জ্বীন কি মানুষের ওপর ভর করার সম্ভাব্য কারণ
ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ (রহিমাহুল্লাহ) বিভিন্ন সহীহ হাদিস, নিজ চোখে দেখা ঘটনা এবং রুক্বিয়ার ভিত্তিতে প্রাপ্ত তথ্য থেকে মানুষের ওপর জ্বীনের ভর করার সম্ভাব্য কারণগুলো উল্লেখ করেছেন। কারণগুলোর স্বপক্ষের হাদীসগুলো গত পর্বেই আলোচনা করা হয়েছে। নিচে কারণগুলো উল্লেখ করছি-
১. পুরুষ কিংবা মহিলা জ্বীনের বিপরীত লিঙ্গের মানুষের প্রতি স্বভাবজাত মুগ্ধতা।
২. জ্ঞানত কিংবা নিজের অজান্তে মানুষের মাধ্যমে কোন জ্বীনের ক্ষতি সাধিত হলে। (গরম পানি ফেলা, প্রস্রাব করা, ইটের টুকরা নিক্ষেপ করা, জ্বীনদের খাবার হাড়/গোবরকে নষ্ট করা, প্রাণীর আকার নেয়া অবস্থায় মারা ইত্যাদি)
৩. শুধুমাত্র অনিষ্টের উদ্দেশ্যে ভর করা। সাধারণত মানুষের তিনটি অবস্থায় শয়তান জ্বীন এই সুযোগ গ্রহণ করে: তীব্র রাগের সময়ে, তীব্র ভয়ের সময়ে এবং মন্দ কোন কিছুর জন্য তীব্র আকাংখার সময়ে। একটু লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারবেন, এই তিনটি পর্যায়ে মানুষের নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ খুব কম থাকে এবং আল্লাহর বিশ্বাসের পথ থেকে দুরে থাকে।
৪. যাদু-টোনার/কু-নজরের কারণে। (যাদু এবং কু-নজরের বিষয়টি ইসলামে অকাট্যভাবে প্রমানিত। রাসুল (সঃ) এর চুল নিয়ে জনৈক ইহুদী কর্তৃক যাদু করা এবং ‘সূরা নাস’ এবং ‘সূরা ফালাক’ এর অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট এবং সহীহ বুখারীর অসংখ্য হাদীস (সহীহ বুখারী ৭১/৬৩৪, ৭৮৪, ৮২৭। ৭/৬৫৮। ৭৫/৪০০। ৬৬/৩৭৮। ৫৪/৪৯০। ৫৩/৪০০) এর প্রমান। কিছু যৌক্তিক কারণে এই বিষয়টি নিয়ে কোন কিছু বিস্তারিত লেখা থেকে নিজেকে বিরত রাখছি। বিস্তারিত জানতে চাইলে নিজে তাফসীর পড়তে পারেন কিংবা কোন মুফতির সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।
মানুষের ওপর জ্বীন ভর করার সম্ভাব্য লক্ষণ সমূহ
সবার প্রথমে একটি বিষয় নিশ্চিত করতে চাই. পবিত্র কুরআন এবং হাদীসের আলোকে জ্বীন আসর করার লক্ষণ সমূহের বিষয়ে “মোহাবিষ্ট”, “উদভ্রান্ত” ইত্যাদি ছাড়া বিস্তারিত কিছু বলা হয় নি। ইবনে তাইমিয়াহ(রহিমাহুল্লাহ), ইবনে কাসীর(রহিমাহুল্লাহ), জালালুদ্দিন সুয়ুতি(রহিমাহুল্লাহ), আব্দুল খালিক আল-আত্তার (রহিমাহুল্লাহ) প্রমুখ প্রখ্যাত ইসলামী ব্যক্তিত্বের লিখিত বইয়ের ভিত্তিতে প্রসিদ্ধ মিশরীয় আলিম ওয়াহিদ আব্দুল সালাম (রহিমাহুল্লাহ) নিচের লক্ষনগুলো বর্ণনা করেছেন। মদিনা ইউনিভার্সিটির সম্মানিত শিক্ষক, বিশিষ্ট ফকীহ এবং আলিম আবু বকর জাবির আল-জাজাইরি (শাইখ আব্দুল আজীজ বিন বাজ এর স্নেহধন্য) এই লক্ষনগুলো নিশ্চিত করেছেন।
রুক্বিয়া বিষয়ে আমার দীর্ঘ পড়াশুনায় যতগুলো বইয়ে সাহর এর “লক্ষণ” এর কথা লেখা দেখেছি প্রায় সব জায়গায় একটি বিষয় প্রথমে নিশ্চিত করা হয়েছে, তাহলো- কারো ওপরে শয়তান জ্বীনের আসরের কারণে লক্ষনগুলো দেখা দিতে পারে। কিন্তু এই লক্ষণ থাকা মানেই কেউ শয়তান জ্বীনের দ্বারা আক্রান্ত, এটা ভাবার কোন যৌক্তিকতা নেই। বর্তমানে চিকিৎসা বিজ্ঞান অনেক উন্নত। প্রথমেই একজন ভালো ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া উচিত হবে।
রুক্বিয়া “অল্টারনেটিভ মেডিসিন” হিসেবে ব্যবহার করা হয়। চিকিত্সা বিজ্ঞানের কোন বিরোধ নেই এই প্রক্রিয়ার সাথে। উপরন্তু, একজন যোগ্য এবং রুক্বিয়ার বিষয়ে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন আলিম ছাড়া জ্বীনের আসর করার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া এবং রুক্বিয়া শুরু করা “তীব্রভাবে নিরুৎসাহিত” করা হয়েছে।
দুই ধরনের লক্ষণের কথা আলোচনা করা হয়েছে- ক) ঘুমন্ত অবস্থায় লক্ষণ, খ) জাগ্রত অবস্থায় লক্ষণ।
ক) ঘুমন্ত অবস্থায় লক্ষণসমূহঃ
১. উদ্বেগ জনিত অনিদ্রা।
২. দুঃস্বপ্ন।
৩. ক্রমাগত স্বপ্নে ভয়ংকর প্রাণী দেখা।
৪. ঘুমের মধ্যে অতিরিক্ত হাসি, কান্না, চিত্কার, গোঙানি।
৫. নিয়মিত ঘুমের ঘোরে হাঁটা ইত্যাদি
খ) জাগ্রত অবস্থায় লক্ষণসমূহঃ
১. কোন শারীরিক সমস্যা ছাড়াই তীব্র মাথা ব্যথা।
২. আল্লাহ, রাসুল (সঃ) এবং ইসলাম ধর্মের নিয়ম-কানুন গুলোর উপরে তীব্র বিতৃষ্ণা।
৩. সবসময় প্রচন্ড অমনোযোগী, অলস এবং মানসিকভাবে বিক্ষিপ্ত থাকা।
৪. কোন শারীরিক সমস্যা ছাড়াই প্রায়ই তীব্র খিঁচুনি।
৫. কোন শারীরিক সমস্যা ছাড়াই শরীরের বিশেষ কোন একটি অঙ্গে তীব্র ব্যথা ইত্যাদি।
মানুষের ওপর জ্বীন ভর করার প্রকার
তিন ধরনের আসর হতে পারে শয়তান জ্বীনের মাধ্যমে-
১. সামগ্রিক: পুরোপুরি ভর করা. প্রায়ই খিঁচুনি সামগ্রিক ভর নিশ্চিত করে।
২. আংশিক: শরীরের কোন একটি নির্দিষ্ট অঙ্গে ভর করা যেমন- পা, হাত, জিহ্বা ইত্যাদি।
৩. স্বল্পস্থায়ী: এই ধরনের আসরে রোগী মিনিট দুইয়েকের জন্য অজ্ঞান হয়ে যায় সাধারণত। অনেকটা দুঃস্বপ্ন দেখার মতো অভিজ্ঞতা হয় রোগীর।
রুক্বিয়া সম্পন্ন করার প্রক্রিয়া
অত্যন্ত যৌক্তিক কিছু কারণে রুক্বিয়া পরিচালনার প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু উল্লেখ করব না। ইবলিশ এবং শয়তান জ্বীন মানুষের আজন্ম শত্রু। এদের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে নামলে পাল্টা আক্রমন খুবই স্বাভাবিক। নিজেকে প্রস্তুত না করে এই যুদ্ধে নামা নিছক বোকামী এবং বিপদজনক।
একজন পরিপূর্ণ মুসলিম যিনি রুক্বিয়া পরিচালনা করার দায়িত্ব নিতে চান, তাঁর নিচের গুনাবলী থাকা অত্যাবশ্যক। নিচের উল্লেখিত গুনাবলী যাচাই করে আমরা নিজেরাই বিবেচনা করতে পারি, আমাদের মধ্যে কে কতটুকু যোগ্য এই কাজের জন্য।
রুক্বিয়া পরিচালনাকারীর আবশ্যক গুনাবলী:
১. তাঁর ঈমানের ভিত অত্যন্ত মজবুত হতে হবে. ঈমানের সকল শাখা-প্রশাখায় তাঁর অবাধ বিচরণ এবং পূর্ণ দখল থাকতে হবে।
২. ইসলামের একত্ববাদের (তাওহিদ) শক্ত কান্ডারী হতে হবে তাঁকে।
৩. “আল্লাহ সুবহানাল্লাহু তা’আলা কথা পবিত্র কুরআন মাজীদের আয়াত শয়তান জ্বীনদের উপরে ভয়ংকর কার্যকারী”- এই ধ্রুব সত্যে বিশ্বাসী এবং যে কোন পরিস্থিতে এই সত্যের ওপরে পর্বত প্রমান স্থির থাকতে হবে।
৪. ইবলিশ এবং শয়তান জ্বীনদের আচরণ, জীবন যাপন থেকে শুরু করে তাদের কর্মকান্ডের বিষয়ে যতদুর সম্ভব স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হবে। আমার আগের পর্বগুলোতে আমি গুটিকয়েক হাদীস বর্ণনা করেছি মাত্র। এ সংক্রান্ত অসংখ্য হাদীস এবং নামকরা তাবেঈ’ন, তাবে তাবেঈ’নদের অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ বই রয়েছে।
৫. কারো ওপরে ভর করার পরে শয়তান জ্বীনদের ধূর্ত আচরণ এবং ফাঁদ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে।
[এ প্রসঙ্গে ইবনে তাইমিয়াহ (রহিমাহুল্লাহ) এর একটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। জ্বীনের আসর করা এক রোগীর ওপরে রুক্বিয়া পরিচালনা করার এক পর্যায়ে শয়তান জ্বীন জানায় যে সে ইবনে তাইমিয়াহ (রঃ) এর সম্মানে রোগীকে ছেড়ে চলে যাবে। ইবনে তাইমিয়াহ (রহিমাহুল্লাহ) সেই মুহুর্তেই পাল্টা জবাব দিয়ে বলেন যে তাঁর সম্মানে চলে যাওয়ার কোন প্রয়োজন নেই জ্বীনের। শুধুমাত্র আল্লাহকে ভয় এবং সম্মান করার কারণে সে রোগীকে ছেড়ে যেতে পারে। ইবনে তাইমিয়াহ (রহিমাহুল্লাহ) এর জন্য এটি ফাঁদ ছিল। তিনি যদি তাঁর সম্মানে জ্বীনের চলে যাওয়াতে রাজী হতেন, তাহলে আল্লাহর উপরে তাঁর অবস্থানের কথাতে (নাউজুবিল্লাহ) প্রকারন্তে সম্মতি জানানো হতো। রুক্বিয়া পরিচালনা করার সময় শয়তান জ্বীন এরকম অসংখ্য উপায়ে পরিচালনাকারীকে ফাঁদে ফেলতে চায়।]
৬. রুক্বিয়া পরিচালনাকারী একজন বিবাহিত মানুষ হলে উত্তম।
৭. ইসলাম ধর্মে নিষিদ্ধ যাবতীয় কাজ থেকে তাকে অবশ্যই দুরে থাকতে হবে।
৮. শুধুমাত্র রাসুলুল্লাহ (সঃ) কর্তৃক শিক্ষা দেয়া দোআ এবং পবিত্র কুরআনের আয়াত দিয়ে রুক্বিয়া পরিচালনার অভ্যাস থাকতে হবে। কোন প্রকার বিদআ’ত/কুফরী কর্মকান্ডের অনুসারী হওয়া যাবে না- সেটা যত খারাপ অবস্থাতেই হোক না কেন।
৯. রুক্বিয়ার মাধ্যমে রোগীকে সুস্থ করা ছাড়া তাঁর অন্য কোন উদ্দেশ্য থাকা যাবে না।
১০. তার মনে দৃঢ় বিশ্বাস থাকতে হবে, যেহেতু তিনি আল্লাহর প্রতি আনুগত্যশীল, সেহেতু আল্লাহ তা’আলা তাকে শয়তান জ্বিনের ওপরে জয়ী অবশ্যই করবেন ইন শা আল্লাহ।
উপরের আবশ্যক গুনাবলী থেকে স্পষ্ট বুঝতে পারা যায় সবার পক্ষে রুক্বিয়া পরিচালনা করা সম্ভবপর নয় এবং উচিতও হবে না।
শয়তান জ্বীনের আসর, যাদু এবং বদ নজর থেকে বেঁচে থাকার উপায়
ইবলিশ এবং ইবলিশের অনুগত শয়তান জ্বীন মানুষের আজন্ম শত্রু। তারা সবসময় মানুষদের পেছনে পথভ্রষ্ট করার জন্য কাজ করে। কিন্তু আল্লাহ সুবহানাল্লাহু তা’আলা অভয় দিয়েছেন যে যারা আল্লাহর দেখানো পথে চলবে, তাদের ওপর শয়তান কর্তৃত্ব স্থাপন করতে পারবে না।
পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন বিষয়ে এই সম্পর্কে স্পষ্ট উল্লেখ করা আছে-
“শয়তান তোমাদের শত্রু; অতএব তাকে শত্রু রূপেই গ্রহণ কর। সে তার দলবলকে আহবান করে যেন তারা জাহান্নামী হয়।” (সূরা ফাতির, ৬)
“হে বনী-আদম! আমি কি তোমাদেরকে বলে রাখিনি যে, শয়তানের এবাদত করো না, সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু?” (সূরা ইয়া সীন, ৬০)
“সে (ইবলিশ) বললঃ আমাকে কেয়ামত দিবস পর্যন্ত অবকাশ দিন। আল্লাহ বললেনঃ তোকে সময় দেয়া হল। সে বললঃ আপনি আমাকে যেমন উদভ্রান্ত করেছেন, আমিও অবশ্য তাদের জন্যে আপনার সরল পথে বসে থাকবো। এরপর তাদের কাছে আসব তাদের সামনের দিক থেকে, পেছন দিক থেকে, ডান দিক থেকে এবং বাম দিক থেকে। আপনি তাদের অধিকাংশকে কৃতজ্ঞ পাবেন না। আল্লাহ বললেনঃ বের হয়ে যা এখান থেকে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়ে। তাদের যে কেউ তোর পথেচলবে, নিশ্চয় আমি তোদের সবার দ্বারা জাহান্নাম পূর্ণ করে দিব।” (সূরা আল-আ’রাফ, ১৪-১৮)
“সে (ইবলিশ) বললঃ আমার প্রভু! তুমি যেমনি আমাকে বিপথে যেতে দিয়েছ, আমিও তেমনি নিশ্চয়ই তাদের নিকট চিত্তাকর্ষক করব এই পৃথিবীতে, আর অবশ্যই তাদের একসাথে বিপথগামী করব তাদের মধ্যে তোমার খাস বান্দাদের ব্যতীত। তিনি (আল্লাহ) বললেনঃ এটিই হচ্ছে আমার দিকে সহজ-সঠিক পথ। নিঃসন্দেহ আমার দাসদের সন্বন্ধে তাদের উপরে তোমার কোনো আধিপত্য নেই, বিপথগামীদের মধ্যে যারা তোমার অনুসরণ করে তাদের ব্যতীত।” (সূরা আল-হিজর, ৩৯-৪২)
“নিঃসন্দেহ আমার বান্দাদের সন্বন্ধে, তাদের উপরে তোমার কোনো প্রভাব নেই। আর কর্ণধাররূপে তোমার প্রভুই যথেষ্ট।” (সূরা বনী ইসরাঈল, ৬৫)
উপরের আয়াতগুলোর মাধ্যমে পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে যে মহান আল্লাহ পাকের দেখানো পথে যারা চলবেন, তাদেরকে ইবলিশ এবং তার জ্বীনবাহিনী কোনভাবেই কাবু করতে পারবে না। আলহামদুলিল্লাহ।
সুতরাং শয়তান জ্বীনের আসর, যাদু এবং বদ নজর থেকে বেঁচে থাকার সর্বোত্তম এবং শ্রেষ্ঠ উপায় হলো “সীরাতুল মুস্তাকিম” এর পথে চলা। সহজ কথায়- আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসুল (সঃ) এর প্রকৃত আনুগত্য এবং প্রদর্শিত উপায়ে শান্তির ধর্ম ইসলামের বিধানসমূহ মোতাবেক জীবন যাপন করা।
এর বাইরেও সহীহ হাদীসের ভিত্তিতে কিছু কিছু বিষয়ে অবশ্যই সতর্কতা অনুসরণ করা উচিত সবার। এছাড়া পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াত এবং রাসুলে করীম (সঃ) এর নিজের শেখানো এবং পড়া কিছু দোআও রয়েছে, যেগুলো নিয়মিতভাবে নির্দিষ্ট কিছু সময়ে পড়লে শয়তান জ্বীনের আসর, যাদু এবং বদ নজর থেকে নিজেকে যথাসম্ভব রক্ষা করা যায়।
হাদীসগুলোর বিষয়ে পূর্বেই বিস্তারিত উল্লেখ করেছি। তাই নিচে বিষয়গুলো পয়েন্ট আকারে উল্লেখ করছি।
১. খাবার খাওয়া, পানি খাওয়া থেকে শুরু করে যে কোন কাজ মহান আল্লাহ সুবহানাল্লাহু তা’আলা নাম নিয়ে শুরু করা।
২. উঁচু কোন জায়গা থেকে লাফ দেয়ার আগে মহান আল্লাহ পাকের নাম স্মরণ করা/পড়া।
৩. কোন অন্ধকার রুমে প্রবেশ করার আগে মহান আল্লাহ পাকের নাম স্মরণ করা/পড়া।
৪. কোথাও গরম পানি ফেলা/ঢালার আগে মহান আল্লাহ পাকের নাম স্মরণ করা/পড়া।
৫. কোন কারণ ছাড়া কোন প্রাণীকে আঘাত না করা।
৬. কোন যৌক্তিক কারণ ছাড়াই একাকী রুমে না ঘুমানো। পরিস্থিতির কারণে যদি একাকী রুমে ঘুমাতে হয়- তাহলে ওজু করে মহান আল্লাহ পাকের নাম স্মরণ করে ঘুমাতে যাওয়া।
৭. কোন গর্ত কিংবা গুহায় প্রস্রাব না করা।
৮. বাসা-বাড়ির ভেতরে কোন সাপ দেখলে সাথে সাথে তাকে হত্যা না করা। বরং তাকে মহান আল্লাহর ওয়াস্তে চলে যেতে বলা উচিত। তিনদিনে তিনবার আল্লহর ওয়াস্তে চলে যাবার কথা বলার পরেও চতুর্থ দিন সাপটিকে হত্যা করা যেতে পারে। (তিনদিন কিংবা তিনবার বলার বিষয়ে আগেই বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।)
৯. সূর্যের আলো এবং কোন কিছুর ছায়ার মিলনরেখায় না বসা।
১০. টয়লেটে প্রবেশের আগে রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর শেখানো দোআ পড়ে নেয়া। দোআটি পরে উল্লেখ করছি।
১১. যৌক্তিক কারণ ছাড়া বাথরুমে অতিরিক্ত সময় না কাটানো। গোসলের সময় পুরোপুরি নগ্ন না হয়ে গোসল করা।
১২. কোন কারণ ছাড়া গভীর রাতে একাকী রাস্তা, বন-মরুভূমিতে ঘুরাঘুরি না করা।
১৩. উঁচু কোন জায়গা থেকে কোন কিছু নিচে নিক্ষেপ করার আগে মহান আল্লাহ তা’আলার নাম স্মরণ করা/পড়া।
১৪. গোবর কিংবা হাড় মেশানো মাটির চাকাকে ঢিলা হিসেবে ব্যবহার না করা।
১৫. হাসি, কান্না, রাগ, ক্ষোভ কোন কিছুতেই তীব্রভাবে আচরণ করা। সব কিছুতেই মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা উত্তম।
১৬. সব সময়, বিশেষ করে রাগের সময় অশ্লীল কথা থেকে নিজেকে বিরত রাখা।
১৭. ইসলামের বিধান মোতাবেক পর্দা প্রথা মেনে চলা।
১৮. কোন কারণে শয়তান জ্বীনদের আক্রমনের শিকার হচ্ছেন বুঝতে পারলে কিংবা ধারণা হলে উচ্চ স্বরে আযান দেয়া।
১৯. সর্ব অবস্থায় নিজেকে ওজুর মধ্যে রাখা খুব গুরুত্বপূর্ণ শয়তান জ্বীনদের বিরুদ্ধে খুবই কার্যকর একটি অস্ত্র।
২০. দিনের শুরুতে এবং ঘুমানোর আগে পবিত্র কুরআনের কিছু নির্দিষ্ট সূরা/আয়াত এবং রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর শেখানো দোআ পড়ে নেয়া।
শয়তান জ্বীনের আসর, যাদু এবং বদ নজর থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য দোআ
পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াত এবং মুহাম্মদ (সঃ) এর নিজের শেখানো এবং পড়া কিছু দোআও রয়েছে যেগুলো নিয়মিতভাবে নির্দিষ্ট কিছু সময়ে পড়লে শয়তান জ্বীনের আসর, যাদু এবং বদ নজর থেকে নিজেকে যথাসম্ভব রক্ষা করা যায়। আমি সেই আয়াতগুলোর বিষয়ে নিচে উল্লেখ করছি। উচ্চারণ এবং অর্থ কুরআন মাজিদ থেকে জেনে নিতে পারবেন।
১. সূরা আল ফাতিহা
২. সূরা আল বাক্বারা (১-৫)
৩. সূরা আল বাক্বারা (১৬৩-১৬৪)
৪. সূরা আল বাক্বারা (২৫৫) [আয়াতুল কুরসী)
৫. সূরা আল বাক্বারা (২৮৫-২৮৬) [শেষ দুই আয়াত]
৬. সূরা আল ইমরান (১৮-১৯)
৭. সূরা আল আ’রাফ (৫৪-৫৬)
৮. সূরা আল মু’মিনুন (১১৫-১১৮) [শেষ চার আয়াত]
৯. সূরা আস সাফফাত (১-১০)
১০. সূরা আল আহক্বাফ (২৯-৩২)
১১. সূরা আর রাহমান (৩৩-৩৬)
১২. সূরা আল হাশর (২১-২৪) [শেষ চার আয়াত]
১৩. সূরা আল-জ্বীন (১-৯)
১৪. সূরা আল ইখলাস
১৫. সূরা আল ফালাক্ব
১৬. সূরা অন নাস
বিশেষ কয়েকটি দোআঃ
এছাড়া “হিসনুল মুসলিম” নামক দোয়ার বই থেকে রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর শেখানো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দোআ’র আরবী উচ্চারণ বাংলা অর্থসহ নিচে থেকে উল্লেখ করছি।
১. ঘুমাতে যাবার আগের বিশেষ দোআঃ
«بِاسْمِكَ اللَّهُمَّ أَمُوتُ وَأَحْيَا»
(বিস্মিকাল্লা-হুম্মা আমূতু ওয়া আহ্ইয়া) | অর্থ: “হে আল্লাহ! আপনার নাম নিয়েই আমি মরছি (ঘুমাচ্ছি) এবং আপনার নাম নিয়েই জীবিত (জাগ্রত) হবো।” [বুখারী, (ফাতহুল বারীসহ) ১১/১১৩, নং ৬৩২৪; মুসলিম ৪/২০৮৩, নং ২৭১১।]
২. ঘুম থেকে জাগার পরের বিশেষ দোআঃ
«الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِيْ أَحْيَانَا بَعْدَ مَا أَمَاتَنَا، وَإِلَيْهِ النُّشُوْرُ»
(আলহামদু লিল্লা-হিল্লাযী আহ্ইয়া-না- বা‘দা মা- আমা-তানা- ওয়া ইলাইহিন্ নুশূর) | অর্থ: “হামদ-প্রশংসা আল্লাহ্র জন্য, যিনি (নিদ্রারূপ) মৃত্যুর পর আমাদেরকে জীবিত করলেন, আর তাঁরই নিকট সকলের পুনরুত্থান।” [বুখারী ফাতহুল বারী ১১/১১৩, নং ৬৩১৪; মুসলিম ৪/২০৮৩, নং ২৭১১]
৩. ঘর থেকে বের হওয়ার সময়ের বিশেষ দোআঃ
«بِسْمِ اللَّهِ، تَوَكَّلْتُ عَلَى اللَّهِ، وَلَاَ حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلاَّ بِاللَّهِ»
(বিসমিল্লাহি, তাওয়াককালতু ‘আলাল্লা-হি, ওয়ালা হাওয়া ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ) | অর্থ: “আল্লাহ্র নামে (বের হচ্ছি)। আল্লাহর উপর ভরসা করলাম। আর আল্লাহর সাহায্য ছাড়া (পাপ কাজ থেকে দূরে থাকার) কোনো উপায় এবং (সৎকাজ করার) কোনো শক্তি কারো নেই।” [আবূ দাউদ ৪/৩২৫, নং ৫০৯৫; তিরমিযী ৫/৪৯০, ৩৪২৬। আরও দেখুন, সহীহুত তিরমিযী, ৩/১৫১।]
৪. টয়লেট/বাথরুমে ঢোকার আগের বিশেষ দোআঃ
«[بِسْمِ اللَّهِ] اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْخُبْثِ وَالْخَبائِث»
([বিসমিল্লাহি] আল্লা-হুম্মা ইন্নী আ‘ঊযু বিকা মিনাল খুব্সি ওয়াল খাবা-ইসি) | অর্থ: “[আল্লাহ্র নামে।] হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট অপবিত্র নর জিন্ ও নারী জিন্ থেকে আশ্রয় চাই।” [বুখারী ১/৪৫, নং ১৪২; মুসলিম ১/২৮৩, নং ৩৭৫। শুরুতে অতিরিক্ত ‘বিসমিল্লাহ্’ উদ্ধৃত করেছেন সা‘ঈদ ইবন মানসূর। দেখুন, ফাতহুল বারী, ১/২৪৪।]
৫. টয়লেট/বাথরুম থেকে বের হবার পরের বিশেষ দোআঃ
«غُفْرَانَكَ»
(গুফরা-নাকা) | অর্থ: “আমি আপনার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।” [হাদীসটি নাসাঈ ব্যতীত সকল সুনান গ্রন্থকারই উদ্ধৃত করেছেন; তবে নাসাঈ তার ‘আমালুল ইয়াওমি ওয়াললাইলাহ’ গ্রন্থে (নং ৭৯) তা উদ্ধৃত করেছেন। আবূ দাউদ, নং ৩০; তিরমিযী, নং ৭; ইবন মাজাহ্, নং ৩০০। আর শাইখ আলবানী সহীহ সুনান আবি দাউদে ১/১৯ একে সহীহ বলেছেন।]
শেষ কথা
ইবলিশ এবং শয়তান জ্বীনের ভর করা এবং রুক্বিয়া নিয়ে আমার দীর্ঘ পড়াশুনা লব্ধ জ্ঞান আপনাদের সাথে শেয়ার করলাম। যেহেতু বিষয়টি প্রথাগত কিছু নয় এবং বাংলা ভাষায় এই বিষয় নিয়ে খুব কম লেখালেখি হয়েছে তাই আমি নিজেও বেশ কিছুটা চিন্তিত ছিলাম বিষয়টি নিয়ে লিখব, কি লিখব না? কারণ ভুল বুঝার অসংখ্য সুযোগ থাকে এই সব অপ্রথাগত বিষয়ে। অতি প্রয়োজনীয় কিন্তু অতি স্পর্শকাতর বিষয়টি নিয়ে যেহেতু বাংলা ভাষায় খুব কম লেখালেখি হয়েছে, তাই এই বিষয়ে আমাদের অধিকাংশের ধারণা অস্বচ্ছ। সেই কারণে, আমরা ইবলিশ এবং শয়তান জ্বীনের আসর থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হই। পাশাপাশি পরিষ্কার ধারণা না থাকার কারণে অনেক বিদআ’ত কাজও করে ফেলি নিজের অজান্তে। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম- ‘আমি লিখব ইন শা আল্লাহ’। সেই লেখা আজকের পর্বের মাধ্যমে শেষ করার সৌভাগ্য হল, আলহামদুলিল্লাহ।
নিশ্চয়ই উপকারী জ্ঞান নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার জন্য নয়।
“আর তোমাদের মধ্যে এমন একটা দল থাকা উচিত যারা আহবান জানাবে সৎকর্মের প্রতি, নির্দেশ দেবে ভাল কাজের এবং বারণ করবে অন্যায় কাজ থেকে, আর তারাই হলো সফলকাম।” (সূরা আল ইমরান, ১০৪)
“যে কেউ কাউকে একটি ভালো কাজের দিকে আহবান করে, সে ভালো কাজটি করা মানুষটির সমপরিমাণ পুণ্য অর্জন করে।” (মুসলিম শরীফ)”আমার শিক্ষা প্রচার কর, এমনকি একটি মাত্র বাক্য হলেও।” (বুখারী, ৫৬/৬৬৭)
“যেই জ্ঞানের দ্বারা কোন উপকার হয় না, তা সেই অনর্থক সম্পদের মতো যা থেকে আল্লাহর পথে ব্যয় করা হয় না।” (তিরমিযী, ১০৮)
সমস্ত প্রশংসা সেই আল্লাহ্র জন্য, যিনি আমাকে এই বিষয়টি নিয়ে লেখার তৌফিক দান করেছেন। শান্তি বর্ষিত হোক রাসুলুল্লাহ (সঃ), তাঁর পরিবার এবং সাথীদের ওপর।
গ্রন্থ সহায়িকাঃ
▪ “Protect yourself from the Jinn and Shaytan” by Waheed Abdussalam Baly
▪ “The World of the Jinn and Devils” by Dr. Umar Sulaiman al-Ashqar
▪ “The Jinn and Human Sickness (Remedies in the light of the Qur’aan and Sunnah)” by Dr. Abul-Mundhir Khaleel ibn Ibraheem Ameen
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।
Alhamdulillah,onek kichhu janlam, Jazakallah Javed vai….