অনেক দিন পার হয়ে গেলো। প্রিয় বন্ধুগুলো আর সেই হারিয়ে যাওয়া আড্ডা এখন রূপকথার মতোই মনে হয় ইফাতের কাছে। ফাহাদ, বাকী আর সায়েমের সাথে শৈশবের সেই সময়টুকু খুব মিস করে সে। অনেক বড় হয়ে গেছে সবাই। যে যার মতো নিজের জীবনটাকে গুছিয়ে নিয়েছে। সেটেল হয়েছে শহরের একেক প্রান্তে। প্রিয় জুবায়ের স্যারের বাড়ির পিছনের পুকুর পাড়ে বসে হাসাহাসি করা আর স্যারের বকুনি খাওয়া এখন শুধুই স্মৃতি!

বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেলো। তর সইছে না ইফাতের। পুকুরপাড়ে বসে একমনে ভাবছে সে, কত দিন পর দেখা হচ্ছে সবার! কত না বলা কথা আজ বলা হবে! শোনা হবে! ভাবতে ভাবতে ইফাত আনমনা হয়ে গেলো। যেন জাগ্রত অবস্থায় স্বপ্ন দেখছে সে। তবে তার এই ভ্রম কাটতে সময় লাগলো না। কাঁধে হাত রাখলো ফাহাদ। যেন বিশ্বাসই হচ্ছেনা বাকীর। ইফাতের পাশেই বসা ছিলো সে। ফাহাদের সাথে বেশি মেলামেশা বাকীরই হতো। তবে একদিন সামান্য একটি ব্যাপার নিয়ে খুব মন খারাপ করেছিলো বাকী ফাহাদের উপর। তবে জুবায়ের স্যারের মধ্যস্থতায় আবার দুজনে মিলেও গিয়েছিলো। পুরনো সেই ব্যাথা কেউই মনে রাখেনি। যাই হোক…

IIRT Arabic Intensive

..একে একে সবাই জমা হলো পুকুরপাড়ে। সায়েম অন্যদের চেয়ে বয়সে ছোট। তবে আজ সবার একসাথে মিলিত হবার পিছনে ওর অবদানই বেশি। জুবায়ের স্যারের বাড়িতে চায়ের পর্বটার প্রস্তাব সায়েমই দিয়েছিলো। জুবায়ের স্যার তার প্রিয় ছাত্রগুলোর সাথে একটি সুন্দর মুহূর্ত কাটানোর জন্য সায়েমের প্রস্তাব খুশি মনে মেনে নিয়েছিলেন।

অতঃপর, স্যারের বাড়িতে প্রবেশ করলো সবাই। স্যার সবাইকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে তিনি সবাইকে আগেই ঠিক করে রাখা চেয়ারগুলোতে বসতে বললেন।

শুরু হলো সুখ দুঃখের গল্প।

অদ্ভুত হলেও সত্য, সবাই কেমন যেন অসুখী মনে হচ্ছে! জীবনের না পাওয়া অধ্যায়গুলোই সবাই একে অন্যের সাথে শেয়ার করছে। জীবন নিয়ে সবার কতই না অভিযোগ!! তবে একমাত্র স্যারকেই হাস্যোজ্জ্বল দেখা গেলো। জীবন নিয়ে মোটেও হাহুতাশ নেই তার। সবার কথা বলার ফাঁকে নিজ হাতেই সবার জন্য চা নিয়ে এলেন। কী মনে করে যেন কয়েক কাপ চা বেশি এনেছেন তিনি। সবাইকে চা নিতে বললেন। চায়ের কাপে বেশ ভেরিয়েশন দেখা যাচ্ছে। কোনো কাপ সিরামিকের, কোনোটা কাঁচের, কোনোটা স্টিলের আবার কোনোটা প্লাস্টিকের! সবাই চা নিলো। পড়ে রইলো কয়েক কাপ চা। যার সবগুলোই ছিলো প্লাস্টিকের কাপ!

