পৃথিবীর সবচেয়ে বিরোধপূর্ণ এলাকার নাম বলতে গেলে যে ভূমিটির নাম সবার আগে বলতে হবে, তা হলো জেরুজালেমের মসজিদ আল-আক্বসা। হাজার বছর ধরে এই ভূমি দখল করার জন্যে মানুষ হন্যে হয়ে আছে বললেও অত্যুক্তি হবে না।

এটি মুসলিমদের অন্তরে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। ইসলামের সর্বাধিক পবিত্র স্থানগুলোর মাঝে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে মসজিদ আল-আক্বসা। এটাই সেই স্থান যেখান থেকে ইসরা ও মিরাজের সময় নবীজি (সাঃ) ঊর্ধাকাশে ভ্রমণ করেছিলেন। মানব সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে অসাধারণ মিলনায়তনটির অবতারণা হয়েছিল এই স্থানটিতেই। সব নবী-রাসূল রাসূল মুহাম্মাদ (সাঃ) এর পেছনে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করার জন্যে একত্রিত হয়েছিলেন এখানেই।

এরপরও মসজিদ আল-আক্বসা সম্পর্কিত এমন কিছু তথ্য আপনাদের সামনে উপস্থাপন করছি যেগুলো হয়তো আপনি পূর্বে অবগত ছিলেন না।

 এটা কেবল একটি মসজিদ নয়

 জি হ্যাঁ –এখানে বেশকিছু মসজিদ রয়েছে, যেগুলোকে আমরা মসজিদ আল-আক্বসা হিসেবে জানি। একদম দক্ষিণ দিকের দালানটিকে আমরা মসজিদ আল-আক্বসা মনে করি। প্রকৃতপক্ষে সেটা হচ্ছে কিবলি মসজিদ। কিবলার নিকটবর্তী হওয়ায় মসজিদটির এমন নামকরণ করা হয়েছে। গোটা পর্বতটিই মূলত মসজিদ আল-আক্বসা। বিভ্রান্তি দূর করার জন্যে একে মাঝেমাঝে হারাম আল-শরীফ বলেও অবহিত করা হয়। তবে সেখানে আরও অনেক মসজিদ রয়েছে এবং সেগুলোও ঐতিহাসিক ঘটনাবলির সাথে সম্পৃক্ত। এর মাঝে উল্লেখযোগ্য হলো বুরাক্ব মসজিদ, মারওয়ানি মসজিদ ইত্যাদি।

মসজিদটি একটি কবরস্থান

স্থানটিতে কয়জন নবীকে এবং নবী (সাঃ) এর সাহাবি্কে সমাহিত করা হয়েছে তাঁর নির্দিষ্ট কোনো হিসেব নেই। তবে অনেকগুলো কবর রয়েছে সেখানে। সুলাইমান (আঃ) কে খুব সম্ভবত এখানেই সমাহিত করা হয়েছিল। কেননা নবীগণ যেখানে মৃত্যুবরণ করেন সেখানেই তাদের কবর দেয়ার বিধান। আর সুলাইমান (আঃ) ঐতিহ্যবাহী কিছু ইমারত নির্মাণ তদারকি করার সময় ওই স্থানেই মৃত্যুবরণ করেন।

এটি ছিল একটি আবর্জনার স্তুপ

একটা সময় ছিল যখন ইহুদিদের এই ভূমিতে বাস করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল। সে সময় রোমান আদিবাসীরা এখানে বাস করত এবং তারা মসজিদ এলাকাকে আবর্জনার স্তুপ হিসেবে ব্যবহার করত। উমার (রাঃ) এই নগরী জয় করে এর সমস্ত জঞ্জাল নিজ হাতে পরিস্কার করেন। শুধু তা-ই নয় তিনি ইহুদিদের কয়েকশ’ বছর ধরে চলা নির্বাসনের অবসান করেন। কাছের এক শহরের সত্তর শরণার্থী ইহুদি পরিবারকে জেরুজালেমে নিয়ে আসেন। আমাদের জ্ঞাতিভাইয়েরা (আহলে কিতাব) এই অসামান্য উপকারের কথা এখন স্মরণে রেখেছে বলে মনে হয় না।

আল গাজ্জালির আবাসস্থল এবং তাঁর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্মের জন্মস্থল

ইসলামি সাহিত্যের বিখ্যাত রচনাগুলোর মধ্যে একটি হলো প্রখ্যাত আলেম আবু হামিদ আল-গাজ্জালি রচিত ‘ইহইয়া উলুম আদ-দিন’। তিনি এমন একজন ব্যক্তিত্ব যাকে সকল মাযহাবের মানুষ সমানভাবে শ্রদ্ধা করেন। কারণ তিনি কুর’আন ও হাদিসের ওপর পূর্ণ আস্থা রেখে অনায়াসে ডুব দিতে পারতেন মানবাত্মার অতল গহ্বরে। আল-গাজ্জালি সম্পর্কে যে তথ্যটি বেশিরভাগ মানুষের অজানা তা হলো, তিনি মসজিদ আল-আক্বসায় বাস করতেন এবং তাঁর বিখ্যাত বইটি তিনি এখানে বাসরত অবস্থায় লিখেছিলেন। মসজিদ ভবনের এক অংশে তাঁর পুরোনো রুমটি চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে।

 মসজিদটিকে ব্যবহার করা হয়েছিল আস্তাবল, প্রাসাদ ও ফাঁসির কুঠুরি হিসেবে

প্রথম ক্রুসেডররা যখন জেরুজালেম দখল করে নিল তখন তারা মসজিদ আল-আক্বসার ভেতরে অধিকাংশ মুসলিমকে আটক অবস্থায় পেল। প্রায় ৭০,০০০ বন্দিকে তারা জবাই করেছিল। এরপর কিবলি মসজিদকে পরিণত করলো প্রাসাদে, পাথরের গম্বুজটিকে ভোজনাগারে আর ভূগর্ভস্থ কুঠুরিকে আস্তাবলে। প্রাথমিক গণহত্যা থেকে যে মুসলিমরা বেঁচে গিয়েছিল তাদেরকে পরবর্তীতে মসজিদের কেন্দ্রে এনে বিরাট এক ক্রুশে বিদ্ধ করে হত্যা করা হয়েছিল। শুধু এই ক্রুশটি সালাহ-উদ্দিন এসে ভেঙেছিলেন। ক্রুশের ভিতটি এখনো সেখানে রয়ে গেছে।

 এর ছিল এক পৌরাণিক মিম্বার

ইসলামের ইতিহাসের এক বীরযোদ্ধা ছিলেন নূরউদ্দিন জেঙ্গি। তিনি ছিলেন প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী। তিনি কেবল জেরুজালেমকে পুনরায় ক্রুসেডরদের হাত থেকে মুক্ত করার স্বপ্নই দেখেননি বরং তা উদ্ধারের পর মসজিদ আল-আকসাতে স্থাপন করার জন্যে বিশেষ একটি মিম্বারও তৈরি করে রেখেছিলেন। মিম্বারটি দেখতেও যেমন অনিন্দ্য সুন্দর ছিল তেমনি তাঁর ছিল কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্য। যেমন এটি তৈরিতে কোনো পেরেক এমনকি সামান্য আঠাও ব্যবহার করা হয় নি। দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে এই জয় নূরউদ্দিন দেখে যেতে পারেননি। তবে তাঁর সুযোগ্য শিষ্য সালাহ-উদ্দিন তাঁর গুরুর স্বপ্ন পূরণ করেছিলেন। ইসলামের ইতিহাসে দ্বিতীয়বারের মতো জেরুজালেমকে স্বাধীন করে নেয়ার পর মিম্বারটি মসজিদে স্থাপন করা হয়। কারুশিল্পীদের জন্যে এখনও এই কাজটি একটি কিংবদন্তী হয়ে আছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, মিম্বারটি টিকে থাকতে পারে নি।

পাথরের গম্বুজটি দেখতে ছিল একেবারে আলাদা

ইসলামের ইতিহাসে নির্মিত প্রথম গম্বুজ ছিল এটি। নির্মাণ করেছিলেন উম্যাইয়া খলিফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ান। শুরুতে গম্বুজটি ছিল কাঠের তৈরি যার ওপর ছিল পিতল, সীসা অথবা চীনামাটির আবরণ। প্রায় এক হাজার বছর পর অটোমান সাম্রাজ্যের মহান খলিফা সুলাইমানের শাসনামলে গম্বুজটিতে স্বাতন্ত্রসূচক সোনার প্রলেপ দেয়া হয়। আর ভবনের সদর দরজায় টাইলস করা হয়।

একে ভস্মীভূত করে দেয়া হচ্ছে

মসজিদ আল আক্বসাকে অবমাননা করা হলে কী হবে তা কখনো ভেবে দেখেছেন? পাথরের গম্বুজের ওপর যখন দখলদারী সেনাদের পতাকা উড়বে বা মসজিদটি যখন জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাবে তখন কী হবে ভেবেছেন? মুসলিম বিশ্ব কি কখনো তা হতে দিতে পারে?

ভেবে দেখুন।


উৎস: Muslimmatters.org (মূল আর্টিকেল লিন্ক)

অনুবাদক: শারিকা হাসান

অনুবাদ কপিরাইট © মুসলিম মিডিয়া

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive