পাশ্চাত্যের চর্যাপদ
পশ্চিমা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন বলে ধারণা করা হয় মহাকাব্য দ্য ইলিয়াডকে। দ্য ইলিয়াড এর রচয়িতা কে, কেবল একজনই এর রচয়িতা কি না – এসব বিষয়ে ইখতিলাফ আছে। মেজরিটি স্কলারদের মতে এর রচয়িতা হোমার। স্পার্টার রাণী হেলেনের সাথে ট্রয়ের রাজকুমার প্যারিসের পরকীয়া এবং তার জের ধরে গ্রীক জোট ও ট্রয়ের মধ্যকার বিখ্যাত যুদ্ধের একাংশ নিয়েই এই মহাকাব্য। তবে এর কাহিনী বর্ণনা করা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। দ্য ইলিয়াড এর মাধ্যমে কীভাবে আজকের নিরীশ্বরবাদী সেক্যুলার চিন্তাকাঠামোর বিভিন্ন দিক ব্যাখ্যা করা যায়, এ নিয়েই আজকের আলোচনা।
নো সিঙ্গেল ট্রুথ
দ্য ইলিয়াড এর কাহিনীর চরিত্রগুলো বহুঈশ্বরবাদী পৌত্তলিক। গ্রীক জোট ও ট্রয়ের এই যুদ্ধে ঈশ্বরেরা সকলে মিলে কোনো এক পক্ষের সমর্থক নয়। প্রধান ও অপ্রধান দেবদেবীরা এখানে নিজ নিজ পছন্দের পক্ষকে – এমনকি পছন্দের ব্যক্তিকে – সাহায্য সহযোগিতা করে। ঈশ্বর বলতেই আমরা বুঝি সত্য-মিথ্যার মানদণ্ড নির্ধারণকারী। সকল দেবদেবী যদি ট্রয়ের পক্ষে থাকতো, তাহলে আমরা বুঝতাম ট্রয় হকের উপরে আছে। সকল দেবদেবী গ্রীক জোটের পক্ষে থাকলে বোঝা যেত গ্রীক জোট হকের উপর আছে। কিন্তু দেবদেবীদের কাউন্সিল এখানে দ্বিধাবিভক্ত। পুরো ঘটনায় তাই কোনো জাজমেন্ট দেওয়া যাচ্ছে না যুদ্ধরত দুই পক্ষের মাঝে কে আসলে যালিম, আর কে মাযলুম। এমনকি স্পার্টার রাজা মেনেলাউসের স্ত্রীকে ফুসলিয়ে নিজের করে নেওয়া প্যারিসকেও অপরাধী বলা যাচ্ছে না, কারণ সে এই কাজ করেছে দেবী অ্যাফ্রোডাইটির নির্দেশেই!
তাওহীদবাদী ধর্মগুলো ঠিক-বেঠিকের ব্যাপারে বড্ড একরোখা। আল্লাহ্ এক। তিনি যা হালাল করেছেন, তা হালাল; তিনি যা হারাম করেছেন, তা হারাম। ইজতিহাদি ব্যাপারে নানারকম মত শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করতে পারে, তবে মূল কাঠামো অপরিবর্তনীয়, সেখানে ভিন্নমত গ্রহণ-অযোগ্য। সেক্যুলার ধর্মের দর্শন এর বিপরীত। নানাজনের নানা মত, একই জিনিস কারো কাছে ঠিক এবং কারো কাছে বেঠিক হতে পারে। সাদা-কালোর মাঝে রয়েছে অনেক ধূসর অঞ্চল। তার মানে ‘সত্য’ কেবল একটি নয়, কোনো সত্যই পরম নয়। ‘সত্য’ অনেক। ‘বাস্তবতা’ অনেক। এর উদাহরণগুলোও চমকপ্রদ। আলো পড়লে কাউকে একটু বেশি ফর্সা লাগে। টিউবলাইটের আলোতে একরকম ফর্সা, সূর্যের আলোতে আরেকরকম। কোন আলোতে তার গায়ের আসল রঙ দেখা যাচ্ছে? বলতে পারেন কোনো আলো ছাড়াই যেরকম দেখা যায়, সেটাই আসল। কিন্তু বস্তুর উপর কোনো না কোনো আলো প্রতিফলিত হয়ে চোখে না আসলে চোখ তো কিছু দেখতেই পারে না! নিরীশ্বরবাদী দর্শন যেন এদিক থেকে সেই বহুঈশ্বরবাদী দর্শনেরই রি-ইনকার্নেশান।
আপাতদৃষ্টিতে সেক্যুলার দর্শন অনেক সহনশীল। অপরের মতকে শ্রদ্ধা করতে শেখায়। তবে সামগ্রিকভাবে একক সত্যের ধারণাটাকেই এভাবে ধ্বংস করে দেওয়ার ধারণাটা ভেতর থেকে দুর্বল। 6-কে উল্টো করে লিখলে 9 মনে হয়, M-কে উল্টো করে ধরলে W মনে হয়। যে 6M বলছে, তাকেও সম্মান করতে হবে; যারা 9W, 6W বা 9M বলছে, তাদের মতকেও সম্মান করতে হবে। কিন্তু দিন শেষে সবগুলোই সঠিক না। পঞ্চম ফ্লোরের ঠিক উপরের তলায় 6 লেখা থাকলে বুঝে নিতে হবে সেটি সিক্সথ ফ্লোর। আপনি মাথায় ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে সেটিকে নাইন পড়লেই আপনার মতকে সম্মান করা বাধ্যতামূলক না। সিক্সথ ফ্লোরে বসবাসকারী Max সাহেবের নাম আপনি উল্টো হয়ে xvW পড়লেই হয়ে গেলো না।
যে ব্যক্তি উপুড় হয়ে মুখের ভরে চলে, সে-ই কি অধিক সৎপথপ্রাপ্ত; নাকি যে সোজা হয়ে সরল-সঠিক পথে চলে, সে? [সূরাহ আল-মুল্ক (৬৭): ২২]
বর্ণ আর সংখ্যার এই উদাহরণটি কাল্পনিক। কিন্তু বাস্তব জীবনের ক্ষেত্রেও এই বিষয়টি সত্য। একক সত্যের ধারণাকে অস্বীকার করে জীবন চলে না। প্রথমে হয়তো ধর্মীয় কর্তৃত্বকে উৎখাত করার জন্য ‘বহু সত্যে’র এই ধারণাটি প্রচারিত হয়। কিন্তু একবার যখন ধর্মকে উৎখাত করে অধর্ম সিংহাসনে আরোহণ করে, তখন সেও নিজেকে একক সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। তখন ধর্মীয় সত্য দিয়ে সেক্যুলার ‘সত্য’কে আক্রমণ করলেই অধর্মের দাঁত-নখ বেরিয়ে আসে। স্পষ্ট হয়ে যায় যে, পরমতসহিষ্ণুতার সেক্যুলার মিথ আসলে কতটা দুর্বল।
আগেও বলা হয়েছে যে, ইসলামের একক সত্যের ভেতর ইজতিহাদগত বিভিন্ন বৈচিত্র্য থাকতে পারে। কিতাবে যেই সিদ্ধান্ত সরাসরি দেওয়া নেই, তা গবেষণা করে বের করতে গেলে দুজন গবেষকের মাঝে মতানৈক্য হতেই পারে – এটি প্রথম যুগ থেকেই ইসলামে স্বীকৃত। যার একটি উদাহরণ হলো একাধিক মাযহাবের অস্তিত্ব এবং একই মাযহাবের দুই বা ততোধিক ‘আলিমের মধ্যকার মতানৈক্য। মাযহাবগুলোর মধ্যে যত দাঙ্গা হয়েছে ও হচ্ছে, সেই ইতিহাসকে অস্বীকার করার কিছু নেই। কিন্তু মাযহাবের অস্তিত্ব এবং মাযহাবের ব্যাপারে উম্মাহর ‘আলিমগণের অ্যাপ্রোচ থেকেই বোঝা যায় ইসলামে পরমতসহিষ্ণুতার স্থান কত বিস্তৃত। তবে সেটি ঘটবে একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যেই। দুইজন দুই জায়গায় হাত বেঁধে পাশাপাশি সালাত পড়তেই পারে। কিন্তু আল্লাহ্ যে এক ও অদ্বিতীয় – এ নিয়ে কোনো ভিন্নমত গ্রহণযোগ্য নয়। আবার ইজতিহাদি বিষয়ে দুনিয়ায় অপরের মতকে সম্মান করে চলা যেতে পারে, কিন্তু আখিরাতে সঠিক ইজতিহাদকারী তার আমলনামায় দেখবে দুই নেকি এবং ভুল ইজতিহাদকারী পাবে এক নেকি। কাজেই অপরের মতকে সম্মান করার যেই বয়ান সেক্যুলার দর্শনের ধারকরা নিয়ে এসেছিলো, তার এক উন্নততর ও বাস্তবসম্মত সংস্করণ আগে থেকেই ইসলামে আছে।
নো হায়ার পারপাজ অব লাইফ
মেনেলাউস বয়স্ক লোক বটে। কিন্তু যুদ্ধের ময়দানের বীরত্বকে পুরুষত্ব হিসেবে ধরলে স্বামী হিসেবে সে নিতান্ত ফেলনা নয়। প্যারিস যে হেলেনকে খুব অত্যাচারী রাক্ষস স্বামীর হাত থেকে উদ্ধার করে ট্রয়ে নিয়ে গেছে, বিষয়টা এমন নয়। আবার যুদ্ধ পারে না বলে প্যারিসও যে স্বামী হিসেবে খুব খারাপ, তাও নয়। সে নারীদের মন ভোলাতে জানে, দেখতে সুন্দর, প্রেমদেবীর আশীর্বাদ ধন্য। তাই মেনেলাউস হেলেনকে কোনো ধ্বজভঙ্গ সন্ন্যাসীর হাত থেকে বাঁচাতে ট্রয়ের উপকূলে ধেয়ে এসেছে, এমনটাও বলা যায় না। দশ বছর স্থায়ী রক্তক্ষয়ী একটি যুদ্ধ বেঁধে গেলো কেবল দুজন (হেলেনকে সহ ধরলে তিনজন) মানুষের যৌনাকাঙ্ক্ষাকে ঘিরে। প্রায়-অমর অ্যাকিলিস ছিলো এই যুদ্ধে গ্রীক জোটের গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। জোটের নেতা অ্যাগামেমনোনের সাথে মনোমালিন্যের কারণে সে দীর্ঘ সময় যুদ্ধ থেকে হাত গুটিয়ে রাখে। মনোমালিন্যের কারণ হলো যুদ্ধবন্দিনী হিসেবে অ্যাকিলিস যেই মেয়েকে সেক্স-স্লেইভ হিসেবে পেয়েছিলো, অ্যাগামেমনোন তাকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। গোটা কয়েক খণ্ডযুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর অ্যাগামেমনোন মরিয়া হয়ে অ্যাকিলিসের সাহায্য চায়। নতুন সেক্স-স্লেইভ আর উপঢৌকন দিয়ে তার মন গলাতে চায়। অ্যাকিলিস গোঁ ধরে বসে থাকে যে, তার নিজের নৌবহর আক্রান্ত না হলে সে আর অস্ত্র তুলছে না। ঘটনাক্রমে তার ঘনিষ্ঠ অনুজ প্যাট্রোক্লাস নিহত হয় ট্রোজান যুবরাজ হেক্টর বিন প্রিয়ামের হাতে। গ্রীক শিবিরে খুশির জোয়ার বইয়ে দিয়ে যুদ্ধে পুনঃযোগদান করে অ্যাকিলিস। অর্থাৎ, যুদ্ধ এবং খণ্ডযুদ্ধগুলোর উদ্দেশ্য ছিলো কীভাবে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ও বস্তুগত সুখ লাভ করা যায়। পাশের দেশে শান্তি, সাম্য, ন্যায়বিচার ইত্যাদি প্রতিষ্ঠার মহৎ উদ্যোগ ছিলো না কোনোটিই।
সর্বোচ্চ বস্তুগত সুখ আস্বাদনকে জীবনের ধ্যান-জ্ঞান বানানোর এই দর্শন অনেক পুরনো। সংজ্ঞাগত কিছু পার্থক্য সহকারে এর নানারকম নাম রয়েছে। যেমন- হিডোনিজম, কনসিকোয়েনশিয়ালিজম, ইউটিলিটারিয়ানিজম ইত্যাদি। নিরীশ্বরবাদী চিন্তা এই দর্শনগুলোকে ঘিরে আবর্তিত হয়। প্রাচীন মতগুলোর সাথে আধুনিক সংস্করণগুলোর পার্থক্য হলো, আধুনিক সংস্করণে ‘অন্যের ক্ষতি না করে’ অংশটা যোগ করা হয়। অন্যের ক্ষতি না করে আপনি সর্বোচ্চ বস্তুগত সুখ আস্বাদনের জন্য যা খুশি, তা-ই করতে পারবেন। গ্রীক জোট আর ট্রয়ের যুদ্ধে উভয় পক্ষ এবং উভয় পক্ষের ভেতরের ব্যক্তিবর্গ চেয়েছে অন্যের ক্ষতি করে হলেও নিজে সর্বোচ্চ সুখ আস্বাদন করতে। আধুনিক নিরীশ্বরবাদীরা ‘অন্যের ক্ষতি না করে’ জীবনের সর্বোচ্চ মজা লোটাকে খারাপ কিছু মনে করে না। যত যা-ই হোক, যেহেতু তাদের মতে ঈশ্বর বলে কেউ নেই, আমাদের সম্পূর্ণ অস্তিত্বই প্রাকৃতিক নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার ফল, তাই উচ্চতর কল্যাণকর কোনো নিয়মসমষ্টিতে বিশ্বাস করে জীবনের মূল্যবান সময় নষ্ট করার কোনো দরকার নেই। এটার উদাহরণ দিতে একসময় সমকামিতা প্রসঙ্গ আনা হতো। কিন্তু এই বিষয়টিকে নিরীশ্বরবাদীরা এখন এতই হালকা করে ফেলেছে যে, এই উদাহরণ দিয়ে আর মানুষকে ভড়কে দেওয়া যায় না। তাই নতুন উদাহরণের দিকে ঝুঁকতে হচ্ছে। ২০১৮ সালের ৩রা মার্চ রিচার্ড ডকিন্স নরমাংসভোজনের ব্যাপারে টুইটারে কিছু কথা লিখেন। মৃত মানুষের আর কোনো ক্ষতি করা সম্ভব না। অন্যদিকে খাওয়াদাওয়া করলে জীবিত মানুষ পুষ্টি লাভ করে, তার ‘সুখে’র পরিমাণ বাড়ে। ধর্মীয় দর্শনগুলো নরমাংসভোজনের বিরুদ্ধে যেই ‘ট্যাবু’ তৈরি করেছে, টিশ্যু কালচারের মাধ্যমে উৎপাদিত নরমাংসের বাজারজাতকরণের মাধ্যমে ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের শেষ দিকেই সেই ট্যাবু ভাঙা যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন ডকিন্স।
আল্লাহ্প্রদত্ত একটি সীমায় বিশ্বাস না করলে বস্তুগত সুখ আস্বাদনের এই দর্শন আমাদের অকল্পনীয় সব জায়গায় নিয়ে যেতে পারে। গীবত করা হারাম। কেন হারাম? কাউকে না জানিয়ে তার নামে এমন কিছু সত্য কথা বলা হচ্ছে, যা শুনতে পেলে সে মাইন্ড করতো। কিন্তু শুনতে তো পাচ্ছে না। উল্টো গীবতকারীরা আড্ডা মারার মজা পাচ্ছে। তাহলে গীবত করলে সমস্যা কোথায়? সমস্যা হলো, আল্লাহ্ একে হারাম করেছেন। তাই তা করা যাবে না।
…একে অন্যের অনুপস্থিতিতে দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করো না। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের মাংস খেতে পছন্দ করবে? তোমরা তো সেটাকে ঘৃণাই করে থাকো।… [সূরাহ আল-হুজুরাত (৪৯): ১২]
পাথর-শীতল যুক্তির বিচারে গীবত এবং ক্যানিবালিজম – কোনোটাই ক্ষতিকর নয়। উল্টো উপকারী। তারেক মাসুদের একটা সিনেমায় ‘হিল্যা বিয়ে’ প্রথার যাঁতাকলে পিষ্ট এক যুবতী বুকফাটা কান্না করতে করতে তার বোন বা এমন কাউকে বলে, “আমারে বাঁসান, হে অমুক! আমারে বাঁসান!” (উল্লেখ্য, সিনেমা দেখা হারাম এবং সিনেমায় দেখানো হিল্যা প্রথার সাথে বিবাহ-তালাকের ইসলামী বিধানের পার্থক্য ব্যাপক। সে ভিন্ন আলোচনা।) যুক্তি আর বিজ্ঞানমনস্কতার এই যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে মানবতাও আজ সেভাবে কাঁদছে, “আমাকে বাঁচান! কেউ আমাকে বাঁচান!” যুক্তির এই জাহান্নাম থেকে বের হওয়ার একমাত্র উপায় হলো মানবপ্রজাতির যুক্তিবুদ্ধি ব্যবহারের ক্ষমতাকে সৃষ্টিজগতের চূড়া মনে না করা। মানুষের চেয়ে উচ্চতর জ্ঞানসম্পন্ন সত্ত্বার অস্তিত্ব স্বীকার করা এবং তাঁর দেওয়া সীমা-পরিসীমা মেনে চলা, তা যুক্তি ও বিজ্ঞানের বিচারে তা যতই অবোধ্য হোক। এমনকি যুদ্ধ করলেও তা ভূমি দখল বা লুটপাটের জন্য না করা। সেই উচ্চতর সত্ত্বার দেওয়া সর্বোচ্চ কল্যাণকর আইন-কানুন বাস্তবায়নের জন্য তা করা।
প্রোমোটেড টু গড
দ্য ইলিয়াড-এ উল্লেখিত ঈশ্বরদের মাধ্যমে হোমার কি সত্যিকারের ঈশ্বরই বুঝিয়েছেন, নাকি মানুষদের বিবেকের কণ্ঠটাকেই রূপক আকারে দেখিয়েছেন – এ নিয়ে স্কলারদের মতভেদ আছে। হোমারের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে অকাট্যভাবে কিছু জানতে না পারলে সে ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। পৌত্তলিকদের এই ধর্মীয় বিশ্বাসগুলো একদম দৃঢ়ভাবে কোনো কিতাবি নিয়ম-কানুনে বাঁধাধরা নয়। তাই এগুলোকে অর্গ্যানাইজড রিলিজিয়ন বলা হয় না, বলা হয় বিলিফ সিস্টেম। এসকল বিলিফ সিস্টেমে প্রায় প্রতিটি প্রাকৃতিক শক্তিকেই এক একটি দেব-দেবী হিসেবে কল্পনা করা হতো/হয়।
এগুলো তো কেবল কতগুলো নাম, যে নাম তোমরা ও তোমাদের পিতৃপুরুষেরা রেখেছো। এর পক্ষে আল্লাহ্ কোনো প্রমাণ নাযিল করেননি।… [সূরাহ আন-নাজম (৫৩): ২৩]
আজকের দিনে নিরীশ্বরবাদী কাঠামোতে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক যত মতবাদ রয়েছে, খুব স্পষ্টভাবেই এগুলো একেকটি ধর্ম, যাদের রয়েছে নিজস্ব মিথোলজি, ঈশ্বর, চিহ্ন, আচার-প্রথা ও বিধিনিষেধ। এরকম কিছু ধর্ম হলো পুঁজিবাদ, সমাজবাদ, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ইত্যাদি। এদের ‘ধর্ম’ বলার কারণ হলো, নৈর্ব্যক্তিক বাস্তবতায় কোনোরকম বস্তুগত অস্তিত্ব ছাড়াই কিছু জিনিস এখানে ‘বিশ্বাস’ করতে হয়। পুঁজি, প্রলেতারিয়েত শ্রেণী, দেশ – প্রতিটিই নিজ নিজ ধর্মের ঈশ্বর। আব্রাহাম লিংকন, কার্ল মার্ক্সরা নিজ নিজ ধর্মের নবী, যাদের আনীত শরিয়তকে সেই ধর্মের অনুসারীরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে। ডাস ক্যাপিটাল বা যেকোনো দেশের সংবিধান সেই সেই ধর্মের ধর্মগ্রন্থ। মানবাধিকার নামক একটি সেট অব রুলসে বিশ্বাস করা, বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাস করা, মাটি ও আকাশের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত অংশের একটি নির্দিষ্ট নাম আছে বলে বিশ্বাস করা – এগুলো সবই অন্ধবিশ্বাস। এদের পক্ষে কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। পার্থক্য হলো, পৌত্তলিকরা স্বীকার করে যে, তারা একটি ধর্মের অনুসারী। আধুনিক নিরীশ্বরবাদীরা তা স্বীকার করতে চায় না। ‘ইম্যাজিন আ ওয়ার্ল্ড উইদাউট রিলিজিয়ন’ কথাটা তাই অবাস্তব। স্বাধীনতা’কামী’ মানুষ যত দিকেই তাই ছোটাছুটি করুক, ধর্ম ও ঈশ্বরের হাত থেকে তার নিস্তার নেই। জেনে বা না জেনে সবাইই ধার্মিক, সবাইই কোনো না কোনো ঈশ্বরের উপাসক।
বিনোদনমত্ততা: সুন্দরী প্রতিযোগিতা ও অলিম্পিক গেইমস
এথিনা, হেরা এবং অ্যাফ্রোডাইটি তিনজন দেবী। রাজপুত্র প্যারিসকে তারা বিচারকের দায়িত্ব দেয় তাদের তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী কে, তা নির্বাচন করার জন্য। তবে প্যারিসের নিজস্ব বিচারবুদ্ধির উপর তা ছেড়ে দেওয়া হয়নি। তিনজন দেবীই তিনটি জিনিস অফার করেছে প্যারিসকে। যদি প্যারিস সেই দেবীকে সিলেক্ট করে, সে তাকে এই উপহার দেবে। তো অ্যাফ্রোডাইটি বলেছিলো তাকে নির্বাচন করলে সবচেয়ে সুন্দরী মানবীর সাথে প্যারিসকে মিলিয়ে দেবে সে। প্যারিস তাকেই সবচেয়ে সুন্দরী আখ্যা দিলো। কথা অনুযায়ী বিশ্বসুন্দরী হেলেনের সাথে প্যারিসের মিলনের পথ খুলে দেয় অ্যাফ্রোডাইটি। এ নিয়ে পরে গ্রীক জোট আর ট্রোজানদের যুদ্ধ বেঁধে গেলে এথিনা আর হেরা গ্রীক জোটের পক্ষ নেয়, অ্যাফ্রোডাইটি পক্ষ নেয় ট্রয়ের।
যুদ্ধের ফাঁকে ফাঁকে বিনোদন নিতে ভুলতো না কোনো পক্ষই। অবসর সময় পেলে সৈনিকেরা বিভিন্ন স্পোর্টসে মেতে ওঠে। গ্রীক শিবিরে আয়োজিত এমনই এক টুর্নামেন্টের দীর্ঘ বর্ণনা রয়েছে দ্য ইলিয়াড-এ। ঘোড়দৌড়, রথ প্রতিযোগিতা, তলোয়ারবাজি, তিরন্দাজী, কুস্তি সহ নানারকম প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। একেক ইভেন্টে অংশ নেয় সেই খেলায় দক্ষতম যোদ্ধারা। বিজয়ীদের জন্য ঘোষণা করা হয় মোটা অংকের পুরষ্কার। তখন তো আর ফিয়াট মানি ছিলো না। প্রাইজ হিসেবে দেওয়া হতো ঘোড়া, রথ, নারী, বর্ম, অস্ত্র, শিরস্ত্রাণ, স্বর্ণ বা রৌপ্য নির্মিত ট্রফি, মুদ্রা ইত্যাদি। পুরো সেনাবাহিনী মিলে উপভোগ করে একেক ইভেন্টে একেক যোদ্ধার ক্রীড়ানৈপুণ্য।
ঈশ্বরবিহীন একটি পৃথিবীতে যেহেতু বিনোদনই হলো অস্তিত্ববাদী আতংক ভুলে থাকার কার্যকর একটি উপায়, তাই নিরীশ্বরবাদ বিনোদনকে ব্যাপক গুরুত্ব দেয়। এই বিনোদনের বড় দুটি ময়দান হলো শোবিজ এবং স্পোর্টস জগত। সুন্দরী প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হতে বা নাটক-সিনেমায় ডাক পেতে হলে আগেই নানাভাবে পুরুষ বিচারকদের ঠাণ্ডা করতে হয়, যেমনটা করার চেষ্টা করেছে ওই তিন দেবী। আগে যুদ্ধের ময়দানের ফাঁকেই সক্রিয় যোদ্ধারা খেলাধুলা করতো। এখন গণতন্ত্রের যুগে রাজনীতির জটিলতা থেকে জনগণের মুখ ফিরিয়ে রাখতে আয়োজিত হয় এসকল গেইমস। বিনোদন জগতের ফলে অর্থনীতি সচল থাকে বটে, কিন্তু অর্থের সুষম বণ্টন হয়ে দারিদ্র্য হ্রাস পায় না। এই বাস্তবতা জানা সত্ত্বেও এগুলোর পেছনে বছর বছর কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ যায়। অল্প কিছু প্রতিবাদকারীর মিছিল, মানববন্ধন, স্লোগানের খবর পত্রিকার এক কোনায় থাকে যদিও।
ধর্মকে বিবেচনায় নিলে বিনোদনের উপর নানারকম বিধিনিষেধ আরোপিত হয়ে যায়। কিন্তু সেসব বিধিনিষেধে ঐশ্বরিক পরিমিতবোধের ছোঁয়া থাকায় তা মেনে চললে যেমন বিনোদনের অভাবে মানুষ দম বন্ধ হয়ে মারা যায় না, তেমনি জীবনের মূল উদ্দেশ্যকে ভুলে গিয়ে বিনোদনের সাগরেই ডুবে যায় না।
শুন্য ও একাধিকের মাঝে
দ্য ইলিয়াড এখানে কেবল উদাহরণ। বহুঈশ্বরবাদের সাথে নিরীশ্বরবাদের আঁতাত নিয়ে লিখতে চাইলে দিস্তার পর দিস্তা লেখা যায়। এখানে উল্লেখিত উদাহরণগুলোকে প্রাথমিক ছাঁচ ধরে পাঠক চাইলে এমন আরো সাদৃশ্য আবিষ্কার করতে পারবেন। দিনশেষে ওই এক-এ ফিরে যাওয়াটাই সমাধান।
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।