বেশিরভাগ মানুষ সমাজের প্রচলিত কমন ট্রেন্ডকে ফলো করে, ফ্যাশানকে অ্যাডোপ্ট করে। কিন্তু সেই ব্যাপারগুলোর ভিতরে ঢুকে না, খুঁজে দেখতে চায় না সেই ট্রেন্ডটার অরিজিন কী, সেই ফ্যাশনটা এলো কোথা থেকে; ভালো কিছু থেকে, না খারাপ কিছু থেকে; সত্য থেকে, না মিথ্যে থেকে।
এই যেমন ধরুন ক্রিসমাসের কথা। খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকে খোদ চার্চগুলোই জেসাস ক্রাইস্টের জন্মদিন পালন করতো না। চার্চ আসলে কারও জন্মদিন পালন করার জন্যই উৎসাহ দিতো না। বরং সম্মানিত ব্যক্তিদের প্রয়াণ দিবসগুলো ভাবগম্ভীর্যের সাথে পালন করার জন্য চার্চ বলতো। অর্থোডক্স ক্রিশ্চিয়ানরা করতোও সেটাই।
চতুর্থ শতকে কী যেন খেয়াল হলো চার্চগুলোর, জেসাস ক্রাইস্টের জন্মের স্মৃতিকে উপলক্ষ করে একটা ফিস্টের আয়োজন করলো। সেটা চললো ওই সারা শতক যাবত, প্রতিটা বছরেই।
তবে একটা চিন্তায় পড়ে গেলো চার্চগুলো। কারন জেসাস ক্রাইস্টের আসল জন্মতারিখ তো কেউই জানে না, যেহেতু চার্চ আগে জন্ম তারিখ-ফারিখ নিয়ে মাথা ঘামায়নি। কোন তারিখকে তারা তবে জেসাস ক্রাইস্টের জন্মদিন হিসবে ধরে নিবে? কোন সেই নির্দিষ্ট তারিখে ফিস্টের আয়োজন করা হবে?
পঞ্চম শতকে তাই পশ্চিমা চার্চগুলো সিদ্ধান্ত নিলো, ডিসেম্বর ১৭ তারিখ থেকে জন্মোৎসবের আমেজ শুরু করে একেবারে ঠিক ২৫ তারিখেই পালন করা হবে জেসাস ক্রাইস্টের জন্মদিন।
১৭ আর ২৫ এর তাৎপর্য কী?
ডিসেম্বর ১৭ তারিখকে বলা হয় ‘স্যাটারনালিয়া’। রোমান মিথোলজি অনুযায়ী, স্যাটারনালিয়া হচ্ছে প্রাচীন রোমানদের একটা ধর্মীয় উৎসব, কৃষি দেবতা ‘স্যাটার্ন’ এর জন্মদিন এদিনে, যেটা পালন করা হচ্ছিলো জেসাস ক্রাইস্ট আগমনেরও বহুবছর আগে থেকে। আর পালন করা হচ্ছিলো মানে একেবারে ঘটা করে পালন করা হতো জন্মদিনটা, সে এক এলাহি কারবার; মন্দিরে পশু বলি, ব্যাক্তিগত উপহার আদান-প্রদান, গ্যাম্বলিং, পার্টি, কার্নিভাল সবই থাকতো। মনিবরা তাদের দাসদাসীদের একটু ছাড় দিতো, আর বেচারাগুলোও একটু ফুর্তি করার সুযোগ পেতো।
বাঙালিদের যেমন একদিনের উরসে মন ভরে না, রোমানদেরও একদিনের উৎসবে মন ভরেনি। তাই স্যাটারনালিয়াকে টেনে ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হলো। উৎসবের এই একটা হপ্তাকে বলা হতো “best of the days”.
আর ২৫ তারিখের ব্যাপারটা হলো, দিনটা পার্সিয়ান দেবতা মিথ্রার জন্মদিন, যাকে বলা হতো ‘the Sun of Righteousness’. পার্সিয়ান এই মিথ্রাইক ধর্মটাও আবার বহু প্রাচীনকালের। সোজা কথায় দুটো ধর্মই ছিলো পেগানিযম, জেসাস ক্রাইস্টের জন্মের বহু বছর আগে থেকে চলে আসা।
পঞ্চম শতকে চার্চগুলো খেয়াল করলো, এই দুই দেবতার জন্মোৎসবের কারণে ডিসেম্বর ১৭ থেকে নিয়ে ২৫ পর্যন্ত সমাজে একটানা উৎসব চলতে থাকে। যেই ভাবা সেই কাজ, ডিসেম্বর ২৫ তারিখকেই চার্চ সেট করে দিলো জেসাস ক্রাইস্টের জন্মদিন হিসেবে। প্রচলিত উৎসবের মাঝেই ঢুকে পড়লো জেসাস ক্রাইস্টের জন্মোৎসব, সাধারণ মানুষ বেশ লুফেই নিলো ব্যাপারটা, চার্চের এত কিছুও আর কেউ খেয়াল করলো না। সাধারণ মানুষ লাফালাফি করার জন্য একটা উপলক্ষ চায় মাত্র। একটা তাদের দিলেই হলো।
লক্ষণীয় ব্যাপার এই, চার্চ কিন্তু শুধু ফিস্টের আয়োজন করেছিলো। পার্টি, উপহার দেওয়া-নেওয়া, ট্রি – ইত্যাদি কিছুই কিন্তু জেসাস ক্রাইস্টের জন্মোৎসবের সাথে সম্পর্কযুক্ত ছিলো না। বরং সেই দুই দেবতার জন্মদিন উপলক্ষে পেগানরা অনেক আগে থেকেই কাজগুলো করে আসছিলো। তিনটা উৎসব একদিকে ঠেলে দেওয়ার ফলে ক্রিশ্চিয়ানদের মধ্যে পেগানদের সেই সংস্কৃতি খুব সহজে ঢুকে যায়। ফলস্বরূপ আজকের এই জাঁকালো ক্রিসমাস দেখতে পাচ্ছেন আপনি। আর চার্চও কোনো ধরনের উচ্চবাচ্য করেনি এটা নিয়ে।
ডিসেম্বরের ২৫ তারিখে উৎসব পালনে রত গোটা পৃথিবীর ক্রিশ্চিয়ানরা হয়তো কল্পনাই করতে পারছে না যে, তারা আসলে জেসাস ক্রাইস্টের জন্মদিন পালন করছে না, করছে পেগান দেবতার জন্মদিন পালন। ওইদিন তাদের বলা প্রতিটা ‘মেরি ক্রিসমাস’ আদতে মিথ্রার কথাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে ইতিহাসবিদদের।
আরও অদ্ভুত ব্যাপার কী জানেন? জেসাস ক্রাইস্টের জন্মের তারিখই যে শুধু অজানা, তা নয়। বরং জন্মের সালটাও চার্চ ঠিকভাবে জানে না! আমাকে বেশ আমোদ দেয় ব্যাপারটা।
আপনি হয়তো ভাবছেন ২০১৪ সালে এসে বাইবেলে বর্নিত জেসাস ক্রাইস্টের বয়স বুঝি ২০১৪ হয়েছে। ব্যাপারটা ভুল।
খুব একচোট হিমশিম খেয়ে চার্চ আমতা আমতা করে এটা বলছে, জেসাস ক্রাইস্টের জন্ম খ্রিষ্টপূর্ব ৬ থেকে ৪ সালে। এর কোনো অর্থই আমি বুঝিনি। যার জন্মই হয়নি, তখন তার নামকে ভিত্তি করে জন্মের ৬/৪ বছর আগে কীভাবে সাল প্রণয়ন করা যায়? আর যদি বলা হয় জেসাস ক্রাইস্টের জন্মের ৪/৬ বছর পর থেকে খ্রিষ্টীয় সাল শুরু, তাহলে ওই ৪/৬ বছরকে কেন বাদ দেওয়া হলো?
যারা আমার কথাগুলো ধৈর্য নিয়ে পড়লেন, তাঁদের কাছে একটা সম্পূরক প্রশ্ন।
আচ্ছা বলুন তো, মানুষের জন্মদিন পালন করার চলটা কোথা থেকে তবে শুরু হলো? ক্রিশ্চিয়ানিটি থেকে নয়, অন্তত এটা তো জানলেন?
১. www.worldtruth.tv/the-truth-about-new-years-and-other-popular-holidays
২. www.ucg.org/bible-faq/when-was-jesus-christ-born-was-jesus-born-december-25-christmas-day
৩. www.en.wikipedia.org/wiki/Saturnalia
৪. www.en.wikipedia.org/wiki/Mithraic_mysteries
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।