– ঈদ মেকাপ ফেস্টিভ্যালে যাবি?
– কোন ডিজাইনারের জামা কিনছিস এবার?
– আমি কিন্তু অমুক বুটিকের ড্রেসই কিনবো, দাম হাজার দশেকের উপর হলেও, ওরা ওয়ান পিস-ই বানায়। তার মানে এই জামা আমি ছাড়া আর কারো থাকবে না!
ঈদের মৌসুম এগিয়ে আসলে সমাজের একাংশের আলোচনার মূল বিষয় থাকে ঈদ শপিং, ডিজাইনারস’ ড্রেস, বহুমূল্যবান পোশাক ইত্যাদি! রোজার মাস শুরু হবার অনেক আগে থেকেই ফ্যাশন পাড়াগুলোর জমজমাট অবস্থা শুরু হয়। ভাবখানা এমন যে, রোজার জন্য ঈদ নয়; বরং ঈদটাই আসল, রোজা তো উসিলা মাত্র! এসব কাণ্ডকারখানা দেখে মনে হয় কোনোভাবে যদি রামাদ্বান মাসকে ডিলিট করে দিয়ে এক লাফে শাওয়াল মাসে চলে যাওয়া যেত, তাহলে ডিজাইনার সমাজের ব্যাপক উপকার সাধিত হতো। অবশ্য তাহলে আবার রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হয়ে যেত। তারাও তো সারা বছর বসে থাকে ‘রোজার’ মাসের জন্য। এই মাসটাই যদি নাই হয়ে যায়, তাহলে প্রতিনিয়ত এত এত ইফতার আর সেহেরি পার্টিগুলো কোথায় হবে?
অন্যান্যবারের মতো আসন্ন রামাদ্বানেও নিশ্চয় দেখা যাবে ফ্যাশন শো, টিভিতে প্রতিদিন ঈদের মেক আপ টিপস নিয়ে প্রোগ্রাম ও ইফতারের রেসিপির অনুষ্ঠানে ছেয়ে যাবে প্রতিটি চ্যানেল। কিন্তু রামাদ্বান কি আদতে এসব অসংযম ও নতুন কাপড়ের প্রতিযোগিতার জন্য আসে? এসবের ভিড়ে আমরা যেন আজ ভুলতে বসেছি যে, আল্লাহ্ আমাদের প্রতি বছর ‘রিস্টার্ট’ বাটনে চাপ দিয়ে জীবনকে নতুন করে শুরু করার সুযোগ দেন রামাদ্বানে। এই মাসে আমাদের জন্য স্পেশাল অফার হিসেবে দেওয়া হয় শ্রেষ্ঠ রজনী লাইলাতুল কাদর-কে। একটু ভালো করে ভেবে দেখলে সবাই স্বীকার করবেন যে, বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় এই সময় ইবাদাতে মন বসানো তুলনামূলকভাবে অনেক সহজ হয় আলহামদুলিল্লাহ্!
অথচ আমরা কী করি? ইফতার পার্টি আর শপিংয়ের আড়ালে আবডালে কখন যে এই মহামূল্যবান সময়টি শেষ করে ফেলি, তা টেরও পাই না! অনেকে বলেন যে, রোজাদারদের ইফতার খাওয়ানোর ও ঈদের দিন ভালো কাপড় পরার কথা ইসলামেও বলা আছে। এজন্যই আমরা এসব করি। কিন্তু আমরা কি আমাদের এ ধরনের খোঁড়া যুক্তি দিয়ে নিজেদেরই ধোঁকা দিচ্ছি না? ইসলামে সিয়ামপালনকারীকে খাওয়ানোর ও ভালো পোশাক পরার যে সংজ্ঞা দেওয়া আছে, তা কি আমরা মানি? নাকি শয়তান ভালো কাজের খোলসে করে আমাদের নিকট আল্লাহ্র অপছন্দনীয় কাজগুলোকে শোভন করে দিচ্ছে?
ইফতার পার্টির নামে হাজার পদ রান্না করে যে শো ডাউনের আয়োজন করা হয়, তা কি আমাদের নবী করীম ﷺ এর সুন্নাতের মাঝে পড়ে? হাজার হাজার লাখ লাখ টাকা খরচ করে আমরা যেসব ঈদের কাপড় কিনি, তা কি কখনো ইসলাম সাপোর্ট করতে পারে? নাকি করা সম্ভব? সামাজিক চাপে হোক অথবা লোক দেখনোর মানসিকতাতেই হোক, সত্যিকার অর্থে সংযমের মাসেই আমরা সবচেয়ে অসংযমী আচরণ করি।
এখনো মনে আছে শৈশবে “ঈদের নতুন জামা” নামক বস্তুটি বিশাল আনন্দের একটি ব্যাপার ছিলো। মা গজ কাপড় কিনে নিয়ে দর্জি দিয়ে তা সেলাই করাতেন। ঈদের আগের রাত পর্যন্ত সেই কাপড় আমরা সযতনে লুকিয়ে রাখতাম, মাঝে মাঝে ভাঁজ খুলে গন্ধ নিতাম। আর নতুন জুতা জোড়ার কথা কী আর বলবো, কয়েক রাত সেই জুতো সাথে নিয়ে না ঘুমালে যেন ঘুমই আসতো না! আজকালকার তুলনায় কত সাধারণ ছিল সেসব জামা জুতো, কিন্তু কী অসাধারণ ছিলো সেইসব অনুভূতি।
আর এখন সারা বছর সবাই এত বেশি কাপড় জামা কেনে যে, ঈদের নতুন কাপড় পাবার আনন্দ অনেকটাই ফিকে হয়ে গেছে। এখন আনন্দের চেয়ে দামী ও হাল ফ্যাশনের কাপড় কেনার প্রতিযোগিতাই চোখে পড়ে বেশি। উৎসবের নিষ্পাপ আনন্দটা তাই আর খুঁজে পাওয়া যায় না। আনন্দের যে এখন বাণিজ্যিকীকরণ হয়ে গেছে!
আমার লেখা পড়ে অনেকেই হয়তো কপাল কুঁচকে বলবে, “লেখকের সমস্যা কী? সব সাধারণ জিনিসেই দেখি সমস্যা খুঁজে বের করেন! দশ বারো পদের ইফতার বানালে এটি হবে বিলাসিতা আবার শপিংও বেশি করতে পারবো না, নতুন জামাও দামী দেখে কিনতে পারবো না? কী আশ্চর্য কথা!! তাহলে ঈদের সময় আমরা করবোটা কী?”
ঈদের সময় ভালো কাপড় পরায় দোষের কিছু নাই। আল্লাহ্ আমাদের মুসলিমদের জন্য দুটো ঈদ দিয়েছেন আনন্দ করার জন্য, তাই এ সময় আমরা আনন্দ করতেই পারি! কিন্তু উৎসবটা যেহেতু আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার দান ও তাঁর নির্দেশ, তাই উৎসব উদযাপনের ঢঙটাও তাঁর পছন্দানুসারে হওয়াটাই নিশ্চয় যুক্তিসঙ্গত হবে। আমরা জাতিগতভাবেই বাড়াবাড়ি পছন্দ করি, তাই ঈদে সুন্দর কাপড় পরার প্রথাটাকেও বাড়াবাড়ির পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছি। কোরবানির সময় যেমন গরুর দাম নিয়ে প্রতিযোগিতা হয়, রোজার সময় সেটি হয় জামা কাপড় নিয়ে। কে কিরণমালা জামা কিনলো আর কে পাখি ড্রেস পেলো না, তা নিয়ে চলে তুলকালাম কাণ্ড!
উচ্চবিত্তদের মাঝে চলে কে কোন ডিজাইনারের জামা কিনলো, সেটি নিয়ে প্রতিযোগিতা! কে জানে, আজকাল অনেকে ঈদের কেনাকাটা করতে হয়তো বিদেশেও যায়। প্রতিদিন পেপারে আর টিভিতে ঈদ ফ্যাশন নিয়ে সুবিজ্ঞজনেরা নানান মতামত ব্যক্ত করেন ও অতি বিজ্ঞ দর্শকরা সেসব দেখে দেখে কেনার জন্য অস্থির হয়ে যান। রোজার মাসের শেষের দিকে পত্রিকার শেষ পাতায় খবর ওঠে সে বছরের সবচেয়ে দামী কয়েক লাখ টাকা দামের লেহেঙ্গার বিক্রয়ের খবর ও সাথে থাকে গর্বিত ক্রেতা-বিক্রেতার হাস্যোজ্জ্বল ছবি।
ঘরে ঘরে ঝগড়া হয় এই কেনাকাটা নিয়ে। স্বামী-স্ত্রী, বাবা-সন্তানে চলে বিবাদ বিসম্বাদ। সমাজের সাথে তাল মেলানোর জন্য নিজের সামর্থ্যের গলায় পাড়া দিয়ে অনেক সময় অদরকারী মূল্যবান জিনিসপত্র ক্রয় করেন অনেকে। আবার সামর্থ্য যাদের আছে, তারা এই গরীব দেশে নির্লজ্জের মতো দশ-পনের হাজার টাকা দামের কামিজ কেনেন, অর্ধ লাখ, এক লাখ টাকা দামের শাড়ি কেনেন।
যেই দেশে মানুষ এখনো না খেয়ে মারা যায়, অল্প কিছু অর্থের জন্য বিনা চিকিৎসায় ধুঁকতে থাকে, সেই দেশে মানুষ কীভাবে পারে স্রেফ কাপড়চোপড়ের জন্য এত কাড়ি কাড়ি অর্থ ব্যয় করতে! দূরের লোকের কথা না হয় বাদই দিলাম, আমাদের ঘরের গৃহকর্মীদের সামনে অতি মূল্যবান এসব পোশাক পরে ঘুরে বেড়াতে কি আমাদের একটুও বিবেকে বাঁধে না! যেখানে কাজের মেয়েটিকে সারা মাস গাধার মতো খাটুনি খাটাবার পরও আমরা গুনে গুনে হাজার কয়েক টাকা দেই, তাকে একশ টাকা বেশি দেবার আগে দশবার চিন্তা করি, সেখানে মুহূর্তের ভেতর এর চেয়ে বহুগুণ অর্থ দিয়ে শাড়ি-কাপড় ক্রয় করি কী করে আমরা? সত্যিই কি আমাদের লজ্জার অনুভূতি এতটাই ভোঁতা হয়ে গিয়েছে?
তাও আবার দামী কাপড়গুলো হাতে গোনা কয়েকবারের বেশি তো পরাও হয় না। ঈদে যে মেয়ে পনের সেট জামা পায়, সেও দেখা যায় এক মাস পর আলমারী খুলে বলবে, “উফ! পরার মতো তো কিছুই নেই আমার কাছে, আবার শপিংয়ে যেতে হবে!” এভাবে একদিকে ধনীদের সমাজে যখন নোংরা প্রতিযোগিতার খেলা হয়, তখন অপর দিকে দরিদ্র পাড়ায় লোকে যাকাতের মশারী মার্কা শাড়ি-লুঙ্গি নিতে গিয়ে ভিড়ের চাপে পদপিষ্ট হয়ে প্রাণ হারায়।
মাঝে মাঝে চিন্তা করি, একজন মানুষের বেঁচে থাকার জন্য কয় সেট কাপড় লাগে? কোনো কাপড় একবার লোকে দেখে ফেললে সেই কাপড় কেন দ্বিতীয়বার তাদের সামনে পরা যায় না! কেন পোশাক-আশাক আর ঐশ্বর্য দিয়ে একজন মানুষের মূল্য নিরুপন করতে হবে? মানুষের পরহেজগারিতা, পবিত্র হৃদয়, উত্তম চরিত্র, মেধা ইত্যাদি দিয়ে কেন তাদের যাচাই করা যাবে না? বাহ্যিক সম্পদশালীতা তো খোলস মাত্র! অন্তরের প্রাচুর্যই তো আসল সৌন্দর্য বহন করে!
আবদুল্লাহ নামে মহানবী ﷺ এর একজন সাহাবী ছিলেন। তিনি অমুসলিম থাকা অবস্থায় কাপড়, সুগন্ধি ইত্যাদির শৌখিনতার জন্য বিখ্যাত ছিলেন! আর সেই মানুষটি ইসলাম ধর্ম গ্রহণের কারণে এক কাপড়ে তাঁর ধনী পরিবার থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। সেই একটি চাদরের মতো কাপড়কে উনি দু টুকরো করে শরীরের ঊর্ধ্বাংশ ও নিম্নাংশে পরিধান করতেন। সবাই তাঁকে ভালবেসে ডাকত “দু কাপড়ের মালিক” নামে। মৃত্যুর সময় এই দু টুকরো কাপড়ই ছিল তাঁর শেষ সম্বল।
আল্লাহ্ তাঁকে দ্বীনের প্রতি ন্যায়নিষ্ঠতার জন্য এতটাই সম্মান দিয়েছিলেন যে, ইসলামের দুই বিশিষ্ট খলিফা তাঁর কবর খোঁড়েন ও রাসুল ﷺ নিজ হাত তাঁকে কবরে শুইয়ে দেন। কই, অল্প বস্ত্র থাকার জন্য তো তাঁকে ইসলামে কোনোরকম হেয় করা হয় নি! বরং তাঁর তাকওয়ার কথা মুসলিমরা আজও স্মরণ করে।
যা হোক, লেখা শুরু করেছিলাম ঈদ শপিং নিয়ে। তাই আবার ফেরত আসছি সেই বিষয়ে। অসংযমী না হয়ে কিছু কেনাকাটা করাতে আশা করি দোষের কিছু নেই। কারণ প্র্যাক্টিক্যালভাবে চিন্তা করলে দেখা যায় কিছু শপিং আমাদের করতেই হয় ঈদের আগে, হয়তো নিজের জন্য ততটা না করলেও অন্যের জন্য হলেও কিনতে হয়। তবে বাজারে গেলে কিছু বিষয় মাথায় রাখলে আমরা অনাকাঙ্ক্ষিত অপচয় ও পার্থিব প্রতিযোগিতা থেকে নিজেদের দূরে রাখতে পারবো ইনশা আল্লাহ্। তাই এ লেখা শেষ করছি শপিংয়ের ওপর অল্প কিছু টিপস দিয়ে-
■ রোজার আগে প্রয়োজনীয় কেনাকাটা সেরে ফেলা, তাহলে রোজার দিনে বাজারে গিয়ে মূল্যবান সময় নষ্ট হবে না।
■ কার জন্য কী লাগবে, তা আগে থেকেই লিস্ট করে নেয়া।
■ লোক দেখানোর জন্য অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটা এবং অহেতুক অতিরিক্ত দামী পোশাক ক্রয় হতে বিরত থাকা।
■ অহঙ্কার প্রদর্শন হয়, এমন পোশাক না কেনা।
■ সত্যিকার অর্থে যাদের ঈদের কাপড় দরকার অথবা যাদের একেবারে না দিলেই নয়, শুধুমাত্র তাদের জন্য কেনা।
■ নিজের কাছে যদি আগে থেকে নতুন পোশাক থাকে অথবা উপহার হিসেবে পাওয়া হয়, তবে নিজের জন্য আবার নতুন করে না কেনা।
■ অনেকে নতুন জামা কাপড়ের সাথে সাথে সংসারের জন্য ঈদ উপলক্ষে নতুন ফার্নিচারও কেনে। এসব হাস্যকর বিলাসিতার ফাঁদে পা না দেওয়া।
■ গরীবদের জন্য যাকাতের টাকায় নিম্নমানের শাড়ি-লুঙ্গি না কেনা। কারণ যাকাতের টাকা সরাসরি প্রাপককে দেওয়াই নিয়ম।
■ যাদের দেবার কেউ নেই, সম্ভব হলে তেমন মানুষ খুঁজে বের করে তাদের জন্য পোশাক কেনা যায়।
■ এবং অবশ্যই ইসলামে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, এমন পোশাক না কেনা। উদাহারণস্বরূপ বলা যেতে পারে অশালীন কাপড়।
পরিশেষে বলতে চাই, ঈদ-উল-ফিতর একটি পবিত্র আনন্দের দিন। সারা মাস সংযম সাধনার পর আমরা উপহারস্বরুপ সুমহান প্রতিপালকের পক্ষ হতে এই উৎসবটি পেয়েছি। তাই সংযমের মাসে যেমন আমাদের চূড়ান্ত অসংযমী হওয়া কাম্য নয়; ঠিক তেমনি ঈদের দিন উপলক্ষে এমন কিছু করা উচিত নয়, যা সারা মাসের ইবাদাত সাধনাকে নষ্ট করে এক লাফে আমাদের জাহিলিয়াতের যুগে ফেরত নিয়ে যাবে।
সওম পালনের মাধ্যমে প্রাপ্ত শিক্ষা এবং অর্জিত তাকওয়াকে যদি আমরা এমন এক লহমায় হারিয়ে ফেলি, তাহলে আমাদেরকে দুর্ভাগা ছাড়া আর কী-ই বা বলা যাবে! আল্লাহ্ সর্বোত্তম সাহায্যকারী, তিনি যেন আমাদের সহায় হন। আমিন।
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।