দরকার।[২৫] সুতরাং, স্টাডি সম্পূর্ণ শেষ হলেই আপনি মেডিসিনটি বাজারে পাবেন, আলহামদুলিল্লাহ্। আশা করি আমার কথা সবটুকুই আপনি বুঝেছেন। আর এটাও আশা করবো যে, আজকের পর থেকে এরকম খোঁটা দেওয়াটা বন্ধ করবেন। আরেকটা ব্যাপার মনে রাখবেন যে, আজ থেকে কয়েক বছর আগেও কালোজিরার এই গুণাগুণগুলো সাইন্টিফিক্যালি প্রমাণিত ছিলো না। তখন আমাকে আপনি জিজ্ঞাসা করলেও আমি প্রমাণ সহকারে উত্তর দিতে পারতাম না। কিন্তু এখন সেটা আমি পেরেছি। কারণ আমার কাছে উপযুক্ত তথ্য ছিলো। সুতরাং, বিজ্ঞান কিন্তু ধীরে ধীরে আগাচ্ছে। তাহলে বিজ্ঞানের আবিষ্কৃত তথ্য – যা প্রতিনিয়ত চেইঞ্জ হয় বা নতুন তথ্য যোগ করে, সেটা দিয়ে যদি একটি কন্সট্যান্ট ধর্মকে যাচাই করে ভুল বের করার চেষ্টা করেন, তাহলে সেটা বাতুলতা ছাড়া আর কিছু নয়। তাই, যদি সত্যিই জানার ইচ্ছা থাকে, তাহলে যারা জানে তাদের কাছে জিজ্ঞাসা করবেন। তাহলে অন্তত এভাবে কলা বিজ্ঞানী হতে হবে না!”
ফাতিমার বুদ্ধিদীপ্ত উত্তরগুলো শুনে আমি মনে মনে বললাম, “যা ব্যাটা! এবার এখান থেকে উঠে জায়গায় যা!”
এরই মধ্যে একটি ছেলে এসে সানিনকে ডাক দিয়ে বললো, “ভাই, যাবেন না? কেক কাটার সময় হয়ে গিয়েছে তো!”
সানিন ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করলো, “আচ্ছা, ছুরি কি পেয়েছিলি?”
“না, পাইনি। অন্য দোকান থেকে এনেছি।” ছেলেটি উত্তর দিলো।
সানিন আমাদের দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে আস্তে চেয়ার থেকে উঠে চলে গেলো। আমি সানিনের দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকলাম। হাসি থামিয়ে ডানে তাকিয়ে দেখি অর্ডারগুলো একটি ট্রেতে দিয়ে গিয়েছে। আমাদের কথা বলায় ব্যস্ত দেখে হয়তো ডিস্টার্ব করেনি। খাবারগুলো মজা করে খেলাম। বিশেষ করে ফালুদা! আহ! আমার ফেভারিট ফুড।
সামনে সুস্বাদু খাবার পেয়ে এমন খাওয়া দিয়েছি যে ‘তিন ভাগের এক ভাগ’ সুন্নাহ আদায় হলো না। বাড়ি যেতেও মনে চাচ্ছিলো না। কিন্তু কী করার? যেতে তো হবেই। “স্যার, বিল।” বলে একজন ওয়েটার একটি কাগজ ধরিয়ে দিলো। বিল পে করে বাইরে আসলাম। গাড়িতে সবাইকে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। গাড়িতে ফাতিমা বই পড়ছিলো। মাঝপথে ফাতিমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “আচ্ছা, এজন্যই কি তুমি প্রতিদিন কালোজিরা খাও?”
ফাতিমা উত্তর দিলো, “যে ব্যক্তি একটি ভুলে যাওয়া সুন্নাহকে পুনর্জীবিত করবে, সে ওই ব্যক্তির কৃতকর্মের প্রতিদান পাবে, যেটা উক্ত ব্যক্তি তাকে দেখে করেছে। এবং এতে শেষের ব্যক্তিটির প্রতিদান বিন্দুমাত্র কমে যাবে না।[২৫]”
ফাতিমার প্রতিটি কথাই আমার জন্য পাথেয় হয়ে থাকে। যোগ্যতা দিয়ে ও অনেক দূর যেতে পারতো। কিন্তু না! পরক্ষণেই কবিগুরুর কথা মনে পড়লো যে, পৃথিবীতে হয়তো দেখার জন্য যোগ্য লোক পাওয়া যায়, কিন্তু যোগ্য লোকের জন্য যোগ্য জায়গাটি পাওয়া যায় না।
[এখানে একজন বহিরাগত নন-মাহরামের সাথে ফাতিমার এভাবে উন্মুক্ত কথোপকথন শরী’য়াহ সম্মত নয়। কিন্তু ঘটনাক্রমে অপবাদ চলে আসায় ফাতিমাকে বাধ্য হয়ে কথা বলতে হয়েছে। লেখাটিকে শুধুমাত্র গল্প হিসেবে পড়ার অনুরোধ থাকলো।
লেখাটিকে যতদূর সম্ভব সহজ করার চেষ্টা করেছি। তবুও একটু সাইন্সের ব্যাকগ্রাউন্ড হলে বুঝতে সুবিধা হবে। সব তথ্যগুলো মেডিকেল জার্নাল অথবা মেডিকেল টেক্সটবুক থেকে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আশা করি, এক্ষেত্রে লেখাটির গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। সমস্ত জ্ঞান তো আল্লাহ তা’আলার কাছেই। লেখাটিতে যা কিছু ভুল, তা আমার ও শয়তানের পক্ষ হতে এবং যা কিছু কল্যাণ, তার সবটুকুই আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে।]
[১] https://islamqa.info/en/2438
[২] The Pharmacological Basis Of Therapeutics (Goodman and Gilman); 12th edition; Page: 1027-1005
[৩] সহিহ বুখারি; অধ্যায়: চিকিৎসা; হাদীস নং- ৫৬৮৮/ আধুনিক প্রকাশনী- ৫২৭৭/ ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫১৭৩
[৪] লিসান আল আরব; খণ্ড: ০৭; পৃষ্ঠা: ৭১৮
[৫] সহিহ বুখারি (মূল আরবি ছাপা); খণ্ড: ০২; পৃষ্ঠা: ৮৪৯; টীকা: ০২
[৫.১] https://islamqa.info/en/154257
[৬] লিসান আল আরব; খণ্ড: ০৫; পৃষ্ঠা: ১৫১
[৭] http://www.sciencedirect.com/science/article/pii/S0006295211003637
http://www.sciencedirect.com/science/article/pii/S0378427413012903
https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC3642442/
https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC4387232/
[৮] http://www.sciencedirect.com/science/article/pii/S0027510714000888
[৯] https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC4387232/
[১০] https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC4387232/
https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC3642442/
http://www.sciencedirect.com/science/article/pii/S1756464615003266
[১১] https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC4387232/
[১২] https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC3642442/
http://www.sciencedirect.com/science/article/pii/S0944501316304475
[১৩] http://www.sciencedirect.com/science/article/pii/S1110093114000192
[১৪] http://www.sciencedirect.com/science/article/pii/S1567576915300011
[১৫] http://www.sciencedirect.com/science/article/pii/S1743919114009807
[১৬] https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/20149611
[১৭] https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/19711253
[১৮] https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC3642442/
[১৯] https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/15850137?dopt=Abstract
https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/16734144?dopt=Abstract
[২০] http://www.sciencedirect.com/science/article/pii/S0378874116304214
https://www.sciencedirect.com/science/article/pii/S104366181500050X
https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC3642442/
https://imed.pub/ojs/index.php/iam/article/view/1863/1320
[২০.১] https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/22272687
[২১] Basic and Clinical Pharmacology by Bertram G. Katzung; Page: 70(12th edition)
[২২] Rang and Dale’s Pharmacology; Page: 781-784(6th edition)
[২৩] Basic and Clinical Pharmacology by Bertram G. Katzung; Page: 74(12th edition)
[২৪] https://pubchem.ncbi.nlm.nih.gov/compound/Thymoquinone#section=Top
[২৫] http://www.journal.ac/sub/view/223
[২৬] সুনান আত-তিরমিজি; হাদীসটি হাসান।
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।