লোক মুখে শোনা যায় বাঙালিরা খুব আড্ডাপ্রিয় জাতি। অর্থাৎ আমরা স্বভাবগতভাবেই আড্ডা দিতে পছন্দ করি। তাই এই প্রিয় জিনিসটার অপ্রিয় কিছু বিষয় তুলে ধরতেই এই লেখা, ইনশা আল্লাহ্।

আমরা সামাজিকতার নিয়মেই বিভিন্ন প্রয়োজনে একসাথে হয়ে থাকি। আর এই একত্রিত হওয়াটা মন্দ কিছু না। তবে যখন এই সামাজিকতার মাঝে অসামাজিকতার সংমিশ্রণ ঘটে যায়, তখনই ইসলাম আপত্তি করে। আর এটাই ইসলামের ফিতরাত, সে কখনো অসামাজিকতা কিংবা মন্দ কিছুকে অনুমতি দেয় না। ইসলাম চায় আমাদের প্রতিটা মুহূর্তই যেন আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্যের দিকে পরিচালিত হয়। অর্থাৎ আমাদের সৃষ্টির উদ্দেশ্য যেন সফল হয়। যেমনটি আল্লাহ্ তা’আলা বলেন-

IIRT Arabic Intensive

আমার ইবাদাত করার জন্যই আমি মানব ও জিন জাতি সৃষ্টি করেছি। [সূরাহ আয-যারিয়াত (৫১): ৫৬]

আড্ডা বলতে সাধারণত আমরা বুঝি যেখানে কয়েকজন সমবয়সী কিংবা সমমনা মিলে স্বাধীনভাবে নিজেদের মনের ভাব প্রকাশ করে থাকে। অর্থাৎ, কোনো নির্দিষ্ট কিংবা অনির্দিষ্ট বিষয়ে মন যা চায় তা-ই বলে। আর যখনই এই আড্ডা কিংবা গল্পের আসরের কোনো সীমারেখা নির্ধারণ করা হয় না, তখনই তা শয়তানের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। আর শয়তানের উদ্দেশ্য তো কেবল মানুষকে মন্দ কাজের দিকে পরিচালিত করা, মানুষকে তার প্রতিপালকের দাসত্ব থেকে মুক্ত করে নিজের (শয়তানের) দলভুক্ত করা। আর এর পরিণামে রয়েছে জাহান্নাম। যেমনটি আল্লাহ্ তা’আলা বলেন-

শয়তান তোমাদের শত্রু। অতএব তাকে শত্রুরূপেই গ্রহণ করো। সে তার অনুসারীদের আহ্বান করে যেন তারা জাহান্নামী হয়। [সূরাহ ফাতির (৩৫): ৬]

আমাদের আড্ডা কিংবা গল্পের আসরগুলো মূলত নির্ভর করে এতে অংশগ্রহণকারীদের উপর। তাই ইসলামিক জীবনযাপনে অজ্ঞ অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা যত বাড়বে, শয়তান তত বেশি সুযোগ নিবে। শয়তান অপ্রাসঙ্গিক কিংবা মন্দ বিষয় চমৎকারভাবে সামনে নিয়ে আসবে। যেমনটি কলেজ-ভার্সিটিতে পড়ুয়া ছেলে-মেয়েদের আড্ডায় বেশি দেখা যায়। চা পানের উদ্দেশ্যে আড্ডা শুরু হলেও ক্লাসের সবগুলো মেয়ের শারীরিক গঠন বিশ্লেষণের মাধ্যমে তা শেষ হয়। এটা মূলত প্রাত্যহিক জীবনে ইসলাম প্র্যাক্টিস না করার ফলাফল। এছাড়া জাস্ট ফান বলে এমনসব কথা মুখ দিয়ে বের হয়, যা তাকে জাহান্নামের আগুন পর্যন্ত পৌঁছে দিতে সক্ষম। যেমনটি রাসূলুল্লাহ্ ﷺ বলেন-

নিশ্চয় মানুষ এমন (কিছু) বাক্যের দ্বারা কথা বলে, এর দ্বারা সে জাহান্নামের মধ্যে এমন এক দূরত্বে পতিত হয়, যার দূরত্ব হবে পূর্ব হতে পশ্চিম পর্যন্ত। [মুসনাদে আহমাদ, আস-সহীহা: ৫৪০]

আর আমাদের আড্ডাগুলোর আরেকটি মূল লক্ষ্য থাকে সবাইকে হাসানো। যে যত বেশি হাসাতে পারবে, সে তত বেশি জনপ্রিয়। সেটা যেভাবেই হোক। তাই তো হাসানোর উদ্দেশ্যে মিথ্যা বলাটা তখন যেন একটা আর্ট হয়ে যায়। তাই সবাই বিভিন্ন সাজসজ্জা দিয়ে মিথ্যা চর্চা শুরু করে। অথচ ইসলাম বলে-