স্যার এবার তাদের কিছু বলতে চাইলেন। সবার মনোযোগ আকর্ষণের পর তিনি বললেন, “দেখো সবার উদ্দেশ্য ছিলো চা পান করার। আর এই চায়ের স্বাদ কখনোই সেটি কোন কাপে আছে, তার উপর নির্ভর করে না। কিন্তু দেখো, তোমরা সবাই ভালো ভালো কাপগুলোই নিয়েছো। অবশিষ্ট রয়েছে শুধু প্লাস্টিকের কাপগুলো। কিন্তু প্লাস্টিকের কাপে তো একই চা আছে। তাহলে তোমরা সবাই অন্য কাপের চা গুলোই নিলে কেন?”

সবাই নীরব হয়ে গেলো। প্রত্যেকের ঠোঁট যেন সেলাই করে দিয়েছে কেউ। তাই উত্তরটা স্যারই দিয়ে দিলেন।

তিনি বললেন, “আমাদের জীবনটা ঠিক এই চায়ের মতো, যেখানে অর্থ, চাকরি, ক্ষমতা-প্রতিপত্তি সব কিছুই জীবন নামক এই চায়ের ‘কাপ’ হিসেবে কাজ করে মাত্র। আমাদের জীবনটা সুন্দর হলেই হলো। আমাদের চাকরি কী? আমাদের অর্থ কত? অথবা আমাদের ক্ষমতাই বা কী? এইসব আমাদের জীবন সুন্দর করার জন্য জরুরী নয়। প্রশান্ত আত্মার মানুষ আর মুত্তাকী হতে চাইলে নিজ জীবনকে পবিত্র করাই যথেষ্ট। আল্লাহ আমাদের চাকরি, অর্থ-সম্পদ আর প্রতিপত্তি কোনোটাই দেখবেন না। দেখবেন শুধু আমাদের অন্তর। তাই আল্লাহ যা দিয়েছেন, তাতেই সন্তুষ্ট থাকা উচিত। আর আল্লাহ বিপদ আপদ দিলে সবর করা উচিত। মনে রাখা উচিত রাসূল ﷺ বলেছেন,

(দুনিয়ার ধন-দৌলত ইত্যাদির দিক দিয়ে) তোমাদের মধ্যে যে নিচে, তোমরা তার দিকে তাকাও; এবং যে তোমাদের উপরে, তার দিকে তাকিয়ো না। যেহেতু সেটাই হবে উৎকৃষ্ট পন্থা যে, তোমাদের প্রতি যে আল্লাহর নিয়ামত রয়েছে তা তুচ্ছ মনে করবে না। (বুখারী, মুসলিম)

এছাড়াও মহান আল্লাহ সূরা আনকাবুতের ৬৪ নম্বর আয়াতে বলেছেন,

وَمَا هَٰذِهِ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا لَهْوٌ وَلَعِبٌ ۚ وَإِنَّ الدَّارَ الْآخِرَةَ لَهِيَ الْحَيَوَانُ ۚ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ

অর্থ: এ পার্থিব জীবন তো খেল-তামাশা ছাড়া কিছুই নয়। আর পরলৌকিক জীবনই তো প্রকৃত জীবন; যদি ওরা জানতো!

তাই আমাদের উচিত জীবন নিয়ে হাহুতাশ না করে, আল্লাহ যতটুকু দিয়েছেন ততটুক দিয়েই জীবনকে সাজানোর চেষ্টা করা। চায়ের কাপের চেয়ে বরং চায়ের স্বাদটা যেমন মুখ্য বিষয়, তেমনি আমাদের জীবনের প্রাপ্তির সংখ্যার চেয়ে আমরা জীবনে কতটা খুশি হলাম, জীবনটাকে কতটা উপভোগ করতে পারলাম, সেইটাই মুখ্য বিষয়। কারণ সন্তুষ্টি মনের বিষয়। বাহ্যিক কোনো আসবাব দিয়েই মনের তুষ্টি আর আনন্দকে প্রকাশ করা যায় না। তাই মনের দিকে নজর দাও, আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করো। দেখবে সকল দুঃখ দূর হয়ে যাচ্ছে।”

………………কথাগুলো শুনতে শুনতে কয়েক দফা পানি গড়িয়ে পড়লো লেখক তিয়াসের চোখ থেকে। দরজার আড়াল থেকে সবকিছুই শুনছিলো সে।

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive