আমাদের প্রথম পর্ব আমরা শুরু করবো বনী ইসরাঈল কারা এবং তাদের সম্বন্ধে জানার প্রয়োজনীয়তা দিয়ে। এই সিরিজটা সবচেয়ে ভালো হতো যদি আমরা আদাম (‘আলাইহিসসালাম) দিয়ে শুরু করতাম। কিন্তু তা না করে আমরা বনী ইসরাঈল দিয়ে করছি তার কারণ দুইটা-

১) বনী ইসরাঈলের কাহিনী জানলে অল্প সময়ে কুরআনের বিশাল একটা অংশ বোঝা হয়ে যায়।

IIRT Arabic Intensive

২) অন্য কাহিনীগুলো পরে বিচ্ছিন্নভাবে জানলেও পুরা ব্যাপারটা বুঝতে তেমন একটা সমস্যা হয় না। আর অন্য কাহিনীগুলো এত বড় না যে, পর্ব করে জানতে হবে।

তবুও বোঝার সুবিধার্থে একবার উল্লেখ করে নিচ্ছি যে, বনী ইসরাঈল ছাড়া অন্য যাদের কাহিনী কুরআনে এসেছে,তাদের ক্রমটা হলো এরকম

আদাম ► ইদরীস ► নূহ ► হুদ (আদ জাতি) ► সালিহ (সামূদ জাতি)

‘আলাইহিমুসসালাম। আরো আছেন শুয়াইব (‘আলাইহিসসালাম), ইউনুস (‘আলাইহিসসালাম) ও আইয়ূব (‘আলাইহিসসালাম), যাদের ক্রম সম্পর্কে সম্ভবত সুনির্দিষ্ট কিছু জানা যায় না ( আমি জানি না)।

বনী ইসরাঈল কারা

আমরা হয়তোবা অনেকেই জানি যে, ইব্রাহীমকে (‘আলাইহিসসালাম) Father of faith বলা হয়। তিনটি প্রধান একেশ্বরবাদী হিসেবে দাবী করা ধর্মেই (Judaism, Christianity and Islam) উনি স্বীকৃত এবং সম্মানিত। উনাকে নিয়ে যে টানাহেঁচড়া আছে, সেটাকে খণ্ডন করে দিয়ে আল্লাহ কুরআনে উনাকে আখ্যায়িত করছেন ‘হানিফ’ হিসেবে।[১]

এখন আমরা দেখবো কীভাবে উনি সকল ধর্মের গোড়াতে আছেন। মাঝখানে অনেকে থাকলেও মূলত ক্রমটা এরকম——

ইব্রাহীমের দুই পুত্র ইসমাঈল ও ইসহাক। ইসহাকের বংশ থেকে আসেন ইয়াকূব (ইসরাঈল), ইউসুফ, মূসা, দাউদ, সুলাইমান ও ঈসা (‘আলাইহিমুসসালাম)। ইসমাঈলের (‘আলাইহিসসালাম) বংশ থেকে আসেন মুহাম্মাদ ﷺ।

আমরা দেখতে পারছি যে, এদেরকে বনী ইসরাঈল বলার কারণ হচ্ছে ইয়াকূবের (‘আলাইহিসসালাম) আরেক নাম ছিলো ইসরাঈল। আর একবারে ইসমাঈলের (‘আলাইহিসসালাম) বংশ থেকে আমাদের রাসূল ﷺ এসেছেন, মাঝখানে আর কেউ নেই।

বনী ইসরাঈলদের  কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য

নিশ্চয়ই আল্লাহই ভালো জানেন যে কেন তিনি তাঁর শেষ আসমানী গ্রন্থ, যা কি না কিয়ামত পর্যন্ত মানবজাতির জন্য পথ প্রদর্শনের জন্য যথেষ্ট হবে, তার এত বিশাল একটা অংশ জুড়ে বনী ইসরাঈলদের কাহিনী উল্লেখ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু আলিমরা বনী ইসরাঈলদের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্যকে এর পেছনে সম্ভাব্য কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন-

■ সময়ের দিক থেকে আমরা ও তারা সবচেয়ে কাছাকাছি। ঈসা (‘আলাইহিসসালাম) ছিলেন রাসূল ﷺ এর ঠিক আগের নবী এবং উনার জাতিও বনী ইসরাঈলদের  অন্তর্ভুক্ত।

■ রাসূল ﷺ এর উম্মাতের পর এটাই সবচেয়ে বড় উম্মাত (সংখ্যার দিক থেকে)।

■ এরাই প্রথম উম্মাত, যাদেরকে আল্লাহ জিহাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। এর আগে আল্লাহ অবাধ্য জাতিদের আযাব দ্বারা সমূলে ধ্বংস করে দিতেন।

■ আল্লাহ এদেরকে অসংখ্য নিয়ামত দিয়েছিলেন। পরে তাদের অবাধ্যতার জন্য তা কেড়ে নিয়েছেন।

এই শেষের বৈশিষ্ট্যটা আমাদের একটু ভালো করে খেয়াল করা দরকার। আমরা যদি নিজেদের অতীত ইতিহাস জানতাম, তাহলে বুঝতাম যে মুসলিমরা একসময় কী দোর্দণ্ড প্রতাপের সাথে, দাপটের সাথে এই বিশ্ব শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শাসন করেছে। ইসলামের একটা বৈশ্বিক এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামো বিদ্যমান এবং এ সংক্রান্ত বিস্তারিত দিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মৌলিকভাবে এটা আসলে একটা রাষ্ট্রীয় জীবন ব্যবস্থা। অথচ এই ব্যাপারটা আজকাল আমাদের কল্পনাতেই আসে না। এর অনেক বিধানকে এইজন্যই আমরা ভুল বুঝি। সবখানে মুসলিমরা কুকুর বিড়ালের মতো মরবে, এটা দেখতে দেখতেই আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। ৯/১১ এর পরে মুসলিমরা নিজেদের নাম পরিবর্তনের জন্য যেভাবে উঠে পড়ে লেগেছিলো, সেটা থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠে যে জাতি হিসেবে আমরা কতটা হীনমন্যতায় ভুগছি।

এই যে একটা চরম সম্মানজনক অবস্থা থেকে লাঞ্চনার চূড়ান্ত পর্যায়ে নেমে আসা, এটা বনী ইসরাঈল ও মুসলিম উভয়ের সাথেই ঘটেছে। বিস্ময়কর হলেও সত্যি যে, ইতিহাসের ঘটনা পরিক্রমাগুলো যদি আমরা একটা গ্রাফে উপস্থাপন করি, তাহলে দুটো জাতি যারা কি না একসময় সম্মান ও প্রতিপত্তির দিক থেকে শীর্ষে অবস্থান করছিলো, অধঃপতন হতে হতে অপদস্থতার চরম সীমায় পৌঁছে যাওয়া বনী ইসরাঈল ও মুসলিম উভয়ের অবস্থা পরিবর্তনের ক্রম যেন একদম হুবহু! কোন উপস্থাপনাটা বনী ইসরাঈলদের আর কোনটা মুসলিমদের, তা আলাদা করাটাই বুঝি দুষ্কর হয়ে যাবে!

বনী ইসরাঈলদের  সম্পর্কে জানার প্রয়োজনীয়তা

তাই বনী ইসরাঈলদের সম্পর্কে জানার সবচেয়ে বড় প্রয়োজনীয়তা বোধ করি তাদের থেকে শিক্ষা নেওয়া। আমাদের মাঝে ওদের কাণ্ডকীর্তি নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করার একটা প্রবণতা আছে যে, দেখো ওরা কেমন করতো। আমরা একবারও ভেবে দেখি না যে, অনুরূপ স্বভাব আমাদের মাঝে আছে কি না বা আমরাও তেমনটা করছি কি না। তাই ঘুরে ফিরে এই পুরো সিরিজ জুড়ে আমরা নিজেদেরকে প্রশ্ন করবো – আমরা কি ধারণ করছি সেসব স্বভাব, যার কারণে আল্লাহ বনী ইসরাঈলদের উপর থেকে তাঁরই দেওয়া নিয়ামাতসমূহ উঠিয়ে নিয়েছিলেন?

এছাড়াও ইনশা আল্লাহ এই সিরিজের আরো যেসব উপকারিতা আছে, তার মাঝে রয়েছে-

১) কুরআন অর্থসহ বোঝা সুবিধা হবে, কারণ কুরআনের একটা বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে বনী ইসরাঈল সম্পর্কিত বর্ণনা।

২) সীরাহর একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ বনী ইসরাঈলদের  রাসূলকে ﷺ অমান্য করার কারণ ও পরিণতি। আমরা সীরাহ আরো ভালোভাবে বুঝতে পারবো, জানবো কেন বনী ইসরাঈলরা এভাবে রাসূলের ﷺ বিরোধিতায় লিপ্ত হয়েছিলো।

৩) আজকে প্যালেস্টাইনে এই যে গণহত্যা চলছে, সেটার পেছনে রাজনৈতিক ছাড়াও একটা ধর্মীয় justification দেখায় ইয়াহুদীরা। সেটার স্বরূপ এবং ইসলামের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্যতা পরিষ্কার হবে।

৪) আমরা বিস্ময়ের সাথে আবিষ্কার করবো যে, আল্লাহ রাসূল ﷺ এর জীবনটা এমনভাবে ডিজাইন করেছেন এবং ইয়াহুদীদের চরিত্র কুরআন ও সীরাহ দ্বারা উন্মোচিত করেছেন যে, আজও তা দিয়ে ইসরাইলের পররাষ্ট্র নীতি সম্পর্কে ধারণা করা যাবে।

৫) এখনকার যায়োনিস্ট কারা, ইয়াহুদী মাত্রই যায়ন কি না, কী তাদের দাবী ইত্যাদি বিষয়সমূহ স্পষ্ট হবে।

তথ্যসূত্র ও গ্রন্থাবলি

[১] ইব্রাহীম ইয়াহুদী ছিলেন না এবং নাসারাও ছিলেন না, কিন্তু তিনি ছিলেন ‘হানীফ’ অর্থাৎ, সব মিথ্যা ধর্মের প্রতি বিমুখ এবং আত্নসমর্পণকারী, এবং তিনি মুশরিক ছিলেন না। (৩: ৬৭)

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive