এক আলহামদুলিল্লাহ্‌, অসম্ভব সুন্দর ঘুম হলো মুযদালিফায়। শক্ত মাটির উপরেও গাফুরুর রাহীম আজ কতই না প্রশান্তি ঢেলে দিয়েছেন! ফজরের ওয়াক্তে সবার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। উযু বানিয়ে জামাতে সালাত পড়লাম আমরা। আমাদের মতো স্টেশনের পাশে যারা রাত কাটিয়েছেন, তাঁদের একজন ইমামতি করলেন। শুরু হলো নতুন একটি দিন। আরাফাতের দিন যেমন ক্ষমা পাবার জন্য অন্যতম শ্রেষ্ঠ দিন, তেমনি আজকের দিনটিও নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর।

ত্যাগের মহিমায় অনন্য যিলহাজ্জ মাসের দশ তারিখ, সারা বছরে আল্লাহ্‌র নিকট সর্বাধিক পছন্দের দিন। কারণ এ দিনে আল্লাহ্‌কে সন্তুষ্ট করার অভিপ্রায়ে সারা পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ কুরবানি করেন। আজকের দিন একই সাথে ত্যাগ স্বীকারের, শুকরানা আদায়ের ও উৎসব উদযাপনের দিন। কিছুক্ষণ পর আমরা মুযদালিফা থেকে মিনা ফিরে যাবো, কুরবানি করবো ও জামারাতে পাথর মারবো।

IIRT Arabic Intensive

মুহাম্মাদ ﷺ মুযদালিফাতে অবস্থানের পরদিন সকালে আউয়াল ওয়াক্তে ফজরের সালাত পড়েছেন, আকাশ ফর্সা হওয়া পর্যন্ত যিকর আযকার করেছেন, অতঃপর পুনরায় মিনায় রওনা হয়েছেন। মুশরিকরা সূর্য উদয়ের পর মুযদালিফা ত্যাগ করতো। তাদের অনুকরণ করতে নিষেধ করা হয়েছে, তাই সূর্য উদয়ের আগে আমাদের কর্তব্য এ স্থান ত্যাগ করা। আকাশ কিছুটা ফর্সা হয়ে এলে আমরা মিনাগামী ট্রেনে উঠে পড়লাম। স্টেশনের কাছে থাকায় ট্রেনে উঠতে বেশি বেগ পেতে হলো না।

মুযদালিফা থেকে অধিকাংশ হাজী সরাসরি জামারাতে রমি করতে (পাথর মারতে) যাবেন। সেখানে থেকে মিনা যাবেন। প্রায় বিশ লাখ মানুষ যেখানে আজ পাথর মারবেন, সেখানে অবশ্যই অনেক ভিড় হবে। অনেক পুরুষরা, মহিলাদের হয়ে পাথর মেরে আসে। অথবা যাদের পক্ষে এত ভিড় ঠেলে যাওয়া সম্ভব নয়, তারা অনেক সময় অন্য হাজীদের দিয়ে নিজেদের এই ritual টি সম্পন্ন করান। শুধুমাত্র জায়েয কারণে অন্যকে দিয়ে কঙ্কর নিক্ষেপের হুকুম আছে।

এটি হাজ্জের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যারা ভিড়ের মাঝে যেতে ভয় পান, অথবা অসুস্থ, তাঁরা রাতে অথবা যে সময় মানুষ কম থাকবে, সে সময় পাথর মারতে পারবেন। রাসূল ﷺ তাঁর পরিবারের দুর্বল সদস্যদের, যেমন সাওদা বিনতে জামাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা)-কে মধ্যরাতের পর মুযদালিফা ত্যাগের এবং জামারাতে ভিড় হবার আগেই পাথর ছোঁড়ার অনুমতি দিয়েছিলেন, তবুও অন্য কারো দ্বারা দুর্বল সদস্যদের তরফ থেকে হাজ্জের এই অংশটুকু সম্পাদন করাননি। এর দ্বারা বোঝা যায়, শারীরিক সামর্থ্য থাকলে নিজের পাথর নিজেকেই মারতে হবে।

আমার আর সাফিরের জন্য হুইল চেয়ার নিয়ে এই প্রচণ্ড জনসমুদ্র ভেদ করে জামারাতে যাওয়া অসম্ভব একটি ব্যাপার। তাই আমরা ঠিক করলাম দুপুরের দিকে ভিড় হালকা হলে তখন যাবো। শামছু ভাই জামারাতের স্টেশনে নেমে গেলেন, আমরা দুজন মিনাতে যার যার তাঁবুতে ফেরত আসলাম। দশ যিলহাজ্জ সারাদিন এবং রাতেও রমি করা যায়। যদিও সকালে করা পছন্দনীয়। এগারো, বারো ও তেরো যিলহাজ্জ সূর্য ঢলে পড়ার পর জামারাতে যেতে হয়।

ইহরামের নিয়ত বাঁধার পর থেকে আজকের দিন পর্যন্ত অধিক হারে তালবিয়া পাঠ করতে বলা হয়েছে। জামারাতে পাথর ছোঁড়ার পর থেকে আইয়্যামে তাশরিকের দিন শেষ হওয়া পর্যন্ত প্রতি ফরয সালাতের পর এবং অন্যান্য সময়েও বেশি বেশি তাকবীর দিতে হয়। যিলহাজ্জ মাসের এগারো তারিখ থেকে তেরো তারিখকে আইয়্যামে তাশরিক বলে।

তাকবীর হলো: “আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়ালিল্লাহিল হামদ।”

অর্থ: আল্লাহ্‌ মহান, আল্লাহ্‌ মহান, আল্লাহ্‌ এক তাঁর কোনো শরীক নেই, আল্লাহ্‌ মহান, আল্লাহ্‌ মহান এবং সমগ্র প্রশংসা আল্লাহ্‌র।

এই সকালে তাঁবুতে খুব কম মানুষ অবস্থান করছেন। অধিকাংশ মুযদালিফা হতে সরাসরি জামারাত হয়ে তারপর মিনা আসবেন। দশ তারিখ সকালে জামারাতে সবচেয়ে বেশি ভিড় হয়। জামারাতের ভিড়ে আগে বহু দুর্ঘটনা ঘটতো, পদদলিত হয়ে মারা যেতেন অনেকে। এসব অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা দূরীকল্পে সৌদি সরকার বর্তমানে জামারাতের চারদিকের স্থাপনার প্রচুর সম্প্রসারণ ও সংস্কার সাধন করেছেন।

আমাদের তাঁবুর নিকট দিয়ে জামারাত যাবার রাস্তা চলে গেছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যাবত হাজিদের ঢল সমুদ্রের ঢেউর মতো অবিরাম জামারাতের দিকে যাচ্ছে এবং ফেরত আসছে। সকলে উচ্চস্বরে, এক তালে, এক লয়ে, এক সুরে তাকবীর দিচ্ছেন। লাখ লাখ মানুষের এ জনস্রোত আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়ে উঠছে। এ দৃশ্যের ভাবগাম্ভীর্য ভাষায় প্রকাশ করার শক্তি আমার নেই। মনে হচ্ছে, আমি বিশ্ব সংসার হতে দূরে কোনো এক অপার্থিব জগতে বাস করছি। এ জগতের দিকে দিকে সর্বক্ষণ যেন শুধু আল্লাহ্‌র প্রশংসা ও মহত্ত্ব ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। এই সু-প্রশংসিত বাণী ছাড়া বাকি সবকিছু এখন মূল্যহীন।

দুই তাঁবুর ভেতর বসে আছি, এমন সময় হঠাৎ আমাদের একজন বলে উঠলেন আজ ঈদের দিন!! অন্যান্য সময় ঈদের দিন সকালে কত প্রস্তুতি চলে, ঈদের জামাত, রান্না-বান্না, খানা-পিনা নিয়ে সবাই কত ব্যস্ত থাকি। অথচ, কী আশ্চর্য! আজ ঈদের কথা অনেকরই মনে নেই! কারণ পৃথিবীর মানুষের জন্য আজ ঈদ হলেও আমরা যারা হাজ্জে আছি, মিনায় আছি, তাদের জন্য আজকের দিন সাধারণ ঈদের চেয়েও অধিক গুরুত্বপূর্ণ!!

মুহাম্মাদ ﷺ বলেছেন,

এটি হাজ্জের শ্রেষ্ঠ দিন। (বুখারি, ১৭৪২)

কারণ হাজ্জের নির্ধারিত দিনসমূহের নির্দিষ্ট কার্যাদির মধ্যে সর্বাধিক সংখ্যক কার্যাবলি দশ যিলহাজ্জ সম্পাদিত হয়। যেমন মুযদালিফা হতে ফিরে এসে জামারাতে কঙ্কর নিক্ষেপ করা, কুরবানি করা, মস্তক মুণ্ডন করে ইহরাম মুক্ত হওয়া, তওয়াফ ও সা’ঈ করা এবং মিনাতে অবস্থান করা। যদিও তওয়াফ আর সা’ঈ আগামী দু দিনেও করা যায়, তথাপি বেশিরভাগ হাজী এসব কাজ আজকের মধ্যে সম্পন্ন করে ফেলেন। যেহেতু আমরা হাজ্জ করছি, তাই আমাদের জন্য আজ কোনো ঈদের সালাতও নেই!!

দশটার দিকে আমাদের তাঁবুর একজন মহিলাকে দেখলাম জামারাত থেকে ফিরলেন। সকালে তিনি স্বামীর সাথে গিয়েছিলেন, ভিড়ের মাঝে কীভাবে যেন দু জন আলাদা হয়ে পড়েন। কোথাও স্বামীকে দেখতে না পেয়ে বেচারি একা একাই ফেরত আসেন। এসে দেখেন পতি প্রবর এখনো আসেননি। কিন্তু উনার মাঝে দুশ্চিন্তার কোনো আভাস দেখা গেলো না, সহি সালামতে পথ চিনে ফেরত আসতে পেরেই বোধহয় তিনি সন্তুষ্ট।

এদিকে সকাল গড়িয়ে দুপুর হলে কয়েক ঘণ্টা পর ভদ্রমহিলার স্বামী ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে ফেরত আসলেন। তাঁর আসতে দেরী হবার কারণ, সকাল থেকে তিনি তার স্ত্রীকে খুঁজছিলেন। খুঁজে না পেয়ে কী মনে করে ক্যাম্পে চলে আসলেন এবং এসে দেখেন, তাঁর হারিয়ে যাওয়া স্ত্রী মহা আরামে হেলান দিয়ে বিশ্রাম করছেন!! তার মানে শুধু শুধুই তিনি ঘুরে মরলেন এতক্ষণ!! এখানে মোরাল অফ দা স্টোরি হলো: “স্বামী হারিয়ে গেলে স্ত্রী তেমন চিন্তিত হন না, কিন্তু স্ত্রীকে খুঁজে না পেলে স্বামী বিরাট দুশ্চিন্তায় পড়ে যান!!”

আজ ঈদের আমেজ না থাকলেও সবার মাঝে অন্যরকম এক উৎসব উৎসব ভাব বিরাজমান। জামারাত থেকে এসে কুরবানি করে সবাই মাথা মুণ্ডন করে সাধারণ কাপড় পরিধান করছেন। মহিলারা মাথার চুলের নিম্ন ভাগ অল্প করে ছেঁটে নিচ্ছেন। বিগত দু দিন পুরুষদের সর্বক্ষণ কেবল মাত্র দু খণ্ড বস্ত্র পরে থাকতে হয়েছে। যারা কিরান হাজ্জ করছেন, তাঁরা নিজের দেশ হতে আসার পর থেকে ইহরামের কাপড় পরে ছিলেন। কিরান হাজ্জ তামাত্তু হাজ্জের চেয়ে অনেক কঠিন। কিরান হাজিরা কুরবানির আগ পর্যন্ত ইহরামে থাকেন, সেই ইহরামের সময়কাল অনেক সময় মাসাধিক কাল হতে পারে। তাই ইহরামের কাপড় বদলে নিজেদের আরামদায়ক কাপড়ে ফিরে যেতে পেরে আজ সকলে যারপরনাই আনন্দিত।

এখানে কেউ কুরবানি নিজ হাতে করেন। অনেকে বিভিন্ন সংস্থায় টাকা জমা দেন, তাঁরা হাজিদের তরফ হতে কুরবানি করে দেন। সরকারিভাবে এই লাখ লাখ হাজির কুরবানির গোস্ত বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের দরিদ্রদের পৌঁছে দেওয়া হয়। এমন অনেক ঘরে তখন কুরবানির মাংস পৌঁছে, হয়তো যাদের সারা বছর গোস্ত খাবার সামর্থ্য থাকে না।

আমরা জেদ্দায় বসবাসরত এক আত্মীয়কে টাকা দিয়ে দিয়েছি। তিনি আমাদের তরফ থেকে মক্কায় কুরবানি করবেন। মাংস বণ্টনের দায়িত্বও তিনি নিয়েছেন। সর্বত্র আজ মাংসের ছড়াছড়ি থাকার পরও মোয়াল্লেমের দেওয়া দুপুরের খাবারে গোস্তের পরিমাণ আগের মতোই থাকলো। ওদিকে পাকিস্তানিদের কিন্তু প্রতি বেলা রুটি-মাংস দেওয়া হচ্ছে। বাঙালির staple food ভাত, তাই আমাদের ভাত দেওয়া হচ্ছে আর পাকিস্তানিদের staple food রুটি, তাই তাদের জন্য বরাদ্দ হয়েছে রুটি মাংস। দুপুরে আমাদের কেউ আর তেমন কোনো অভিযোগ করলো না। কিন্তু খাবার প্রচুর নষ্ট হলো। যারা ভালো করে খেতে পারলো না, তারা উচ্ছিষ্ট অংশ ময়লার বাক্সে ফেলে দিলো। কিছুক্ষণের মাঝে ডাস্টবিনে ভাতের স্তূপ হয়ে গেলো। আমি খাবার নষ্ট পছন্দ করি না, অল্প গোস্ত দিয়েও ভাত খেতে পারি, তাই আমার খাবারটুকু ধীরে ধীরে খেয়ে নিলাম।

তিন বেলা তিনটার পর আমি, সাফির আর রুকসানা আন্টি জামারাতে গেলাম। রুকসানা আন্টির স্বামী আরো আগে জামারাতে কাজ সেরে মক্কা ফেরত গেছেন। বড়লোকের দুলাল এ ভদ্রলোক, মিনাতে গত কদিন ঠিক মতো বাথরুমে যাননি, ভালো করে মনে হয় ঘুমাতেও পারেননি। উস্কখুস্ক চুলে, লাল টকটকে মুখে, কেমন বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিলো তাঁকে। রুকসানা আন্টি ভিড় এড়ানোর জন্য দুপুরে পাথর মারবেন বলে মনঃস্থির করেছেন, কিন্তু তাঁর স্বামীর পক্ষে দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করার মানসিক অবস্থা ছিলো না। তাই তিনি সকালে একাই মক্কা চলে গেছেন, একেবারে তওয়াফ ও সা’ঈ করে মিনাতে ফিরবেন।

দুপুরের এই সময়ে রাস্তায় একদম ভিড় নেই। আমাদের মতো অল্প কয়েকজন বিচ্ছিন্নভাবে জামারাতে চলছে। দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য জামারাত বিল্ডিং এখন এক তলা থেকে কয়েক তলা পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে। আগে উঁচু পিলারে লোকে পাথর মারতো, এখন পিলারের পরিবর্তে চওড়া দেয়াল তৈরি করা হয়েছে পাথর মারার জন্য। এভাবে বিভিন্নভাবে সম্প্রসারণ করার পর আজকাল এখানে দুর্ঘটনার হার উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে।

সাফির হুইল চেয়ারে আর আমরা দুই মহিলা ওর পাশে হাঁটতে হাঁটতে গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। আমাদের তাঁবু থেকে জামারাতের দূরত্ব মাইলখানেক হবে। যাদের হাজ্জ প্যাকেজ যত দামী হয়, তাদের তাঁবু জামারাতের তত নিকটে হয়। মানুষের চাপ না থাকায় আমরা সুস্থিরতার সাথে কঙ্কর নিক্ষেপ করলাম। প্রত্যেকবার পাথর ছোঁড়ার সময় ‘আল্লাহু আকবার’ বলতে হয়। একবারে সাতটি পাথর মারলে হবে না। নিয়ম হলো, প্রায় মটর দানার আকৃতির সাতটি পাথর আলাদা আলাদা করে ছুঁড়ে মারা। প্রথম দিন শুধু বড় জামারাতে, তথা জামারাতুল আকাবায় পাথর মারতে হয়।

অনেকে ভাবে জামারাতে পাথর মারার অর্থ শয়তানকে পাথর মারা। যে কারণে কিছু লোকে সাংঘাতিক উত্তেজিত হয়ে, জুতা স্যান্ডেল থেকে শুরু করে হাতের কাছে যা পায়, তা-ই ছুঁড়ে মারে। যে শয়তানের জ্বালাতনে আমাদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে যায়, তাকে আঘাত করার এই সুবর্ণ সুযোগ অতীব রাগান্বিত ব্যক্তিগণ হাত ছাড়া করতে চান না। তাঁরা বোঝেন না এরূপ যুক্তিহীন কর্মকাণ্ডে বরং শয়তান আরো আনন্দিত হয়ে পড়বে। কারণ তার কাজ হলো মানুষকে রাগিয়ে দেওয়া। আর রেগে যাওয়া অর্থ শয়তানকে সফল করে দেওয়া!! তাই পাথর মারার সময় উত্তেজনা পরিহার করে, ধীরতা অবলম্বন করে আল্লাহ্‌কে গভীরভাবে স্মরণ করা ও আল্লাহ্‌র প্রতি মনকে বিনীত করাই কাম্য।

ইবরাহীম (‘আলাইহিসসালাম) যখন ইসমাঈল (‘আলাইহিসসালাম)-কে আল্লাহ্‌র রাহে কুরবানি করতে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তিনটি স্থানে শয়তান তাঁকে আল্লাহ্‌র আদেশ হতে বিরত থাকার জন্য প্ররোচিত করতে চেয়েছিলো। তখন তিনি প্রত্যেকবার সাতটি করে পাথর নিয়ে শয়তানের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে মারেন। উক্ত তিন স্থানে পরবর্তীতে তিনটি জামারাত নির্মাণ করা হয়েছে এবং আমরা ইবরাহীম (‘আলাইহিসসালাম) এর অনুকরণে জামারাতে পাথর মারি। এখানে পাথর মারাও ইবাদাতের অন্তর্গত।

হাজ্জের বেশিরভাগ কাজের সাথে কোনো না কোনোভাবে ইবরাহীম খলিলুল্লাহর জীবনের ঘটনাবলী বিজড়িত। আল্লাহ্‌র উপর উনার তাওয়াক্কুল এবং আল্লাহ্‌র নির্দেশ পালনের প্রতি একনিষ্ঠতা সকল মুসলিমের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ।

পশু কুরবানির সময় কি আমরা একবার অন্তত ভেবে দেখি, আমাদেরকেও যদি নির্দেশ দেওয়া হতো নিজের প্রাণাধিক প্রিয় সন্তানকে উৎসর্গ করতে, তাহলে আমাদের কী উপায় হতো!! শত কষ্ট হলেও আমাদের পালন করতে হতো এই কঠিন বিধান! ইবরাহীম (‘আলাইহিসসালাম) আল্লাহ্‌র কতটা একনিষ্ঠ বান্দা হলে বিনা বাক্যব্যয়ে এরূপ কঠিন-তম হুকুম পালন করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন! আল্লাহ্‌ উনাকে ত্যাগের এই চরম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ করেন, উনার মহান কুরবানি কবুল করেন ও আমাদের জন্য এই দিনকে বছরের শ্রেষ্ঠ আনন্দের দিনে পরিণত করেন। আমাদের জন্য সন্তানের বদলে পশু কুরবানির বিধান দিয়ে আমাদের উপর অপার দয়া করেন পরম করুণাময় প্রতিপালক।

কুরবানির ইতিহাস সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারলে এই দিনে পশু কুরবানির সাথে সাথে সত্যিকারের ত্যাগের আনন্দ আমরা অনুভব করতে পারতাম এবং অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে আমাদের প্রতি আল্লাহ্‌র রহমত স্বীকার করে, তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে পারতাম।

চার পাথর মারা শেষ হবার পর আমরা একটা বাসে করে মক্কা পৌঁছলাম। আজ সবকিছুর ভাড়া গগণচুম্বী। যে যত পারছে, যাত্রীদের থেকে ভাড়া আদায় করছে। আকাশ ছোঁয়া ভাড়া নিলেও কোনো বাহনই যাত্রীদের সম্পূর্ণ পথ পৌঁছে দিতে পারছে না। প্রচণ্ড ভিড়ের কারণে যতদূর সম্ভব এগিয়ে দিচ্ছে, এরপর সবাইকে পদব্রজে চলতে হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে দামী প্যাকেজ আর কম দামী প্যাকেজের সকল হুজ্জাজদের অবস্থা অভিন্ন। হাজ্জে এলে আসলে হাঁটার কোনো বিকল্প নেই।

বাস জান্নাতুল মাওয়া গোরস্থানের পাশে আমাদের নামিয়ে দিলো। মদিনাতে বাকি আল গারক্বাদে যেমন সাহাবী, তাবিই ও তাবিঈনদের কবর আছে, তেমন মক্কার এই গোরস্থানে বিভিন্ন সাহাবীর কবর আছে। এছাড়া খাদীজা (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা), আব্দুল মুত্তালিব ও আবু তালিবেরও কবর রয়েছে এখানে।

জান্নাতুল মাওয়া থেকে হারাম শরীফ বেশি দূরে নয়। আসরের সালাত আদায় করতে আমরা মাসজিদে প্রবেশ করলাম, এরপর হোটেলে চলে যাবো। সাফিরের মাথা ন্যাড়া করতে হবে ও আমার চুল কাটতে হবে। এছাড়া নিজস্ব বাথরুমে লম্বা গোসল নেবার আকাঙ্ক্ষায় মন প্রাণ উন্মুখ হয়ে আছে। হোটেল থেকে আবার মাসজিদে এসে তওয়াফ-সা‘ঈ করে মিনায় ফেরত যাবার প্ল্যান করলাম। রাতে যেকোনো উপায়ে মিনায় ফেরত যেতে হবে, না হলে ওয়াজিব ছুটে যাবে।

এদিকে হোটেলে এসে সাফিরের সাথে এক দম্পতির কিছুটা মতানৈক্য দেখা দিলো। তাদের মতে রাতের ভিতর মিনায় ফিরে যাওয়া আবশ্যক নয়। তারা আজ হোটেলে থেকে যাবে। সাফির রেফারেন্স খুলে দেখিয়ে দিলো আজকের রাতে মিনায় থাকা অবশ্য কর্তব্য। কিন্তু রেফারেন্স দেখেও তারা মানতে নারাজ। এসব নিয়ে আর ঝগড়া করা ঠিক না। সাফির কী আর করবে, চুপ হয়ে গেলো।

এবার এক হাস্যকর সমস্যা উদ্ভূত হলো। অবশ্যই সমস্যার উদ্যোক্তা আমি! আমার খুব শখ হলো আমি নিজ হাতে সাফিরের মাথা ন্যাড়া করে দেবো। এই পা নিয়ে আবার নিচে না যাবার জন্য নাকি জানি না, ও আমার প্রস্তাব এক কথায় মেনে নিলো। আমি মহা উৎসাহে দুইটা রেজার নিয়ে ওর মাথায় এক গাদা সাবান লাগিয়ে মাথা কামাই করা শুরু করলাম। একবার এদিক পোঁচ দেই, তো আরেকবার অন্যদিকে পোঁচ দেই। তুমুল উদ্দীপনা নিয়ে কাজ করছি। কিছুক্ষণের মাঝে খেয়াল করলাম, যে অনুপাতে পোঁচ দিলাম, সে অনুপাতে চুল শেভ হলো না। শক্ত শক্ত চুলগুলো ড্যাব ড্যাব করে আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসতে লাগলো।

রেজার দুটোও ভোঁতা হয়ে গেলো। এদিকে মাথার চুল খুব অল্পই চাঁছা হলো। অনেকক্ষণ চুলের সাথে যুদ্ধ করে আমার তখন “ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি” অবস্থা! আমার এখন ছাড়ারও উপায় নেই, কাঁদারও উপায় নেই। সাফিরের মাথার অবস্থা দেখার মতোন হলো! কোথাও অল্প চুল কোথাও বেশি চুল, আবার কোনো পাশে একদম ন্যাড়া!! এই অবস্থায় ওর হোটেল থেকে বের হয়ে নাপিতের কাছে যাওয়া সম্ভব নয়। মাথায় টুপি পরেও নাপিতের কাছে যেতে পারবে না। কারণ মস্তক মুণ্ডন না করা পর্যন্ত ওকে ইহরামের কাপড় পরে থাকতে হবে, অন্যান্য কাপড় পরতে পারবে না! শেষ পর্যন্ত কোনো উপায় না দেখে ওকে এরকম হাস্যকর শোচনীয় অবস্থায় রেখে দোকানে ছুট দিলাম, নতুন ধার রেজর কিনে আনতে।

সেই রেজর দিয়ে বহু পরিশ্রমের পর মাথা সম্পূর্ণভাবে ন্যাড়া হলো। এবং নাপিত আমি চুল কাটার পেশায় প্রথম দিনেই অবসর গ্রহণ করলাম!

মাথা মোড়ানোর পালা শেষ করে আমরা ভালো করে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। এ কদিনের কাপড় ধুয়ে শুকাতে দিয়ে পরিষ্কার কাপড় পরলাম ও আগামী দুদিনের জন্য ব্যাগে কিছু কাপড় নিয়ে নিলাম। রাত হয়ে আসছে। কা‘বার তওয়াফ করে সা‘ঈ শেষ করতে হবে। হোটেল ছেড়ে বের হবার সময় সাফির দুঃসাহসী একটি সিদ্ধান্ত নিলো। ও বললো, হুইল চেয়ার এখানেই রেখে যাবে এবং ইন শা আল্লাহ্‌ হাজ্জের বাকি সব কাজ নিজের পায়ে হেঁটে হেঁটে করবে। ডাক্তার ওকে আরো কিছুদিন হাঁটতে মানা করেছিলো, কিন্তু ওর বোধহয় আর মন মানছিলো না এভাবে পরনির্ভরশীল হয়ে থাকতে। হাজ্জের কোনো কাজই যদি নিজে হেঁটে করতে না পারে, তাহলে দেশে ফিরে যাবার পর গভীর আফসোস রয়ে যাবে অন্তরে।

পাঁচ আস্তে আস্তে হেঁটে হেঁটে আমরা এক কিলোমিটার দূরের হারাম মাসজিদে আসলাম। মাসজিদে আজ ভিড় নেই একদম। সব ভিড় কা‘বাকে ঘিরে। লাখ লাখ মানুষ সকাল থেকে তওয়াফ করছে। অবর্ণনীয় ভিড়ের জন্য মাতাফের (তওয়াফের স্থানের) চারপাশে সিকিওরিটির লোকেরা ঘেরাও করে রেখেছে। নতুন করে কাউকে মাতাফে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। কা‘বার চারপাশে, নিচতলায়, দোতলায়, উপরে হুইল চেয়ারের তওয়াফের রাস্তায়, ছাদে সর্বত্র হাজীগণ তওয়াফ করছেন। তাও তিল ধারণের যায়গা নেই কোনোখানে।

আমরা মাসজিদের ভেতরে বসে আছি। হোটেল থেকে এতদূর এসে ওর পা ব্যথা শুরু হয়েছে। গোড়ালির দিক বেশ ফুলে গেছে, একেবারে টনটন করছে জায়গাটি। তওয়াফের সুযোগ পাবার পরও আমরা তওয়াফ করতে পারলাম না। সাফির বললো, ঈশার সালাত পড়ে তারপর তওয়াফ ও সা‘ঈ করবে। ততক্ষণ বিশ্রাম নিলে হয়তো পায়ের ফোলা কমে যাবে।

ঈশার সালাত পড়ার পরও ওর পায়ের কোনো উন্নতি হলো না, আমরা অসহায়ের মতো বসে আছি। কী করবো, বুঝতে পারছি না। রাত গভীর হয়ে গেলেও সমস্যা। কারণ মিনাতে ফেরত যেতে হবে। উপায় না দেখে সিদ্ধান্ত নিলাম, আমরা এখন মিনায় ফিরে যাবো, কাল আবার এসে তওয়াফ করব। অধিকাংশ মানুষ আজকের ভেতর সব কাজ শেষ করে ইহরাম মুক্ত হয়ে, আইয়ামে তাশরিকের দিনগুলো আরাম করে মিনাতে কাটিয়ে দেন ও সময় মতো শুধু জামারাতে পাথর মেরে আসেন। সারাদিন আর কোনো পরিশ্রমের কাজ করতে হয় না তাঁদের। এখন আমাদের মিনায় ফিরে যাবার অর্থ, কাল আবার এত দূর পথ অতিক্রম করে মক্কা আসতে হবে এবং আমরা আজ পুরোপুরিভাবে ইহরাম মুক্ত হতে পারবো না।

শেয়ারে একটি মাইক্রো বাস পেয়ে সেখানে উঠে পড়লাম। হাজ্জের মৌসুমে গাড়ির বসার জায়গার সর্বোচ্চ ব্যবহার করা হয়। আমরা গাড়িতে গাদাগাদি করে বসে আছি। গাড়ি শম্বুক গতিতে চলছে। কত রাতে মিনা পৌঁছবো জানি না। একপর্যায়ে ড্রাইভার আমাদের নামিয়ে দিলো। কারণ তার পক্ষে আর সামনে যাওয়া সম্ভব না। মানুষের ভিড়ে গাড়ি আর যাবে না। বেচারার কোনো দোষ নেই, কারণ কাহিনী সত্য। এত মানুষের মাঝে গাড়ি চালানো আসলেই অসম্ভব!

আমরা নেমেছি জামারাতের অনেক আগে। মিনায় আমাদের তাঁবু এখনো চার/পাঁচ কিলোমিটার দূরে!!!! শুরু হলো দীর্ঘ রাস্তা। সর্বত্র শুধু মানুষ আর মানুষ। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হাজিরা মিনায় ফেরত যাচ্ছেন। মিনা এলাকায় প্রবেশ করার পর দেখতে পেলাম, বহু দরিদ্র দেশের হাজী আছেন, যারা মিনার তাঁবুতে থাকার সামর্থ্য রাখেন না। তাঁরা রাস্তায় রাস্তায় প্লাস্টিকের তাঁবু খাঁটিয়ে হাজ্জ করছেন। এই নিচু তাঁবুগুলোতে দাঁড়ানোও সম্ভব নয়, কষ্ট করে হয়তো রাতটা কাটানো যায়। ইনাদের খাবার দাবারের বন্দোবস্ত কীভাবে হচ্ছে, আল্লাহ্‌ই জানেন। তিনি নিশ্চয় তাঁর মেহমানদের উত্তম প্রতিদান দেবেন।

আমাদের রাস্তা আর শেষ হচ্ছে না। উঁচু রাস্তা, ঢালু রাস্তা, ব্রিজ, বড় রাস্তা, সরু রাস্তা ইত্যাদি পার হয়ে আমরা এগিয়ে চলছি। আমি একটু পর পর কাহিল হয়ে পড়ছি আর সাফিরের পা ব্যথা তো আছেই। যার জন্য কিছুক্ষণ পরপর রাস্তায় মাদুর বিছিয়ে বসে পড়ছি। আমাদের আশেপাশে আরো অনেকে এরকম পথের ধারে বসে বিশ্রাম নিচ্ছেন, কেউ সেখানেই শুয়ে পড়ছেন।

পেটে যা খাবার ছিলো, তা বহু আগেই হজম হয়ে গেছে। ক্ষুধার রাজ্যে এখন পৃথিবী গদ্যময়।

মিনাতে মাঝ রাতের আগে পৌঁছানোর কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। রাস্তার একপাশে কিছু খাবার দোকান আছে। সব দোকানে দীর্ঘ লাইন। মেনু থেকে খাবার পছন্দ করে বিল দিয়ে লাইনে দাঁড়ালাম। লম্বা লাইন শেষ হবার পর খাবারের প্যাকেট হাতে পেলাম এবং খাবারের পরিমাণ দেখে বুঝলাম, এই খাবারে দুজনের কোনোভাবেই পেট ভরবে না। দুর্দান্ত ক্ষুধার কিছুটা প্রশমন হবে হয়তো। আবার নতুন করে খাবার কেনার ইচ্ছা হলো না। যা পেয়েছি, তা-ই খেয়ে পুনরায় হাঁটা দিলাম।

ছয় তখনো অনেক দূর পথ বাকি … এমনসময় এক ৩৫/৩৬ বয়সের পাকিস্তানী পুরুষ তাঁর ষাটোর্ধ্ব মা-কে নিয়ে আমাদের সামনে এসে খুব কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়ালেন। লজ্জিত স্বরে মহিলার ছেলে বললেন, তাঁদের টাকা পয়সা সব হারিয়ে গেছে, রাতে পেটে কোনো খাবার পড়েনি, তাঁরা অত্যন্ত ক্ষুধার্ত। আমরা যদি কিছু অর্থ সাহায্য করি, তাঁদের খুব উপকার হবে। সত্যি বলতে, আমাদের কিছুটা মেজাজ খারাপ হলো। এদেশে হাজিদের এমন পরিস্থিতে পড়া কোনো আনকমন ঘটনা নয়। তবে শুনেছি, অনেকে মিথ্যেমিথ্যি এমন কথা বলে মানুষের থেকে টাকা নেয়।

সাফির কী মনে করে অল্প কিছু টাকা দিলো, মাত্র দশ রিয়াল! হাজ্জের সময় খালি হাতে ফিরিয়ে দিতে মন চাইলো না। এই টাকায় দুজনের পেট ভরার মতো খাবার পাওয়া যাবে না। এই দেশে দশ রিয়াল কিচ্ছু না। এরা সত্যিকারের বিপদে পড়েছিলো কি না জানি না। আল্লাহু আলাম। আল্লাহ্‌ জানেন কে সত্যি, কে মিথ্যা।

আমরা যখন অবশেষে মিনার ক্যাম্পে প্রবেশ করলাম, তখন মধ্যরাত অতিক্রান্ত হয়েছে। সারাদিনের ব্যস্ত তাঁবুর নগরী এখন ঘুমের রাজ্যে পরিণত হয়েছে। শরীর ভেঙে ক্লান্তি ঝরে পড়ছে। কিন্তু শারীরিক ক্লান্তির চেয়ে অন্য এক স্বাভাবিক মানবীয় অনুভূতির আগ্রাসন এখন অধিক শক্তিশালী আকার ধারণ করেছে। ক্ষুধার তাড়নায় আমরা দুজনেই অস্থির। প্রায় দশ কিলোমিটারের বেশি হাঁটা হয়েছে আমাদের। আমার জীবনে এক দিনে কখনো এত হাঁটিনি। প্রয়োজনের সময় আল্লাহ্‌ মানুষের মাঝে অন্যরকম শক্তি দিয়ে দেন!!

মিনায় সবার রাতের খাবার খাওয়া বহু আগে শেষ। এখন কোনো খাবার আশা করাও মরীচিকার মতো। তাও আমরা সেই পাকিস্তানী মা-ছেলের মতো লজ্জিত, কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে ক্যাম্পের রান্নাঘরের দিকে গেলাম। উঁকি দিয়ে দেখবো, কোনো খাবার রয়ে গেছে কি না। যা ভেবেছিলাম, তা-ই। খাদ্যের কোনো নাম গন্ধ দেখলাম না, রান্নাঘর বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। এক দুজন কর্মচারী আছেন, তাঁরা গল্প করতে করতে গুছিয়ে নিচ্ছেন সব কিছু।

আমরা হতাশ হয়ে আমাদের তাঁবুর দিকে হাঁটা দিলাম। ঠিক এমন সময় …

কে যেন আমাদের আওয়াজ দিলো! আশা-নিরাশার দোলাচলে থমকে দাঁড়ালাম। রান্নাঘর থেকেই ডেকেছে কেউ, হয়তো করুণ চেহারা নিয়ে আমাদের উঁকিঝুঁকি দিতে দেখেছে। তাদের একজন আমাদের জিজ্ঞেস করলো আমরা খেয়েছি কি না। সাফির বলে উঠলো, “না খাইনি।” তখন লোকটি দৌড়ে গিয়ে বড় দুই বাক্স খাবার নিয়ে আসলো, সাথে বড় বড় লম্বাকৃতির পাঁচটি বন রুটি!!

বাক্স খুলে আমাদের চোখ ছানাবড়া! বড় বড় গোস্ত আর আলুর টুকরো ঝোল করে রাঁধা। এক বাক্স আমাদের জন্য যথেষ্ট, দু বাক্স নিলে নষ্ট হবে, তাই দ্বিতীয় বাক্সটি ফেরত দিয়ে দিলাম। ক্ষুধার্ত অবস্থায় খাবার পেলে এত আনন্দ লাগে কে জানতো! আমাদের ক্যাম্পের তাবৎ বাঙালির মাঝে আমরাই আজ সবচেয়ে ভালো খাবার পেলাম। ডাস্টবিনে উপচে পড়া ভাতের স্তূপ দেখে বুঝলাম, বাকিদের জন্য বরাদ্দ ছিলো সেই বিখ্যাত বিরিয়ানি!! কেন যেন মনে হচ্ছে, সেই পাকিস্তানি মাতা পুত্র সত্যি কথাই বলছিলেন। ইশ! অন্য মুসলিম সম্পর্কে খারাপ ধারণা করেছিলাম কীভাবে! আমাদের মন এত সংকীর্ণ কেন?

নিশ্চয় আল্লাহ্‌ আমাদের এই ক্ষুদ্র দান কবুল করেছেন। তা না হলে এই গভীর রাতে পেট ভরে খাবার খেতে পারবো, তা তো কল্পনাও করিনি। আল্লাহ্‌ কয়েক ঘণ্টার মাঝে প্রতিদান দিয়ে দেখিয়ে দিলেন, আল্লাহ্‌র রাহে অতি অল্প ব্যয় করলেও তিনি তা কত গুণ বর্ধিত করে ফেরত দেন। আবার আমাদের লজ্জাও দিলেন, এক মুসলিম হয়ে আমরা অন্য মুসলিমের প্রতি খারাপ ধারণা অনুমান করে কত নীচ মনের পরিচয় দিয়েছি।

আল্লাহ্‌ আমাদের প্রথমে ওদের মতো ক্ষুধার্ত বানিয়ে ক্ষুধার অনুভূতি শেখালেন। তারপর আশার চেয়ে উত্তম খাবার দিয়ে উনার অনুগ্রহ আস্বাদন করালেন। আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল ‘আলামীন। আমরা আল্লাহ্‌র কোন নিয়ামাতকে অস্বীকার করবো!

স্ব-গৃহে মজাদার ভোজন, সুরম্য বাড়িঘর, আরামদায়ক বিছানা, ইত্যাদি নিয়ামাত আমরা প্রতিদিন ভোগ করছি। আর-রাযযাক সহজেই আমাদের এসব ভোগ করতে দিয়েছেন দেখে আমরা এসবের শুকরিয়া আদায় করতেও ভুলে যাই। এক দু দিন এসবের থেকে দূরে থাকলে বোঝা যায় প্রতিনিয়ত আমরা আল্লাহ্‌র কতই না দয়ায় ডুবে থাকি, অথচ কত নাফরমান আমাদের অন্তর। এত কিছু পাবার পরও নির্লজ্জের মতো অভিযোগ করি আমার হেন নাই কেন? তেন নাই কেন? আমরা সারা জীবন সেজদায় পড়ে থাকলেও কি তাঁর অনুগ্রহের পর্যাপ্ত শোকরগুজার হতে পারবো?

সাত কুরবানি ঈদের রাতের একটি দৃশ্যের বর্ণনা দিয়ে এই অধ্যায় শেষ করি। তখন নিশুতি রাত, আকাশে তখনো চাঁদ আছে, পূর্ণিমার দু এক দিন বাকি থাকা স্বত্বেও চাঁদের নরম আলোর পরশ ছুঁয়ে যাচ্ছে এ ধরণীকে। শুভ্র তাঁবুতে ঢাকা এ শহরে রাস্তার উপর বসে আছে দুজন ক্ষুধার্ত তরুণ তরুণী। তারা খুব আগ্রহ নিয়ে রুপালী ফয়েলে ঢাকা বাক্স খুলে গোস্তের টুকরোগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। রাজভোজের আসন্ন আনন্দে তাদের চোখ চকচক করছে। হাতের বড় রুটি থেকে কিছু অংশ সাবধানে ঝোলে ডুবিয়ে মুখে দিল একজন। ঝোলের ঝাল মসলায় আর নরম রসালো গোস্তের স্বাদে প্রাণ জুড়িয়ে গেলো তাদের। এমন তৃপ্তি নিয়ে তারা খাবারটি খেলো, যেন বহুদিন পর পেট ভরে খাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। পাঁচ তারকা হোটেলের খাবারেও তো এত তৃপ্তি নেই!!

উপরে বর্ণিত দৃশ্যটি কি এ পৃথিবীতে একেবারে নতুন? নাকি অতি স্বাভাবিক দৃশ্যগুলোর একটি!! প্রতি রাতে কত মানুষ ভুখা পেটে ঘুমিয়ে পড়ে। কত মানুষ আজ ঈদের রাতে বছরে একবার মাংসের স্বাদ পায়! রেল লাইনের পাশের বস্তিতে স্ত্রী সন্তান নিয়ে যে দিনমজুর থাকে, সে কিন্তু সারা জীবন বলতে গেলে খোলা আকাশের নিচেই কাটিয়ে দেয়, তার পলিথিনে ঢাকা ঘর খানিকে ‘তাঁবু’ বললেও অতিরঞ্জিত করা হবে। কদাচিৎ যেদিন তারা ভরপেটে খেতে পায়, অথবা কখনো যদি প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত অবস্থায় উপরের রাজভোজের মতো খানা পায়, তাদের ঘরে নেমে আসে আনন্দের বন্যা। কুপি জ্বালানোর তেল নেই বলে হয়তো ল্যাম্প পোস্টের নিচে খেতে বসে তারা। চাঁদের আলোয় দেখা যায় তাদের আনন্দ মাখা চকচকে মুখাবয়ব …

ধনীরা হাতে গোনা কয়েক দিনের জন্য হাজ্জে এসে দরিদ্রর জীবনের হালকা আভাস নিয়ে যায়। যাদের বোধ আছে, তারা বাকি জীবন হাজ্জ হতে প্রাপ্ত শিক্ষা কাজে লাগিয়ে দরিদ্রদের কষ্ট বোঝার চেষ্টা করে। আবার অনেক দেশে ফিরে গিয়ে নরম তাকিয়ায় হেলান দেওয়া মাত্র সব বিস্মৃত হয়।

আল্লাহ্‌ যেন আমাদেরকে তাঁর কাছে ক্ষমা চাইবার বুঝ দেন, কৃতজ্ঞ হবার শক্তি দেন, উদার হবার মানসিকতা দেন।


পরবর্তী পর্ব- হাজ্জের ফরয তওয়াফ ও সা’ঈ

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive