মাঝে মধ্যেই দেখি ফেসবুক থেকে এমন অনেক দ্বীনি ভাই বিদায় নিচ্ছেন যারা দীর্ঘদিনের পরিচিতির কারণে আপন মানুষ হয়ে গিয়েছিলেন। এই দ্বীনি কম্যুনিটির বাইরেও অনেকেই এখন এই নীল-সাদা দুনিয়ার প্রতি ত্যক্ত-বিরক্ত। এটাই অবশ্য স্বাভাবিক। লাগামছাড়াভাবে লেবু বেশি কচলালে তা তিতা হবেই। এখানে কিছু আইডিয়া তুলে ধরলাম যে কীভাবে বিরক্তিহীনভাবে ফেসবুক ব্যবহার করা যায়-
১। লগইন করার সময় দ্বীনের কথা বলার নিয়তে ‘’বিসমিল্লাহ” বলে লগইন করবেন।
২। ঘন্টার পর ঘন্টা বা মিনিটের পর মিনিট উদ্দেশ্যহীনভাবে নিউজফিড স্ক্রল করতে থাকবেন না। প্রতিদিন কতটুকু সময় ফেসবুকে থাকবেন তা ঠিক করে ফেলুন। কিছুতেই সেই সময়ের অতিরিক্ত সময় ফেসবুকে কাটাবেন না। অনেক সময় দেখা যায় লগআউট করার আগ মুহূর্তে কেউ নক দিয়ে কথা শুরু করে দেয়, আর বের হওয়া হয়ে উঠে না। এক্ষেত্রে উত্তর না দিয়ে ফেসবুক থেকে বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন। তবে যদি জেনে থাকেন যে, প্রশ্নকারীর জরুরী প্রয়োজন তবে তাকে সাহায্য করুন। সেক্ষেত্রেও আপনার সময় স্বল্পতার কথা তাকে জানিয়ে দিন।
৩। যখন তখন যখন যা মাথায় আসে তাই পোস্ট দিবেন না। একটা পোস্ট শিডিউল করে ফেলুন কবে কয়টা এবং কোন বিষয়ে পোস্ট দিবেন। এখানে একটা নমুনা দিচ্ছি-
বার | বিষয় |
শনি | ১ টি আয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসীর (নির্ভরযোগ্য তাফসীর গ্রন্থ থেকে) |
রবি | ১ টি যিকরের ফযিলত |
সোম | ১ টি আয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসীর (নির্ভরযোগ্য তাফসীর গ্রন্থ থেকে) |
মঙ্গল | ১ টি হাদীসের সংক্ষিপ্ত বাখ্যা (আলেমদের থেকে শেখা, নিজের মনগড়া নয়) |
বুধ | ১ টি যিকরের ফযিলত |
বৃহস্পতি | ১ টি হাদীসের সংক্ষিপ্ত বাখ্যা (আলেমদের থেকে শেখা, নিজের মনগড়া নয়) |
শুক্র | নিজের জ্ঞানার্জন থেকে শেখা কোন বিষয় |
পোস্টের সংখ্যা এবং বিষয়বস্তু নিজের মত করে ঠিক করে নেবেন। উপরোক্ত চার্টের উদ্দেশ্য একটা ধারণা দেওয়া। তবে দিনে ২ টির বেশী পোস্ট না দেওয়া উত্তম। অতিরিক্ত সময় হাতে থাকলে তা দ্বীনের জ্ঞানার্জনে ব্যয় করা উচিত।
৪। ঝগড়াঝাটি চলছে এমন Post এ গিয়ে ভুলেও Comment করবেন না কিংবা ঝগড়াকারীদের Comment পড়ে সময় নষ্ট করবেন না। এসব জায়গায় সাধারণত গায়ের জোরে অশ্লীল গালিগালাজ চলে, নিজেকে শোধারানোর নিয়তে কেউ কথা বলে না। সুতরাং ঐসব Post এবং Comment অবশ্য পরিত্যাজ্য।
৫। সব মেসেজের রিপ্লাই দিবেন না। যদি মনে হয় আপনার উত্তর পেলে প্রশ্নকারীর উপকার হতে পারে তবেই কেবল উত্তর দিবেন। এতে কেউ আপনাকে যা ভাববে ভাবুক, আপনার সময়ের মূল্য সবার আগে। মেসেঞ্জারে অনর্থক চ্যাট করে সময় নষ্ট করবেন না। চেষ্টা করুন সর্বদা চ্যাটবক্স অফ রাখার জন্য।
৬। যেকোন পোস্টের/কমেন্টের বিষয়বস্তুর সাথে দ্বিমত হলেই সেখানে কমেন্ট করতে যাবেন না/ শেয়ার করে ট্রল করবেন না। ফেসবুকে কোটি কোটি মানুষ আছে যাদের সাথে আপনি একমত হতে পারবেন না কখনও। তাহলে সামনে কেউ পড়লেই নিজের মত জানান দেওয়ার কী দরকার ? এই বিষয়টা মেনে চলতে পারলে দেখবেন মানসিক শান্তি ও সময়ের বরকত অনেক বেড়ে গিয়েছে।
৭। তবে যেখানে শরীয়তের কোন বিষয়ে সুস্পষ্ট ভ্রান্তি ছড়াতে দেখবেন সেখানে অবশ্যই তার প্রতিবাদ করবেন। কিন্তু প্রতিবাদ করতে গিয়ে আবার শয়তানের ফাঁদে পড়বেন না। দরকার হলে আপনার মত দলীল-প্রমাণসহ উল্লেখ করে সেই পোস্টের নোটিফিকেশন বন্ধ করে দিন।
৮। কোন পোস্ট দেওয়ার পর/কোন পোস্টে কমেন্ট করার পর যদি বারবার সেই পোস্টের নোটিফিকেশন চেক করার বদভ্যাস থাকে আপনার, তবে পোস্ট দেওয়ার পর সেই পোস্টের নোটিফিকেশন বন্ধ করে দিন। এতে অনেক সময় সাশ্রয় হবে। এছাড়া যদি লাইক-শেয়ারের কারণে আপনার ইখলাস নিয়ে আপনি শঙ্কিত হন সেক্ষেত্রেও এই পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারেন।
৯। গণহারে কমেন্ট করার অধিকার দিলে যদি আপনার ফলোয়ার সংখ্যা বেশি হয় তবে আপনার পোস্টের/ প্রোফাইলের পরিবেশ দূষিত হতে পারে। তাই প্রাইভেসি দিয়ে কমেন্ট করার অধিকার শুধু আপনার ফ্রেণ্ডদের জন্যই রাখুন। আর শুধু তাদেরকেই ফ্রেণ্ড বানাবেন যারা পরমতসহিষ্ণু, উদারমনা এবং পরিচ্ছন্ন চিন্তা ও পজিটিভ মানসিকতার অধিকারী। এতে বারবার নিজের মতামতকে ডিফেণ্ড করা লাগবে না। ফলে অনেক সময় সাশ্রয় হবে এবং মানসিকভাবেও হাল্কা থাকবেন।
১০। বিয়ে/ বহুবিবাহ এসব নিয়ে ফাউল আলাপ/ রসিকতা করে কিংবা ট্রল শেয়ার দিয়ে নিজের ব্যক্তিত্ব কমাবেন না। বিয়ের জন্য মায়াকান্না করে ফেবুতে কেউ করুণা পায় না-মনে রাখবেন। যাকে তাকে নিজের বিয়ের সিভি ইনবক্স করবেন না কিংবা ছেলে/ মেয়ে খোঁজার দায়িত্ব দিবেন না। পরিচিত ও বিশ্বস্ত কোন ভাই এই কাজে আগ্রহী হলেই তাকেই শুধু বলতে পারেন।
১১। কিছু বলার না থাকলে কাউকে মেসেঞ্জারে শুধু লম্বা চওড়া সালাম দিয়ে পালাবেন না। নিউজফিড বাস্তব জীবনের রাস্তাঘাট নয় যে সামনে পড়লেই ইনবক্সে সালাম দিতে হবে। কিছু বলার থাকলে সালাম দিয়ে কথা শুরু করুন, না থাকলে নক দেওয়ারই দরকার নাই।
১২। বিপরীত লিঙ্গের কোন গাইরে মাহরাম এর সাথে ম্যাসেজিং করবেন না এবং তাদের পোস্টে অনর্থক কমেন্ট করবেন না। এক্ষেত্রে শয়তান অনেক বুঝ দেয় যে দ্বীনের দাওয়াতের জন্য কিংবা তাকে দ্বীনের পথে সাহায্য বা সংশোধন করার জন্য এটা দরকার। এমন কোন প্রয়োজন সত্যিই দেখা দিলে আপনার কোন মাহরাম এর সাহায্যে বা তার কোন মাহরামের মাধ্যমে তাকে সংশোধনের চেষ্টা করুন।
১৩। সবার শেয়ার করা সব পোস্ট/ছবি/ভিডিও দেখার দরকার নাই। সবকিছু আপনার উপকারে আসবে না কখনই। উপকারী মনে হলেই দেখবেন কেবল।
১৪। ফিক্বহী মাস’আলার ইখতিলাফী আলোচনা-সমালোচনা সর্বতোভাবে পরিহার করুন। ইখতিলাফী বিষয়ে আলোচনা করা আলেমদের কাজ, আমার-আপনার কাজ নয়। নিজের জ্ঞান জাহির করার জন্যতো বটেই, খালেস নিয়তেও ইখতিলাফী আলোচনা পরিহার করা উত্তম। ফেসবুকে এসব আলোচনায় তেমন একটা ফায়দা নেই। এই সময়ে গঠনমূলক কিছু করুন।
১৫। অন্য মানহাজ ও মাযহাবের আলেমদের সমালোচনা করা পুরোপুরি বন্ধ করুন।
১৬। আলেমগণ ছাড়া কাউকে ফতওয়া জিজ্ঞেস করবেন না, তিনি যত বড়ই সেলিব্রেটি হোন না কেন, যত লাখ ফলোয়ারই থাকুক না কেন। কোন ইসলামিক/অনৈসলামিক গ্রূপ, যেখানে আলেমগণ ফতোয়া দেন না, সেখানেও সাধারণ মানুষের উপর আস্থা রেখে ফতোয়া জিজ্ঞেস করবেন না।
১৭। নিজের প্রতিটা কাজ/আমলকে ফেসবুকে প্রকাশ করবেন না। সাধারণত রক্তদান কিংবা কোন দুস্থ ব্যক্তির চিকিৎসা/অন্যান্য খরচ বহন করার ঘোষণা দিয়ে অনেকেই ফেসবুকে পোস্ট দেন। এগুলো সবই অনেক সাওয়াবের কাজ যদি ইখলাস ঠিক থাকে। সুতরাং নিজের আমল গোপন রাখার চেষ্টা করুন।
১৮। অনর্থক বসে বসে অন্যের পোস্ট এর কমেন্ট পড়বেন না। এতে কিছু উপকার হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও তার চেয়েও দরকারী অনেক কিছু করার আছে।
১৯। ফালতু রসিকতা করে কিংবা অন্য ভাই/বোনদেরকে ব্যঙ্গাত্মক নামে ডেকে নিজের weight কমাবেন না। “ভাল কথা বলা নয়ত চুপ থাকা”-রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর বাণীটি সর্বদা মাথায় রাখবেন।
২০। গণহারে সবাইকে friend request পাঠাবেন না বা accept করবেন না।
২১। অনেকেই দেখা যায় সিক্রেট/ক্লোজড গ্রূপে পরিবারের সদস্যদের [স্বামী/স্ত্রী/শ্বশুর/শাশুড়ী ইত্যাদি] বদনাম করেন কিংবা অন্যের বদনামের আলোচনায় অংশ নেন। এই কাজ অবশ্য অবশ্য পরিত্যাজ্য। এটা একদিকে যেমন গীবাহ নামের মারাত্মক কবীরা গুনাহ তেমনি পরিবারের সদস্যদের ‘সম্মান’ নামক আমানতের খিয়ানত। এছাড়াও স্বামী/স্ত্রী/ছেলে/মেয়েদের কমন কিছু দূর্বলতা নিয়ে রসিকতা করা বা ইমেজ বানিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া ঘোরতর অন্যায়। কোন মানুষই ভুলের ঊর্ধে নয় আর নির্দিষ্ট কিছু মানুষের ভুলের কারণে সবাইকে গণহারে রসিকতার পাত্র/পাত্রী বানানো আরেক অন্যায়।
বিরক্তিহীনভাবে ফেসবুক ব্যবহার করার জন্য আপাতত এই চিন্তাগুলোই মাথায় এসেছে। এই লিখার যা কিছু ভাল ও উপকারী তা আল্লাহ্র পক্ষ থেকে আর যা কিছু ভুল তা আমার ও শয়তানের পক্ষ থেকে। আল্লাহ আমাদেরকে প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার করার তৌফিক দিন। আমীন।
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।