Why so serious, son?
আমার জন্মের সময়টায় ফুটবলের প্রতি বাঙালি দারুণ একটা craze পার করেছিলো। আবাহনী-মোহামেডান এল ক্লাসিকো নিয়ে দেশ দুইভাগ হয়ে যায়, এমন অবস্থা। বড় ভাইয়ের ডায়েরিতে (অনুমতি নিয়েই) টানটান স্নায়বিক যুদ্ধের কাহিনী পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিলো আমিও হানাদার আবাহনী লিমিটেডের বিরুদ্ধে বন্দুক হাতে মোহামেডানসেনার মতো লড়াই করছি। সত্য ঘটনা।
ডায়েরির কাহিনীটা মনে হয় অনেকটা এরকম ছিলো যে, মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব ২-০ তে পিছিয়ে আছে। গল্পের In medias res, যেখানে কাহিনীর শুরুতেই নায়ক সবচেয়ে বিপর্যস্ত অবস্থায় থাকে। তারপর কেমনে কেমনে যেন ৩-২ এ জিতে গেলো। আমার এক মামা খুশিতে লাফ দিতে গিয়ে এক আবাহনীসমর্থক বন্ধুর চশমা ভেঙে ফেলেছিলো। দেশ স্বাধীন করার মতো অবস্থা! স্বভাবতই দলটার জন্য মনে একটা সফট কর্নার তৈরি হয়ে যায়। এরপর মোহামেডানের সুখে দুঃখে অনেক হেসেছি কেঁদেছি। বড় দল হিসেবে প্রায়ই তারা যেকোনো টুর্নামেন্টের সেমিফাইনাল বা ফাইনালে যায়। আর অনেকবারই খেলা গড়িয়েছে পেনাল্টি শুট আউট পর্যন্ত। আজীবন মনে থাকবে আমার শিরদাঁড়ার সেই কাঁপুনি আর গলায় আটকে থাকা হৃদপিণ্ডটার স্বাদ।
তবে ওই সময়টাতে ঘরে ঘরে ডিশ পৌঁছে গেছে। বিদেশি বোতলের স্বাদ পেয়ে দেশিটার কদর একটু হলেও কমেছে। আবাহনী-মোহামেডান খেলা নিয়ে মারামারি কাটাকাটি হয়ে যাওয়ার শুধু কাহিনীই শুনেছি, চোখে দেখা হয়নাই। যা-ই হোক, একই খেলা দেখলাম সাদা কালো বাদামী অনেকেই খেলে। একেকটা দেশ একেকটা দল। আর কী রঙবেরঙয়ের সব জার্সি!
এর মধ্যে কমলা জার্সি পরা একটা দলকে সাপোর্ট করতেন বড় ভাই। নাম হল্যান্ড (সবকিছু কমলা অথচ নাম কমল্যান্ড না হয়ে হল্যান্ড হওয়ার ব্যাপারটা আজও আমায় ভাবিয়ে তোলে)। বাচ্চারা অনুকরণপ্রিয়। মনে আছে ২০১০ বিশ্বকাপের সময় হল্যান্ডের খেলা দেখতে টিউটরের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে বাসায় চলে এসেছিলাম। কী অপ্রতিরোধ্যভাবেই না ফাইনালে উঠে এসেছিলো তারা! সেই রাতে বসেছিলাম এক বন্ধুর গিফট করা একটা পেন্সিল হাতে। পেন্সিলটার ডগায় একটা হুইসেল। ইভটিজার বলে সন্দেহে পড়ার ভয়ে রাস্তায় বাজাতে পারি না, আজ হল্যান্ড গোল দিলে বাজাবো। ডাচদের ভাগ্যে কাপ পিরিচ কিছু নাই। হারলো। আমারও হুইসেল বাজানো হলো না। রাগে দুঃখে পেন্সিলটা পাশের বাসার এক ভাগ্নেকে দিয়ে দিলাম। নে রে ব্যাটা! তোর বাপ তো নৌবাহিনীর অফিসার, তুই না হয় বড় হয়ে ট্রাফিক পুলিস হইস।
এরও অনেক আগের ঘটনা। খেলোয়াড়দের নাম খুব একটা জানতাম না। পেপারে একটা নাম দেখলাম রুদ ফন নিস্টলরয়। একেই ওলন্দাজ নাম, আবার মাঝে থেকে ‘স্ট’ আর ‘র’ সরিয়ে দিলে আমার নাম হয়ে যায়। কেমন খেলে, কয়টা গোল দিয়েছে জীবনে – কিছু না জেনেই প্লেয়ারটার প্রতি আগ্রহ জন্মে গেলো। খবরের সাথে ছবিটাতে দেখলাম লোকটার পরনে লাল একটা জার্সি। সেদিন থেকে জানলাম ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের নাম। লাল শয়তান! কিছু না বুঝেই দলটার ভক্ত হয়ে গেলাম। ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট খোলার পরে তাদের পেইজে লাইকও দিলাম। একদিন নিউজ ফীডে পেইজটার কোনো পোস্ট না পেয়ে পেইজের নাম লিখে সার্চ দিলাম। প্রথম দুই তিনটা রেজাল্ট এলো ‘উই হেইট ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড’! লাইকসংখ্যা ম্যানইউ’র পেইজের দশ বারো গুণ। মাথায় রক্ত চড়ে গেলো। সবচেয়ে বড় পেইজটাতে ঢুকে ওয়ালে লিখে এলাম “শকুনের দু’আয় গরু মরে না।” অন্যসব সাপোর্টেড দলের মতোই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের জন্য জান কুরবান হয়ে গেলাম। তাদের জয় পরাজয়কে literally নিজের মনে করে নিলাম। বিদেশি ক্লাব ফুটবলের ফিকশ্চার কেমন গোলমেলে। একটা টুর্নামেন্টের মাঝে আরেকটা চলে, খেই রাখতে পারি না। তাও খবর রাখতাম প্রতিপক্ষের চেয়ে লাল শয়তানদের গোল বেশি আছে কি না।
এই শকুনের দু’আয় গরু না মরার ব্যাপারটা একটা দুই ধারওয়ালা খঞ্জরের মতো। প্রতিপক্ষকে শকুন বলা গেলেও নিজেকে গরু হয়ে যেতে হয়। বাস্তবিকই গরু হয়ে গিয়েছিলাম, যেদিন একটা কথা বুঝতে পেরেছিলাম। প্রিয় দল হারলে আমার কিন্তু কোনো ক্ষতি হয় না। তারা জিতলে ট্রফি বা প্রাইজমানিটাও আমি পাই না। শুধু প্রতিযোগিতার মজাটা পাওয়ার জন্যই মানুষ প্রবৃত্তিগতভাবে একটা পক্ষের সাথে নিজের সাদৃশ্য খোঁজে। ওই পক্ষটার সাথে একাত্ম হয়ে যেতে চায়। হতে পারে সেটা নিজে যে জায়গায় থাকে ওই জায়গার দল, প্রিয় রঙয়ের জার্সি পরা দল ইত্যাদি। কোনো দল ভালো খেলে বলেই সবাই সেটা সাপোর্ট করে, এটা ভুল কথা। কেউ বলে বার্সা বেশি ভালো খেলে, কেউ বলে রিয়াল। কারটা মানবো? সবাই আবার নিজ মতের পক্ষে পরিসংখ্যানের দালীল নিয়ে আসে।
যা-ই হোক, দিনশেষে এটা কেবল খেলা। পাশের মহাদেশেরও পরের মহাদেশের একটা ভূখণ্ডকে কেউ সমর্থন করে। তার ভাই সমর্থন করে হয়তো আরেকটা ভূখণ্ড। তার সহপাঠী করে অন্য আরেকটা মহাদেশের কোনো একটাকে। সবই নির্দিষ্ট কোনো কারণ ছাড়া। পতাকা টাঙাতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যায় অনেকে, তাও অকারণে। প্রিয় দলের পরাজয়ে হার্ট অ্যাটাক করে মরে কেউ কেউ। অকারণে। অকারণে সবাই অনেক সিরিয়াস। বধূয়ার মতো, যে গায়কের চোখে জল এনেছে, হায় বিনা কারণে!
পত পত পতাকা…
একটু ক্রিকেট প্রসঙ্গ আনি। বাংলাদেশ যেবার পাকিস্তানকে হারিয়েছিলো, ওই ম্যাচের দিন। তখন খাটের সাথে মশারি টাঙানোর স্ট্যান্ড থাকতো। আমরা বাংলাদেশের প্রমাণ সাইজের একটা পতাকা কিনে সেটার সাথে লাগিয়ে রেখেছিলাম। ম্যাচের আগে দিয়ে দেখালো এক পাকিস্তানি তাদের পতাকা নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে। আমরা সমস্বরে ‘ধুর! ধুর!’ বলে মশারির স্ট্যান্ডে লাগানো পতাকাটা ঝাঁকাতে লাগলাম। যেন যত ঝাঁকি তত রান। আমরা যদি পতাকা ওই লোকটার চেয়ে বেশি ঝাঁকাতে পারি, তাহলেই বাংলাদেশ জিতে যাবে! অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় আমরাই বেশি ঝাঁকিয়েছিলাম। নইলে বাংলাদেশ জিতলো কীভাবে?
আরেকবার SAAF ফুটবলের টুর্নামেন্ট চলাকালীন ঘটনা সম্ভবত। ধুমধাম ফাইনালে চলে গেছে বাংলাদেশ। প্রতিপক্ষ ভারতমাতা। ফাইনালের দিন আমার বড় ভাই গেলেন নানুর বাসায়, মামাদের সাথে একসাথে টিভিতে খেলা দেখতে। পরনে পতাকার ডিজাইনে একটা টিশার্ট, সেমিফাইনালের পর সেলাই করা। আমি বাসাতেই ঘুমিয়ে ছিলাম। ঘুম থেকে উঠতেই আম্মু খবর দিলো, “বাংলাদেশ ৪-০ তে পিছিয়ে আছে।” প্রথমেই যে চিন্তাটা মাথায় এলো তা হচ্ছে, “ধুর! হুদাই পতাকার মতো টিশার্টটা সেলাই করলো!”
ফুটবল বিশ্বকাপের জন্য তেমনভাবে পতাকা টাঙানো হয়নি কখনোই। একবার শুধু কাগজে রঙ পেন্সিলে হল্যান্ডের পতাকা এঁকে দরজায় লাগিয়েছিলাম। পরে দেখলাম ফ্রান্সের একটা পতাকা চুরি করে এনে খাড়া করে টাঙিয়ে দিলেই হতো। ফার্স্ট ইয়ারে থাকতে ভার্সিটির হলে যে রুমটায় থাকতাম, তার কোনো আদি নিবাসী পাঁড় ব্রাজিলভক্ত ছিলো। দরজার দুইপাশে দেয়ালে বড় করে ব্রাজিলের পতাকা আঁকা, দরজার উপরে লেখা ‘ই-শ্বর BRAZIL’। মারকাটারি অবস্থা!
পতাকাওয়ালাদের দেশপ্রেম নিয়ে একবার প্রশ্ন উঠলো। এরপর থেকে একটা ট্রেন্ড আসলো, ছোট্ট একটা জাতীয় পতাকা আর সাপোর্টেড দলের বিশাল একটা পতাকা একই বাঁশে ভরে দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া। এমন এক দেশপ্রেমিককে হানিফ সংকেতও নিজের অনুষ্ঠানে দেখিয়েছিলো।
সেইসাথে অনলাইন খেলোয়াড়রা তো আছেই। প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়ের ছবি বিকৃত করে হিজড়া বানিয়ে, নিজ দলের জার্সি পরা কার্টুনকে প্রতিপক্ষের পতাকায় মুতু করিয়ে এরা দলের গোলসংখ্যা বাড়ায়। কয়েক বছর ধরে দেখছি গ্রাম্য মোবাইল টয়লেটের দরজা হিসেবে প্রতিপক্ষের পতাকা। কেউ নাকি দুই দলেরই জার্সি কিনবে – একটা পরতে, আরেকটায় পা মুছতে।
বাঙালি আবার চৌকস আছে। ক্রিকেট বিশ্বকাপের সময় ভারত বা পাকিস্তানের পতাকা ঝুলিয়ে রিস্ক নিতে চায় না। ফুটবল বিশ্বকাপের সময় কেবল অনেক দূরের দূরের দেশের পতাকা নিয়ে লাফালাফি করে। যাতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও না লাগে, আবার খেলোয়াড়ের মানহানি বা পতাকার অবমাননার খবর পেয়ে সেই দেশ হামলা-মামলাও না করে বসে। আর যেই দূরের দেশ, হামলা করতে চাইলেও ওখান থেকে আসতে আসতেই প্লেইনের তেল ফুরিয়ে ঠুস হয়ে যাবে।
সচেতন নাগরিক হিসেবে কথাটা জেনে রাখি। সব দেশের পতাকার নির্দিষ্ট আকৃতি আছে। দেড়শ হাত পতাকা বানিয়ে বিপক্ষকে টেক্কা দেওয়া যায়, আইন মানা যায় না। আর জাতীয় দিবসগুলো ছাড়া অন্য দিনগুলোতে আবাসিক বাসা বাড়িতে জাতীয় পতাকা লাগানোই বেআইনী, বিজাতীয় পতাকার কথা তো বাদই দিলাম। বাংলাদেশ পতাকা বিধিমালা ১৯৭২ এর বিধি ৯(৪) অনুযায়ী, সরকারের বিশেষ অনুমোদন ছাড়া বিদেশি রাষ্ট্রের পতাকা ভবনে বা গাড়িতে লাগানো অবৈধ। সরকার চাইলেই নির্দেশ দিতে পারে সব পতাকা নামানোর। তবে এত বড় ভোটব্যাংক কেউ হারাতে চায় না।
জাতীয় ঐক্য: পথ ও পন্থা
আর্জেন্টিনায় নাকি একসময় মিলিটারি অ্যাকাডেমির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় জনগণ সেদিকে দেখিয়ে বলতো, “ওই যে দেখো! আমাদের ভবিষ্যৎ প্রেসিডেন্টদের ট্রেইনিং চলছে।” সেনা অভ্যুত্থান সেখানে খুব স্বাভাবিক বিষয় ছিলো। দেশের টালমাটাল পরিস্থিতি সামাল দিতে একটা বিশ্বকাপ আয়োজনে মরিয়া ছিলো প্রশাসন। সার্কাসে জিতে গেলে আমজনতা সাধারণত বিপ্লব ভুলে যায়। ফিফা সেই সুযোগ দেয়। ১৯৭৬ সালে ক্ষমতা দখল করে সেনাবাহিনী। বিশ্বকাপ ১৯৭৮ সালে। সামরিক জান্তা নানা খাত থেকে খরচ কমিয়ে এনে ফুটবল ফোলাতে শুরু করে। শহরে যত লোক বাস করতে পারে না, সেই শহরে অবস্থিত স্টেডিয়ামের ধারণক্ষমতা হয় তার চেয়ে বেশি। জান্তার স্লোগান “25 Million Argentinians will Play in the World Cup” মানুষের মুখে মুখে পাল্টে হয়ে যায়, “25 Million Argentinians will Pay for the World Cup”. ভালো দিক যে নেই, তা না। বিশ্বকাপ আয়োজনের ফলে সে দেশে মুদ্রাস্ফীতি ৬০০% থেকে নেমে ১৩৮% এ চলে আসে।
উন্নয়নের এই মহাসড়কে বাধা সৃষ্টিকারীদের সাথে সামরিক সরকার একরকম গৃহযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। বাংলাদেশের হাজার বছর আগেই গুম সংস্কৃতির প্রবর্তন করে নিজেদের দেশে। এগারো হাজার মানুষ গুম হয়ে যায়। জান্তার পতনের পরও বছরের পর বছর ধরে হারানো সন্তানদের মৃত্যুরহস্য উদঘাটনের দাবিতে সংগ্রাম করে গেছে গুম হওয়া ব্যক্তিদের মা-নানী-দাদীদের একটি সংগঠন ‘মাদারস অব দ্য প্লাজা ডি মায়ো’।
তবে এতকিছুর পরও দল যদি চ্যাম্পিয়নই না হয়, মানুষ তো ঠাণ্ডা হবে না। এদিকে দ্বিতীয় রাউন্ডের এক ম্যাচে মোটামুটি শক্তিশালী দল পেরুকে কমপক্ষে ৪-০ ব্যবধানে না হারালে ফাইনালেই যেতে পারবে না আর্জেন্টিনা। পেরুতেও তখন সামরিক শাসক, যারা টাকাপয়সার দিক থেকে একটু টানাটানিতে ছিলো। রহস্যময় এক ম্যাচে পেরু পরাজিত হলো ৬-০ গোলে! কাপটা শেষমেশ জিতেই নিলো আর্জেন্টিনা। দেশের মানুষ সব দুঃখ-কষ্ট, ব্যথা-বেদনা, ক্যাথলিক-প্রোটেস্ট্যান্ট-ইহুদি ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে একই দেশে এক প্রাণ হয়ে একই পতাকা হাতে নিয়ে “তোমার আমার ঠিকানা, আর্জেন্টিনা আর্জেন্টিনা” স্লোগানে আনন্দমিছিলে নেমে পড়লো। বিপ্লব ফুরলো, নটে গাছটি মুড়লো।[১]
‘ভ’-তে ভিনেগার
২০১৪ বিশ্বকাপ হয়েছিলো রমাদ্বান মাসে। আমি ছিলাম ভার্সিটি ক্যাম্পাসে। হাফ-টাইম শেষ হলেই ক্যান্টিন-ডাইনিং আর বটতলায় সুহুর খাওয়ার ভিড় লেগে যায়। চৌকস আমি হাফ টাইমের ১০ মিনিট আগে ঘুম থেকে উঠে সুহুর খেতে চলে যেতাম। বয়-বেয়ারার দল প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে রেডিওতে এক কান রেখে আরেক কান দিয়ে আমার অর্ডার শুনতো। আরামে খেয়েদেয়ে যখন বের হতাম, তখন প্রথমার্ধের চুল, দাড়ি ও লোমচেরা বিশ্লেষণ করতে করতে টিভিরুম থেকে বেরিয়ে ক্যান্টিন-ডাইনিং বা বটতলার দিকে আসতো বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্যরা।
আর্জেন্টিনা ১৯৭৮ বিশ্বকাপে ৭০ থেকে ১০০ মিলিয়ন ডলার খরচ করবে বলে ধারণা করেছিলো। তবে জান্তার নানা ফষ্টিনষ্টিতে সেটা ৭০০ মিলিয়নে গিয়ে দাঁড়ায়। মানে ওই পর্যন্তই সরকার প্রকাশ করেছে। এর বাইরেও আরো কোনো খরচ থাকলে সেটা বললে চাকরি থাকবে না। তো ২০১৪ সালে বিশ্বকাপ আয়োজনে তাদেরকে বিশাল ব্যবধানে হারিয়ে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিল খরচ করেছে ১৪ বিলিয়ন ডলার। মানে এটাও সরকারি হিসাব আরকি।
ফাইনাল ম্যাচের আলাদা সম্মান। তাই সে ম্যাচের জন্যই বরাদ্দ ২ বিলিয়ন। স্টেডিয়ামের কাজে খরচ হয়েছে ৩.৬ বিলিয়ন আর অবকাঠামো নির্মাণে ১.৩ বিলিয়ন। আর ‘নিরাপদতম’ অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য রয়েছে ৯০০ মিলিয়ন ডলারের সিকিওরিটি ব্যবস্থা।[২]
ব্রাজিলের ৬১ শতাংশ মানুষ মনে করে বিশ্বকাপটা আয়োজন না করলেই ভালো হতো। এত শতকোটি টাকা হাওয়া থেকে আসেনি। এসেছে চাপিয়ে দেওয়া অতিরিক্ত পরিবহন ভাড়া থেকে, আর এসেছে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের ভাত মেরে। ব্রাজিলের বিভিন্ন শহরে আর বিশ্বব্যাপী প্রবাসী ব্রাজিলিয়ানরা এ নিয়ে বিক্ষোভ করে আসছে সেই ২০১৩ সালে ব্রাজিলেই আয়োজিত কনফেডারেশানস কাপের সময় থেকে।
ব্রাজিলিয়ান প্রেসিডেন্ট দিলমা রুসেফ আর ফিফা সভাপতি সেপ ব্ল্যাটার তোপের মুখে পড়েন উদ্বোধনী ভাষণ দিতে গিয়ে। প্রতিটি ম্যাচের সময়ই বিক্ষোভ হয়েছে স্টেডিয়ামের বাইরে। চলেছে ফিফা-বিরোধী স্লোগান।
একটি বৃহত্তর আন্দোলনের অংশ হিসেবেই এর সূত্রপাত। ১৯৯২ সালের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফার্নান্দো কলোর ডি মেলো’র পতন আন্দোলনের পর এটিই ব্রাজিলে সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ। এটি ‘২০১৩ কনফেডারেশানস কাপ রায়টস’, ‘ব্রাজিলিয়ান স্প্রিং’, ‘জুন জার্নিস’ ইত্যাদি নামে খ্যাত। আরেকটি নাম হলো ‘ভি ফর ভিনেগার মুভমেন্ট’। কারণ টিয়ার গ্যাস থেকে বাঁচতে বিক্ষোভকারীরা ভিনেগার বহন করেন। আন্দোলনের কারণগুলোর মধ্যে আছে বাস, ট্রেইন, মেট্রো ভাড়া বৃদ্ধি; অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতের ব্যয়; জীবনযাত্রার অতিরিক্ত খরচ, স্পোর্টস ইভেন্টগুলোতে অতিরিক্ত বিনিয়োগ ইত্যাদি। রিও ডি জেনিরো থেকে ৩ লাখ ও সাও পাওলো থেকে ১ লাখ সহ প্রায় ২ মিলিয়ন বিক্ষোভকারী এতে অংশ নেন। পুলিশি ধরপাকড়ে মারা যায় কমপক্ষে ১০ জন, আহত আড়াই শ। সাড়ে ছয় শ এর বেশি গ্রেফতার হয়।[৩]
বিশ্বকাপের কিছু আগেই দক্ষিণ ব্রাজিলে বন্যা হয়। আক্রান্ত অঞ্চলগুলোর মধ্যে আছে পারানা, যার রাজধানী কুরিতিবা হচ্ছে ১২টি বিশ্বকাপ ভেন্যুর একটি।[৪]
দৈনিক প্রথম আলোতে উৎপল শুভ্রর একটা কলামে প্রকাশিত হয়েছে এরেনা করিন্থিয়ানস স্টেডিয়ামের মিডিয়া সেন্টারের প্রবেশদ্বারে একটু উপরে তাকালেই চোখে পড়ে একটা দেয়াললিখন ‘…কাপ’। রাফ বাংলা অনুবাদ হতে পারে ‘বেশ্যাকাপ’। বিশ্বের হাততালির শব্দে এমন অনেক গালাগালির শব্দই চাপা পড়ে যায়।
তো? আমার কী?
লেখাটার বেশিরভাগ অংশ আমি লিখেছিলাম ২০১৪ বিশ্বকাপের সময়ে। সম্মানিত ভাই মাহমুদ বিন আমান অনেক কষ্ট করে তা স্টোর রুম ঘেঁটে বের করে আনেন। সেই লেখায় ‘ইসলামের আলোয়, ইসলামের তাপে, ইসলামের ছায়ায়’ শিরোনামে একটা অংশ ছিলো। জাতীয়তাবাদ, সতর খোলা রাখা, মদ-জুয়া-অশ্লীলতার সয়লাব ইত্যাদি দিয়ে আমি প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিলাম যে, এসব খেলাধুলা দেখা হারাম। কিন্তু পরে শিক্ষিত ও ইসলাম-সচেতন কিছু ভাইদের সাথে আমার ওঠা-বসা হয়। তাঁরা আমার এই আধো আধো হারাম পুলিশিংকে অ্যাকাডেমিক দালীল-আদিল্লা দিয়ে রীতিমতো ধসিয়ে দেন। কোনো এক মাযহাবে যে পুরুষের সতর কেবল লজ্জাস্থান, এইটুকু জ্ঞানই আমার ছিলো না। তাই আমি ওই আগের লেখার এই অংশটুকু সরিয়ে নিয়েছি। সাথে আরো কিছু যোগ-বিয়োগ করেছি।
কিন্তু কিছু ব্যাপারে প্রতিটি মুসলিমই একমত হবেন। আল্লাহ্ আমাদেরকে আরদ্বে খলিফা হিসেবে প্রেরণ করে যেসব দায়িত্ব দিয়েছেন, বৈশ্বিক ক্রীড়াকৌশল আয়োজনের এই প্রক্রিয়ায় (যেগুলোর বেশিরভাগ অংশের নেতৃত্বে আছে কাফিররা) আমাদের সেসব দায়িত্বের অনেকগুলোই ব্যাহত হচ্ছে। আর কিছু না হোক, অন্তত এই পালা-পার্বণগুলো যে নির্দোষ বিনোদনের সীমানা ছাড়িয়ে জালিমদের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে – তা নিয়ে কারোরই দ্বিমত নেই। মুসলিমদের মাঝে দালীল-সচেতন সেন্সিবল একটি অংশ যদিও সকল ফরয দায়িত্ব ঠিক রেখেই খেলাধুলা উপভোগ করছেন, কিন্তু বৃহত্তর অংশটি তাদের ফ্যানাটিসিজমকে অনেক আগেই হালালের সীমা পার করিয়ে ছেড়েছে। পুরো লেখাটিতে আমি মূলত এই কথাগুলোই প্রমাণ করার চেষ্টা করেছি। ব্যক্তিগতভাবে কে কী করছে, তা আমি জাজ করার কেউ নই। কিন্তু উম্মাহভিত্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে আমাদের এসকল সার্কাস পার্টির দিকে প্রশ্রয়ের দৃষ্টি নিক্ষেপ করা অনুচিত বলেই আমার মনে হয়। সঠিক ব্যাপার আল্লাহ্ই ভালো জানেন।
[১] Soccer Against the Enemy, Simon Kuper
[২] http://en.wikipedia.org/wiki/Brazil_2014
[৩] http://en.wikipedia.org/wiki/2013_protests_in_Brazil
[৪] http://www.globalpost.com/dispatch/news/afp/140609/brazil-floods-kill-nine
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।