আমি ফারিসকে বললাম, ‘চল, রিকশায় যাই।’ কিন্তু ও আমার কথায় পাত্তা দিলো না – হাঁটতে শুরু করলো। অগত্যা আমিও ওর পিছু-পিছু ছুটতে লাগলাম। প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট হাঁটার পর আমরা মারুফদের বাসায় পৌঁছালাম। মারুফ আমাদের সহপাঠী। আমাদের বন্ধু। ছেলেটা বেশ সহজ সরল প্রকৃতির। সারাক্ষণ চুপচাপ থাকে। অন্যদের মতো মুখ দিয়ে কথার খই ফুটে না। বেশ লাজুকও বটে। গুরুগম্ভীর স্বভাবের জন্য ওকে আমরা ‘মেনা’ বলে ডাকতাম। কিছুদিন আগেও ছেলেটা এগনোস্টিক ছিলো। ধর্মের প্রতি উদাসীন ছিলো। ফারিসের সাথে মাসখানিক কাটানোর পর এখন আবার ইসলামের দিকে ফিরে এসেছে। আলহামদুলিল্লাহ। মারুফের পরিবর্তনে সবথেকে বেশি খুশি হয়েছে তার মা। তিনিই ফারিস আর আমাকে তাঁদের বাসায় দাওয়াত করেছেন। তাই বেড়াতে আসা।
সদর দরজা খোলাই ছিলো। আমরা ভিতরে প্রবেশ করলাম। ভিতরে ঢুকেই তো আমি অবাক! এটা তো যেন-তেন বাড়ি নয় – একটা প্রকাণ্ড জমিদার বাড়ি। গল্প বা উপন্যাসে জমিদার বাড়িগুলো যেমন থাকে, এ-ও তেমন। অবশ্যি পুরোনো হলেও বাড়িটি এখনো তার সৌন্দর্য ধরে রেখেছে। দো’তলা বাড়ি। সদর দরজা থেকে একেবারে থাকার ঘর পর্যন্ত একটি সরু ইটের রাস্তা। রাস্তার দুপাশে ঝাউগাছ। কিঞ্চিৎ দূরে গোলাকার করে বানানো একটি বৈঠকখানা। আরেকটু দূরে একটি মস্ত পুকুর। আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নানান প্রজাতির ফুল আর ফলের গাছপালা। হাস্নাহেনা ফুলের গাছ চোখে পড়ার মতো। বেশ ক’প্রজাতির ঔষধী গাছও নজরে পড়লো। এককথায় বাড়িটি অসাধারণ।
বাড়িটি দেখার পর আমি ফারিসকে বললাম, ‘নিশ্চয়ই মারুফদের পূর্বপুরুষ কেউ জমিদার ছিলো। তাই না?’
‘না।’ ফারিসের ঝটপট উত্তর।
আমি আরও কনফিডেন্টলি বললাম, ‘না মানে! তুই দেখিস আমার কথাই সত্যি হবে।’
ফারিস কেবল এক ফালি হাসি উপহার দিয়ে বললো, ‘আচ্ছা পরে দেখা যাবে।’
আমি কলিংবেল চাপলাম। ভেতর থেকে মারুফ এসে দরজা খুলে দিলো। সালাম বিনিময় শেষে আমরা বাসার ভিতরে প্রবেশ করলাম। একটি প্যাঁচানো কাঠের সিঁড়ি বেয়ে আমরা দো-তলায় উঠলাম। দো-তলায় মোট আটটি রুম। মারুফ থাকে পশ্চিমের কামরায়। এই রুমটায় সূর্যের আলো অপেক্ষাকৃত বেশি প্রবেশ করে। তাই হয়ত মারুফ রুমটিকে বেছে নিয়েছে। ওর আবার অন্ধকারের বাতিক আছে। তাই রাতে আলো জ্বালিয়ে ঘুমায়। ছাপোষা টাইপের লোকেরা একটু বেশিই ভীতু হয়। মারুফও তার ব্যতিক্রম না।
আমরা মারুফের রুমে গিয়ে বসলাম। মিনিট দশেক পর একজন বৃদ্ধলোক প্রবেশ করলেন। হাতে তাঁর বাহারী রঙের খাবার। এত খাবার দেখে ফারিস রাগান্বিত হলো। ফারিসকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে মারুফ বললো, ‘এগুলোর একটাও আমি করতে বলিনি। সব আব্বুর আদেশে তৈরি করা হয়েছে। তোরা আসবি সেটা আব্বুকে আগেই জানিয়েছিলাম। তিনিই এসবের ব্যবস্থা করেছেন। আমার কোনো দোষ নেই।’
ফারিস বললো, ‘হয়েছে হয়েছে। আর শাক দিয়ে মাছ ঢাকা লাগবে না। নে শুরু কর।’
যে খাবারগুলো আমাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যেও একটা রাজকীয় ভাব আছে। মোগলাই, গরুর গোশত দিয়ে বানানো পুলি, শিক কাবাব আরও অনেক কিছু। খাবারের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হলো, মারুফদের বাসা জমিদার বাড়ির মতো। খাবার দাবার আগেকার রাজা বাদশাদের মতো। অবশ্যই ওরা জমিদার বংশের সন্তান হবে। ফারিস আমার কাছে এইবার ঠিক হেরে যাবে।
খাওয়া দাওয়া শেষ হলে আমরা কিছুক্ষণ মারুফের রুমে বসে গল্প-গুজব করলাম। এরপর মারুফ আমাদের বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখালো। সত্যিই বাড়িটি বেশ অসাধারণ। সবথেকে সুন্দর হলো পুকুরটা। শানবাঁধানো ঘাটটিতে বসে জ্যোৎস্না দেখলে মনটা তৃপ্তিতে ভরে যাবে। দূর থেকে কামিনী ফুলের গন্ধ আসছে। কামিনী গাছও যে অধিক পরিমাণে আছে তা আমি খেয়াল-ই করিনি। গোটা পুকুর পাড়টাই কামিনী ফুলে ভর্তি।
আধঘণ্টা পর যখন আমরা চলে যাওয়ার মনঃস্থ করেছি, এমন সময় বৃদ্ধলোকটি এসে বললেন, ‘বড়সাহেব আপনাদের বাইরের বৈঠকখানায় ডেকেছেন।’
আমরা বাইরের বৈঠকখানায় গেলাম। গিয়ে দেখি আংকেল আগে থেকেই সেখানে বসা। আংকেলের সামনে রাখা গোলাকার একটি টেবিল ও তিনটি চেয়ার। চেয়ারগুলো কাঠের। ফারিস মাঝের চেয়ারটিতে বসলো। আমি আর মারুফ দুপাশের দুটিতে। আমরা আসন গ্রহণ করার পর মারুফ আমাদের আংকেলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। কিছুক্ষণ পর বৃদ্ধ লোকটি ট্রেতে করে চারকাপ চা নিয়ে এলেন। আংকেলের সুগার ফ্রি চা-টা আলাদা করে রাখলেন।
বৃদ্ধ লোকটি চলে যাওয়ার পর আংকেল বললেন, ‘মারুফের মুখে ফারিসের কথা অনেক শুনেছি। আজ তোমাকে দেখলাম। সত্যিই তোমাদের দেখে বেশ ভালো লাগছে। যৌবন কালেই ধর্মীয় বেশভূষা ধরেছো। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলছো – বেশ ভালো। আমি বিশ্বাস করি, প্রত্যেকটি মানুষের নিজের মতো করে জীবনকে উপভোগ করার অধিকার আছে। ধর্মের প্রতি আমার কোনো বিদ্বেষ নেই। কেবল ধর্মের কিছু কিছু দিকগুলো আমার কাছে এক্সট্রিম মনে হয়। এই আর কি। নাও, চা নাও।’
মারুফ আমাদের আগেই জানিয়েছিলো, ওর বাবা মুক্তচিন্তার চর্চা করেন। ধর্মটা আংশিক পালনের চেষ্টা করেন। তবে মানুষের কর্মের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন। তাই পরিবারের কাউকেই কোনো কাজে বাধা দেন না। যে যেভাবে ইচ্ছে চলতে পারে।
ফারিস চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললো, ‘যদি কিছু মনে না করেন তাহলে একটা প্রশ্ন করতে পারি?’
‘শিওর। হোয়াই নট?’
‘ধর্মের কোন কোন দিকগুলো আপনার কাছে এক্সট্রিম বলে মনে হয়?’
‘যেহেতু আমি মুসলিম পরিবারে জন্ম নিয়েছি, তাই ইসলামের কথাই বলি। ইসলাম তার অনুসারীদের বাধ্য করে ধর্মের আইনকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে। এর জন্য প্রয়োজন হলে যুদ্ধ করতে। এই রুলটা আমার কাছে অনেক এক্সট্রিম মনে হয়।’
‘আপনাকে ধন্যবাদ, আংকেল। খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং সময় উপযোগী কথা বলেছেন। আচ্ছা আংকেল! বর্তমান বিশ্ব কাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়? মানে বিশ্বের নীতিনির্ধারক কারা?’
‘ওয়েস্টার্ন কান্ট্রিগুলো। কিন্তু হঠাৎ এ প্রশ্ন?’
‘বলছি কেন। তার আগে আমার আরও একটি প্রশ্ন করার আছে। আপনি অনুমতি দিলে বলবো।’
‘বলো, বলো। নো প্রবলেম।’
‘থাংকয়্যু আংকেল। বর্তমান বিশ্বে মোড়লের ভূমিকায় অভিনয় করে কোন দেশ?’
‘ইট’স ভেরি সিমপল, মাই সান। এভরিবডি নোস দিস – আমেরিকা।’
‘খোদ আমেরিকার অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বৈষম্যের মাত্রাটা কেমন, জানেন আংকেল?’
‘না বাবা। বলতে পারবো না।’
‘মাত্র ১% আমেরিকানদের কাছে রয়েছে আমেরিকার মোট সম্পদের ৩৫ ভাগ। উচ্চমধ্যবিত্ত আমেরিকান – যাদের সংখ্যা ২০%, তাদের কাছে আছে ১১ ভাগ। আর সবথেকে নিচুস্তরের – যাদের সংখ্যা ৪০%, তাদের কাছে আছে ১ভাগেরও কম।’[১]
ফারিসের তথ্যগুলো অবাক করার মতো। অবাক করবে না কেন বলুন। সম্পদের এত বৈষম্য! তাও আবার খোদ আমেরিকাতে, যারা সাম্যের স্লোগান নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। যারা সাম্য প্রতিষ্ঠার দোহাই দিয়ে নিরীহ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে। অথচ এরা নিজেদের দেশ নিয়ে ভাবে না। ভাবে না নিজেদের দেশের অর্থনৈতিক সাম্যের কথা। ফারিসের কাছ থেকে আরও জানা যায়, সম্পদের বৈষম্যের দিকটা প্রথম ফুটে উঠে ২০০৭ সালে। এর আগ পর্যন্ত তারা বিষয়টিকে ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিলো। পরবর্তীকালে এই বৈষম্য আরও বাড়তে থাকে। ২০১১-তে এসে এই বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করে। সবচেয়ে ধনী মাত্র ৪০০ জন আমেরিকানের সম্পদের পরিমাণ, আমেরিকার মোট সম্পদের অর্ধেকের চাইতেও বেশি।[২] আর শুধু আমেরিকাই নয়, পাশ্চাত্যের অন্যান্য দেশগুলোর অবস্থাও একই।
‘আংকেল, বেয়াদবি না নিলে আরেকটি প্রশ্ন করি?’ ফারিসের প্রশ্ন।
আংকেল জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। অবশ্যই। কেন নয়!’
‘আপনি জানেন কি, সম্পদের বৈশ্বিক বৈষম্যটা কেমন?’
‘পত্র পত্রিকায় একটু একটু পড়েছিলাম। তবে এখন ভুলে গেছি। বয়স হয়েছে তো, তাই এখন আর কিছু মনে থাকে না। যা পড়ি, সব ভুলে যাই। শুনেছি মাত্র ১% লোকের হাতে বিশ্বের মোট ৪০ ভাগ সম্পদ বন্দী।’[৩]
‘হ্যাঁ, আংকেল। আপনি ঠিকই শুনেছেন। তবে সেটা জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড ওয়েলথ রিপোর্ট, ২০০৬-এর একটি হিসাব। তাদের ২০১৫-এর রিপোর্ট এর থেকে ভিন্ন তথ্য দিয়েছে।’[৪]
‘যেমন?’
‘তারা জানিয়েছে, বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ১ শতাংশ মানুষের হাতে রয়েছে পৃথিবীর শতকরা ৫০ ভাগ সম্পদ।’[৫]
‘তার মানে গত ৯ বছরে ১ ভাগ ধনীর সম্পদ বেড়েছে ১০ শতাংশ?’[৬]
‘জ্বী, আংকেল। ঘুরিয়ে বললে, এই ৯ বছরে ৯৯ ভাগ মানুষের সম্পদ কমেছে ১০ শতাংশ। আরও মজার বিষয় হলো, বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ৩০০ জনের সম্পদের পরিমাণ সচেয়ে দরিদ্র ৩ বিলিয়ন মানুষের সম্পদের সমান।’[৭]
‘তাদের সম্পদের পরিমাণ তো তাহলে ইন্ডিয়া, চীন, আমেরিকা, ব্রাজিলের মোট সম্পদের চাইতেও বেশি?’
‘হ্যাঁ আংকেল, ঠিক তা-ই। অপরদিকে ধনী দেশগুলোর বাৎসরিক মাথাপিছু আয় ১০০০০০ ডলার। আর দরিদ্র দেশগুলোর মাত্র মাথাপিছু আয় ১০০০ ডলার। যাদের মধ্যে ২০% এর দৈনিক আয় হলো ১.২৫ ডলারেরও কম। পৃথিবীতে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য কী হারে বাড়ছে, তা অনুধাবনে এই একটি পরিসংখ্যানই যথেষ্ট।’[৮]
‘হুঁ। তা তুমি ঠিকই বলেছো।’
‘বিশ্বের সবথেকে ধনী দেশগুলো কী পরিমাণ সম্পদ দখল করে রেখেছে, জানেন আংকেল?’
‘না, বাবা। আমার ধারণা নেই। তুমিই বলো।’
‘ধনী দেশগুলোর কাছে বন্দী আছে মোট সম্পদের ৯৪ ভাগ। আর বাকি ৮০% লোকের কাছে রয়েছে ৬ শতাংশ সম্পদ।’[৯]
‘স্ট্রেইঞ্জ! এভাবে তো ভেবে দেখিনি।’
‘আমাদের অনেকের কাছেই এই জিনিসগুলো ক্লিয়ার না। অথচ এটা তুচ্ছ কোনো বিষয় নয়। নোবেল বিজয়ী মানবাধিকার কর্মী কৈলাস সত্যার্থী মনে করেন, বিশ্বব্যাপী আয় বৈষম্য রীতিমতো অর্থনৈতিক সহিংসতার রূপ পেয়েছে। এই সহিংসতা মানবজাতির নিরাপত্তা ও শান্তির জন্য হয়ে উঠেছে বড় ধরনের হুমকি।’[১০]
আংকেল সুগার ফ্রি কাপে চুমুক দিয়ে ফারিসকে প্রশ্ন করলেন, ‘আচ্ছা বাবা! ধনী দেশগুলো তো দরিদ্র দেশগুলোকে আর্থিক অনুদান দেওয়ার মাধ্যমে এই বৈষম্য কমানোর চেষ্টা করে। তাই না?’
‘হ্যাঁ, করে।’
‘তাহলে অযথা তাদের দোষ দিয়ে লাভ কী? তারা তো দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়তা করে যাচ্ছে। বৈষম্য কমিয়ে আনার চেষ্টা করছে।’
‘তাদেরকে দোষ দেওয়া যেতো না যদি তারা বৈষম্য কমিয়ে আনার জন্যেই অনুদান দিতো। কিন্তু তারা অনুদান সম্পদের বৈশ্বিক বৈষম্য কমানোর জন্যে দেয় না। কারণ, এর মাধ্যমে দরিদ্র দেশগুলোর তো উন্নতি হচ্ছেই না, বরং তারা আরও দরিদ্র হচ্ছে। পক্ষান্তরে ধনী দেশগুলো দিন-দিন আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে। এই অনুদান পদ্ধতিটা পশ্চিমাদের পাতানো কূটকৌশল ছাড়া আর কিছুই নয়।’
‘বিষয়টি কি একটু বুঝিয়ে বলবে? আমার কাছে অস্পষ্ট মনে হচ্ছে। বুড়ো মানুষ তো, তোমার কথা ঠিকমতো ধরতে পারছি না।’
‘আমি বিষয়টি ব্যাখ্যা করছি। প্রতি বছর ধনী দেশগুলো গরীব দেশগুলোকে প্রায় ১৩০ বিলিয়ন ডলার অনুদান দেয়। স্বভাবতই প্রশ্ন আসতে পারে, তার পরেও কেন সম্পদের বৈষম্য কমছে না, বরং বেড়েই চলছে।
‘হুঁ, হুঁ।’
‘এর একটা কারণ হলো – ট্রেড মিসপ্রাইসিং নামক ট্যাক্স ফাঁকির মাধ্যমে মাল্টি ন্যাশনাল কর্পোরেশনগুলো প্রতি বছর দরিদ্র দেশ থেকে ৯০০ বিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এর বাইরে দরিদ্র দেশগুলো বিভিন্ন ঋণের বিপরীতে ধনী দেশগুলোকে প্রতি বছর ৬০০ বিলিয়ন ডলার সুদ দিতে বাধ্য হচ্ছে। পাশাপাশি দরিদ্র দেশগুলো টাকা হারাচ্ছে ঐসব বাণিজ্যনীতির কারণে যা ঠিক করা হচ্ছে ধনী দেশগুলো থেকে। ইউনিভার্সিটি অফ ম্যাসাচুসেটসের অর্থনিতিবিদদের মতে এসব বাণিজ্যনীতির কারণে দরিদ্র দেশগুলো ৫০০ বিলিয়ন ডলার হারাচ্ছে প্রতি বছর। সব মিলিয়ে সবচে’ দরিদ্র দেশগুলো থেকে সবথেকে ধনীদের কাছে যাচ্ছে ২ ট্রিলিয়ন ডলার, প্রতি বছর।[১১] এখন আংকেল বলুন তো, ধনী দেশগুলো যে ঋণ দিচ্ছে; তার মাধ্যমে কি দিন দিন সম্পদের বৈষম্য কমছে? না আরও বেড়ে যাচ্ছে?’
ফারিসের কথাগুলো আমার অন্তরে বিঁধছে। ঋণ দেওয়ার নাম করে ওরা আমাদেকে নিঃস্ব করে দিচ্ছে। আমাদের কষ্টার্জিত টাকাগুলো শুষে নিয়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে। অবশ্যি এর পেছনেও একটা কারণ আছে। পাশ্চাত্যের ভোগবাদী সমাজকে টিকিয়ে রাখতে টাকার প্রয়োজন। টাকা নেই, তাদের ঘুমও নেই। টাকার জন্য তারা মরিয়া। টাকার জন্য তারা যেকোনো পথ বেছে নিতে রাজি। টাকার জন্য মানব বিধ্বংসী কাজেও অংশগ্রহণ করতে তাদের হাত কাঁপে না কভু। অর্থের পাহাড় গড়ে তোলার জন্য অশ্লীলতাকে প্রমোট করে যাচ্ছে এরাই। সম্পদ অন্বেষণ করতে গিয়ে উন্নত রাষ্ট্রগুলো আজ হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। ঔপনিবেশিক শাসনামলে তারা সরাসরি বিভিন্ন রাষ্ট্রকে শোষণ করতো। এখন নব্য ঔপনিবেশ যুগে তারা স্বদেশে বসেই আমাদের শোষণ করছে – পার্থক্য কেবল এতটুকুই।
ফারিসের করা প্রশ্ন শুনে আংকেল কিছুক্ষণ চুপ ছিলেন। এরপর বললেন, ‘আসলে এভাবে ভেবে দেখিনি, বাবা। তবে সব দেশই তো কমবেশি উন্নতির দিকে আগাচ্ছে। এভাবে হয়ত দরিদ্র দেশগুলো পর্যায়ক্রমে উন্নতির দিকে পৌঁছাবে।’
‘পৌঁছাবে হয়তো কোনোদিন। যেদিন আপনার তিন হাজার প্রজন্ম গত হবে!’
‘ব্যাপারটা বুঝলাম না, ফারিস!’
‘আমি বুঝিয়ে বলছি। জিম্বাবুয়ে একটি উন্নয়নশীল দেশ। যে গতিতে দেশটি উন্নতির দিকে আগাচ্ছে, এভাবে যদি আগাতে থাকে তাহলে একটি উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে উঠতে মিনিমাম ২৭২২ বছর লাগবে। সে পর্যন্ত আপনার তিনহাজার প্রজন্ম গত হবে না?’
ফারিসের কথা শুনে আমরা সবাই হেসে উঠলাম। হাসি থামিয়ে আংকেল বললেন, ‘বুঝতে পেরেছি, বাবা। বুঝতে পেরেছি। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কী হতে পারে বলে তুমি মনে কর?’
‘এর বিপরীতে আমাদের সামনে একটি সুন্দর ব্যবস্থা রয়েছে। যেখানে ব্যক্তিবিশেষের কিংবা রাষ্ট্রবিশেষের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়নি। মানুষকে ইচ্ছামতো অর্থনৈতিক কাঠামো দাঁড় করানোর ক্ষমতা প্রদান করা হয়নি। যেটি মানুষের বানানো নয়, বরং মানুষের স্রষ্টা আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে আগত। যার নাম ইসলাম।’
‘তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু পুঁজিবাদের সাথে এ ব্যবস্থার পার্থক্য কী, তা তো বললে না। তাহলে কীভাবে আমি তোমার কথা মেনে নিতে পারি?
‘বলছি আংকেল। আসলে পুঁজিবাদ আর ইসলাম একটি আরেকটির বিপরীত। একেবারে 180 ডিগ্রি এঙ্গেলে অবস্থিত। প্রথমত, ইসলাম তার অনুসারীদের বাহ্যিক দিকের চেয়ে আত্মিক পরিবর্তনের প্রতি অধিক গুরুত্বারোপ করে থাকে। যা পুঁজিবাদ করে না। আর মানুষ বাইরে যতই ভালো হোক না কেন, ভেতরটা ভালো না হলে তার দ্বারা মানবকল্যাণ করা সম্ভব নয়। তাই ইসলাম প্রথমেই তার অনুসারীদের আত্মিক পরিশুদ্ধির দিকে দৃষ্টি দেয়, যাতে সে নিজ থেকেই ভালো কর্মের দিকে উদ্ধুদ্ধ হয় – মন্দকে পরিত্যাগ করতে শেখে। দ্বিতীয়ত, ইসলাম উপার্জনের বৈধ অবৈধ পন্থা নির্ণয় করেছে। ইসলামে বৈধ অবৈধ পন্থা নির্ধারণ করা হয় ওয়াহীর দ্বারা। আর পুঁজিবাদে তা নির্ণিত হয় গুটিকয়েক ক্ষমতাবানদের দ্বারা। যার ফলে আইনের মধ্যে ঐ বিশেষ শ্রেণির ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে। ইসলামে এই ধরণের কোনো সুযোগ নেই। ইসলাম ঐসব ব্যবসাকে হারাম করেছে, যা মানবতার জন্য অকল্যাণকর। যেমন, নেশাদার সামগ্রী, পর্নোগ্রাফি, মদ, জুয়া, পতিতাবৃত্তি, অশ্লীল ও যৌন উত্তেজক সকল প্রকার দ্রব্যাদি ইত্যাদি। আপনি লক্ষ করলে দেখবেন পুঁজিবাদ এ সকল কর্মকে নিষেধ তো করেইনি, বরং ক্ষেত্রবিশেষে উৎসাহিত করেছে। সমাজের মধ্যে মাদক, অ্যালকোহল, পর্নোগ্রাফিকে সহজলভ্য করছে। পুঁজিবাদ চায় মানুষ এই আত্মবিধ্বংসী দ্রব্যগুলোর দিকে আকৃষ্ট হোক। এগুলোর ভোক্তায় পরিণত হোক। কেননা মানুষ যত এই নেশাদার দ্রব্যগুলোর দিকে আকৃষ্ট হবে, তাদের ব্যবসা ততবেশি জাঁকজমক হবে। পুঁজিবাদের এ সকল মানবতাবিরোধী ব্যবসাগুলোই অনেককে বিত্তশালী করে তুলছে।[১২] পতিতাবৃত্তি কি আজ বিশ্বব্যাপী সবচে’ লাভজন ব্যবসা নয়?’
‘তা অবশ্য ঠিক বলেছো। আজ তো এসব জিনিসকে সহজলভ্য করে আকর্ষণীয় করে যুব সমাজের সামনে উপস্থাপন করা হচ্ছে। পতিতাবৃত্তির লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে। বৃদ্ধ থেকে শুরু করে একেবারে টিন এইজের ছেলেরাও এই রোগে আসক্ত। সেদিন পত্রিকায় দেখলাম, টিন এইজের ছেলেরাই পতিতালয়ে নিয়মিত খদ্দের। ওকে, ক্যারি অন।’
‘তৃতীয়ত, ইসলাম অর্থ-সম্পদকে গচ্ছিত করে রাখাকে অবৈধ করেছে। আপনি যদি এমন টাকা গচ্ছিত রাখেন যা আপনার কোনো কাজেই লাগে না – বছর পূর্তি হলে ইসলাম সেই টাকার উপর যাকাত নির্ধারণ করবে। আর পুঁজিবাদ ব্যাংকে গচ্ছিত টাকা থেকে আপনাকে মাসে মাসে ইন্টারেস্ট দেবে। ফলে আপনার টাকা তো কমবেই না – দিন দিন বাড়তে থাকবে। যাকাত হচ্ছে ইসলামী অর্থব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যাকাত আদায় করার ফলে বিত্তশালীদের সম্পদের অংশ সাধারণ মানুষের মধ্যে বণ্টিত হবে। ফলে সম্পদ একটি শ্রেণির হাতেই কেবল কুক্ষিগত হয়ে রইবে না, বরং তা সমাজের প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে পড়বে।’
ফারিসের কথা একদম সত্যি। যাকাতভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সুফলটা আসলে মানুষকে বলে বুঝানো সম্ভব হবে না। খলীফা ওমার ইবনুল আব্দুল আযীয (রাহ.)-এর সময় যাকাত এমনভাবে বণ্টিত হয়েছিলো যে, বছর দুয়েকের মধ্যে যাকাত নেয়ার মতো কোনো লোক খুঁজে পাওয়া যায়নি। কোনো লোককে গরীব থাকতে হয়নি। অভাবী থাকতে হয়নি। না খেয়ে মরতে হয়নি। বরং যাকাতের টাকা পেয়ে বছর দুয়েকের মধ্যেই অনেকে যাকাত দেওয়ার মতো সক্ষমতা অর্জন করে ফেলেছিলো।
একটু কেশে নিয়ে এরপর ফারিস বললো, ‘ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সাথে পুঁজিবাদের চতুর্থ পার্থক্য হলো – ইসলাম অর্থব্যয়ের নির্দেশ দিয়েছে। বিভিন্ন মানবকল্যাণমূলক কাজে অংশীদার হতে উৎসাহিত করেছে। আর এখানেই পুঁজিবাদের সাথে মূল পার্থক্য। কেননা পুঁজিবাদ মনে করে দান করলে মূলধন থেকে তা কমে যায়। আর ইসলাম মনে করে দান করলে তা কমে না, বরং তা বেড়ে যায়। আর পুঁজিবাদের সাথে ইসলামের অর্থব্যয়ের পার্থক্য হলো, ইসলাম লৌকিকতামুক্ত দানকে গ্রহণ করে। আর পুঁজিবাদে দানের ক্ষেত্রে লৌকিকতাই মূখ্য ভুমিকা পালন করে। আপনি একটু লক্ষ করলেই দেখবেন, যারা বিভিন্ন সময়ে অসহায় মানুষের পাশে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় তারা তা পত্র-পত্রিকায় ফলাওভাবে প্রচার করতে থাকে। অপরদিকে ইসলাম এমন দানকে বেশি পছন্দ করে, যে দান লোকচক্ষুর আড়ালে সম্পাদিত হয়। পঞ্চমত, পুঁজিবাদ ঋণ দেয় – তবে সুদ ছাড়া নয়। সুদবিহীন ঋণদান কর্মসূচী পুঁজিবাদ কখনো কল্পনাও করে না। ফলে দেখা যায়, ঋণগ্রহীতা কখনোই ঋণদাতাকে আর্থিক দিক দিয়ে অতিক্রম করে যেতে পারে না। অনেক সময় সুদের টাকা পরিশোধ না করার অপরাধে পুঁজিবাদ ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে তার বাসস্থান, আসবাবপত্র ছিনিয়ে নেয়। তাকে দেউলিয়া করে দেয়। অপরদিকে ইসলাম সুদকে চিরতরে হারাম করেছে। তবে ঋণদানকে উৎসাহিত করেছে। ইসলাম ঋণ দেয় – তবে সুদবিহীন। কেননা সুদ ইসলাম কখনো কল্পনাও করতে পারে না। পাশাপাশি ইসলাম ঋণগ্রহীতাকে তাকাদা দিতে অনুৎসাহিত করেছে। এমনকি ঋণগ্রহীতা ঋণ পরিশোধে অক্ষম হলে তাকে ক্ষমা করে দিতে উৎসাহিত করেছে – যা পুঁজিবাদে অকল্পনীয়। পুঁজিবাদের মাধ্যমে একটা সময় অর্থনৈতিক মন্দাভাব দেখা দেবে। ফলে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।’[১৩]
‘সেটা কীভাবে?’
‘ধন সঞ্চয় করে সুদী ব্যবস্থায় নিয়োগ করার ফলাফল হলো, সম্পদ কিছুসংখ্যক মানুষের হাতে কুক্ষিগত হয়ে যাবে। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা দিন দিন কমে যাবে। ফলে কৃষি, শিল্প, ব্যবসায় মন্দাভাব দেখা দেবে। অবশেষে এমন অবস্থায় পৌঁছাবে যে, পুঁজিপতিরা তাদের টাকা বিনিয়োগ করার রাস্তা খুঁজে পাবে না।’
‘অহহ আচ্ছা। এখন বুঝতে পেরেছি। এর বিপরীতে ইসলাম কী ব্যবস্থা নিয়েছে?’
‘ইসলামে যাকাত, দান, সদকাহ এর মাধ্যমে সম্পদকে কিছু শ্রেণির মানুষের কাছে পুঞ্জিভূত হতে না দিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে একদিকে বিত্তবানদের বিনিয়োগের ক্ষেত্র তৈরি হবে। অপরদিকে সমাজের সাধারণ মানুষের উপকার হবে। কেননা সমাজের যাকাত, দান, সাদাকাহ এর অর্থ ইসলামিক রাষ্ট্রের বায়তুল মালে জমা হবে। এই বায়তুল মাল-ই মুসলিমদের কো-অপারেটিভ সোসাইটি, ইনশিওরেন্স কোম্পানি এবং প্রভিডেন্ট ফান্ড। এখান থেকেই বেকার মুসলিমদের সহায়তা করা হয়। এতিম, বিধবা, প্রতিবন্ধী, রুগ্ন ও অসহায়রা এখান থেকেই সহযোগিতা পায়। সবচে’ বড় কথা হলো, এ ব্যবস্থা মুসলমানদেরকে ভবিষ্যৎ অন্ন সংস্থানের চিন্তা থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত করে। পাশাপাশি ইসলাম রাষ্ট্র পরিচালনা, সিভিল সার্ভিস, সেনাবাহিনী ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যয় সংকোচন করেছে। আর রাষ্ট্রের অর্থের বেশিরভাগ মানবতার কল্যাণে ব্যয় করতে উৎসাহিত করেছে। পুঁজিবাদে রাষ্ট্রীয় কাজেই সম্পদের সিংহভাগ ব্যয়িত হয়, যা ইসলাম করে না।’[১৪]
ফারিস আর আংকেলের কথোপকথন আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছিলো। চা পান করা ও এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার ছিলো না। তবে ফারিসের কথা শুনে বেশ ঈর্ষা হচ্ছিলো। ছেলেটার মাথায় যে কত ধরণের জ্ঞান আছে – তা একমাত্র আল্লাহ-ই জানেন। ফারিসের চোখে চোখ পড়তেই আমাকে বললো, ‘কথাগুলো কি বেশি জটিল হয়ে যাচ্ছে?’
‘হুঁ। আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। মারুফ, তোর মাথায় ঢুকছে?’
‘না বাবা। আমি ফারিসের মতো অত পড়ুয়া ছেলে নই যে, সাইন্সের ছাত্র হয়েও অর্থনীতি সম্পর্কে জানবো। নিজের পড়াই শেষ করতে হিমশিম খাই – বাইরের পড়া কখন পড়বো?’ মারুফ জবাব দিলো।
আমাদের কথা শুনে ফারিস মুচকি হেসে বললো, ‘একটা সহজ উদাহরণ দিচ্ছি, খেয়াল কর। পুঁজিবাদের দাবি হচ্ছে – অর্থ সঞ্চয় করতে হবে এবং অর্থের পরিমাণ বাড়ানোর জন্য সুদ নিতে হবে। ফলে সুদের নালা দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে আশেপাশের লোকদের সবার টাকা পয়সা এ পুকুরে এসে পড়বে। অপরদিকে, ইসলাম নির্দেশ দেয় – টাকা পয়সা জমা করে রাখা যাবে না। আর যদি কখনো জমা হয়ে যায়, তাহলে এ পুকুর থেকে নালা কেটে দিতে হবে। যাতে আশেপাশের শুকিয়ে যাওয়া ক্ষেতগুলোতে পানি পৌঁছে যায় এবং সমস্ত জমি তরতাজা হয়ে সবুজে শ্যামলে ভরে উঠে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ধন আবদ্ধ ও জমাটবদ্ধ হয়ে থাকে – কিন্তু ইসলামে তা মুক্ত। স্বাধীন। অবাধ গতিশীল। পুঁজিবাদের পুকুর থেকে পানি নিতে হলে গ্রহীতার কাছে অবশ্যই কিছু পানি থাকতে হবে। নয়তো এক ফোঁটা পানিও তাকে দেওয়া হবে না। কিন্তু ইসলামী ব্যবস্থায় পুকুরের নিয়ম হচ্ছে – যার নিকট প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি থাকবে, সে তার বাড়তি পানি ঐ পুকুরে ঢেলে দিয়ে যাবে। আর যার যার পানির প্রয়োজন হবে, সে ওখান থেকে পানি নিয়ে যাবে।[১৫] কী? এবার মাথায় কিছু ঢুকেছে?’
‘হুঁ। এবার কিছুটা বুঝেছি।’
ফারিস হয়ত আরও কিছু বলতো। কিন্তু আংকেল ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো, ‘সবই বুঝলাম। কিন্তু আমার উত্তরটা তো পেলাম না।’
‘মাফ করবেন, আংকেল। আপনার উত্তর দেওয়ার জন্যেই কথাগুলো বললাম।’
‘মানে?’
‘মানে হলো, আপনার সামনে দুটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পার্থক্য আমি কিছুটা তুলে ধরার চেষ্টা করলাম। এখন আপনি বলুন তো, এ দুটির কোনটি বেশি মানবকল্যাণমূলক?’
‘মনে হচ্ছে ইসলামিক ইকোনোমিক সিস্টেমটাই বেটার।’
‘আংকেল, এটা তো কেবল ইসলামের একটি আইনের সৌন্দর্য আপনি দেখলেন। আসলে ইসলামের প্রত্যেকটি আইনই এমন সুন্দর। আর ইসলামের আইনগুলো কোনো মানুষ তৈরি করেনি। সর্বশক্তিমান স্রষ্টা এগুলো তৈরি করেছেন। তাই এখানে কিছু মুষ্টিমেয় লোকের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে কোনো আইন তৈরি করা হয়নি। ইসলামের সকল আইন তৈরি করা হয়েছে সকলের কল্যাণের জন্যে। প্রত্যেকটি আইনের মধ্যেই নিহিত রয়েছে মানবতার কল্যাণ। এই ভণ্ডামিপূর্ণ সিস্টেমের বিপরীতে ইসলাম যদি তার সুন্দর ‘ল’ গুলোকে এস্ট্যাবলিশ করতে নির্দেশ দেয়, এর জন্য কি ইসলামকে আপনি সন্ত্রাসী ধর্ম বলবেন?’
আংকেল এবারো কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন। এরপর বললেন, ‘তা না হয় বুঝলাম। তবে তার জন্য যুদ্ধের আদেশটা কেন?’
‘মারুফের কাছে শুনেছি আপনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। সত্যিই?’
‘এনি ডাউট?’
‘না, আংকেল। ডাউট থাকবে কেন? শুধু জানার জন্যই জিজ্ঞাসা করা। আচ্ছা আংকেল, আপনি পাকিস্তানীদের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন কেন?’
‘পশ্চিম পাকিস্তানীদের অন্যায় অবিচারের কালো হাতকে ভেঙে দিতে। অন্যায়ের শিকল থেকে নিজের মাতৃভূমিকে মুক্ত করতে।’
‘তাই বলে যুদ্ধ?’
‘আমরা তো প্রথমে যুদ্ধে যেতে চাইনি। আমরা শান্তিপূর্ণ উপায়ে এর সমাধান চেয়েছি। অনেক আন্দোলন করেছি, কিন্তু লাভ হয়নি। পাকিস্তানি শাসকেরা সব সময়-ই আমাদেরকে দমিয়ে রাখতে চেয়েছে। এভাবে যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, তখন অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছি।’
‘ইসলামও যদি একই কাজ করে, তাহলে আপনার অসুবিধা কোথায়?’
‘মানে?’
‘ইসলামও প্রথমে সমাজ বিপ্লবের কথা শিখিয়েছে। শান্তিপূর্ণ উপায়ে মানুষকে সত্যের পথে আহ্বান করতে শিখিয়েছে। আর যেসব কারণে ইসলাম যুদ্ধের অনুমতি দিয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো, অশুভ শক্তির অন্যায় অবিচারের কালো হাতকে ভেঙে দিয়ে মানবতাকে মুক্তি দিতে। শোষণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে মানুষকে উদ্ধার করতে। মানুষকে মানুষের দাসত্ব থেকে স্বাধীন করে দিতে। মানুষ যাতে স্রষ্টার আসনে বসে মানুষের উপর কর্তৃত্ব করতে না পারে, সেজন্যেই ইসলাম প্রয়োজন অনুযায়ী যুদ্ধের অনুমতি প্রদান করেছে।’
ফারিস যে কথার পিঠে কথা কীভাবে বের করে – তা বুঝা মুশকিল। নয়তো ইসলামী সমাজ বিপ্লব যে রক্তপাত ছাড়াও সম্ভব, সে কথা আমি ভুলেই বসেছিলাম। হঠাৎ মনে হলো, রাসূলের (ﷺ) মাদানী জীবনের কথা। মদীনার ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো সমাজবিল্পবের দ্বারা। কোনো রক্তপাত কিংবা যুদ্ধ ছাড়াই রাসূল (ﷺ) মদীনার প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। ইসলামের আইনগুলোকে সে সমাজে বাস্তবায়ন করেছিলেন।
ফারিসের আলোচনা শুনে আংকেল সন্তুষ্ট হয়েছেন বলেই মনে হলো। হঠাৎ আংকেলের ফোনে কল আসলো। কোনো এক জরুরী মিটিং আছে, তাই এখনি উঠতে হবে। চলে যাওয়ার সময় আংকেল বললেন, ‘বেশ ভালো লাগলো তোমার সাথে কথা বলে। তোমার কথাগুলো বেশ যৌক্তিক ও প্রাণবন্ত। ঠিক আছে, তোমরা গল্প কর। আমি উঠি। আমাকে একটা মিটিং-এ এটেন্ড করতে হবে। থ্যাংস, মাই সান। থ্যাংস আ লট।’
আংকেল চলে যাওয়ার পর মারুফ ফারিসকে বললো, ‘তুই পারিসও! আব্বুকে আজ পর্যন্ত আমি কিছু বুঝাতে পারিনি। তুই একেবারে সোজা করে ছেড়ে দিলি!’
ফারিস বললো, ‘থাক থাক। আর পাম দিতে হবে না। আজ বিদায় দে। অনেক সময় বেলা গেছে। এখন ফিরতে হবে।’
আমরা বেরিয়ে যাবো, এই মুহূর্তে আমি মারুফকে বললাম, ‘আচ্ছা মারুফ, এই বাসাটা কি পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া? মানে তোদের পূর্বপুরুষ কি কেউ জমিদার ছিলো?’
আমার কথা শুনে মারুফ তো হাসতে হাসতে একেবারে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে। হাসি থামিয়ে আমাকে বললো, ‘কেন? তোর কেন এমনটা মনে হলো কেন?’
‘না মানে, এত বড় প্রকাণ্ড জমিদার বাড়ি তো। তাই জিজ্ঞেস করলাম আর কি।’
‘না রে, ভাই। জমিদার টমিদার কিছু না। বাবার পছন্দেই এই বাড়িটি কেনা হয়েছে। উনি একটু শৌখিন মানুষ তো, তাই।’
সত্যিই ফারিসের কথাই ঠিক হলো। এবারও ওর কাছে হেরে গেলাম। আগ্রহভরে আমি ফারিসকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আচ্ছা বন্ধু! তুই কীভাবে বিষয়টা আন্দাজ করলি?’
‘কীভাবে আবার? খুবই সহজ। ঐ যে দেখ, বাড়ির পূর্ব কোণে একটি তুলসি-বেদি। তুলসি গাছ নেই, কিন্তু বেদিটা আছে। আবার পশ্চিমকোণে পূজোর ঘরের ধ্বংসাবশেষ এখনো টিকে আছে। আর মারুফদের পূর্বপুরুষ কেউ অমুসলিম ছিলো না, যেটা আংকেল নিজ মুখেই বললেন। তাই বাড়িটি যে মারুফদের পূর্বপুরুষদের কেউ নির্মাণ করেনি, তা সহজেই বুঝা যায়।’
[১] Wikipedia, Article: Distribution of wealth,
https://en.wikipedia.org/wiki/Distribution_of_wealth?oldid=780446889
[২] Bruenig, Matt (March 24, 2014). “You call this a meritocracy? How rich inheritance is poisoning the American economy”. Salon. Retrieved August 24, 2014.
[৩] https://www.google.com/amp/s/amp.theguardian.com/money/2015/oct/13/half-world-wealth-in-hands-population-inequality-report?espv=1
[৪]
Wikipedia, Article: International inequality,
https://en.wikipedia.org/wiki/International_inequality?oldid=781262244
[৫] https://www.oxfam.org/en/pressroom/pressreleases/2017-01-16/just-8-men-own-same-wealth-half-world
https://www.google.com/amp/s/amp.theguardian.com/money/2015/oct/13/half-world-wealth-in-hands-population-inequality-report?espv=1
[৬] http://www.jugantor.com/old/window/2015/10/31/345315
[৭]
Wikipedia, Article: List of countries by distribution of wealth,
https://en.wikipedia.org/wiki/List_of_countries_by_distribution_of_wealth?oldid=777844352
[৮]
Wikipedia, Article: International inequality,
https://en.wikipedia.org/wiki/International_inequality?oldid=781262244
[৯] Wikipedia, Article: International inequality
[১০] http://www.bdnews24us.com/bangla/article/585805/index.html#sthash.knTqQDtw.dpuf
[১১] https://www.youtube.com/watch?v=1BEpVjG-rCYhttps://www.youtube.com/watch?v=UbGt69BqHUc
[১২] ইসলামী অর্থনীতি, সম্পাদক: অধ্যাপক শরীফ হোসাইন; (শতাব্দী প্রকাশনী, চতুর্থ মুদ্রণ, ফেব্রুয়ারি, ২০০৯)
[১৩] ইসলামী অর্থনীতি, সম্পাদক: অধ্যাপক শরীফ হোসাইন; (শতাব্দী প্রকাশনী, চতুর্থ মুদ্রণ, ফেব্রুয়ারি, ২০০৯)
[১৪]
ইসলামী অর্থনীতি, সম্পাদক: অধ্যাপক শরীফ হোসাইন; (শতাব্দী প্রকাশনী, চতুর্থ মুদ্রণ, ফেব্রুয়ারি, ২০০৯)।
শাহ মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান, ইসলামী অর্থনীতি নির্বাচিত প্রবন্ধ; (দি রাজশাহী স্টুডেন্ট’স ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন, চতুর্থ সংস্করণ, এপ্রিল, ২০১৫)
[১৫] ইসলামী অর্থনীতি, সম্পাদক: অধ্যাপক শরীফ হোসাইন; (শতাব্দী প্রকাশনী, চতুর্থ মুদ্রণ, ফেব্রুয়ারি, ২০০৯)
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।