চরম সর্বনাশ ওই ব্যক্তির জন্য, যে মানুষকে হাসানোর উদ্দেশ্যে মিথ্যা কথা বলে থাকে। তার জন্য সর্বনাশ, তার জন্য সর্বনাশ। [তিরমিযী: ২৩১৫; আবু দাউদ: ৪৯৯০]

বর্তামান আড্ডাগুলোতে গায়রে মাহরাম ছেলে-মেয়ের মিক্সিং না থাকলে আবার নাকি জমে উঠে না। তাই আড্ডাকে জমিয়ে তুলতে পাশে মেয়ে থাকা চাই। যেমনটি বিভিন্ন গাছ তলা আর লাইব্রেরিতে অহরহ চোখে পড়ে। এসব আড্ডার টপিকগুলো কাছ থেকে না শুনলে হয়তো আধুনিকতার মোড়কে সামাজিকতাই মনে হবে। অথচ মেয়েদেরকে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা সম্মানিত করেছেন তাদের গোপনীয়তা দিয়ে। অর্থাৎ মেয়েদের সৌন্দর্য দেখিয়ে বেড়ানোর মধ্যে কোনো কল্যাণ নেই, বরং এতে রয়েছে তার প্রতিপালকের অবাধ্যতা। তাই এসব আড্ডায় গায়রে মাহরামদের সাথে মেয়েদের উপস্থিতিতে শয়তানের উদ্দেশ্যই বাস্তবায়িত হয়। যেমনটি রাসূলুল্লাহ্ ﷺ বলেছেন-

নারী হচ্ছে গোপন বস্তু। যখন সে বাড়ি থেকে বের হয়, তখন শয়তান তাকে নগ্নতার প্রতি ক্ষিপ্ত করে তুলে। [তিরমিযী, মিশকাত, হা/ ৩১০৯]

এছাড়া প্রায় আড্ডাগুলোর একটি অংশ থাকে অন্যের দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করা। এই যেমন কোন ছেলেটা ক্ষেত, কোন মেয়েটা ভাব নেয়, কোন লোকটা অসামাজিক ইত্যাদি। আর এসব সমালোচনা ব্যতীত আড্ডাগুলো যেন পানসে হয়ে উঠে। তাই শয়তান আড্ডার মধ্যে তা খুব লোভনীয়ভাবে মিশ্রিত করে দেয়। অথচ এরকম দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করাকে ইসলাম ‘গীবাত’ বলে চিহ্নিত করেছে এবং কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। এ বিষয়ে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন

…তোমাদের কেউ যেন কারও পশ্চাতে নিন্দা না করে। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভ্রাতার মাংস ভক্ষণ করা পছন্দ করবে? [সূরাহ আল-হুজুরাত (৪৯): ১২]

আমাদের প্রতিদিনের জমিয়ে তোলা আড্ডার নানান দিক নিয়ে বেশ কিছু কথা বলা হলো, আলহামদুলিল্লাহ্। তবে এমন কিছু আড্ডা রয়েছে, যেখানে শয়তানের কোনো প্রভাব থাকে না। বরং সেখানে ফেরেশতাগণ অবতীর্ণ হন এবং তা বরকতময় করে তুলেন। এর কারণ মূলত এসব আড্ডায় বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহ্ তা’আলার প্রশংসা করা হয়, আল্লাহর দ্বীন নিয়ে আলোচনা হয়। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই নেতৃত্বের আসনে থাকতে হবে সবচেয়ে ইলমধারী ব্যক্তিটা। অন্যথায় তা হিতের বিপরীত হয়ে যেতে পারে। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলর স্মরণে বসা মজলিসের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ্ ﷺ বলেন-

কোনো মানবমণ্ডলী কোনো মজলিসে বসে তাতে আল্লাহর যিকির করলে আল্লাহর ফেরেশতাগণ তাদেরকে ছেয়ে ফেলেন ও আল্লাহর রহমত তাদেরকে ঢেকে ফেলে। আর আল্লাহ তাঁর নিকটতম ফেরেশতাদের মধ্যে তাদের সুখ্যাতি বর্ণনা করেন। [মুসলিম: ২৭০০; তিরমিযী: ১৪২৫]

পরিশেষে এতটুকুই বলবো, আমরা কাদের সাথে এবং কোন বিষয়ে আড্ডা দিচ্ছি, তা সবই আমাদের প্রভুর সামনে প্রকাশ পাবে। তাই এ বিষয়গুলো যেন সেদিন আমাদের লজ্জার কারণ না হয়, আমাদের হেরে যাওয়ার কারণ না হয়। সবশেষে এই বিষয়ে রাসূলুল্লাহ্ ﷺ এর দুটি হাদীস দিয়ে শেষ করছি-

মানুষ (দুনিয়াতে) যাকে ভালোবাসে, (কিয়ামত দিবসে) সে তারই সাথী হবে। [রিয়াদুস স্বা-লিহীন: ৩৭২]

যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন ভালো কথা বলে অন্যথায় চুপ থাকে। [বুখারী,মুসলিম]

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive