ছোটবেলায় যখন কেউ জিজ্ঞেস করতো, “বড় হয়ে তুমি কী হতে চাও?” আমি বলতাম “একজন সুখী মানুষ।” এইটুকুই…সত্যি সত্যি আমি এটাই চাইতাম। আসলে তার মানে যা-ই হোক না কেন। সুখী হতে যে পথেই হাঁটতে হোক না কেন আমি রাজি ছিলাম, প্রস্তুত ছিলাম।
আমার সমাজ আমাকে বুঝিয়েছে, জীবনের সর্বোচ্চ সাধনা হচ্ছে সুখ নামক সোনার হরিণের দেখা পাওয়া। আর তোমার মনে যদি কোন দুঃখ বা অশান্তি থাকে, তার মানে হলো তুমি তোমার জীবনের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে ব্যর্থ হয়েছ। এরকম জীবনযাত্রা আসলে জীবনের প্রতি তীব্র একটা পরিহাস ছুঁড়ে দেয়, জীবনকে করে তোলে আরো বেশি অসুখী, তৈরি করে অপূর্ণতার অনুভূতি আর নিরাপত্তাহীনতা, যেটা বেশিরভাগ সময় ঠেলে ফেলে দেয় হতাশার নর্দমায়।
সুখের সাধনায় মগ্ন মানুষগুলোকে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিয়ে আমাদের সমাজ বলে যে, বিনোদন, খাওয়া দাওয়া আর সব চরম আত্ম-উপভোগ মূলক কাজই (যেসব আসলে আমাদের জন্য মোটেও সুখকর নয়) আমাদের জন্য সুখ বয়ে আনবে! কিন্তু আসলে এই ধরণের সুখ সন্ধান আমাদেরকে শূন্য আর অসুস্থ করে দেয়।
সর্বসাধারণের ধারণা পার্থিব ভোগবিলাসই সুখী জীবনের নিয়ামক। কিন্তু মনোবিজ্ঞানীরা এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা বলেন। তাঁদের ভাষায়- যেসব লোক পরলৌকিকতা আর বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে বাঁচে, তারাই হালকা চালে জীবন কাটিয়ে দেওয়া লোকদের চেয়ে বেশি সুখী।
যেসব লোক তাদের বিশ্বাসে দৃঢ় এবং যাদের জীবন আবর্তিত হয় পরকালকে ঘিরে, তাদেরকে প্রচণ্ড সুখী মানুষ বলা হয়ে থাকে। একটা দীর্ঘজীবন তারা বেঁচে থাকে। হতাশা আর আত্মহত্যার ঝুঁকিও কম থাকে তাদের। তারা বেশি সহনশীল আর মানিয়ে চলতে সক্ষম। সম্পর্কগুলোর ক্ষেত্রে তারা অনেক বেশি বিশ্বস্ত। তাদের বাচ্চাকাচ্চারা থাকে উৎফুল্ল। সর্বোপরি তারা পারিবারিক জীবন নিয়ে তুষ্ট থাকে।
বিশ্বাস আর আধ্যাত্মিকতা সুখের ক্ষেত্রে অনেকভাবেই প্রভাব ফেলতে পারে, যেগুলোকে মাঝে মাঝে স্ববিরোধীও মনে হতে পারে।
অন্যকে প্রাধান্য দেওয়া
আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি কোন মুসলিমের পার্থিব কষ্টসমূহের একটি কষ্ট দূর করে দেয়, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার একটি বড় কষ্ট দূর করে দিবেন। যে ব্যক্তি কোন অভাবীর অভাবের কষ্ট লাঘব করে দেয়, আল্লাহ দুনিয়া ও আখিরাতে তার অভাবের কষ্ট লাঘব করবেন। যে ব্যক্তি কোন মুসলিমের দোষ গোপন রাখে, আল্লাহ দুনিয়া ও আখিরাতে তার দোষ গোপন রাখবেন। বান্দা যতক্ষণ তার মুসলিম ভাইয়ের সাহায্য করতে থাকে আল্লাহও ততক্ষণ তার সাহায্য করতে থাকেন।” (মুসলিম, তিরমিযী-১৮৮০ : হাসান )
মুসলিম হিসেবে আমরা জানি যে, আমরা যদি নিজেদের ভালো চাই, তাহলে প্রথমেই অন্যের ভালো করার চিন্তা করতে হবে। অন্যকে সাহায্য করার মাধ্যমে এবং আমাদের চেয়ে কম সৌভাগ্যবানদের কাছে আত্মিকভাবে পৌঁছে একটা উত্তম আর স্থিতিশীল সমাজ গড়ার মাধ্যমে অবর্ণনীয় আনন্দ পাওয়া যায়। আমাদের আসলেই কতটা আছে তা আমরা অনুভব করতে পারি দানের মাধ্যমে, যেটা অপরিসীম পূর্ণতায় উদ্বেলিত করে।
গ্রহণের চেয়ে প্রদান ভালো সবক্ষেত্রেই। ইউনিভার্সিটি অফ রচেস্টারের একজন মনোবিজ্ঞানী রিচার্ড রায়ান বলেন, “বেশিরভাগ সময় আমরা ভাবি, নিজের পাওয়ার মাধ্যমেই আসে সুখ। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে এর বিপরীতটাই ঠিক। অন্যকে দেওয়ার মধ্যেই বেশি সুখ। সবসময় এর উল্টোটাই প্রচার করা হয় এমন এক সমাজের জন্য এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
“শপথ প্রাণের এবং যিনি তা সুবিন্যস্ত করেছেন, তাঁর। অতঃপর তাকে তার অসৎকর্ম ও সৎকর্মের জ্ঞান দান করেছেন। যে নিজেকে শুদ্ধকরে, সে-ই সফলকাম হয়।” [সুরা আশ-শামস (৯১): ৭-৯]
আমাদেরকে সবসময় নিজের খেয়ালখুশির বিরুদ্ধে চলতে শেখানো হয়, যেহেতু আমরা মুসলিম। অলসতা ঝেড়ে ফেলে উঠে পড়া। তারপর সালাত পড়া, ক্ষুৎপিপাসার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা, উদ্বেগ-উৎকন্ঠার সময়ে ধৈর্য ধরা, এরকম আরো অনেক কিছু। নিজের কামনা-বাসনার বিরুদ্ধে এই যুদ্ধই আমাদেরকে সালাতের পরে আরো বেশি একাগ্র করে, সিয়াম পালনের পরে অনেক বেশি শান্তি লাগে, ধৈর্য ধরার পরে আসে অনাবিল এক সন্তুষ্টির অনুভুতি।
মনে হতে পারে, যে সংগ্রাম প্রচণ্ড স্ট্রেসের কারণ হয় সেটা কি ক্ষতিকর না? সবসময় না আসলে। এনবিসি নিউজে এসেছে, “গবেষকরা স্ট্রেসের ভাল দিকগুলো নিরীক্ষা করছেন। তাঁদের মধ্যে একদল বিশ্বাস করেন, স্বল্পমেয়াদে স্ট্রেস বাড়ালে এটা আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে আরো শক্তিশালী করতে পারে এবং মস্তিষ্কের কোষগুলোকে সর্বোচ্চ সক্ষম রেখে বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগ, যেমন আলঝেইমার থেকে রক্ষা করতে পারে।”
কৃতজ্ঞ হওয়া
“যখন তোমাদের পালনকর্তা ঘোষণা করলেন যে, যদি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করো, তবে তোমাদেরকে আরও দেবো। আর যদি অকৃতজ্ঞ হও, তবেনিশ্চয়ই আমার শাস্তি হবে কঠোর।” [সুরা ইব্রাহীম (১৪): ৭]
ইসলাম শেখায় কৃতজ্ঞ হতে। বুঝতে শেখায় যে, এখন আমাদের যা আছে তা নিয়ে যদি সুখী হতে না পারি তাহলে এর চেয়ে বেশি থাকলেও কখনো সুখী হতে পারবো না। আমাদের যতটুকু আছে ততটুকু নিয়েই যদি সন্তুষ্টির সেই স্তরে পৌঁছাতে পারি, তাহলে আমরা সত্যিই পূর্ণতার বোধে আবিষ্ট হতে পারবো খুব সহজেই।
হাফিংটন পোস্ট অনুসারে, “রবার্ট এ.ইমন্স, (পিএইচডি) ইউসিডেভিসে সন্তুষ্টির উপরে সম্প্রতি একটি গবেষণা পরিচালনা করেছেন। সেখানে প্রমাণিত হয়েছে, যেসব ব্যক্তি সন্তুষ্টির চর্চা করে, তাদের শারীরিক, মানসিক এবং পারস্পরিক সম্পর্কের সুস্থতার উপর এর অপরিসীম প্রভাব রয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে তিনি লিখেছেন, প্রচলিত ধারণা হচ্ছে প্রত্যেক মানুষেরই সুখী হওয়ার একটা নির্দিষ্ট ‘সেট পয়েন্ট’ আছে এবং সেটাকে ‘রিসেট’ করার কোনো মাধ্যমই আমাদের জানা নেই। কিন্তু পরিতৃপ্তি বা সন্তুষ্টির ব্যাপারে যেসব গবেষণা আছে সেগুলো এই ধারণার বিপরীতে যায়।”
সুখ
সুখের খোঁজে আত্মমগ্ন থেকে যৌবন পার করলাম, কিন্তু পেলাম শুধু গহীন শূণ্যতা…তারপর আমি ইসলামে প্রবেশ করলাম। আমার এই বিশ্বাসের কারণে নিজেকে দেওয়ার চেয়ে অন্যকে দেওয়ার প্রতি বেশি জোর দিলাম। বেশি বেশি চাওয়ার চেয়ে নিজের যা আছে তাই নিয়ে আরেকটু বেশি কৃতজ্ঞ হলাম। নিজেকে আনন্দিত করার চেয়ে স্রষ্টার সন্তুষ্টিকেই বেশি গুরুত্ব দিলাম।
আমার এই মনোভাবের পরিবর্তনের অবিস্মরণীয় এবং ব্যাপক প্রভাব রয়েছে আমার জীবনে, আমার দৃষ্টিভঙ্গিতে আর আমার সুখের পরিসরে।
অবশেষে আমি আমার সুখী হওয়ার গন্তব্যে পৌঁছলাম, ইসলামের মাধ্যমে…যে পথের কথা আমি কখনও কল্পনাও করিনি!
উৎস: Psychology of Happiness (মূল আর্টিকেল লিংক)
অনুবাদক: উম্মে আফরাহ, মুসলিম মিডিয়া প্রতিনিধি
অনুবাদ কপিরাইট © মুসলিম মিডিয়া
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।