এক ইসলামের পঞ্চম ভিত্তি হাজ্জের বিভিন্ন কার্যাবলী মূলত যিলহাজ্জ মাসের আট তারিখ থেকে তেরো তারিখ পর্যন্ত ব্যাপৃত। এর প্রতিটি দিনের জন্য নির্ধারিত করে দেওয়া রয়েছে নির্দিষ্ট দায়িত্ব এবং আলাদা করে বিশেষায়িত করা হয়েছে দিনসমূহের মর্যাদা। আরাফাত ও কুরবানির দিনের পরের তিনদিনকে একাধারে “তাশরিকের দিন” অথবা “আইয়্যামে তাশরিক” বলা হয়। আইয়্যামে তাশরিকের উল্লেখ ও গুরুত্ব কুরআনের একাধিক আয়াত ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।

আল্লাহ্‌ বলেছেন,

IIRT Arabic Intensive

অতঃপর যখন মহান হাজ্জের করণীয় কার্যাবলী সমাপ্ত করবে, তখন আল্লাহ্‌র স্মরণে মশগুল হও, যেমন তোমরা নিজেদের বাপ দাদাদের স্মরণে মশগুল থাকো, বরং তার চেয়েও বেশি স্মরণ কর। … [সূরাহ আল-বাকারা (২) :২০০]

তোমরা নির্দিষ্ট দিনগুলিতে আল্লাহ্‌কে স্মরণ করবে … । [সূরাহ আল-বাকারা (২) :২০৩]

রাসূল (ﷺ) বলেছেন,

এ দিনগুলোতে সিয়াম রেখো না, কারণ এই দিনসমূহ হলো ভোজন করা, পান করা এবং আল্লাহ্‌কে স্মরণ করার দিন। (আহমাদ হতে বর্ণিত, হাদীস নং ১০২৮৬ )

আইয়্যামে তাশরিকের নির্ধারিত দিবসগুলোয় দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ কামনায় ও জাহান্নামের ভয়াবহ আযাব থেকে পরিত্রাণের আশায় বেশি বেশি দু’আ করার কথা বলা হয়েছে। যেভাবে নিজেদের পূর্ব পুরুষদের নিয়ে লোকে গর্ব করতো ও তাদের স্মরণ করতো, তার চেয়েও অধিক হারে এ সময়ে আল্লাহ্‌র স্মরণে নিমগ্ন থাকতে বলা হয়েছে। আল্লাহ্‌র যিকির, কুরআন তিলাওয়াত, দু’আ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে উক্ত তিন দিন ব্যয় করা বাঞ্ছনীয়। ফরয সালাতের পর মিনার সর্বোৎকৃষ্ট ইবাদত হলো আল্লাহ্‌র স্মরণে ও দু’আয় নিয়োজিত থাকা।

মিনা থেকে ফিরে এসে পরিতাপ হয়েছে, কত সুন্দর করে এই বিশেষ সময়ের সদ্ব্যবহার করা যেত। কিন্তু এ মর্যাদাপূর্ণ সময়ের গুরুত্ব অনুধাবন করার আগেই দিনগুলো শেষ হয়ে গেলো!! আমাদের অনেকে মিনায় থাকার গুরুত্ব ও করণীয় সঠিক সময়ে অনুভব করতে পারে না। অনেকে ভাবে হাজ্জের সব কাজ শেষ, এখন কোনোমতে আইয়্যামে তাশরিক শেষ করে মক্কা ফিরে গেলেই হলো।

অলস সময়ক্ষেপণ ও গল্প গুজবের দ্বারা অমূল্য এ সময় অতি দ্রুত অতিবাহিত হয়ে যায়। আল্লাহ্‌ কুরআনে যেমন বলেছেন, বাপ দাদাদের মানুষ যেভাবে স্মরণ করে সেভাবে অথবা তার চেয়েও অধিক হারে সুমহান মালিককে স্মরণ করতে। আসলেই মিনাতে নিজেদের বাপ দাদা, কার পরিবার কেমন, ঘরে কাকে কাকে ফেলে এসেছে, ছেলে মেয়েরা কী করে, মেয়ের জামাইরা কী করে, ইত্যাদি বিষয় নিয়ে দিনমান আলোচনা হয়!

হাজ্জে যাবার আগে আমাদের হাজ্জের প্রতিটি দিনের তাৎপর্য সম্পর্কে উত্তমরূপে পড়াশোনা করে নেয়া উচিৎ। তা না হলে নিজেদের অজান্তেই আমরা হারিয়ে ফেলবো মাহাত্ম্যপূর্ণ সময়ে আমাদের মালিকের যিকির করার ও তাঁর নিকট দু’আ করার অমূল্য সুযোগ!

তাশরিকের দিনে হাজীগণের ব্যস্ততা সাধারণত কম থাকে। দশ যিলহাজ্জ যারা তওয়াফ ও সা’ঈ করে ফেলেছেন, সারাদিন তাঁরা মিনাতে অবস্থান করেন। সূর্য ঢলে পড়ার পর (যুহরের ওয়াক্ত হবার পর) তিনটি জামারাতে পাথর মেরে আসেন। এই তিন দিন প্রথম দিনের মতো ভীড় থাকে না। আমি আর সাফির দুপুরের পর পাথর মারতে গেলাম। আজ তিনটি জামারাতেই পাথর মারতে হবে। জামারাতের কাছাকাছি চলে এলে সেখানের রাস্তার উপর থেকেই প্রয়োজনীয় আকৃতির পাথর সংগ্রহ করা যায়। তাই কোথা থেকে পাথর যোগাড় করবো, এ ধরনের ব্যাপারে দুশ্চিন্তা করার কোনো কারণ নেই।

অল্প দূরত্বে কিছু দূর পর পর মোট তিনটি জামারাত আছে। যথাক্রমে ছোট, মাঝারি ও বড় জামারাত। মুহাম্মাদ (ﷺ) প্রথমে ছোট জামারাতে পাথর মারতেন তারপর কিছুটা সামনে এগিয়ে গিয়ে কেবলার দিকে মুখ করে দু’আ করতেন। ২য় জামারাতের ক্ষেত্রেও একই কাজ করতেন। কিন্তু তৃতীয় অর্থাৎ বড় জামারাতে পাথর মেরে দু’আ করতে না, চলে যেতেন। আমরাও অনুরূপ করলাম।

দুই জামারাত থেকে আমরা হাজ্জের তওয়াফ ও সা’ঈ করার জন্য মক্কার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। আমাদের মতো অনেকেই বিচ্ছিন্নভাবে মক্কার দিকে যাচ্ছেন। রাস্তার এক পাশে বড় ক্যারাভান থেকে হাজ্জ যাত্রীদের বোতলে করে মিনারেল ওয়াটার সরবরাহ করা হচ্ছে। আমরাও পানি নিলাম, এবং সেই পানির কিছুটা খেলাম ও কিছুটা দিয়ে উযু করলাম। আসরের ওয়াক্ত হয়ে যাওয়াতে সকলে পথিমধ্যে যাত্রা বিরতি দিয়ে সালাত আদায় করে নিলাম।

আজ দেখলাম বেশ কিছু বাস মক্কা যাচ্ছে, আমরা উঠে পড়লাম লাল রঙের ‘সাপেরো’ নামের সরকারি এসি বাসে। খুব আরামে গন্তব্যে চলে এলাম। মিনা থেকে মক্কা যাবার একটি টানেল আছে, বাস সেই টানেল দিয়ে এসে আমাদের মাসজিদুল হারামের নিকটে নামিয়ে দিয়ে গেলো। টানেল থেকে বের হয়ে নিজেদের মাসজিদ এলাকার অভ্যন্তরে আবিষ্কার করলাম।

হাজিদের প্রচণ্ড ভীড়ে মাতাফ এলাকা আজও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মাসজিদের বাহিরের দিকের প্রাঙ্গণে বিশাল এল সি ডি টিভির পর্দায় মাতাফের ভীড় দেখানো হচ্ছে ও স্ক্রিনে লেখা ভেসে উঠছে, “এখন মাতাফ এলাকা বন্ধ”। যারা তওয়াফ করছেন, তাঁদের কাজ শেষ হলে আবার মাতাফ খুলে দেওয়া হবে। তখন অপেক্ষমানরা তওয়াফ করতে পারবেন। আমরা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মাসজিদের ভেতর সুশীতল হাওয়ায় অপেক্ষা করতে লাগলাম।

অবশেষে একসময় সুযোগ পেলাম ও তওয়াফের জনস্রোতে ঢুকে পড়লাম। সুবহানআল্লাহ, তখন মাতাফে কত হাজার মানুষের সাথে একত্রে তওয়াফ করেছি জানি না। হাজার হাজার মানুষের ভীড়ে আমরা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেলাম। আমার চতুর্দিকে অসংখ্য মানুষ, সামনে পেছনে, ডানে বামে সর্বত্র। সাফির পেছন থেকে আমাকে আড়াল করে রেখেছে, যেন আমার গায়ে কারো ধাক্কা না লাগে।

এক এক বার কাবাকে চক্কর দিতে দীর্ঘসময় লেগে গেলো। সূর্যকে কেন্দ্র করে যেমন গ্রহমালা এক নির্দিষ্ট নিয়মে ঘূর্ণায়মান থাকে, আজ যেন তেমনি করে অজস্র হাজি বিশ্বের প্রাচীনতম ইবাদাতের পবিত্র গৃহকে কেন্দ্র করে ঘূর্ণনে আবদ্ধ। সব আল্লাহ্‌ভীরু মুসলিমের অন্তরে সম্মানিত এ বাইতুল্লাহর তওয়াফ করার একান্ত বাসনা অতি সযত্নে প্রতিপালিত হয়। বিশ্ব জাহানের সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী, সর্বশক্তিমান প্রভু যখন আমন্ত্রণ জানান, শুধুমাত্র তখন কোনো বান্দা এই ইবাদাতে শরীক হতে পারে। হাজ্জে আসতে পারা আমাদের মতো ক্ষুদ্র, তুচ্ছাতিতুচ্ছ বান্দার প্রতি আল্লাহ্‌র অপার অনুগ্রহ ছাড়া আর কিছু নয়!

তওয়াফের সময় সকলে আল্লাহ্‌র কাছে আকুল হয়ে দু’আ করেন। যারা বিভিন্ন বিদ’আতি বই থেকে সাত চক্করের সাতটি আলাদা আলাদা দু’আ পড়ে আসেন অথবা বই দেখে দেখে সেসব দু’আ করার পরিকল্পনা করে আসেন, তাঁদের অবস্থা আজ কীরূপ হয়েছে জানি না। এ বিশাল জনসমুদ্রে নিজে টিকে থাকাই যেখানে পরিশ্রম সাধ্য, সেখানে ঐসব দু’আর বই বের করে পড়া আর এতগুলা দু’আ ‘মনে’ করে পড়া নিতান্তই অসম্ভব।

ভীড়ের চাপে পিষ্ট প্রায় অবস্থায় জানা দু’আও অনেক সময় মনে পড়ে না। এসবের পরিবর্তে সহীহ দু’আ পড়া ও নিজের ভাষায় আল্লাহ্‌র দরবারে প্রার্থনা করা অনেক উত্তম। যেমন তওয়াফের সময় কাবা ঘরের এক কোনা (যার নাম রুকনে ইয়ামেনি) থেকে হাজরে আসওয়াদ পর্যন্ত অংশ অতিক্রম করার সময় সুন্নাত হলো, “রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানাতাও, ওয়া ফিল আখিরাতি হাসানাতাও, ওয়া কিনা আযাবান্নার” দু’আটি বারবার পড়া।

প্রায় দেড় ঘণ্টা লাগলো তওয়াফ শেষ হতে। এরপর আমরা জমজমের পানি খেয়ে তওয়াফ পরবর্তী দু রাকাত সুন্নাত সালাত আদায় করলাম। এবং মাগরিবের সময় হয়ে যাওয়াতে জামাতের পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে সা’ঈ শুরু করলাম।

নিচতলায় সাফা থেকে মারওয়া আসা যাওয়ার সময় কিছুটা উঁচু ও নিচু জায়গায় ওঠা নামা করতে হয়। হাজিদের সুবিধার্থে প্রতি তলায় সা’ঈ করার ব্যবস্থা আছে। নিচ তলায় বেশি ভীড় হলে উপর তলায় সা’ঈ করে নেয় অনেকে। অপর দিকে উপরের তলাগুলো নির্মিত হয়েছে পাহাড়দ্বয়ের ওপর দিয়ে, তাই সেখানে সমতল ভূমিতে সা’ঈ করা যায়। সা’ঈ শেষ হবার পর মনে হলো বিশাল এক চিন্তার বোঝা মাথা থেকে নেমে গেছে। হঠাৎ নিজেদের মুক্ত বিহঙ্গের মতো ফুরফুরে মনে হচ্ছিলো।

সা’ঈ করার সাথে সাথে আমরা ইহরাম মুক্ত হলাম! ইহরামরত অবস্থায় সচেতন এবং অচেতনভাবে মনে এক ধরনের ভয় কাজ করে। পাছে ইহরাম ভঙ্গ হয়, এমন কিছু যদি করে ফেলি! তাই সবসময় কিছুটা সাবধানতা অবলম্বন করে চলতে হয়।

তিন গতকাল হাজ্জের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ তওয়াফ ও সা’ঈ করতে ব্যর্থ হওয়ায় আজ সারাদিন দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে ছিলাম। বারবার মনে হচ্ছিলো, যদি সময় মতো এসব করতে না পারি, তাহলে তো আমাদের হাজ্জ বাতিল হয়ে যাবে!! কিন্তু এখন হাজ্জের সব কার্যাদি প্রায় শেষ, শুধু মিনাতে আর কটা দিন অবস্থান করলেই আমরা যে উদ্দেশ্যে এ দেশে এসেছিলাম, তা পূর্ণ হয়ে যাবে।

গতকালের মতো রাতের খাবার না খেয়ে মিনা রওনা হওয়ার মতো বোকামী করলাম না। মাসজিদ সংলগ্ন খাবারের দোকান “আল বাইকে” গিয়ে পেট ভরে খেয়ে নিলাম। তারপর বাসে করে মিনার বাসে উঠে পড়লাম। যথারীতি বাস আমাদের কয়েক কিলোমিটার আগে নামিয়ে দিলো। ব্যাপক হাঁটাহাঁটির পর গভীর রাতে মিনা পৌঁছলাম। হিসেব করে দেখলাম, ৩.১৫ কিলোমিটার সাফা মারওয়া সা’ঈ করা সহ প্রায় আট কিলোমিটার হাঁটা হয়েছে আজ। গতকাল ক্লান্ত ক্ষুধার্ত ও তওয়াফ না করার ব্যর্থতা কাঁধে নিয়ে ফিরে এসেছিলাম। কিন্তু আজ কিছুটা পরিশ্রান্ত বোধ করলেও হাজ্জের দুটি বড় কাজ সম্পন্ন করতে পারার পরিতৃপ্তি ও আনন্দ সকল ক্লান্তিকে ম্লান করে দিয়েছে।

চার পরদিন ছিলো বারোই যিলহাজ্জ। প্রশান্ত ও নির্ভার মনে নতুন একটি দিন শুরু করলাম। তাঁবুতে কেউ নিজ বিছানায় বসে কুরআন তিলাওয়াত করছেন, অনেকে নাস্তা করছেন, কেউ আবার হালকা মেজাজে গল্প করছেন। সর্বত্র মিষ্টি এক প্রশান্তিময় পরিবেশ বিরাজমান।

যুহরের পর সকলে জামারাতে পাথর ছুঁড়তে যাবে। বারো তারিখ পাথর মারা পর্যন্ত মিনাতে অবস্থান করতেই হয় এবং তেরো তারিখ অবস্থান করা বাধ্যতামূলক নয়। তবে কেউ যদি বারো তারিখ সূর্যাস্তর সময়েও মিনাতে রয়ে যায়, তবে তাকে পরদিন তেরো তারিখও জামারাতে পাথর মারতে হবে, অতঃপর মিনা হতে প্রস্থান করতে পারবে। আজ আমাদের কিছু কাজে একবার মক্কা যেতে হবে।

আমাদের দুজনের খুব ইচ্ছা, আমরা রাতে মিনাতে ফেরত আসবো এবং আগামীকাল পাথর মেরে মক্কা ফেরত যাবো। যদিও ব্যাপারটা আমাদের জন্য কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে, কারণ আগামী শনিবার (১৪ই যিলহাজ্জ) দুপুরে আমাদের দেশে যাবার ফিরতি ফ্লাইট ও খুব ভোরে জেদ্দা যাবার বাস। আজ বৃহস্পতিবার যদি আমরা আবার এখানে ফিরে আসি, তাহলে আগামীকাল শুক্রবার (১৩ যিলহাজ্জ) রাতের আগে মক্কা পৌঁছতে পারবো না। তখন গোছগাছ সারার জন্য খুব অল্প সময় পাওয়া যাবে, তার উপর বিদায়ী তওয়াফও সারতে হবে।

আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেছেন,

… অতঃপর যে ব্যক্তি তাড়াতাড়ি করে দু’দিনে চলে যায়, তার প্রতি কোনো গুনাহ নেই এবং যে ব্যক্তি অধিক সময় পর্যন্ত বিলম্ব করবে, তার প্রতিও গুনাহ নেই। এটা তার জন্য, যে ব্যক্তি তাকওয়া অবলম্বন করবে এবং আল্লাহ্‌কে ভয় করতে থাকবে। এবং জেনে রেখো, তোমরা সকলেই তাঁরই দিকে একত্রিত হবে। [সূরাহ আল-বাকারা (২): ২০৩]

আল্লাহ্‌ যেহেতু বলেছেন, আজ যারা চলে যাবে, তাদের কোনো গুনাহ হবে না; তাই অতি অল্প কিছু ব্যক্তি ব্যতীত বাকি সবাই আজ মিনা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।

মিনাতে আইয়্যামে তাশরিকের বারো তারিখ দুপুর পর্যন্ত অবস্থান করা আবশ্যকীয় হলেও যারা কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়া এ সময়ে মিনাতে থাকতে ব্যর্থ হয়, তাদের ফিদিয়া (কাফফারা) স্বরূপ একটি পশু কুরবানি করতে হয় এবং এ কুরবানির গোস্ত থেকে সে নিজে কিছু খেতে পারবে না, পুরোটাই গরীবের মাঝে বিলিয়ে দিতে হবে।

কিন্তু যারা অসুস্থতা অথবা অন্য কোনো যৌক্তিক কারণে এ দিনসমূহে মিনায় থাকতে পারে না, তাদের জন্য কোনো কাফফারা নেই (শেখ বিন বায (রঃ) এর মতে)। কারণ আল্লাহ্‌ রাহমানুর রাহীম বলেছেন, “অতএব তোমরা যথাসাধ্য আল্লাহ্‌কে ভয় কর, শুনো, আনুগত্য কর এবং ব্যয় কর … ।”

পাঁচ সেদিনই দেখলাম অনেকেই ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছেন, যুহরের পর পাথর মেরে জামারাত থেকেই সরাসরি তাঁরা মক্কা রওনা হবেন। বেশির ভাগ তাঁবু গুটিয়ে ফেলা হচ্ছে। লাখ লাখ মুসলিমের মিলন মেলায় এখন ভাঙনের সুর লেগেছে। মিনা হাজ্জের মৌসুমে নির্দিষ্ট কয়েকটি দিনের জন্য জেগে ওঠে, তাশরিকের দিন শেষ হলে আবার চলে যায় দীর্ঘ শীত-নিদ্রায়। আমার তাঁবুর সবার ভেতর তুমুল তাড়াহুড়া। কারণ কোনো কারণে মিনা থেকে বের হবার আগেই যদি সূর্যাস্ত হয়ে যায়, তাহলে আগামীকাল পাথর না মেরে মিনা ছাড়তে পারবে না। তাহলে আরো একদিন তাদেরকে হোটেলের আরামদায়ক জীবন ফেলে বেদুইনদের মতো তাঁবু-বাসী হয়ে থাকতে হবে।

যুহরের পর তিনটি জামারাতে পাথর মেরে আমি আর সাফির মক্কার পথে হাঁটা দিলাম। ঘণ্টা দেড়েক লাগলো আমাদের টানেল পর্যন্ত আসতে। টানেলে পৌঁছে আবারো হাজারো হুজ্জাজের সাথে মিশিয়ে দিলাম নিজেদের। এখানে ভেতরে শীতল হাওয়ার ও পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা আছে। তাই অন্ধকার বা দমবন্ধ ভাব নেই কোথাও। অনেকে ছোট-বড় দলবদ্ধ হয়ে হাঁটছেন, আবার অনেকে একা একা। কোনো ধাক্কাধাক্কি বা হুড়াহুড়ি নেই।

সবাই শান্তিপূর্ণ ভাবে হাঁটলেও পথ যেন আর শেষ হচ্ছিলো না। সারাদিনের ধকলে মলিন কাপড় চোপড়ে, রিফিউজিদের মতো মাথার ওপর ব্যাগের বোঝা নিয়ে হাঁটতে লাগলাম গন্তব্যের দিকে। এ কদিন নিজেদের দিকে তাকানোর মতো তুচ্ছ কাজের সময় হয়নি কারো, সুতরাং অনেকের চেহারায় অযত্নের ছাপ স্পষ্ট ছিলো। কিন্তু স্বীকার করতেই হবে যে, ক্লান্তি ছাপিয়ে অসাধারণ এক তৃপ্তির ছাপ ফুটে উঠেছিলো সবার মাঝে।

মাসজিদুল হারামে ঈশার সালাত আদায় করে রাতে খেয়েদেয়ে হোটেলে ফিরে আসলাম। এত চড়াই উৎরাই পেরিয়ে মক্কা পৌঁছে বেশ বুঝতে পারলাম, আমাদের শরীরে এত রাতে আবার মিনা ফেরত যাবার মতো বিন্দুমাত্র শক্তি অবশিষ্ট নেই। কী আর করা? যে দু’দিন থাকা বাধ্যতামূলক ছিলো, আল্লাহ্‌র রহমতে সে দু’দিন তো থাকতে পেরেছি। অনেক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আইয়্যামে তাশরিকের আরো একটি দিন মিনায় কাটাতে পারলাম না।


পরবর্তী পর্ব- জুমু’আ ও বিদায়ী তওয়াফ

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive