ফুফাতো ভাই শাহারিয়ার ফোন দিয়েছিলো সকালে। বললো যে, কাল সকালে ওদের ভার্সিটিতে নাকি একটা সিম্পোজিয়াম হবে। সেখানে মানুষের দৃষ্টি ও শ্রবণশক্তির ডেভেলপমেন্ট নিয়ে আলোচনা করা হবে। ফাতিমাকে সাথে নিয়ে আমাকে যেতে বললো কিন্তু টিকিট খরচ আমার দেওয়া লাগবে এই শর্তে। আমার টিকিট খরচ শাহারিয়ার দিবে কেন? এমনিতেই ও স্টুডেন্ট এবং আমার ছোটভাই। সম্ভবত টিকিট খরচ বেশি, এইজন্যে আমাকে ডেকেছে। যাতে আমি টিকিট খরচও দিয়ে দেই। কোনো সমস্যায় পড়েছে হয়তো।

অজানা বিষয় জানার জন্য মানুষের মধ্যে আগ্রহ সেই প্রাচীন যুগ থেকে। সেরকমই আগ্রহের একটি বিষয় হচ্ছে, একজন মায়ের গর্ভে কীভাবে ভ্রূণ বেড়ে ওঠে। বিজ্ঞানের এই শাখাকে বলে ভ্রূণবিদ্যা। প্রাচীন যুগ থেকেই বিভিন্ন বিজ্ঞানী এই বিষয়ে তাঁদের ধারণা শেয়ার করেছেন। এমনকি এই যুগেও অনেক এম্ব্রায়োলজিস্ট তাঁদের গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল আমাদের সাথে শেয়ার করছেন। এভাবেই বিজ্ঞানের ‘ভ্রূণবিদ্যা’ নামের শাখাটি বর্তমানে ভ্রূণ সম্পর্কে আমাদের প্রচুর তথ্য দেয়। কিন্তু বিজ্ঞানের অধিকাংশ শিক্ষার্থীরাই এ ব্যাপারে অজ্ঞ বা খুবই কম জানে। আমি আবার একটু কৌতূহলী ধরনের। এসব বিষয় কেন যেন আমাকে খুব টানে! তাই আমি এক বাক্যে রাজি হয়ে গেলাম।

IIRT Arabic Intensive

কিন্তু ফাতিমাকে রাজি করানো যাবে কি না আমি ঠিক বুঝতে পারছি না! তবুও চেষ্টা করতে দোষ কোথায়? দুপুরে বাসায় গিয়ে লাঞ্চ করে রেস্ট নেওয়ার সময় ফাতিমাকে অফার দিলাম আমার সাথে শাহারিয়ারের ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য। যা ভেবেছিলাম তা-ই! সে যেতে রাজি না। অনেক চেষ্টা করেও কাজ হলো না। অবশেষে শেষ টোপ ফেললাম। বললাম, “আমার ফুফাতো বোন প্রাচীকে তো চেনোই। ও একটু এগ্নোস্টিক টাইপের। ঠিক ফুফুর মতো। প্রাচী তো তোমার বয়সী। তাই তুমি ওকে ইসলামের দাওয়াত ভালো দিতে পারবে। আল্লাহ তা’আলা তো আমাদের দায়িত্ব দিয়েছেন ইসলাম প্রচার করার। তাই না?”

এবার দেখলাম একটু পজিটিভ। বললাম, “তাহলে আমি শাহারিয়ারকে বলে দিলাম আমরা যাবো ইনশা-আল্লাহ?” ফাতিমার সম্মতি পেলাম। এবার আরেক রুমে গিয়ে শাহারিয়ারকে ফোন দিলাম। কাল সেমিনারে আসার সময় যেন প্রাচীকে নিয়ে আসে সেজন্য প্রেশার দিলাম। শাহারিয়ার প্রথমে একটু অসম্মতি প্রকাশ করলেও প্রাচীর টিকিট খরচ আমি দিয়ে দিবো বললে ও রাজী হয়ে গেলো।
পরের দিন সকালে গাড়িতে করে রওনা দিলাম ভার্সিটির উদ্দেশ্যে। এক ঘণ্টা পরে ভার্সিটি চত্বরে পৌঁছে দেখলাম শাহারিয়ার আর প্রাচী গেইটে অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। গাড়ি দেখেই চিনে ফেলেছে। হাত দিয়ে থামানোর ইশারা দিলে গেইটে গাড়ি থামালাম। ওদের গাড়িতে উঠিয়ে ভিতরে চলে গেলাম। গাড়ি পার্ক করে টিকিট কাউন্টারে গিয়ে ১৬০০ টাকা দিয়ে চারটি টিকিট কাটলাম। ভালোই ব্যবস্থাপনা দেখছি। টিকিটে প্রত্যেকের নামও লিখে দিচ্ছে। লেকচার গ্যালারির নিচে ওরা দাঁড়িয়ে ছিলো। সেখানে গিয়ে সবাইকে যার যার টিকিট বুঝিয়ে দিলাম।

শাহারিয়ার বললো, “ভাইয়া, আমার টিকিট কাটলে কেন?”

আমি ওর কান মলে দিয়ে বললাম, “হুম, বুঝেছি! এবার ভিতরে চল। আচ্ছা, টিকিটের দাম এত কেন?”

ফাতিমা হেসে দিয়ে বললো, “ভালোই ফর্মালিটি মেইন্টেইন করো দেখছি!”

শাহারিয়ার উত্তর দিলো, “অনুষ্ঠান শেষে লাঞ্চ আছে। এজন্য মনে হয়। আচ্ছা, চলো ভিতরে যাই।”

এবার বুঝলাম শাহারিয়ার কেন এই অনুষ্ঠানে এসেছে। সাধে তো আর দেখতে ভোম্বল না! স্টুডেন্ট অবস্থায় আমিও তো কম ছিলাম না। যা-ই হোক, কথা বলতে বলতে সবাই গ্যালারিতে চেক পয়েন্টে চলে গেলাম। টিকিট দেখিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। শাহারিয়ার সবাইকে গ্যালারিতে বসার ব্যবস্থা করে দিলো। আমরা চারজন চতুর্থ সারিতে লাইন দিয়ে বসলাম। ফাতিমা আমার ডান পাশে ছিল আর বামে শাহারিয়ার। আর প্রাচী বসলো ফাতিমার পাশে।

কিছুক্ষণ পরে গোল ফ্রেমের চশমা পরে একজন লোক এবং তাঁর পিছনে কিছু লোক এসে গ্যালারির স্পিকার প্যানেলে বসলেন। আমরা সবাই তাঁদের সম্মান দিলাম। গোল চশমা পরা লোকটি সবার মাঝখানে বসলেন। মনে হচ্ছে এই লোকই আজ মূল লেকচার দেবেন।

ঘড়িতে এগারোটা বাজে। কুরআন তিলাওয়াত দিয়ে শুরু হলো অনুষ্ঠান। এরপরে সবার জ্ঞানগর্ভ আলোচনা শুরু হলো। প্রায় সব কথাই আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছিলো। তবুও সব বোঝার ভান করে মাথা নাড়াচ্ছিলাম। স্টুডেন্ট লাইফের অভ্যাস। হে হে। সবার শেষে আসলো সেই গোল চশমা পরা লোকের বক্তৃতার পালা। তিনি মাইক্রোফোন নিয়ে সালাম দিয়ে বললেন, “সবাই তো অনেক কিছুই বললেন। আমি সহজে আপনাদের কিছু বলার চেষ্টা করি।”

বয়সে এই গ্যালারির সবচেয়ে বয়স্ক তাঁকেই লাগছে। কিন্তু কথা বলছে আপনি আপনি করে। মনে হচ্ছে খুব ভদ্রলোক। ভাবলাম যে, এই স্যারের সহজ বক্তৃতা মনে হয় আগের সবার মতো মাথার উপর দিয়ে যাবে না। এবার একটু নড়েচড়ে বসলাম। অধিক আগ্রহ নিয়ে তাঁর কথাগুলো বুঝার চেষ্টা করলাম। উনি যা বলছেন, সাথে সাথে আবার প্রোজেক্টরের সাহায্যে স্লাইডে দেখিয়ে দিচ্ছেন। কিছুক্ষণ শুনে দেখলাম ভালোই লাগছে।

তিনি বলছিলেন, “আপনারা তো সবাই জানেন যে, পুরুষের শুক্রাণু এবং নারীদের ডিম্বাণু মিলিত হয়ে জাইগোট তৈরি হয়। এরপরে এতে বিভাজন শুরু হয়। তারপর থেকে মায়ের গর্ভে প্রায় ৯ মাস ভ্রূণে বিভিন্ন অঙ্গ প্রকাশ পেতে থাকে এবং একটি পর্যায়ে গিয়ে পূর্ণতা লাভ করে। আজকের আলোচনার বিষয় যেহেতু দৃষ্টি এবং শ্রবণশক্তি নিয়ে, তাই আপনাদের আজ এই দুটি বিষয়েই বলবো। প্রথমে চোখের ব্যাপারে বলি। ভ্রূণে চোখ তৈরি শুরু হয় ২২তম দিনে। চারটি অংশ এখানে অংশগ্রহণ করে। প্রথমটি হলো, নিউরোএক্টোডার্ম। এখান থেকে তৈরি হয় রেটিনা। যেখানে প্রতিফলিত ছবি কেমিক্যাল সিগন্যাল আকারে ব্রেইনে গেলে আমরা দেখতে পাই। দ্বিতীয়টি হলো, সার্ফেস এক্টোডার্ম। এখান থেকে তৈরি হয় লেন্স। যেখানে আলো পরে প্রতিসরিত হয়ে রেটিনায় গিয়ে পড়ে। এই দুই অংশের মধ্যে অবস্থিত মেসোডার্ম থেকে আসে চোখের ধমনী এবং শিরা। আর সর্বশেষ নিউরাল ক্রেস্ট থেকে আসে সাদা অংশ, যাকে স্ক্লেরা বলে।[১] চোখের ডেভেলপমেন্ট মূলত ৩ থেকে ১০ সপ্তাহ পর্যন্ত হয়।[২] তারপরেও চোখের স্নায়ুগুলোর ডেভেলপমেন্ট হতে থাকে। তখনও চোখের পাতা বন্ধ থাকে। এজন্য ভ্রূণ কিছুই দেখতে পারে না। পরবর্তীতে ৭ মাসের মধ্যে চোখের পাতা খুলে যায়। তখন ভ্রূণ দেখতে পায়।[৩] জন্মের পরে একটি শিশু কিন্তু তার চোখ দিয়ে সবকিছু পরিষ্কার দেখতে পারে না। বাচ্চার জন্মের পরেও ৬ থেকে ৮ মাস লেগে যায় চোখে পরিষ্কার কোনোকিছু দেখতে।[৪] এখন আপনারা বলুন যে, আপনারা বুঝেছেন কি না।”

সবাই সমস্বরে সম্মতি দিলো। তিনি একটু মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, “আপনাদের একটি গল্প বলি। কোনো এক কলেজের একটি শিক্ষকের পড়ানো কেউ বুঝতো না। কিন্তু শিক্ষক যখন জিজ্ঞাসা করতেন যে তারা বুঝেছে কি না, সবাই বলতো ‘জ্বি, স্যার।’ কিন্তু ছাত্রের দিকে তাকালে তিনি দেখতেন যে, যে যার কাজে ব্যস্ত। কেউ লেকচার খেয়ালই করছে না। শিক্ষক বুঝতে পারলেন যে, ছাত্ররা তাঁর সাথে মজা নিচ্ছে। যেমন ছাত্র, তেমন শিক্ষক! একদিন লেকচারের ফাঁকে প্রশ্ন করলেন, ‘এই, তোরা নাকি কলেজের বাগানের আম চুরি করেছিস?’ ছাত্ররা বললো, ‘জ্বি, স্যার।’ এরপরে এটা নিয়ে সে কী কাণ্ড!”

স্যারের কৌতুক শুনে গ্যালারির সবাই সশব্দে হাসাহাসি শুরু করলো। ভালো টিচারের বৈশিষ্ট্যই এমন যে, কোনো কঠিন লেকচার দেওয়ার মাঝে মাঝে শিক্ষার্থীদের একটু রিফ্রেশমেন্টের ব্যবস্থা করবে। এখানে স্যারও সেই পদ্ধতি অ্যাপ্লাই করলেন। স্যার সবাইকে হাসি থামাতে বলে আবার বলা শুরু করলেন, “এবার শ্রবণশক্তির কথা বলি। মানুষের কানের তিনটি অংশ। বহিঃকর্ণ, মধ্যকর্ণ এবং অন্তঃকর্ণ। কানের ডেভেলপমেন্ট মূলত ৩ থেকে ১৮ সপ্তাহ পর্যন্ত হয়। ১৮ সপ্তাহে বা প্রায় ৫ মাসে একটি ভ্রূণের কান শব্দ শোনার জন্য উপযোগী হয়। আর ২৫ থেকে ২৬ সপ্তাহ বা ৬ মাসে ভ্রূণটি বাইরের কোনো শব্দে প্রতিক্রিয়া দেখায়।[৫] বাচ্চার জন্মের ১ মাস পরেই সে ভালোভাবে শুনতে পায়।[৬] আপনারা মনে হয় বুঝতে পারেননি! তাই না?”

সবাই বললো, ‘না স্যার, বুঝেছি।”

স্যার হেসে দিয়ে বললেন, “তাহলে আপনারা সেই স্টুডেন্টদের মতো নন। আমি সেটাই বুঝলাম। ধন্যবাদ আমার কথাগুলো মন দিয়ে শোনার জন্য। আপনারা একটি জিনিস কি ভেবে দেখেছেন যে, আমি এতক্ষণ যা কিছু বললাম এবং দেখালাম তার সবটুকুই আপনারা কান দিয়ে শুনেছেন এবং চোখ দিয়ে দেখেছেন? এবং ব্রেইন দিয়ে বুঝতে পেরেছেন। আমাদের এই সিম্পোজিয়ামের একটি উদ্দেশ্য এই যে, মানুষ তার দুটি চোখ এবং দুটি কানের মূল্য বুঝুক। যাদের এই দুটি অঙ্গ নেই, তারা দেখতে বা শুনতে পারে না। তাদের কাছে পৃথিবীটা খুব কষ্টের! তাই সিম্পোজিয়ামের দ্বিতীয় উদ্দেশ্য এই যে, এখান থেকে প্রাপ্ত অর্থ আমরা তাদের রিহ্যাবিলিটেশনে কাজে লাগাবো।”

আমরা সবাই করতালি দিয়ে তাঁদের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানালাম। স্যার আবার মাইক্রোফোনটি নিয়ে বললেন, “এবার একটি গল্প বলে আমি আমার বক্তব্য শেষ করতে চাই। একবার এক শিক্ষক ক্লাসের ছাত্রদের একটি ব্যাক্টেরিয়ার ছবি এঁকে টেবিলের উপর রাখতে বললেন। যে সবচেয়ে সুন্দর ছবি জমা দেবে, তাকে স্যার পুরষ্কার দেবেন বলে ঘোষণা দিলেন। সবাই ব্যাকটেরিয়ার ছবি এঁকে স্যারকে জমা দিলো। একটি ছেলে সাদা কাগজ জমা দিলো। শিক্ষক এর কারণ জিজ্ঞাসা করাতে সেই ছাত্র উত্তর দিলো, ‘স্যার আমি ব্যাক্টেরিয়া এঁকেছি ঠিকই, কিন্তু ব্যাক্টেরিয়া তো খালি চোখে দেখা যায় না। তাই আপনি দেখতে পাচ্ছেন না।’ হা হা হা।”

স্যারের সাথে আমরাও হাসতে থাকলাম। তারপর স্যার বললেন, “সবাই ছেলেটিকে বোকা বললেও আমি কিন্তু ছেলেটিকে জিনিয়াস বলবো।”

এই বলে স্যার সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করলেন। এবং যাওয়ার সময় ক্যান্টিনে লাঞ্চ করে যেতে বললেন। আমরা সবাই গ্যালারি থেকে বেরিয়ে ক্যান্টিনে চলে গেলাম। একটি টেবিলে চারজন একসাথে বসলাম। ফাতিমা আমাকে ধন্যবাদ দিলো তাকে এরকম সুন্দর একটি অনুষ্ঠানে নিয়ে আসার জন্য। ধন্যবাদটি অবশ্য শাহারিয়ারের পাওয়ার কথা। কিন্তু ক্রেডিটটা আমিই নিলাম। কিন্তু ভোম্বলটা গড়গড় করে বলে দিলো যে, ফাতিমাকে সে আসতে বলেছে। এর জন্যে আবার আরেকটি ট্রিট চেয়ে বসেছে ফাতিমার কাছে। আমি প্রাচীকে বললাম, “শাহারিয়ারকে খাওয়ার ব্যাপারে কিছু বলিস না কেন?” প্রাচী উত্তর দিলো, “তাহলে আমি বাড়িতে দুই দিন ওর যন্ত্রণায় আর কোনো খাবারই পাবো না।”

প্রাচীর কথা শুনে ফাতিমা বললো, “আমার ভাইও এমন ছিলো। খাবারের প্রতি আগ্রহ বেশি। আচ্ছা আদনান, তোমাকে আজকে স্যার যে লেকচার দিলেন সেই আলোকে কুরআনের কিছু সৌন্দর্য তুলে ধরবো। স্যার তাঁর লেকচারে বলেছেন, ভ্রূণের কান শব্দ শোনার জন্য উপযুক্ত হয় প্রায় ৫ মাসে এবং চোখ দেখতে উপযোগী হয় প্রায় ৭ মাসে। এবং জন্মের পরেও এক মাসের মধ্যে কান ভালোমতো শুনতে পায় এবং চোখ ভালোভাবে দেখতে পায় ৬ থেকে ৮ মাস পরে। তার মানে মানুষের কান আগে হয়, তারপরে চোখ। আর মানুষ আগে শব্দ শুনতে পায় এবং পরে দেখতে পায়। ঠিক এই ব্যাপারটি কুর’আনেও আল্লাহ তা’আলা আমাদের জানিয়েছেন। আল্লাহ তা’আলা সূরা সাজদাহ এর ৯ নং আয়াতে…”

এটুকু বলতেই প্রাচী ফাতিমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললো, “ফাতিমা, আমি আম্মুর কাছে তোমার ব্যাপারে জেনেছি। শুনেছি তুমি ভালোই যুক্তি দিয়ে কথা বলো। দুঃখের ব্যাপার হলো, ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে তোমরা একেক সময় একেক পদ্ধতি ব্যবহার করো। বর্তমানে তোমরা ইসলামের প্রচারের ধরন একটু চেঞ্জ করেছো। তোমরা বর্তমানে ইসলামকে বিজ্ঞানের সাথে উপস্থাপনের মাধ্যমে ইসলাম প্রচার করো। তুমি যে বিষয়ে বলতে চাচ্ছো, সে বিষয়ে আমি অনেক আগে থেকেই জানি। কিন্তু আমি প্রমাণ করতে পারবো যে, তোমার যুক্তি ভুল।”

ফাতিমা বললো, “প্রাচী, ইসলামে রয়েছে পরিপূর্ণ জীবন-ব্যবস্থা। অর্থনীতি, পরিবার নীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি, পররাষ্ট্রনীতি ইত্যাদি সকল বিষয়ে ইসলাম অন্যান্য সবার দেওয়া নীতির চেয়ে সুন্দর। আর ঠিক এ কারণেই খিলাফাহ চলাকালীন তাঁদের সমৃদ্ধি আকাশচুম্বী ছিলো। আর বৈজ্ঞানিক নিদর্শন সম্বলিত কিছু তথ্য আল্লাহ তা’আলা কুরআনের মাধ্যমে আমাদের জানিয়েছেন। সুতরাং আমরা সেটা বলতেই পারি। আর আমি যা বলতে চেয়েছিলাম, সেই বিষয়ে তুমি কী জানো? আর আমার কোন যুক্তি ভুল? অবশ্য আমি এখনো কোনো যুক্তি দেইনি। এত ওভার রিঅ্যাক্টিভ হওয়ার তো কিছু নেই।”

প্রাচী বললো, “ওভার রিঅ্যাক্টিভ মোটেও হইনি। তুমি সূরা সাজদা’র ০৯ নং আয়াতের কথা বলবে যে, ওই আয়াতে বলা হয়েছে যে, আল্লা ভ্রূণকে সুষম করে, তাতে রূহ সঞ্চার করে এবং তাতে দেয় কান, চোখ ও অন্তঃকরণ। যেহেতু এখানে আগে কানের কথা এসেছে এবং পরে চোখের কথা এসেছে, সেহেতু কান আগে হয় আর চোখ পরে হয়। তোমাদের ক্লেইমটা এমন। আর এতেই তোমরা কোরানকে বিজ্ঞানময় বলতে থাকো। কিন্তু এভাবে যদি একটি শব্দের পরে আরেকটি আসলে সেটা তৈরি হওয়ার ক্রম বুঝায়, তাহলে আমি অন্য আয়াত দিয়ে বৈজ্ঞানিক ভুল বের করতে পারবো। যেমন ধরো, কোরানে সূরা নাহলের ৭৮ নং আয়াতে আছে, আল্লা আমাদেরকে মায়ের গর্ভ থেকে বের করেছে। এবং আমাদের দিয়েছে কান, চোখ ও হৃৎপিণ্ড। এবার তাহলে বলো যে, পরপর থাকার কারণে যদি সৃষ্টির ক্রম বুঝায়, তাহলে এই আয়াত বিজ্ঞানসম্মত থাকে কি না। নিশ্চয়ই তুমি বলবে না যে, বাচ্চা জন্ম হবার পরে চোখ এবং কান হয়। এখানে আরেকটি বৈজ্ঞানিক ভুল হলো, এই আয়াতে বলেছে কান এবং চোখ তৈরি হওয়ার পরে হৃৎপিণ্ড তৈরি হয়। কিন্তু বিজ্ঞান বলে হৃৎপিণ্ড ভ্রূণের প্রথম ফাংশানাল অর্গান। এটি ২২ থেকে ২৩ দিনেই পাম্প শুরু করে।[৭] এখন তাহলে বলো যে, কোরান ভুল নাকি তোমার যুক্তি ভুল।”

ফাতিমা মনোযোগ দিয়ে প্রাচীর কথাগুলো শুনছিলো। ওর কথা শেষে ফাতিমা ব্যাগে হাত দিয়ে একটি পকেট কুরআন বের করলো। কুরআনটি খুলতে খুলতে বললো, “প্রাচী, তুমি আসলেই আমি যেটা বলতে চেয়েছিলাম, প্রায় সেটাই বলেছো। এবং এর সাথে কিছু ভুলভ্রান্তি উল্লেখ করেছো। তুমি বলেছো যে, কান ডেভেলপমেন্ট শেষ হয় প্রায় ৫ মাসে এবং চোখ ডেভেলপমেন্ট শেষ হয় ৬-৮ মাসে। যেহেতু কান চোখের আগে ডেভেলপ করে, তাই আমি ‘অতঃপর তিনি তাকে সুষম করেন, তাতে রূহ সঞ্চার করেন এবং তোমাদেরকে দেন কর্ণ, চক্ষু ও অন্তঃকরণ’ – এই আয়াত থেকে বৈজ্ঞানিক মিরাকল বলবো। কিন্তু আমি একটু ভিন্ন আঙ্গিকে বলতাম। তুমি এখানে যে শব্দের অনুবাদ চোখ বলেছো, সেই শব্দটি হলো ‘আল-আবসার (اَلْأَبْصَٰرَ)’। শব্দটি এসেছে ‘বাসারুন (بَصَر)’ থেকে। এই শব্দের অর্থ মূলত দৃষ্টি বা দৃষ্টিশক্তি।[৮] আবার যে শব্দটির অনুবাদ কান করেছো, সেই শব্দটি হলো ‘আস-সাম’আ (اَلسَّمْعَ)’। শব্দটি এসেছে ‘সাম’উন (سَمْع)’ থেকে। এই শব্দের অর্থ শোনা বা শ্রবণ করা।[৯] অর্থাৎ, কুর’আনে যেখানে সাম’উন এবং বাসারুন শব্দ এসেছে, সেখানে এর অর্থ হবে যথাক্রমে শ্রবণশক্তি এবং দৃষ্টিশক্তি। কারণ চোখ ও কান হিসেবে আরবিতে অন্য শব্দ ব্যবহার করা হয়। চোখের আরবি প্রতিশব্দ আ’ঈন (عَين)।[১০] এবং কানের আরবি প্রতিশব্দ উযুনুন (أُذُن)।[১১] যদিও ‘সাম’উন (سَمْع)’ এবং ‘বাসারুন (بَصَر)’ শব্দ দু’টি দিয়ে কান ও চোখ মাঝে মাঝে উদ্দেশ্য হয়। কিন্তু কিছু কিছু ‘আলিম এই শব্দগুলোর মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য করেছেন। অর্থাৎ, সাম’উন এবং বাসারুন শব্দের অর্থ হবে যথাক্রমে শ্রবণশক্তি এবং দৃষ্টিশক্তি। এগুলো আমাদের ভালোভাবে বুঝতে হবে। যা-ই হোক, আমি মিরাকলটা এভাবে বলবো যে, স্যারের কথা মতো মানুষ আগে শ্রবণশক্তি পায় এবং পরে দৃষ্টিশক্তি পায়। এটা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। অতএব, কুরআন এই বৈজ্ঞানিক সত্যটিই আমাদের জানিয়েছে সেই ১৪০০ বছর আগে। এবার তোমার বাকি ক্লেইমগুলোর যৌক্তিকতা আছে কি না এবং কুরআন ভুল নাকি আমার যুক্তি ভুল, সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে আগে আমাকে সূরা নাহলের সেই আয়াত দেখতে হবে। কত নম্বর আয়াত বলেছিলে যেন?”

প্রাচী বললো, “সূরা নাহল। চ্যাপ্টার সিক্সটিন অ্যান্ড ভার্স সেভেন্টি এইট। আর সূরা সাজদা। চ্যাপ্টার থার্টি টু অ্যান্ড ভার্স নাইন।”

ফাতিমা মোবাইলে কুরআনের অ্যাপ ওপেন করে সেখান থেকে কিছুক্ষণ আয়াতগুলো দেখে নিলো। তারপর প্রাচীর প্রশ্নের উত্তরে বললো, “আসলে প্রাচী, এক্ষেত্রে কুরআনও ভুল নয় এবং আমার যুক্তিও ভুল নয়। বরং, তোমার উত্থাপিত প্রশ্নগুলোই অযৌক্তিক। একটি ভাষাকে যখন তুমি অন্য ভাষায় অনুবাদ করবে, তখন অনেক শব্দের মূল অর্থ তুমি সবসময় অনুবাদ দিয়ে প্রকাশ করতে পারবে না।”

“সেটা কেমন?” প্রশ্ন করলো প্রাচী।

ফাতিমা বললো, “আচ্ছা বলছি। প্রথমে সূরা সাজদাহ’র আয়াত নিয়ে আলোচনা করি। সূরা সাজদাহ’র ৯ নং আয়াতের কয়েক আয়াত আগের অর্থ দেখলে ৯ নং আয়াতে যে পরপর ‘শ্রবণশক্তি’ এবং ‘দৃষ্টিশক্তি’ শব্দ ব্যবহারে এদের ক্রমই বুঝানো হয়েছে, সেটা পরিষ্কার হয়ে যায়। আমি তোমাকে ৭ থেকে ৯ নং আয়তগুলো পড়ে শোনাচ্ছি। আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘যিনি তাঁর প্রত্যেকটি সৃষ্টিকে সুন্দর করেছেন এবং কাদামাটি থেকে মানুষ সৃষ্টির সূচনা করেছেন। অতঃপর তিনি তার বংশধর সৃষ্টি করেন তুচ্ছ পানির নির্যাস থেকে। অতঃপর তিনি তাকে সুষম করেন, তাতে রূহ সঞ্চার করেন এবং তোমাদেরকে দেন শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি ও অন্তঃকরণ। তোমরা সামান্যই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।’ এই আয়াগুলোতে প্রথমে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, আদম ‘আলাইহিস সালামকে তিনি মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। তারপর আদম ‘আলাইহিস সালামের বংশধরদের তিনি পুরুষ এবং মহিলার রিপ্রোডাক্টিভ ফ্লুইড তথা শুক্রাণু এবং ডিম্বাণু থেকে তৈরি করেছেন। কারণ পানির নির্যাস বলতে বীর্যের নির্যাস শুক্রাণু এবং ফলিকুলার ফ্লুইডের নির্যাস ডিম্বাণুকে বুঝায়। এখানে ‘অতঃপর’ শব্দটি আরবি যে শব্দের অনুবাদ সেই শব্দটি হলো ছুম্মা (ثُمَّ)। এটি এমন একটি শব্দ, যার অর্থ এই আয়াতে বিরতির সাথে ক্রম নির্দেশক।[১২] তার মানে আদম ‘আলাইহিস সালামকে আল্লাহ মাটি দিয়ে তৈরির পরে সময়ের ব্যবধান ছিলো। এবং ক্রমানুযায়ী বংশধরদের পুরুষ এবং মহিলার রিপ্রোডাক্টিভ ফ্লুইড তথা শুক্রাণু এবং ডিম্বাণু থেকে তৈরি করেছেন। এর পরে আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর তিনি তাকে সুষম করেন, তাতে রূহ সঞ্চার করেন এবং তোমাদেরকে দেন শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি ও অন্তঃকরণ।’ এই আয়াতটিও আল্লাহ তা’আলা আবার ‘ছুম্মা’ শব্দ দিয়ে শুরু করেছেন। অর্থাৎ, এই আয়াতের ঘটনাগুলো আগের আয়াতের ঘটনার পরে কিছুক্ষণ হলেও বিরতিতে সংঘটিত হয় এবং ক্রমানুসারে হয়। এই আয়াতে শ্রবণশক্তি এবং দৃষ্টিশক্তি আরবি ‘ওয়াও (و)’ বা ‘এবং’ দিয়ে যুক্ত। এই আয়াতের প্রথমে ‘সুম্মা’ এবং পরে ‘ওয়াও’ দিয়ে শব্দগুলোর সংযুক্তি এদের সৃষ্টির ক্রমই নির্দেশ করে। বুঝতে পেরেছো?”

প্রাচী উত্তর দিলো, “হুম। তারপর?”

ফাতিমা বললো, “ব্যাপারটি এমন যে, একজন বললো, ‘আমি ফুটবল খেলতে যাবো। তারপর আমি ক্রিকেট খেলবো। তারপর আমি বাসায় এসে ফ্রেশ হবো, খাবো, পড়তে বসবো।’ এখানে ফ্রেশ হওয়া, খাওয়া, পড়তে বসা ইত্যাদি প্রত্যেকটি ঘটনাই ক্রমানুসারে সে করবে কারণ সে বাক্যের আগে ‘তারপর’ শব্দটি যুক্ত করেছে। ছেলেটি যদি প্রত্যেকটি কাজের কথা বলার আগে ‘তারপর’ শব্দটি যুক্ত করত, তাহলে তার বক্তব্যের সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যেত। যেমন- ‘রেলের ওপর দিয়ে চলে যে গাড়ি, সেই গাড়িতে ভ্রমণ আরামদায়ক।’ এ কথা যদি আমরা বলি ‘রেলগাড়িতে ভ্রমণ আরামদায়ক’ তাহলে বাক্যটি একদিকে যেমন সংক্ষিপ্ত হলো, আবার অন্যদিকে শ্রুতিমধুরও হয়। অল্প কথায় মনের ভাব প্রকাশ করতে পারা একটি বিশেষ গুণ। আর আল্লাহ’র কুরআনের এই গুণ তো প্রত্যেকটি পৃষ্ঠায়ই দেখা যায়। অতএব, ৯ নং আয়াতে আল্লাহ তা’আলাও অল্প শব্দেই ব্যাপক অর্থ বুঝিয়েছেন। সুতরাং, এই আয়াত দিয়ে আমি কুরআনের বৈজ্ঞানিক মিরাকল প্রচার করতেই পারি। যেই ঘটনা মানুষ গত শতাব্দীতে জেনেছে, কুরআন আমাদের সেই ঘটনার ইঙ্গিত ১৪০০ বছর আগে দিয়েছে। আল্লাহু আকবার! প্রাচী, তোমাকে কি বুঝাতে পারলাম?”

ফাতিমার এক্সপ্লানেশান আমার কাছে অস্থির লেগেছে। আর কুরআনের ভাষা শৈলীও মাশা-আল্লাহ। অল্প কথায় আল্লাহ তা’আলা কত কিছুই না বুঝিয়েছেন! সুবহানাল্লাহ। এরই মধ্যে প্রাচী বললো, “ঠিকাছে, তুমি তো তোমার যুক্তি যে ঠিক; সেটা প্রমাণ করলে। কিন্তু তাহলে কিন্তু সূরা নাহলের আয়াতটি অনুযায়ী কুরআন ভুল হয়ে যায়। ওখানে তো বলা হয়েছে কান এবং চোখ মায়ের গর্ভ থেকে বের হওয়ার পরে ডেভেলপ হয়। এবার কী বলবে?”

ফাতিমা বললো, “সূরা নাহলে তুমি যেই শব্দের অনুবাদ কান এবং চোখ বলেছো, সেই শব্দের অনুবাদ শুধু কান এবং চোখেই সীমাবদ্ধ নয়। এখানে,এই আয়াতেও আল্লাহ তা’আলা সাম’উন এবং বাসারুন শব্দ ব্যবহার করেছেন এবং অনেক তাফসিরকারকদের মতে এই আয়াতে শব্দদুটি দ্বারা উদ্দেশ্য যথাক্রমে শ্রবণশক্তি এবং দৃষ্টিশক্তি। আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের মায়ের গর্ভ থেকে বের করেছেন। তোমরা তো কিছুই জানতে না। তিনি তোমাদেরকে শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি ও অন্তর দিয়েছেন, যাতে তোমরা অনুগ্রহ স্বীকার কর।’ এখন এই আয়াতে আল্লাহ তা’আলা কিন্তু ‘ছুম্মা’ বা ‘অতঃপর’ শব্দটি ব্যবহার করেননি। এখানে স্বাভাবিকভাবেই আল্লাহ তা’আলা একই আয়াতে আমাদের প্রতি একটির পরে আরেকটি অনুগ্রহ বর্ণনা করেছেন। সুতরাং, এই আয়াতে ঘটনাগুলো ক্রম নির্দেশ করে না।

ওয়াও ফাতিমা, খুব সুন্দর ব্যাখ্যা। প্রাচী, এত কম জ্ঞান নিয়ে তুই কুরআনের ভুল ধরতে যাস? আফসোস হয় তোদের দেখলে রে! এদিকে বাঁয়ে তাকিয়ে দেখি শাহারিয়ার নেই। কখন যে উঠে গিয়েছে দেখিনি। আমি তো মনোযোগ দিয়ে ফাতিমা আর প্রাচীর বিতর্ক শুনছিলাম। দূরে তাকিয়ে দেখি শাহারিয়ার নিজেই খাবার নিয়ে আসছে। মনে হয় আমাদের বকবকানি ওর ভালো লাগছিলো না। খাদ্য প্রিয় মানুষ, খাবারের খোঁজেই গিয়েছে। কাছে এসে বললো,

-‘তোমাদের কথাবার্তা শেষ হয়েছে?’

-‘না, শেষ হয়নি। আর তুই তোর একার খাবার নিয়ে এসেছিস? অথচ আমরা এখানে কয়েকজন মানুষ না খেয়ে আছি!’

-‘তোমাদের কথা কখন শেষ হয় তার ঠিক নেই! আমি ততক্ষণ ওয়েট করতে পারলাম না। স্যরি!’

-‘ইটস ওকে। আচ্ছা, তুই এখানে বসে খেতে থাক।’

শাহারিয়ার আমার পাশের চেয়ারে বসে খাওয়া শুরু করলো। আমি আবার ওদের তর্কে মনোযোগ দিলাম।

প্রাচীকে অবজ্ঞার সুরে বলতে শুনলাম, “এখনো তো মূল প্যাঁচই বাকি। আমি জানতাম তুমি এভাবেই আমার একটি প্রশ্ন এস্কেইপ করবে। এসব তর্কে আমি এক্সপার্ট। সুতরাং, আমি বুঝি কে কোথায় চালাকি করতে পারে। তুমি এখানে একটি চালাকি করেছো!”

প্রাচী বারবার ফাতিমার কাছে হেরেও ভালোই নিজের স্মার্টনেস দেখাচ্ছে। ফাতিমা চাইলেই ওকে অপমান করতে পারতো। কিন্তু ও তেমন না। আমি হলে এতক্ষণে প্রাচীর খবর ছিলো। অজ্ঞ মানুষ বিদ্যার বড়াই দেখালে আমার বিরক্তি লাগে।

বোতলের পানিতে গলা ভিজিয়ে প্রাচীকে ফাতিমা বললো, “তো, কী চালাকি করলাম? হয়তো তোমার কিছু প্রশ্ন আমি ভুলে গিয়ে থাকতে পারি। মনে করিয়ে দাও। তাহলেই উত্তর দিবো, ইনশা-আল্লাহ।”

প্রাচী বললো, “সূরা নাহলের ৭৮ নম্বর আয়াতে তো শেষে হৃৎপিণ্ড আছে। তুমি তো সেটাকে অন্তর বলে কাটিয়ে গেলে! যদিও শ্রবণশক্তির পরে দৃষ্টিশক্তি হয়। কিন্তু দৃষ্টিশক্তির পরে তো আর হৃৎপিণ্ড হয় না! তাই না?”

ফাতিমা হেসে দিয়ে বললো, “ও, এই ব্যাপার। এখন বুঝলাম, তোমার আসলে আরবি ভাষার জ্ঞান নেই। হয়তো কোনো ব্লগ থেকে লেখাটি পড়েছো এবং অনুবাদ দেখেই কুরআনের ভুল ধরতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছো। তুমি সূরা সাজদাহ’র ৯ নং আয়াতের অর্থ বলেছিলে, আল্লাহ ভ্রূণকে সুষম করেন, তাতে রূহ সঞ্চার করেন এবং তাতে দেন কান, চোখ ও অন্তঃকরণ। আবার ‘সূরা নাহল’-এ বলতে গিয়ে তুমি বলেছো যে, কান এবং চোখের পরে হৃৎপিণ্ড দেন। কিন্তু দুই সূরাতেই একই শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। শব্দটি হলো ‘আল-আফইদাহ (اَلْأَفْـِٔدَةَ)’। তাহলে তুমি দুই জায়গায় দুই অর্থ কেন বললে?”

প্রাচী উত্তর দিলো, “দুই অর্থই তো আছে। তাহলে আমি তো ইচ্ছামতো ব্যবহার করতেই পারি।”

ফাতিমা বললো, “না, তোমার সেই যোগ্যতা নেই যে তুমি বুঝবে কোথায় কোন অর্থ বুঝানো হয়েছে। তাই যে জানে, তার কাছ থেকে তোমার জেনে নেওয়াই উচিত ছিলো। যা-ই হোক, আমাদের আলোচিত শব্দটি হলো ‘আল-আফইদাহ (اَلْأَفْـِٔدَةَ)’। এই শব্দটি ‘ফুয়াদ (فُؤَاد)’ শব্দের বহুবচন। এর অর্থ আবেগী অন্তর, হৃৎপিণ্ড ইত্যাদি।[১৩] কুরআনের এসব শব্দের মূল অর্থ না বুঝে অনুবাদ পড়লে বিভ্রান্তিতে পড়াই স্বাভাবিক। ফুয়াদের একটি অর্থ হৃৎপিণ্ড, কিন্তু সবসময় আল্লাহ তা’আলা ‘হৃৎপিণ্ড’ অর্থে শব্দটি ব্যবহার করেননি। এক্সাম্পল হিসেবে বলা যায়, রাসূলুল্লাহ ﷺ যখন নবুয়ত পেলেন, তখন জিবরাঈলকে (‘আ) তাঁর প্রকৃত রূপে দেখেছিলেন। তখন তিনি আবেগপ্রবণ হয়ে যান। কিন্তু তাঁর অন্তর অর্থাৎ, ‘ফুয়াদ’ তাঁকে অস্বীকার করেনি। অর্থাৎ, তিনি মনে করতে পারতেন যে, হয়তো শয়তান বা জ্বিন দেখেছেন। কিন্তু জিবরাঈলের চেহারা ও দৈহিক বিশালতা দেখে তাঁর অন্তর অর্থাৎ, ‘ফুয়াদ’ এই চিন্তায় সাড়া দেয়নি।[১৪] তুমি কি শুনছো?”

“হুম, শুনছি। বলতে থাকো।” বলল প্রাচী।

ফাতিমা বললো, “এই ঘটনা সংক্রান্ত আয়াত সূরা নাজমে আছে। আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘সে যা দেখেছিলো, তার ফুয়াদ তথা অন্তর সেটাকে মিথ্যে মনে করেনি।’ আবার কুরআনে আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘তোমার যে বিষয়ে নিশ্চিত জ্ঞান নেই, তার পিছনে পড়ো না। নিশ্চয়ই শ্রবণ, দৃষ্টি এবং ফুয়াদ বা অন্তর সম্পর্কে তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে।’[১৫] এই আয়াতে দেখো প্রথমে বলেছেন জ্ঞানের কথা। জ্ঞান আসলে কী? জ্ঞান হলো, তথ্য, বুদ্ধিবৃত্তি, দক্ষতা যা অভিজ্ঞতা এবং শিক্ষার মাধ্যমে পরিপূর্ণ হয়।[১৬] এই অভিজ্ঞতা এবং শিক্ষাই দেখা, শোনা এবং বুদ্ধির মিশ্রিত রূপ। তারপর বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই শ্রবণ, দৃষ্টি এবং ফুয়াদ সম্পর্কে আমরা জিজ্ঞাসিত হবো।’ এই আয়াতে প্রথমে যেহেতু জ্ঞান অর্জনের উপকরণের কথা বলা হয়েছে এবং পরে সেই উপকরণ বা ইন্দ্রিয় সম্পর্কেই জিজ্ঞাসিত হবার প্রতিশ্রুতি আল্লাহ তা’আলা দিয়েছেন, সেহেতু এই আয়াতে ‘ফুয়াদ’ এর অনুবাদ হৃৎপিণ্ড গ্রহণযোগ্য নয়। তাই এই আয়াতে ফুয়াদের সঠিক অনুবাদ হবে অন্তর। যা দিয়ে আমরা চিন্তা করি। আবার সূরা নাহলের ৭৮ নং আয়াতেও বলা হয়েছে, জন্মের পরে তো আমরা কিছু জানতাম না। তিনি আমাদের শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি ও ফুয়াদ বা অন্তর দিয়েছেন। এখানেও প্রথমে জন্মের পরে আমাদের অজ্ঞতার কথা বলা হয়েছে এবং কীভাবে আমাদের জ্ঞান অর্জনের ব্যবস্থা করেছেন, সেটা বলেছেন। সুতরাং, জ্ঞানের সাথে যেহেতু হৃৎপিণ্ডের সম্পর্ক নেই, তাই এই আয়াতেও ‘ফুয়াদ’ এর অনুবাদ হৃৎপিণ্ড করা যুক্তিযুক্ত নয়। সঠিক অনুবাদ হবে অন্তর। এবার বুঝেছো, কেন আমি সূরা নাহলের ৭৮ এবং সাজদাহ’র ৯ নং আয়াতে ফুয়াদের অর্থ অন্তর বলেছি?”

প্রাচী কোনো কথা বলছে না! কী-ই বা বলবে? ওর আর কোনো অস্ত্র আপাতত নেই। হা হা। ফাতিমা গ্লাসে রাখা পানি দিয়ে গলা ভিজিয়ে আবার বলা শুরু করলো, “প্রাচী, নিচে না তাকিয়ে আমার দিকে তাকাও। লজ্জার কিছু নেই। কেউ ভুল জানতেই পারে। কিন্তু সত্য জানার পরে গ্রহণ করার সৎ সাহস থাকা দরকার।”

প্রাচী মাথা উঁচু করে ফাতিমার দিকে তাকালে ফাতিমা বললো, “এবার কোনো শিশুর অন্তঃকরণ অর্থাৎ, যার সাহায্যে চিন্তা করে, সেটা কিন্তু ১ বছরেও ডেভেলপ করে না। বরং, এগুলো শ্রবণশক্তি এবং দৃষ্টিশক্তির পরেই ডেভেলপ করে। সুতরাং, এই আয়াতও বিজ্ঞান অনুযায়ী সঠিক। এবার কি তুমি ভুল স্বীকার করতে প্রস্তুত?”

প্রাচী উত্তর দিলো, “এ বিষয়ে আমি তোমার সাথে অন্যসময়ে কথা বলতে চাই। সময় করে বাসায় ডাকলে এসো প্লিজ। ঠিকাছে?”

ফাতিমা বললো, “আচ্ছা, ঠিকাছে। তোমার ভার্সিটি ছুটি হলে বোলো। আমি আসবো ইনশা-আল্লাহ। তোমার সাথে একটি ঘটনা শেয়ার করি। আমার এক বোন কানাডায় থাকে। সেখানে ফার্মাসি পড়ছে। ও দেশে আসলে আমি যখন বিভিন্ন রোগ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করি, তখন ও বলে, ‘ওগুলো ডক্টরদের বিষয়। আমার বলা ঠিক হবে না।’ ওদের মধ্যে একটি বিষয় লক্ষ করলাম যে, ওরা নিজের লিমিট বোঝে। যে বিষয়ে জ্ঞান নেই, সেগুলো সোজা বলে দেয় যে, সে জানে না। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্য, আমাদের দেশে অনধিকার চর্চা করার মতো লোকের অভাব নেই। এমন একটি টেন্ডেন্সি এদেশের মানুষ পোষণ করে, যেন সব বিষয়ে তাকে জ্ঞান জাহির করতেই হবে! এই তো সেদিন আদনানের কাছে শুনলাম, ও একটি দোকানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো। কিছু লোক নাকি চা খাচ্ছিলো। তখন, একটি কোম্পানির ওয়ার্কার কিছু বেকারির মাল দিতে এসে বসে চায়ের অর্ডার দিলো। দোকানদার উনাকে চিনি বেশি নাকি কম এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করাতে সে উত্তর দিয়েছিলো, ‘আরে ভাই, আমার কোনো ডায়াবেটিসের চিন্তা নাই। ওসব কোনো রোগ না। সবই ডাক্তারদের টাকা ইনকামের ধান্দা। এমনও রোগ আছে যাতে দিনে ১ কেজি চিনি খাওয়া লাগে!’ এই ঘটনা শুনে আমি তো অবাক! আল্লাহ তা’আলাই ভালো জানেন পৃথিবীর কোন রোগে দিনে ১ কেজি চিনি খাওয়া লাগে। আমার জানা নেই। আর এটাও জানা নেই যে, এই জাতি কবে এই অভ্যাস ত্যাগ করবে!”

আমি প্রাচীকে বললাম, “প্রাচী, ফাতিমা কী জন্য তোকে কথাগুলো বলেছে, বুঝেছিস?”

“হ্যাঁ, বুঝেছি।” প্রাচী মৃদু কণ্ঠে উত্তর দিলো।

“আদনান, আমাদের খাবারগুলো প্যাকেট করে নিয়ে আসো। আজ আর বসবো না। বাসায় চলো।” বললো ফাতিমা। আমি টিকিটগুলো নিয়ে গিয়ে ফাতিমা, প্রাচী আর আমার খাবার নিয়ে এলাম। ওদিকে শাহারিয়ার বন্ধুদের সাথে গল্প করছিলো। খাবার হাতে নিয়ে ফাতিমা শাহারিয়ারকে ডাক দিয়ে খাবারের প্যাকেটটি দিয়ে বললো, “ট্রিট চেয়েছিলে না? এই নাও।”

তৎক্ষণাৎ ট্রিট পেয়ে শাহারিয়ারের মুখের দিকে যেন তাকানোই যাচ্ছে না। খুশিতে দাঁতের মাড়ি পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল। এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি! আমি তাহলে আর প্রাচীকে বঞ্চিত করব কেন? আমার প্যাকেটটি প্রাচীকে দিয়ে বললাম, “যা, বাড়ি গিয়ে ফুফুকে নিয়ে খাস।”

ওদের বিদায় দিয়ে আমি আর ফাতিমা গাড়িতে উঠে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। গাড়ি নিয়ে শাহারিয়ার আর প্রাচীর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ফাতিমা হাত নাড়িয়ে বিদায় দিলো। কিন্তু আমি দেখছিলাম প্রাচী বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে তর্জনী চুলকাচ্ছিলো। এটা ওর ছোটবেলার অভ্যাস। আমি জানি যে, আজকের পরাজয়ের প্রতিশোধের উন্মত্ততা এখন তার স্নায়ুতে বয়ে যাচ্ছে। জেদি মেয়ে বলে কথা! হিংসা তো ওর পৈতৃক সূত্রেই প্রাপ্ত সম্পদ।


[ইসলামিক শরী’আহ অনুযায়ী কোনো মুসলিমের জন্য তার ফুফাতো বোন এবং কোনো মুসলিমাহ’র জন্য তার ফুফাতো ভাই মাহরাম নয়। আবার দেবর এবং ভাবী একে অপরের মাহরাম নয়। এদের প্রত্যেকের সাথে প্রত্যেকের পর্দা করা ফরজ। এবং কথা বলার সময় হিজাব মেইন্টেইন করা জরুরী। এখানে এগুলো কিছুই হয়নি। এক্ষেত্রেও গল্পটি শুধুমাত্র একটি গল্প হিসেবেই পড়ার অনুরোধ রইলো। সমস্ত জ্ঞান তো আল্লাহ তা’আলার কাছেই। লেখাটিতে যা কিছু ভুল, তা আমার ও শয়তানের পক্ষ হতে এবং যা কিছু কল্যাণ, তার সবটুকুই আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে।]

তথ্যসূত্র ও গ্রন্থাবলি

[১] The Developing Human by Keith L. Moore and T. V. N. Persaud; 10th edition; page: 417

[২] http://education.med.nyu.edu/course…

[৩] Larsen’s Human Embryology by Gary C. Schoenwolf, Steven B. Bleyl, Philip R. Brauer, Philippa H. Francis-West; 5th edition; page: 498

[৪] https://www.babycenter.com/0_baby-s…

[৫] https://www.healthline.com/health/p…

[৬] https://www.babycenter.com/0_baby-s…

[৭] The Developing Human by Keith L. Moore and T. V. N. Persaud; 10th edition; page: 284(CVS)

[৮] Al-Mawrid; By Dr. Rohi Baalbaki; Dar As-Salam Publication; Page: 238

[৯] Al-Mawrid; By Dr. Rohi Baalbaki; Dar As-Salam Publication; Page: 643

[১০] Al-Mawrid; By Dr. Rohi Baalbaki; Dar As-Salam Publication; Page: 789

[১১] Al-Mawrid; By Dr. Rohi Baalbaki; Dar As-Salam Publication; Page: 68

[১২] Al-Mu’jam Al-Waseet; Volume One; Page: 105

[১৩] Arabic-English Lexicon; by Edward William Lane; volume: 06; page: 107,108

[১৪] তাফসির ইবনে কাছির (ইসলামিক ফাউন্ডেশন); খণ্ড: ১০; পৃষ্ঠা: ৫১৪

[১৫] Surah Najm(53); Verse: 11

[১৬] Surah Al Isra(17); Verse: 36

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive