পরম করুণাময় ও দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি
ইসলামকে ধূলায় মিশিয়ে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হওয়া খ্রিষ্টান সৈন্যদের খবরটি যখন আবু ক্বুদামা আশ শামীর কানে এলো, তিনি দ্রুত মাসজিদের মিম্বরে উঠে দাঁড়ালেন। জ্বালাময়ী এবং আবেগঘন খুতবার মাধ্যমে আবু ক্বুদামা জনগণের অন্তরে নিজ ভূমিকে প্রতিরক্ষার, আল্লাহর পথে জিহাদের জন্য চেপে রাখা বাসনাকে জাগিয়ে তুললেন। তিনি যখন মাসজিদ ছেড়ে নির্জন আঁধার গলি দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন, একজন মহিলা তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন, ‘‘আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।’’ আবু ক্বুদামা থমকে দাঁড়ালেন, কিন্তু কোনো জবাব দিলেন না। মহিলাটি আবারো সালাম জানালেন, সাথে এও বললেন, ‘‘দ্বীনদার মানুষের আচরণ এমন হওয়া উচিত না।’’ এ কথা বলে মহিলাটি আবছায়া থেকে সামনে বের হয়ে এলেন। ‘‘মুমিনদের জিহাদে যোগ দেওয়ার জন্য মাসজিদে আপনার আহ্বান আমি শুনেছি। জিহাদের জন্য আমার শুধু এটিই দেওয়ার সামর্থ্য আছে …’’ এই কথা বলে মহিলাটি দুটি লম্বা বেণী আবু ক্বুদামার হাতে তুলে দিলেন। বললেন, ‘‘এ দু’টি ঘোড়ার লাগাম হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। হয়তো এটার কারণে আল্লাহ আমার নাম তাদের সাথে লিখে রাখবেন, যারা জিহাদে যোগ দিচ্ছেন।’’
পরের দিন গ্রামের সব মুসলিমেরা যখন ক্রুসেডারদের মুখোমুখি হওয়ার জন্য রওয়ানা হচ্ছিলো, একটি ছোট ছেলে ভীড় ঠেলে দৌড়ে এসে আবু ক্বুদামার ঘোড়ার সামনে দাঁড়ালো। বললো, ‘‘আল্লাহর ওয়াস্তে আমাকে আপনাদের সাথে যাওয়ার অনুমতি দিন।’’ কিছু বয়স্ক সৈনিক হাসাহাসি করে বলতে লাগলো, ‘‘তুমি তো ঘোড়ার পায়ের নিচেই পিষ্ট হয়ে যাবে।’’ কিন্তু ছেলেটি আবার অনুনয় জানালো, ‘‘আমাকে আল্লাহর ওয়াস্তে আপনাদের সঙ্গে নিয়ে নিন।’’ আবু ক্বুদামা ছেলেটির চোখের দিকে গভীরভাবে লক্ষ করলেন। ‘‘এক শর্তে।’’ আবু ক্বুদামা বললেন, ‘‘যদি তুমি যুদ্ধে শহীদ হও, আমাকেও তুমি তোমার সাথে জান্নাতে নিয়ে যাবে।’’ ছেলেটি হাসি দিয়ে বললো, ‘‘কথা দিলাম।’’
যুদ্ধ যখন তীব্রতর হলো, ছেলেটি আবু ক্বুদামার ঘোড়ার পিঠে বসা অবস্থায় বললো, ‘‘আল্লাহর ওয়াস্তে আমাকে তিনটি তীর দিন।’’
‘‘তুমি তো তীর গুলো হারিয়ে ফেলবে!’’
ছেলেটি আবারো বললো, ‘‘আল্লাহর দোহাই, আমাকে ঐগুলো দিন।’’
আবু ক্বুদামা ছেলেটিকে তীরগুলো দিলে ছেলেটি তীরের লক্ষ্য স্থির করলো। ‘‘বিসমিল্লাহ!’’ একটি তীর ছুটে গিয়ে একজন রোমান সৈন্যকে ধরাশায়ী করে দিলো। ‘‘বিসমিল্লাহ!’’ দ্বিতীয় তীরটিও ছুটে গিয়ে আরেকজনকে বিদ্ধ করলো। ‘‘বিসমিল্লাহ!’’ তৃতীয় তীরও আরেকজনকে হত্যা করলো। ঠিক তখনই একটি তীর এসে ছেলেটির বুকে গেঁথে গিয়ে তাকে ঘোড়ার পিঠ থেকে ছিটকে ফেলে দিলো। আবু ক্বুদামা লাফ দিয়ে ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে ছেলেটির পাশে ঝুঁকে বসলেন। ছেলেটিকে মুমূর্ষু অবস্থায় দেখে বললেন ‘‘সেই শর্তের কথা ভুলে যাবে না তো?’’ ছেলেটি নিজের পকেটে থেকে একটি ছোট পুটলি বের করে বললো, ‘‘এটা আমার মায়ের কাছে পৌঁছে দেবেন।’’ ‘‘কে তোমার মা?’’ জানতে চাইলেন আবু ক্বুদামা।
‘‘যিনি গতকাল আপনার কাছে তাঁর বেণী দিয়ে গিয়েছিলেন।’’
চিন্তা করে দেখুন সেই নারীর কথা, যিনি কীভাবে পরহেযগারিতার এই স্তরে পৌঁছে গেছেন যে, তিনি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজের চুল উৎসর্গ করে দিয়েছেন। অথচ আজকের দিনের নারীরা একই কাজ করে বিধর্মী কোনো সেলিব্রিটির অনুকরণে অথবা কোনো ফ্যাশন ট্রেন্ডের অনুসরণে। আর সেই ছেলেটির কথাই ভাবুন। এখনকার যুগে ছেলে ঘরের বাইরে কিছুক্ষণ থাকলেই মায়েরা অস্থির হয়ে পড়েন। আসলে সেই নারীটি তাঁর সমস্ত জীবন আল্লাহর আনুগত্যে অতিবাহিত করেছিলেন। যখন পরীক্ষার মুহূর্ত এলো, তিনি সফল হয়ে গেলেন। তিনি শুধু নিজেই সাফল্য অর্জন করেননি, তাঁর সন্তানেরাও ঈমানের জ্যোতিতে দীপ্যমান হয়েছে; যাদেরকে তিনি নিজ হাতে লালন পালন করে গড়ে তুলেছিলেন।
বর্তমানে আমারা বেশিরভাগ সুন্নাহ ভুলতে বসেছি। ইদানীং প্রায়শই ওয়াজে, খুতবাতে, বক্তৃতায়, সবখানে মুসলিম পুরুষদেরকে উদ্দেশ্য করে সব কথা বলা হয়। আমরা ভুলে গিয়েছি যে, আমাদের হিদায়াতের পথের দিশারী রাসূলের ﷺ সুন্নাহ ছিলো প্রতি সপ্তাহের একটি দিন নারীদের শিক্ষাদানের জন্য বরাদ্দ রাখা। নারীরাও হাজ্জের সময়, পথে ঘাটে, তাঁর বাড়িতে তাঁর কাছে আসতেন দ্বীনের বিষয়ে প্রশ্নের উত্তর জানতে। ঈদের সালাতের পর ঈদের খুতবা শেষ করে তিনি বিলালকে (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) সাথে নিয়ে মহিলাদের অংশে যেতেন এবং মহিলাদের উদ্দেশ্য করে নসীহা দিতেন। আল্লাহ তা’আলা কুরআনের একটি সম্পূর্ণ সূরা নাযিল করেছেন, যার নামই ‘আন-নিসা’ বা ‘নারী’। আরেকটির নাম – ‘মারইয়াম’। আরো একটির নাম দেওয়া হয়েছে – ‘মুজাদালাহ’ বা ‘অনুযোগকারিণী’। আজকের এই বক্তব্যটিতে সেই সুন্নাহকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রয়াসেই মুমিনাহ নারীদেরকে সম্বোধন করা হচ্ছে।
আমার প্রিয় বোনেরা, মায়েরা, কন্যারা – প্রত্যেকেই সুখ আর আনন্দের সন্ধানে থাকে, আর স্বভাবতই আপনারাও তার ব্যতিক্রম নন। আসলে কীসে আছে সেই সুখ আর আনন্দ? কোথায় আর কখন তা পেতে চান? আপনারা কি সেই সুখ, শান্তি, আনন্দ দুনিয়াতেই পেতে চান? আখিরাতের বিনিময়ে? নাকি আখিরাতে যখন আপনি আল্লাহর সামনে দাঁড়াবেন, তখন সুখী হতে চান?
আপনি যেখানেই যান, আপনার আশেপাশের একদল লোক, মিডিয়া, এমনকি আপনার সমাজ-সংস্কৃতির সকলে জোর গলায় আপনাকে বারবার বোঝাতে চাইবে যে, এই দুনিয়ার আনন্দই আসল আনন্দ। এটা কি আসলেই সত্যিকারের আনন্দ? চূড়ান্ত হিসাবের দিন আল্লাহ এই দুনিয়ার সবচেয়ে ‘সুখী’ কাফিরকে নিয়ে জাহান্নামের আগুনে একবার ডুবিয়ে ওঠাবেন। তারপর প্রশ্ন করবেন, ‘‘তুমি কি কখনো সুখের স্বাদ আস্বাদন করেছিলে?’’ সেই কাফির তখন উত্তর দেবে, ‘‘কক্ষনো না!’’
দুনিয়াতে যা-ই ঘটুক, আসল সুখ হলো পরকালের চিরস্থায়ী সুখ। কিয়ামাতের দিন আল্লাহ দুনিয়াতে সবচেয়ে বেশি কষ্টের পরীক্ষায় থাকা মানুষটিকে নিয়ে একবার জান্নাতের সুখে অবগাহন করিয়ে ওঠাবেন, তারপর প্রশ্ন করবেন, ‘‘তুমি কি কখনো কষ্ট কী জিনিস, দেখেছো?’’ সেই লোকটি তখন জবাব দেবে, ‘‘কখনোই না!’’
এটাও আবার ভাববেন না যে, এই সব সুখ আর আনন্দ শুধুই পরকালেই লাভ করার জিনিস। এগুলো এই দুনিয়ার জীবনের সাথেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দেখুন এবং বোঝার চেষ্টা করুন আল্লাহ কী বলেছেন
পুরুষ আর নারীদের মধ্যে যে কেউ সৎকাজ করবে আর সে মুমিনও, তাকে আমি অবশ্য অবশ্যই উত্তম জীবন দান করবো। আর তারা যা করে, তাদেরকে অবশ্য অবশ্যই তার চেয়ে উত্তম প্রতিফল দান করবো। [সূরাহ আন-নাহল (১৬): ৯৭]
প্রিয় বোনেরা, আপনাদের সবারই এটা মনে রাখা উচিত যে, আপনি অথবা আমরা যে কেউ জাহান্নামের অধিবাসী হয়ে যেতে পারি! আল্লাহর কসম, আমরা কেউই রাসূলের ﷺ কন্যা ফাতিমার (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) চেয়ে উত্তম নই। আমাদের প্রিয় রাসূলই ﷺ তাঁর কন্যাকে বলেছিলেন,
হে মুহাম্মদের ﷺ কন্যা ফাতিমা! আমার ধন-সম্পদ থেকে যা ইচ্ছে চাও, কিন্তু আল্লাহর নিকট আমি তোমার কোনোই উপকারে আসবো না। [সহীহ বুখারী:৪৭৭১]
যার অর্থ হলো, তুমি আমার মেয়ে তাতে কিছু আসে যায় না। তুমি যদি জান্নাত অর্জনের জন্য চেষ্টা না করো, ‘‘অমুক অমুক আমার পিতা ছিলেন’’ এ কথা আল্লাহর কাছে গিয়ে বললে সেদিন তা কোনো উপকারেই আসবে না।
ইসলামের ইতিহাসে এমন অনেক মুমিনা নারীর উদাহরণ আছে, যারা পরিপূর্ণ তাক্বওয়া অর্জন করতে পেরেছিলেন। অন্যান্য নারীরা যখন বিধর্মী গায়ক, গায়িকা, খেলোয়াড়, অভিনেতা, অভিনেত্রীদের পোস্টার লাগিয়ে রাখে, আপনি তখন ফাতিমা (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) ও এরকম আরো অন্যান্য মুমিনাদের ছবি আপনার হৃদয়ের মণিকোঠায় লাগিয়ে রাখুন।
আসিয়া, ফির’আউনের স্ত্রী। আল্লাহর প্রতি তাঁর ঈমান এমন একজনের প্রতিচ্ছায়ায় থেকে মজবুত হয়েছিলো, যে কি না দাবী করতো, ‘‘আমিই তোমাদের রব, মহান অধিপতি!’’ যখন নিজের স্ত্রীর ঈমানের সংবাদ ফির’আউনের কানে পৌঁছলো, সে নিজে আসিয়াকে প্রহার করলো, তার প্রহরীদের দিয়ে প্রহার করালো। প্রহরীরা তাঁকে হাত পা বেঁধে তপ্ত দুপুরের রোদে বাইরে ফেলে ক্রমাগত মারতে লাগলো। আসিয়া তখন কী করলেন? তিনি আল্লাহর দিকে ফিরলেন। প্রার্থনা করে বললেন, ‘‘আমার রব, আমাকে আপনার কাছে একটি ঘর নির্মাণ করে দিন; আমাকে ফির’আউন ও তার কর্ম থেকে আশ্রয় দিন, এবং সীমালঙ্ঘনকারীদের থেকে আমাকে বাঁচান।’’
বর্ণনায় এসেছে, তিনি যখন এই দু’আ করলেন, তখন তাঁর জন্য আকাশের দরজা খুলে দেওয়া হয়েছিলো। সেখানে তিনি জান্নাতে নিজের ঘর দেখতে পেয়েছিলেন! তাঁর মুখে আনন্দের হাসি ফুটে উঠলো। প্রহরীরা হতবাক হয়ে দেখলো এত অত্যাচারের পরও এই নারীর মুখে এইরকম স্বর্গীয় হাসি! হতাশ হয়ে ফির’আউন নির্দেশ দিলো বড় একটি পাথরের চাঁই এনে আসিয়ার মাথা পিষে ফেলতে, তাঁকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে ফেলতে। কিন্তু সেই পাথর আনার আগেই আল্লাহ তাঁর রুহ নিয়ে নিলেন, আর তাঁকে কিয়ামাত পর্যন্ত সকল মুমিন মুমিনা বান্দাদের জন্য দৃষ্টান্ত বানিয়ে দিলেন
আর যারা ঈমান আনে, তাদের ব্যাপারে আল্লাহ ফির’আউনের স্ত্রীর দৃষ্টান্ত দিচ্ছেন। সে প্রার্থনা করেছিলো, ‘‘হে আমার প্রতিপালক! আপনি আমার জন্য আপনার নিকট জান্নাতে একটি ঘর বানিয়ে দিন আর আমাকে আপনি ফির’আউন ও তার (অন্যায়) কার্যকলাপ থেকে রক্ষা করুন। উদ্ধার করুন আমাকে যালিম সম্প্রদায় থেকে।’’ [সূরাহ আত-তাহরীম (৬৬) :১১]
আমরা যখন জিহাদ বা শহীদদের কথা বলি, আমরা সবাই কি জানি আল্লাহর পথে প্রথম শহীদ কে হয়েছিলেন? তিনি ছিলেন সুমাইয়াহ (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা), আম্মারের (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) জননী। আবু জাহল যখন সুমাইয়ার, তাঁর স্বামী ইয়াসিরের এবং ছেলে আম্মারের (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুম) ইসলাম গ্রহণের খবর শুনলো, সে ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁদের প্রত্যেককে চাবুকের আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করলো, প্রচণ্ডভাবে মারধোর করলো। সেই অত্যাচার এতটাই নির্মম ছিলো যে, রাসূল ﷺ যখন তাঁদের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন আর তাঁদেরকে এভাবে ঈমানের পরীক্ষা দিতে দেখেছিলেন, তিনি বললেন,
ধৈর্য ধরো, হে ইয়াসিরের পরিবার! কারণ তোমাদের জন্য জান্নাত নির্ধারিত।
সুমাইয়াহকে (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) শাস্তিস্বরূপ তপ্ত বালুতে চিত করে আটকে রাখা হয়েছিলো। আবু জাহল সুমাইয়াহকে (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) শাস্তি দিয়েই যাচ্ছিলো। কিন্তু তবুও ইসলাম থেকে তাঁকে ফেরাতে ব্যর্থ হচ্ছিলো। সে তখন প্রচণ্ড ক্ষেপে গিয়ে হাতে বর্শা তুলে নিলো। সেই বর্শা সুমাইয়াহর (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) শরীরের মধ্যখান চিরে ঢুকে গেলো। তাঁর পরিবারে তিনিই প্রথম শাহাদাত বরণ করলেন। শুধু পরিবারেরই নয়, বরং সমগ্র উম্মাতে মুহাম্মাদির মধ্যে তিনি সেই নারী, যাকে প্রথম শহীদ হিসেবে আল্লাহ কবুল করলেন।
প্রিয় বোনেরা, আমাদের আদর্শ কুরআনে বর্ণিত নারীরা। আপনারা নিশ্চয়ই সেই বালক এবং রাজার ঘটনাটি শুনেছেন। যখন বালকটির মৃত্যুতে সমস্ত গ্রামবাসী ইসলাম কবুল করে নিলো, রাজা আদেশ দিলো যেন বিশাল একটি অগ্নিকুণ্ড প্রস্তুত করা হয়। যারা ইসলাম থেকে ফিরে না আসে, তাদেরকে যাতে জীবন্ত দগ্ধ করে হত্যা করা হয়। একজন মুমিনাহ নারী সেই অগ্নিকুণ্ডের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর কোলের নিষ্পাপ শিশুটির মুখের দিকে তাকিয়ে মুহূর্তকাল ইতস্ততঃ করছিলেন, আর ভাবছিলেন শিশুটির জীবন রক্ষার্থে ফিরে আসবেন কি না। কোলের শিশুটি তখন বলে উঠলো, ‘‘তুমি কীসের জন্য দেরী করছো, মা? এগিয়ে যাও, তুমি তো সঠিক পথে রয়েছো।’’ সেই নারী মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মত হলেন। তখন কোলের শিশুসহ তাঁকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে হত্যা করা হলো।
তারা তাদেরকে নির্যাতন করেছিলো একমাত্র এই কারণে যে, তারা মহাপরাক্রান্ত প্রশংসিত আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছিলো। আসমানসমূহ ও জমিনের সর্বময় কর্তৃত্ব যার; আর আল্লাহ সবকিছুর প্রত্যক্ষদর্শী। [সূরাহ আল-বুরূজ (৮৫):৮-৯]
প্রিয় বোন, আপনার আদর্শ খুঁজে পেতে পারেন এ সময়ের এমন নারীর মধ্যেও। যেমনটি এক মহিলার ছেলে বর্ণনা করছিলো তার মায়ের ব্যপারে। একটি মুসলিম দেশের এই বয়স্ক মহিলা অনুধাবন করলেন, মহিলাদের অসার গালগল্প-আড্ডার জীবন তাঁর জন্য নয়। তিনি নিয়মিত সালাত, তাহাজ্জুদ ইত্যাদি ইবাদতে রত হলেন। এক রাতে তিনি তাঁর সালাতের ঘর থেকে তাঁর ছেলেকে ডাকতে লাগলেন। ছেলেটি তার মায়ের অবস্থা বর্ণনায় বললো, ‘‘আমি মায়ের ডাকে তাঁর ঘরে গিয়ে দেখলাম তিনি সিজদার ভঙ্গিতে আছেন এবং বলছেন যে তিনি প্যারালাইজড হয়ে গেছেন, শরীর নাড়াতে অক্ষম।’’ ছেলেটি তার মাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলো, নানাভাবে তাঁর চিকিৎসা চালানো হলো। কিন্তু সব চেষ্টা বিফলে গেলো। তার মা তখন ছেলেকে আদেশ করলেন তাঁকে তাঁর বাড়িতে, তাঁর সালাতের ঘরটিতে, তাঁর সিজদার জায়গায় ফিরিয়ে নিতে। সিজদায় তিনি আল্লাহকে ডাকতে লাগলেন। সেই রাতে তিনি তাঁর ছেলেকে ডেকে বললেন, ‘‘আমি তোমাকে আল্লাহর উপর ভরসা করে রেখে যাচ্ছি; আর যে আল্লাহর উপর ভরসা করে, সে কিছুই হারায় না।’’ সিজদারত অবস্থায়ই তিনি মৃত্যু বরণ করলেন। এই ভঙ্গীতেই তাঁর পেশীগুলো জমে গেলো, তাই এভাবেই তাঁকে সিজদা অবস্থায় গোসল করাতে হলো। সিজদা অবস্থাতেই তাঁর জানাযার সালাত পড়া হলো, এইভাবেই তাঁকে কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হলো, এই ভঙ্গীতেই তিনি কবরে প্রবেশ করলেন।
রাসূল ﷺ বলেছেন, আমাদেরকে কিয়ামাতের দিন সে অবস্থায় উঠানো হবে, যে অবস্থায় আমরা মারা যাবো। কাজেই কিয়ামাতের দিন এই মহিলাটিকেও আল্লাহর সিজদায় অবনত অবস্থায় উঠানো হবে; কারণ আল্লাহর প্রতি অবনত হয়েই তিনি জীবনযাপন এবং মৃত্যু বরণ করেছেন।
এরকম আরো বহু মজবুত ঈমানে বলীয়ান মায়েদের, স্ত্রীদের, বোনদের ঘটনা রয়েছে, যা আমরা হয়তো জানি; এবং এমন আরও অনেকের কথা যা শুধু আল্লাহ জানেন। যখনই কোনো দ্বীনি সমাবেশ হয়, নারীদের সংখ্যা পুরুষের চেয়ে বেশি থাকে। অ্যামেরিকান ওপেন ইউনিভার্সিটিতেও শিক্ষার্থীদের মধ্যে অধিকাংশই মুসলিম নারী। যেকোনো ইসলামী শিক্ষক/স্কুলের সমাবেশে যান, অথবা কোনো দ্বীনি লেকচারের হালাকায় যান, ভাইদের তুলনায় বোনদের বেশি উপস্থিতির দৃশ্য আপনার চোখে পড়বে। মুসলিমাহ নারীদের তুলনায় পুরুষদের এমন উদ্যমহীনতা মাঝে মাঝে বড়ই দুঃখজনক মনে হয়। কিন্তু এই সবকিছুর মধ্যে আশাব্যঞ্জক ব্যাপার হলো, ইনশা আল্লাহ্, সেই বোনদের লালন পালনে ঈমানদার নারী পুরুষের বাহিনীর একটি প্রজন্ম গড়ে উঠবে। ওয়াল্লাহু আকবার!
ইমাম আহমাদ যখন খুব ছোট, তখন তাঁর বাবা মারা যান। তাঁর মা তাঁকে কীরকম কষ্ট স্বীকার করে লালন পালন করেছেন, সে কথা তিনি তাঁর ছাত্রদের কাছে বলতেন আর তাঁর জন্য দু’আ করতেন। বাগদাদের কনকনে শীতের রাতে তাঁর মা অনেক আগে আগে ঘুম থেকে উঠে পানি গরম করে রাখতেন, যাতে তাঁর ছেলে আহমাদ ফজরে উযু করতে পারে। তারপর ছেলেকে কম্বলে মুড়িয়ে, নিজে জিলবাবে আবৃত হয়ে তিনি অন্ধকার শীতল গলি ঘুপচি দিয়ে প্রধান মাসজিদে নিয়ে ফজরের অনেক আগেই ছেলেকে পৌঁছে দিয়ে আসতেন, যাতে তাঁর ছেলে ক্লাসে ভালো একটি জায়গায় বসার সুযোগ পায়। তাঁর ছেলে আহমাদকে দ্বিতীয়-তৃতীয় শ্রেণীতে থাকা অবস্থায় সারাদিন কুরআন ও সুন্নাহর পাঠ নিতে হতো। তাঁর মা তখন সারাক্ষণ বাইরে বসে অপেক্ষা করতেন, যাতে পড়া শেষ হলে নিরাপদে ছেলে বাড়ি ফিরতে পারে। ইমাম আহমাদ যখন ১৬ বছর বয়সে উপনীত হলেন, তাঁর মা তাঁর জন্য টাকা জোগাড় করে দিলেন আর সাথে কিছু খাবার দিয়ে বললেন, ‘‘তোমার জ্ঞান অন্বেষণের সফরে বেরিয়ে পড়ো।’’ তিনি মক্কা, মদীনা এবং আরো বিভিন্ন জায়গায় গেলেন, অনেক আলেমদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করলেন। তাঁর মায়ের অবদানে তিনি হয়ে উঠেছেন পৃথিবীময় সর্বজনস্বীকৃত ইসলামের চারজন বিখ্যাত ইমামের একজন।
প্রিয় বোনেরা, এ সবকিছুর পরে কোনো কাফিরকে জিজ্ঞেস করে দেখুন তো সে আপনার জন্য কী চায়। সে আপনাকে মুক্ত করতে চায়? কী থেকে মুক্ত করতে চায়? আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ﷺ এর কাছ থেকে? কুরআন এবং সুন্নাহ থেকে? জান্নাত থেকে? এই দ্বীন থেকে, যা আল্লাহ আপনার জন্য নির্ধারণ করেছেন?
আর এর পরিবর্তে সে আপনাকে কী দিতে চায়? সুখ? আল্লাহর কসম, সুখের মালিকানা তার হাতে নেই যে, সে তা আপনাকে দেবে। সে কি আপনাকে এমন ভালোবাসা দিতে পারবে, যা কবরের শাস্তি থেকে আপনাকে রক্ষা করে দেবে, কিংবা জাহান্নামের দ্বাররক্ষীদের কাছ থেকে, অথবা মৃত্যু থেকে? এমনই কেন হয় যে, তারা শুধু রূপ যৌবনে পরিপূর্ণ নারীদেরই মুক্তির স্বাদ দিতে উদগ্রীব? কেন তারা বৃদ্ধাদের মুক্ত করার কথা বলে না? কেন তারা আদিবাসী নারীমুক্তির কথা বলে না? কেন তাদের ‘মুক্তি’ বাণিজ্যের মূল টার্গেট অল্প বয়সী সুন্দরী নারীরা, যাদের বয়স ১৩-২৮ এর মধ্যেই? এবং কেনই বা তাদের প্রথম আহ্বান হয় হিজাব খুলে ফেলার?
এমন ‘বন্ধু’কে ভালো করে চিনে রাখুন। কারণ আল্লাহর কসম, নিঃসন্দেহে এই বন্ধুটিই হিসাব নিকাশের দিনে আপনার সবচেয়ে বড় শত্রু হয়ে আপনার সামনে দাঁড়াবে;
বন্ধুরা সেদিন হয়ে পড়বে একে অন্যের শত্ৰু, মুত্তাকীরা ছাড়া। [সূরাহ আয-যুখরুফ (৪৩):৬৭]
একজন কাফিরাহ অল্প কথায় তুলে ধরেছিলো নারীদেরকে আসলে কী চোখে দেখা হয়, ‘‘তুমি কে, তাতে কিছু আসে যায় না। বরং তুমি কেমন পোশাক পরো আর তুমি দেখতে কেমন – সেটাই আসল।’’ আর ফ্যাশান ইন্ডাস্ট্রির অন্ধকার জগত সম্পর্কে একজন ফরাসী ‘মডেল’ ফেবিয়ানের তিক্ত স্বীকারোক্তি শুনুন, ‘‘ফ্যাশন হাউজগুলো আমাকে একটি প্রদর্শনীর পুতুল বানিয়ে ফেলেছে, কাঠের পুতুল। এর উদ্দেশ্য : মানুষের মন নিয়ে সুতোয় বাঁধা পুতুলের মতো খেলা করা, চিন্তা চেতনা পরিবর্তন করে দেওয়া। আমি শিখেছি কীভাবে মূল্যহীন হয়ে যেতে হয়, অন্তঃসারশূন্য, শীতল হতে হয়। আমরা এক পঙ্কিলতায় পূর্ণ অন্ধকার জগতে বাস করি, যেখানে নোংরামিই সবকিছু।’’
রাসূল ﷺ যখন আরাফাতের ময়দানে দাঁড়িয়ে বিদায় ভাষণ দিলেন, তিনি উম্মাতের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন,
নারীদের সাথে সদ্ব্যবহার করো!
ইতিহাসে সংরক্ষিত হয়ে আছে যে, ঠিক এই বছরে এই সময়ে যখন ইসলামে এই কথা বলা হচ্ছিলো, ইউরোপে তখন খ্রিষ্টান পাদ্রীরা এই নিয়ে বাদানুবাদে ব্যস্ত ছিলো যে নারীরা কি মানুষ, নাকি জন্তু পর্যায়ের! এই পাদ্রীরা হলো তাদের পূর্বপুরুষ, যারা আজ আপনাকে ‘মুক্ত’ করতে এসেছে। অনেক কিছুই বলার আছে এ বিষয়ে। আজ শুধু এটা বলেই বিদায় নিতে চাই যে, রাসূল ﷺ প্রতিটি মা, স্ত্রী ও কন্যার উদ্দেশ্যে বলেছেন,
কোনো নারী যদি পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করে, রমাদ্বানের সিয়াম পালন করে, পর্দার হেফাজত করে, এবং স্বামীর অনুগত থাকে, তাকে বলা হবে, ‘‘যে দরজা দিয়ে খুশি, জান্নাতে প্রবেশ করো!’’
বোনেরা, এই জান্নাতই তো আপনারা চান।
হে বিশ্বাসীগণ! রাসূল যখন তোমাদেরকে এমন কিছুর দিকে আহ্বান করে, যা তোমাদের মাঝে জীবন সঞ্চার করে, তখন আল্লাহ ও রাসূলের আহ্বানে সাড়া দাও এবং জেনে রাখো যে, মানুষ ও তার হৃদয়ের মাঝে আল্লাহ অন্তরায় হন এবং তাঁরই নিকট তোমাদেরকে একত্রিত করা হবে। [সূরাহ আল-আনফাল (৮):২৪]
আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ﷺ আপনাকে জীবনের দিকে ডাকছেন। প্রিয় বোন, সাড়া দিন!
উৎস: কালামুল্লাহ ডট কম (মূল আর্টিকেল লিংক)
অনুবাদক: আমাতে রাব্বানী, মুসলিম মিডিয়া প্রতিনিধি
অনুবাদ কপিরাইট © মুসলিম মিডিয়া
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।