শুক্রবার, জুমু’আর সালাতের জন্য মসজিদে অন্য দিনের চেয়ে অধিক মুসল্লির আগমন। ইমাম সাহেব বাংলায় খুৎবা দিচ্ছেন, সবাই মনোযোগের সাথে শুনছেন। প্রথমে বিভিন্ন হালাল-হারামের বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু করলেন। ইমাম সাহেব একের পর এক বলে যাচ্ছেন- সুদ হারাম, জুয়া হারাম, নেশাকর বস্তু হারাম, গান-বাজনা হারাম ইত্যাদি। এরপর বলতে শুরু করলেন জান্নাত-জাহান্নাম নিয়ে। জান্নাতের সৌন্দর্য ও ভোগ-বিলাসিতা, আর জাহান্নামের কাঠিন্য ও ভয়াবহতা নিয়ে অনেক কিছু বললেন। যেমন- জান্নাত কেবল বিশ্বাসীদের জন্যই, সেখানে কারো মৃত্যু ভয় থাকবে না, সেখানে কেউ অতৃপ্ত থাকবে না, সেখানে গরীবদের সংখ্যাই বেশি হবে, সেখানে শহীদগণই সর্বোচ্চ মর্যাদা পাবেন ইত্যাদি; আবার জাহান্নাম খুবই যন্ত্রণাদায়ক স্থান, সেখানে নিকৃষ্ট বান্দারাই থাকবে, সেখান কেউ মরবেও না বাঁচবেও না ইত্যাদি। সবশেষে সালাতের ব্যাপারে বললেন, সালাত ব্যতীত মুসলিম থাকা যায় না, কিয়ামতের মাঠে সালাতের হিসাবই প্রথম নেওয়া হবে, একজন অমুসলিম ও একজন মুসলিমের মধ্যে সালাত বড় একটি পার্থক্য ইত্যাদি।

উপরে (সংক্ষিপ্তভাবে) উল্লেখিত খুতবার মতো শতশত খুতবা আমরা ইতিমধ্যে শুনে ফেলেছি। কিন্তু এতসবের কতটুকু আমাদের উপর কার্যকর হয়েছে? এককথায় খুবই কম। মসজিদ থেকে বের হয়েই আমরা সবকিছু ভুলে যাই। এমনকি মসজিদটাও ভুলে যাই। এক সপ্তাহ পরে পারিবারিক চাপে কিংবা সামাজিকতা রক্ষায় আবার মসজিদের সাথে দেখা হয়। আর এই চক্রাকারেই চলতে থাকে আমাদের ধর্মীয় জীবন, মাঝখান থেকে হারিয়ে যায় গুরুত্বপূর্ণ কিছু নসীহা। তাই তো মসজিদ থেকে বের হতেই সুদ, ঘুষ, জুয়া, নেশা, নোংরামি সবই সমান গতিতে চলতে থাকে। তবে হারিয়ে যায় মহামহিম আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার দিকে ফিরে আসার উত্তম কথাগুলো, আর ভুলে যাই ওপারের সুন্দর ও পবিত্র জীবনটা।

IIRT Arabic Intensive

একদিন আল্লাহর রাসূল ﷺ বললেন, “তোমরা আল্লাহকে যথাযথভাবে লজ্জা কর।” সকলে বললো, “হে আল্লাহর নবী! আমরা তো আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহকে লজ্জা করে থাকি।” তিনি বললেন, “না, ঐরূপ নয়। আল্লাহকে যথাযথভাবে লজ্জা করার অর্থ এই যে, মাথা ও তার সংযুক্ত অন্যান্য অঙ্গ (জিভ, চোখ এবং কান) কে (অবৈধ প্রয়োগ হতে) হিফাযত করবে, পেট ও তার সংশ্লিষ্ট অঙ্গ (হাত, পা, হৃদয় ও লজ্জাস্থান) কে (তাঁর অবাধ্য আচরণ ও হারাম হতে) হিফাযত করবে এবং মরণ ও তার পর হাড় মাটি হয়ে যাওয়ার কথা (সর্বদা) স্মরণে রাখবে। আর যে ব্যক্তি পরকাল (ও তার সুখময় জীবন) পাওয়ার ইচ্ছা রাখে, সে ইহকালের সৌন্দর্য পরিহার করবে। যে ব্যক্তি এ সবকিছু করে, সে-ই প্রকৃতপক্ষে আল্লাহকে যথাযথভাবে লজ্জা করে।” [আহমাদ ৩৬৭১, তিরমিযী ২৪৫৮]

যেখানে সাপ্তাহিক এ খুতবাগুলো আমাদের পথনির্দেশ হওয়ার কথা ছিলো, কিন্তু তা না হয়ে এগুলো হয়ে গেছে অবহেলিত। যার প্রভাব আমাদের দৈনন্দিন জীবনে পড়তে শুরু করেছে। তাই আমরা মসজিদে তাওহীদের ঘোষণা দিলেও মসজিদ থেকে বের হয়েই নানারকম শির্ক ও কুফরিতে নিমজ্জিত হতে দ্বিধা করছি না। কারণ আমরা আল্লাহর ভয়ে মসজিদে না গিয়ে সামাজিকতা রক্ষার্থে মসজিদে যাচ্ছি কিংবা আমরা আমাদের প্রতিপালককে যথাযথ ভয় করছি না। তাই মসজিদ থেকে কল্যাণকর কোনো উপদেশ নিয়ে আসতে পারছি না। এজন্যই তো দেখা যায় খতিব সাহেব দাড়ি রাখার গুরুত্ব নিয়ে খুতবা দেওয়া সত্ত্বেও পরের সপ্তাহে ক্লিন শেভকে সুন্নাহ মনে করেই (অর্থাৎ, দাড়ি শেইভ করাকেই পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার অঙ্গ মনে করে।- সম্পাদক) অনেকে মসজিদে যাই। আবার পর্দার গুরুত্ব জেনেও মেয়েটার পর্দাহীন চলাফেরা ঠাণ্ডা মাথায় মেনে নিচ্ছি। যা খুবই দুঃখজনক।

বর্তমানে আরেকটি ট্রেন্ড দেখা যাচ্ছে যে, কেউ কেউ একদম সালাত শুরু হওয়ার পূর্ব মূহূর্তে দৌড়ে এসে উপস্থিত হয়। তাদের কারো কারো কাছে খেলা দেখা, মুভিটা শেষ করাই যেন অধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। তাই তারা সাপ্তাহিক এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ের গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো থেকে দূরেই থেকে যায়। অথচ আল্লাহর রাসূল ﷺ বলেন,

“যে ব্যক্তি জুমু‘আহ’র দিন ফরজ গোসলের ন্যায় গোসল করে এবং সলাতের জন্য আগমন করে, সে যেন একটি উট কুরবানি করলো। যে ব্যক্তি দ্বিতীয় পর্যায়ে আগমন করে, সে যেন একটি গাভী কুরবানি করলো। তৃতীয় পর্যায়ে যে আগমন করে, সে যেন একটি শিং বিশিষ্ট দুম্বা কুরবানি করলো। চতুর্থ পর্যায়ে যে আগমন করলো, সে যেন একটি মুরগী কুরবানি করলো। পঞ্চম পর্যায়ে যে আগমন করলো, সে যেন একটি ডিম কুরবানি করলো। পরে ইমাম যখন খুতবাহ প্রদানের জন্য বের হন, তখন মালায়িকা (ফেরেশতামণ্ডলী) যিক্র শ্রবণের জন্য উপস্থিত হয়ে থাকে।” [বুখারী, মুসলিম, আল লু’লু ওয়াল মারজান, হাদিস নং ৪৯৩]

জুমু’আর দিনের ফযিলত সম্পর্কে আমরা অনেক কিছুই জানি, যেমন- সাপ্তাহিক ঈদের দিন, সপ্তাহের শ্রেষ্ঠ দিন, দু’আ কবুলের বিশেষ মূহূর্ত ইত্যাদি। ইবনুল কাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) আরও বলেন, “অন্য মাসের তুলনায় রামাদ্বান মাসের মর্যাদা যেমন, সপ্তাহের অন্যান্য দিনের তুলনায় জুমু’আ বারের মর্যাদা ঠিক তেমন। তাছাড়া রামাদ্বানের কদরের রাতে যেমনভাবে দু’আ কবুল হয়, ঠিক তেমনি শুক্রবারের সূর্যাস্তের পূর্বক্ষণেও দু’আ কবুল হয়।” [যাদুল মা’আদ ১/৩৯৮]

তবে এই লিখার মূল মেসেজটি হলো- আমরা প্রতিনিয়ত যে গুরুত্বপূর্ণ সুযোগটি (অর্থাৎ সাপ্তাহিক জুুমু’আর খুতবাকে) অবহেলা করে যাচ্ছি, তা যেন আর না হয়। আমাদের দেশে অধিকাংশ মসজিদে আরবিতে খুতবা দিলেও এর পূর্বে বাংলায় কিছুু নসীহাত করা হয়। আর বিজ্ঞ খতিবগণ ঐ মূহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছুই বলে থাকেন, যা আমাদেরকে সহজ-সরল পথটির সন্ধান দিতে পারে। তাই সাপ্তাহিক এই সুযোগকে আমরা যেন কোনোক্রমেই অবহেলা না করি। প্রয়োজনে আমরা যেন কোনো বিজ্ঞ আলিমকে খতিব হিসেবে মনোনয়ন করি এবং তাঁর দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ নসীহাগুলো নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করি। আর আমাদের সম্মানিত খতিবগণও যেন তাঁদের খুতবাকে প্রথাগত খুুতবা হিসেবে না নেন এবং প্রতিটা খুতবাই যেন হয় আমাদের নিত্যদিনের পথ চলার স্পষ্ট দিকনির্দেশনা। আল্লাহ্ আমাদের জন্য সহজ করুন। (আমিন)

অবশেষে আমাদের সবার প্রতি আল্লাহ সুুবহানাহু ওয়া তা’আলার পক্ষ থেকে একটি রিমাইন্ডার-

‘হে মানুষ! কীসে তোমাকে তোমার মহান প্রতিপালক সম্পর্কে ধোঁকায় ফেলে দিয়েছে?’ [সূরাহ আল-ইনফিতার (৮২): ৬]

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive