“সত্যি করে বলুন, আজ আপনাকে বলতেই হবে, আপনি কি আমাকে আর ভালোবাসেন না?”
জীবনসাথীর কাছ থেকে আসা উত্তরটা যেনো অবশ্যই সত্য হয়- এই চাওয়ার পেছনের দাবীটা আর বুকের ধুকপুকানিটা একদমই নিখাঁদ।
সত্যকে জানতে চাওয়ার এই তীব্র আকুতিটা আমাদের জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রেই একেবারে লতাপাতায় জড়ানো। ডাক্তার সাহেব সত্যি কথা বলবেন, চাকুরীর নিয়োগদাতা মিথ্যা বলবেন না, বই আর প্রবন্ধে সত্যি কথা লেখা থাকবে এই চাওয়াগুলো কার ভেতরে নেই? সংবাদ সংস্থা থেকে শুরু করে বিচারালয়, স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, শিক্ষক, রাজনীতিবিদ, পরিবহন ব্যবস্থা, ঔষুধের বোতল, বিজ্ঞাপনদাতা কিংবা খাবারের প্যাকেটের গায়ে উপাদানের পরিমাণেও যেনো সত্য কথা লেখা থাকে এটাই আমাদের চাওয়া। টাকা-পয়সার লেনদেন, সম্পর্ক, নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য কিংবা শিক্ষা প্রতিটা ক্ষেত্রেই আমাদের দাবী, আমাদের চাওয়া একটাই। সেটা হলো “সত্য”। এইসব ক্ষেত্রে ছাড় দেয়ার, আপোষ করার প্রশ্নই আসে না। কক্ষনো না।
সত্যের প্রতি আমাদের এই সু-তীব্র দাবী আর সুন্দর ভালোবাসাটাই কেমন যেনো ম্যাটম্যাটে, নিরস, মেরুদন্ডহীন আর অসৎ হয়ে পড়ে, যখন নৈতিকতা আর ধর্মের সত্যের বিষয়টা সামনে এসে দাঁড়ায়। আমরা তখন আনমনা হয়ে মুখ উদাস করে মাথা চুলকাতে চুলকাতে কেটে পড়ার ধান্দা করি, কিংবা চুপ মেরে যাই। নিজের ভেতরটাকেও “চোওওপ” বলে একটা কড়া ধমক দিয়ে থামিয়ে দিতে চাই।
ধর্ম বা নৈতিকতার ব্যাপারে আমাদের ভেতরের এই নেতিবাচক মনোভাবটা খুব কম মানুষই স্বীকার করে। এই নেতিবাচক মনোভাবের ভিত্তিটা যে যৌক্তিক আর বুদ্ধিবৃত্তিক নয়, বরং ইচ্ছাকৃতভাবেই এড়িয়ে যাওয়া- এটা বলার মতো সাহসী আর সৎ মানুষ খুব কমই দেখা যায়। এইসব ক্ষেত্রে আমরা কিছু না বুঝেই ঝটাপট তৈরী করা কিছু উত্তর ঝেড়ে দিই। “সামাজিক জীব” হিসেবে আমরা প্রায় সবসময়ই কিছু স্ববিরোধী তথা আত্মঘাতী বক্তব্যকে অন্ধভাবে অনুসরণ করি, যেমনঃ
“আরে ধম্মো-টম্মো এইসব মানুষের বানানো ব্যাপার, এর মাঝে সত্যের কিছু নেই।”
“এটা আপনার জন্যে সত্যি, আমার জন্যে নারে ভাই।”
“বুঝলা মিয়া, নিশ্চিত সত্য বলে কিছু নাই।”
“সবকিছুই আপেক্ষিক।”
“হুম, এইসব আসলে দৃষ্টিভঙ্গীর ব্যাপার।”
“এইটা আপনি বিচার করার কে?”
“ধর্ম হচ্ছে বিশ্বাসের ব্যাপার। এখানে ফ্যাক্ট তথা নিশ্চিত সত্যের কোনো ব্যাপার নাই।”
দিনশেষে আমরা আসলে ঐ সত্যটাকেই পছন্দ করি, যেটা আমাদেরকে আনন্দিত করে, স্বস্তি দেয়, কষ্ট দেয় না। কোনো সত্য যখনই চোখে আঙ্গুল দিয়ে আমাদের অন্ধকারকে দেখিয়ে দেয়, বুঝিয়ে দেয় যে আমরা দোষী, ভুল করে চলেছি, তখন আমরা সেই সত্যকে আর পছন্দ করি না। দূরে দূরে থাকতে চাই। যেনো দূরে থাকলেই সত্যটা পাল্টে যাবে। মিথ্যে হয়ে যাবে। সম্ভবত এটাই সত্য যে, সত্যকে হজম করবার মতো শক্তি আমাদের নেই।
আমাদের হৃদয় আর মননে গেঁথে যাওয়া এই অশুভ সাংস্কৃতিক অসততা সমাধানের জন্যে সত্যের ব্যাপারে কয়েকটা প্রশ্নের সমাধান করা অতীব জরুরী। কী সেগুলো?
১. সত্য কী?
২. সত্যকে কি জানা সম্ভব?
৩. ঈশ্বর সম্পর্কিত সত্যকে জানা সম্ভব?
৪. এসবে কী আসে যায়? সত্য নিয়ে এত প্যানপ্যানানির কী আছে?
সত্য কী?
“যেটা যেরকম, সেটাকে ঠিক সেভাবেই বলা” অথবা “যা কোনোকিছুর প্রকৃত অবস্থাকে বর্ণণা করে” সেটাই সত্য।
আমাদের সমাজে ইদানীং সত্যকে আপেক্ষিক হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়, অথচ যা সত্য, তা সবসময়েই সত্য। সত্য কারো মতামতের উপরে নির্ভরশীল নয়। কোনো বিষয়ে একজন জ্ঞানী মানুষের মতামত মিথ্যে হতে পারে, আবার একজন অজ্ঞের মতামতও সত্য হয়ে যেতে পারে। মতামত আর চলতি বিশ্বাস যাই হোক না কেনো, সত্য সত্যই থাকে। বিশ্বাস পরিবর্তনশীল হতে পারে, মতামত আর দৃষ্টিভঙ্গী বদলে যেতে পারে, কিন্তু সত্য অপরিবর্তনশীল।
উদাহরণ দেয়া যাক। মানুষ একসময় বিশ্বাস করতো পৃথিবী একটা বিছানো সমতল ভূমি। সত্যটা প্রকাশ পাওয়ার পর দেখা গেলো মানুষের বিশ্বাসে ভুল ছিলো। ঐ সময়ের মানুষের বিশ্বাস, মতামত আর বিশ্লেষণের ক্যানভাসে পৃথিবীর ছবি চারকোণা সমতল হলেও, আসলেই কি পৃথিবী চারকোণা সমতল ছিলো? মোটেও না। পৃথিবী গোলাকারই ছিলো সবসময়। দৃঢ়বিশ্বাস আর ব্যক্তিগত মতামত সত্যের উপরে কোনো প্রভাবই ফেলে না, তা যতো লক্ষ বছরের বিশ্বাস আর প্রতিষ্ঠিত মতামতই হোক না কেনো।
সত্যের একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটা সবসময়ের জন্যেই সত্য। সত্য আপেক্ষিক না। সত্য সবসময়েই পরম (absolute)। আরো একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সত্যের উল্টোটা সবসময়েই মিথ্যা। ঠান্ডা মাথা নিয়ে একটু ভেবে দেখা যাক তাহলে। ধরা যাক, “সূর্য গোল” এই কথাটা যদি সত্যি হয়, তাহলে এর উল্টো কথা হচ্ছে “সূর্য গোল না”। প্রথম কথাটা সত্যি হলে, সেটা সবসময়ের জন্যেই সত্যি, এবং সেইক্ষেত্রে দ্বিতীয় কথাটা সবসময়েই মিথ্যা। এটাই ফ্যাক্ট। সব সত্যের উল্টো কথাই মিথ্যা। এটা ধর্মীয় সত্যের ক্ষেত্রেও সত্যি। আশা করি বুঝা গেছে। তাও গোলমেলে মনে হচ্ছে? তাহলে পড়তে থাকুন। একটু পরে একদমই ফকফকা ক্লিয়ার হয়ে যাবে ইনশা’আল্লাহ। ঠিক আছে?
অনেকক্ষণ ভারী ভারী কথা হলো। এখন একটা হালকা গল্প কল্পনা করি। অনল আর হামজা। দুই ত্যাঁদড় টাইপের বন্ধু গলা ফুলিয়ে তর্ক করছে। চায়ের কাপে সুনামি চলছে। আড্ডার অন্যান্য বন্ধুরা হা করে চুপচাপ এই দুই ট্যালেন্টের তর্ক শুনছে গালে হাত দিয়ে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। এক পর্যায়ে অনল দাঁড়িয়ে শ্রোতা বন্ধুদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলোঃ
“তোরা দ্যাখ, এই মুসলিমগুলা কত্তো সংকীর্ণমনা! আমি হামজার সব কথা শুনলাম। তোরা জানিস হামজা কী বিশ্বাস করে? ও বিশ্বাস করে যে ইসলামই সত্য আর যেটা ইসলামের উল্টা কিংবা সাংঘর্ষিক সেটা মিথ্যা। এই মুসলিমগুলা সব আসলেই সংকীর্ণমনা!”
হামজা মিটিমিটি হাসছিলো অনলের কথা শুনে। অনলের কথা শেষ হবার পর সে উঠে দাঁড়িয়ে সবার দিকে তাকিয়ে সিরিয়াস একটা মুখ বানিয়ে বললোঃ
“তোরা দ্যাখ, এই এথিইস্টরা (atheists) কত্তো সংকীর্ণমনা! আমি অনলের সব কথা শুনলাম। তোরা জানিস অনল কী বিশ্বাস করে? ও বিশ্বাস করে যে এথিইজমই (atheism) সত্য আর যেটা এথিইজমের উল্টা কিংবা সাংঘর্ষিক সেটা মিথ্যা। এই এথিইস্টগুলা সব আসলেই সংকীর্ণমনা!”
আড্ডার বন্ধুরা একটু চমকে উঠলো প্রথমে, তারপরেই বুঝতে পেরে ঠাঠা করে হাসতে শুরু করলো। আসলেইতো। এথিইস্টদের সত্যের দাবীটাওতো মুসলিমদের সত্যের দাবীর মতোই সংকীর্ণ! যদি মুসলিমদের কথা সত্য হয়, তাহলে উল্টো হবার কারণে এথিইস্টদের দাবী মিথ্যে। একইভাবে, এথিইস্টদের দাবী যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে মুসলিমদের দাবীটা মিথ্যে হতে হবে।
সত্যের ব্যাপারে আরো কিছু সত্য এখানে দেয়া হলোঃ
১. কেউ জানুক বা না জানুক, বুঝুক বা না বুঝুক, সত্য সত্য হিসেবেই অস্তিত্বে থাকে। সত্যকে খুঁজে বের করতে হয়, সত্যকে তৈরী যায় না। যেমনঃ নিউটন সাহেবের আগেও মহাকর্ষ ছিলো।
২. সত্য টাইম-স্পেস বা সময়-কালের উপরে নির্ভর করে না। যা সত্য, তা সকল সময়ের সকল স্থানের জন্যেই সত্য। যেমনঃ ২ আর ৩ এ যোগ করলে ৫ হয়, এটা সকল সময়ের সব জায়গার সব মানুষের জন্যেই সত্য।
৩. সত্যের ব্যাপারে আমাদের “বিশ্বাস” বদলাতে পারে, “বিশ্বাসে” ভুল থাকতে পারে, কিন্তু সত্য সবসময়েই অপরিবর্তনশীল। সত্য বদলায় না। যেমনঃ মানুষ বিশ্বাস করতো পৃথিবীকে কেন্দ্রে রেখে সূর্য ঘুরছে। এতে কিন্তু সত্যটা বদলে যায়নি, বরং সত্যটা বুঝতে পারার পর মানুষের বিশ্বাস বদলেছে।
৪. বিশ্বাস কখনো সত্যকে বদলে দিতে পারে না, সেটা যতোই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করা হোক না কেনো! একজন মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে যে পৃথিবীর চারপাশে সূর্য ঘুরছে। তার এই মনেপ্রাণে বিশ্বাসের কারণে সত্যটা বদলে যাবে না।
৫. কারো চরিত্র বা আচার-আচরণের কারণেও সত্য বদলে যায় না। আচার-আচরণে ভালো একজন মানুষ যেমন ভুল করতে পারেন, আবার একজন অহংকারী মানুষের কথাও সত্যি হতে পারে। সত্য কারো ব্যক্তিগত চরিত্রের উপরে নির্ভরশীল নয়।
৬. সকল সত্যই পরম সত্য। এমনকি যেগুলোকে আপেক্ষিক সত্য বলে ভ্রম হয়, সেগুলোও আসলে সত্য। উদাহরণস্বরুপ, “আমি, মোহাম্মদ তোয়াহা আকবর, আজ ১৩ই জানুয়ারী, ২০১৬ তে বড্ড মন খারাপ অনুভব করছি” কথাটাকে আপাতদৃষ্টিতে খুবই আপেক্ষিক অর্থাৎ শুধু আমার জন্যেই সত্য বলে মনে হলেও, এটা আসলে সব জায়গার সব সময়ের সব মানুষের জন্যেই পরম সত্য যে, মোহাম্মদ তোয়াহা আকবরের ঐ নির্দিষ্ট দিনে আসলেই মন খারাপ ছিলো।
সারকথা হলো, ভুল বিশ্বাস থাকা সম্ভব, কিন্তু ভুল বা আপেক্ষিক সত্য থাকা সম্ভব না। আমরা বিশ্বাস করতেই পারি যে আমাদের চোখের আকৃতি কাঁঠালের মতো, কিন্তু আমাদের সেই বিশ্বাস চোখের সত্যিকার আকৃতিকে কখনোই বদলে দেবে না। চোখের আকৃতির ব্যাপারে সত্যটা সত্যই থেকে যাবে।
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।