এই প্রবন্ধটির শিরোনাম নেয়া হয়েছে একটি হাদিস থেকে। নবী (সাঃ) থেকে প্রাপ্ত একটি বর্ণনা যা প্রথমবার পড়ার পর আমি অভিভূত হয়েছি। এরপর আমি যতবারই এটা পড়ি বারবারই আমি অভিভূত হতে থাকি। আমার গভীর আসক্তির একটি বিষয়ের সারাংশ এটা, আর তা হলো কুরআন নিয়ে চিন্তা গবেষণা করা। আমরা কিভাবে কুরআনের সাথে সম্পর্ক গড়বো এবং আল্লাহর সাথে আমাদের সম্পর্কের প্রকৃতি কেমন হওয়া উচিত তারই সারসংক্ষেপ (এই হাদিস)।
এই হাদিস আমাদের সামনে কঠিন কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করে। আর তা হলো-
১. বাস্তব জীবনে আমাদের ওপর কুরআনের কী প্রভাব রয়েছে?
২. আমরা কী কুরআনের সাথে পর্যাপ্ত সময় ব্যয় করি?
৩. কিভাবে আমরা আল্লাহর কিতাবের সাথে আরো বড় পরিসরে সম্পর্ক গড়তে পারি?
৪. আমরা নিজেদের সুবিধামত কুরআন পড়ি, নিজেদের মত বুঝি এবং কিছু কিছু অংশ মুখস্তও করি। কিন্তু এগুলো কী আমাদের জীবনে আদৌ কোনো প্রভাব ফেলছে?
যখন আমি কুরআনের সাথে নিজের (এবং অন্যরা নিজেদের ব্যাপারে আমার কাছে যা বলে) সম্পর্কের কথা বিবেচনা করি আর তা মিলাই আল্লাহর নবী (সাঃ) কুরআনের সাথে যেমন সম্পর্ক গড়েছিলেন তার সাথে, তখন দুইয়ের মধ্যে আকাশ-পাতাল বৈপরীত্য দেখতে পাই। কিছু বর্ণনা এমন পাওয়া যায় যা থেকে বোঝা যায় যে, এই প্রবন্ধের উদ্দিষ্ট পাঠকদের তুলনায় কত ব্যাপক পরিসরে এই কুরআন নবী (সাঃ) এর জীবনে পরিবর্তন এনেছিল। এটি শুধুমাত্র চারিত্রিক এবং আধ্যাত্মিক দিকেরই পরিবর্তন আনেনি, বরং শারীরিক পরিবর্তনও এনেছিল!
আবু জুহাইফা এবং অন্যান্য (রাদিয়াল্লাহু আনহুম আজমাইন) দ্বারা বর্ণিত (তিরমিযী এবং অন্যান্য জায়গায়) এই হাদিসে এসেছে যে, একদিন আবু বাকর (রাঃ) নবী (সাঃ) এর কাছে আসলেন এবং বললেন যে তাকে (নবী (সাঃ)) বৃদ্ধ দেখাচ্ছে। সুনির্দিষ্ট শব্দটি ছিল ‘শাইব’ যা এমন অবস্থাকে বোঝায় যখন কারো চুল ধূসর ও সাদা হয়ে যায়। এই বর্ণনা থেকে সাহাবীদের ভেতরের অবস্থা বোঝা যায় যে, তারা কিভাবে নবী (সাঃ) এর সূক্ষ থেকে সূক্ষাতিসূক্ষ বিষয়ের দিকেও খেয়াল রাখতেন। তারা শুধুমাত্র তার কথা এবং কাজকেই আত্মস্থ করেননি, বরং তারা তার সূক্ষাতিসূক্ষ পরিবর্তনের দিকেও নজর রাখতেন। এই পর্যবেক্ষণের আশ্চর্যজনক দিক হলো, নবী (সাঃ) এর মৃত্যুর সময় তার ২০টির বেশি চুল ও দাঁড়ি পাকা ছিলনা (বুখারীতে আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত)। অথচ এই সামান্য কয়টি সাদা চুলও (সাহাবীদের) নজর এড়াতে পারেনি।
আরেকটি আকর্ষণীয় বিষয় হলো যে আবু বাকর (রাঃ) এর এই কথাটি ছিল খুবই মামুলি একটি উক্তি। আমরা এধরণের কথা হর-হামেশাই আমাদের পরিবার-পরিজন, বন্ধু বান্ধবদের বলে থাকি, বিশেষত দীর্ঘদিন পর সাক্ষাত হলে। আমরা তাদের নিয়ে মশকরা করি যে তারা বুড়ো হয়ে গেছে, তাদের মাথার চুল পাতলা হয়ে গেছে, তারা মোটা অথবা চিকন হয়ে গেছে ইত্যাদি। উত্তরে সাধারণত সেই বন্ধু জবাব দিবে কী কারণে তাদেরকে বুড়ো কিংবা ভিন্নরকম দেখাচ্ছে। হয়ত সে কাজের চাপে জর্জরিত, অথবা তার শারীরিক কোন সমস্যা রয়েছে কিংবা তার স্ত্রী-সন্তানদের কারণে তার ওপর ধকল যাচ্ছে।
কিন্তু নবী (সাঃ) এর জবাব এমনটি ছিলনা। আমরা যদি নিষ্ঠার সাথে চিন্তা করি তাহলে দেখতে পাবো যে তার জীবনে কত ধরণের চাপ যাচ্ছিল। তিনি ছিলেন একাধারে একজন স্বামী, পিতা, বন্ধু, ইমাম, নেতা এবং সেনাপতি। অর্থাৎ, সবকিছুর দায়ভার তার উপরেই ন্যস্ত ছিল। তাকে জুমার খুতবা প্রস্তুত করতে হত, সালাতের ইমামতি করতে হত, লোকজনের নানবিধ বাক-বিতন্ডার সমাধা করতে হত। এরপর তিনি ঘরে ফিরে আসতেন ও নিজের পরিবারের ভরণপোষণ করতেন, নাতিদের সাথে খেলাধুলা করতেন এবং নিজের মেয়েদের সাথে কৌতুক করতেন। তিনি বৃদ্ধ ও অসুস্থদের দেখতে যেতেন, নিজের বন্ধুদের সাথে সময় কাটাতেন এবং দরিদ্রদের খাবার খাওয়াতেন। এরপর তাকে কুরাইশ এবং অন্যান্য শত্রুদের মোকাবেলায় নিজের বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিতে হত, সেসময়কার রাজনৈতিক বিষয়গুলো সামলানো সহ আরো অগণিত কাজ করতে হত।
কিন্তু এতোকিছুর কোনোটিই তার বৃদ্ধ হয়ে যাবার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি। বরং নবী (সাঃ) জবাব দিলেন, “সূরা হুদ এবং তার বোনেরা (অনুরূপ সূরাগুলো) আমাকে বুড়ো বানিয়ে দিয়েছে”। আরেকটি বর্ণনায় পাওয়া যায়, নবী (সাঃ) সবগুলো সূরার নাম উল্লেখ করে বলেন, “সূরা হুদ, ওয়াকিয়া, নাবা এবং তাকউয়ির আমাকে বুড়ো বানিয়ে দিয়েছে”।
এই লেখাটি এখানেই শেষ করে দিতে আমার মন আমাকে প্রলুব্ধ করে। ইচ্ছে করে সবাইকে এই বর্ণনা সম্পর্কে চিন্তা করতে ছেড়ে দিতে। কিন্তু আমি কিছু বিষয় এখানে যোগ করতে চাই। প্রথমত, এখান থেকে বোঝা যায় যে কুরআনের সাথে নবী (সাঃ) এর সম্পর্ক কেমন ছিল। তিনি যখন উপোরোল্লিখিত সূরাগুলো পড়তেন যার মধ্যে পূর্ববর্তী জাতিদের ওপর আপতিত শাস্তি, বিচার দিবস এবং জাহান্নামের বর্ণনা রয়েছে, তখন তিনি সেই আয়াতগুলোকে অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করতেন এবং নিজেকে সেই জায়গায় কল্পনা করতেন।
দ্বিতীয়ত, কুরআনের সাথে আমাদের ভাসা ভাসা সম্পর্ক হলে চলবেনা। এর সাথে আমাদের সম্পর্ক কেবলমাত্র একটি অনুপ্রেরণামূলক বয়ান কিংবা সুন্দর তেলাওয়াত শোনাতে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবেনা। কুরআনের দাবি এই যে, আমরা এর বাণীকে অন্তরে ধারণ করবো এবং আমাদের শরীরের মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করবো। এজন্য দরকার কঠোর পরিশ্রম, আত্মনিয়োগ এবং অধ্যবসায়।
তৃতীয়ত, বিষয়টি এমন মনে হচ্ছে যেন এক একটা প্রজন্ম পার হচ্ছে আর আমরা আস্তে আস্তে কুরআন থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। আমাদের সমাজের ভবিষ্যত নির্ধারণের জন্য বর্তমানের শিশু ও তরুণদের সাথে কুরআনের প্রতিটি বিষয়ের সুদৃঢ় বন্ধন তৈরি হওয়া অতীব জরুরী। তা অর্জন করা আমাদের সম্মিলিত দায়িত্ব।
সবশেষে, যদি আমাদের মানসিকতা না পালটায়, তাহলে আমরা এমন এক ঝুঁকিতে থাকব যেখানে কুরআন আমাদের কাছে একটি কিতাব যাকে আমরা সম্মান করি ও ভালোবাসি, কিন্তু যার কথাগুলো আমরা বুঝিনা। এর শিক্ষা, শব্দাবলি এবং আয়াতগুলো আমাদের কাছে রহস্যময়ই থেকে যাবে, এর রত্ন ও মনি-মুক্তাগুলো এর ভেতরেই থেকে যাবে এবং এর কল্যাণ কদাচিতই পাওয়া যাবে। আমি আমার এই প্রবন্ধটি শেষ করতে চাই আরেকটি হাদিস উল্লেখ করে যা থেকে বোঝা যায় যে সূরা হুদের সাথে নবী (সাঃ) এর সম্পর্ক এককালীন ছিলনা, বরং তা ছিল সুদৃঢ় ও সমুন্নত।
আইশাহ (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, যখনই নবী (সাঃ) মেঘ ও জোরালো বাতাস দেখতে পেতেন তখনই খুব বিচলিত হয়ে যেতেন। তিনি আরো বলেন যে, লোকেরা যখন এগুলো (মেঘ ও বাতাস) দেখত তখন বৃষ্টির আগাম বার্তা মনে করে আনন্দিত হত। কিন্তু তাঁকে (নবী (সাঃ)) খুব বিষণ্ন দেখাত। তিনি বলেন, “হে আইশাহ, আমি কিভাবে নিশ্চিত হই যে এটা (আল্লাহর তরফ থেকে) শাস্তি নয়? (পূর্বের জাতিদেরকে) প্রচণ্ড বাতাস ও অন্যান্য বস্তু দ্বারা শাস্তি দেওয়া হয়েছিল, অথচ তারা মনে করেছিল তা হল বৃষ্টি বহনকারী মেঘ (আল বুখারী)”। যে জাতির কথা তিনি এখানে উল্লেখ করেছেন তা হল হুদ (আঃ) এর জাতি। সুতরাং, হুদ (আঃ) এর জাতির বর্ণনা নবী (সাঃ) এমনভাবে আত্মস্থ করেছেন যে তার আচরণের মধ্যেই পরিবর্তন চলে এসেছিল।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন-
“অতঃপর তারা যখন শাস্তিকে মেঘরূপে তাদের উপত্যকা অভিমুখী দেখল তখন বলল, এ তো মেঘ, আমাদেরকে বৃষ্টি দেবে। বরং এটাতো সেই বস্তু যা তোমরা তাড়াতাড়ি চেয়েছিলে। এটি বাতাস যাতে রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি। তার পালনকর্তার আদেশে সবকিছুকে ধ্বংস করে দেয়। অতঃপর ভোরবেলায় তারা এমন হয়ে গেল যে তাদের বসতিগুলো ছাড়া কিছুই দৃষ্টিগোচর হল না।” (সূরা আহকাফঃ ২৪-২৫)
উৎস: muslimmatters.org (মূল আর্টিকেল লিংক)
অনুবাদক: মিনহাজ মুক্তাদীর, মুসলিম মিডিয়া প্রতিনিধি
অনুবাদ কপিরাইট © মুসলিম মিডিয়া
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।