আমরা প্রতিনিয়ত এমন কিছু মৃত্যু সংবাদ শুনি, যা শুনতে আমরা কখনোই প্রস্তুত থাকিনা। এই যেমন ব্রেইন স্ট্রোক, হার্ট এট্যাক, গাড়ি চাপার মতো কিছু আকস্মিক কারণে পরিচিত মানুষগুলো দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে ওপারে চলে যাওয়া। তবে এটাও সত্য যে আমাদের মতো বেখবর মানুষগুলোর জন্য মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকা খুবই কঠিন। কারণ আমরা এমন সব বিষয় নিয়ে প্রস্তুতি নিয়ে যাচ্ছি যা মৃত্যুকেই ভুলিয়ে দেয়। তাই মৃত্যুর ঠিক পূর্বমুহূর্তের সময়টাকে স্মরণ করতেই এই ছোট্ট লেখা, যা হয়তো অল্প কিছুক্ষণের জন্য হলেও আমাদেরকে মৃত্যু নিয়ে ভাবাবে। (ইনশা আল্লাহ তা’আলা)।

আমাদের প্রত্যেকের জীবনের একটি স্টেশন রয়েছে যা অবশ্যই অতিক্রম করতে হবে। আর তা অতিক্রম করার মাধ্যমেই আমাদের এই সফরের পরিসমাপ্তি ঘটবে। কিন্তু এই স্টেশনটা অতিক্রম করার ঠিক আগ মূহুর্ত পর্যন্ত নিজেকে বদলানোর সুযোগ থাকলেও এটা অতিক্রম করার সাথে সাথেই এই সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। আর শুরু হয়ে যায় অনন্ত জীবনের সেই পথযাত্রা। যে পথটা আমি সেই স্টেশন অতিক্রম করার পূর্বে তৈরি করে এসেছি। তাহলে বুঝতেই পারছি সেই স্টেশন অর্থাৎ অন্তিম মূহুর্তের পূর্বের সময়গুলো আমাদের জন্য কতোটা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সেই অন্তিম মূহর্তে যখন মৃত্যুদূত আমার সামনে উপস্থিত হয়ে যাবে তখন আমাকে আর পেছনে ফিরে তাকানোর সুযোগ দিবে না। আমি প্রস্তুত থাকি কিংবা না থাকি আমাকে আমার প্রতিপালকের ডাকে সাড়া দিতে হবে। যেমনটি আল্লাহ্ তা’আলা বলেছেন-

IIRT Arabic Intensive

সেদিন সবকিছুর যাত্রা হবে তোমার প্রতিপালকের পানে।  [সূরা আল কিয়ামাহ :৩০]

মৃত্যুর আগের সময়টার একটা নাম আছে, এটাকে বলা হয়, আল-ইহতিদার। এটি মৃত্যুর একদম পূর্বপর্যায়, এ পর্যায়ে মৃত্যুর ফেরেশতা জান কবজ করতে অবতরণ করে।আল-ইহতিদার পর্যায়ে যখন ফেরেশতারা অবতরণ করেন তখন মৃত্যুর দিকে অভিমুখী ব্যাক্তি তাকে দেখতে পায়। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেন,

মু’মিন ব্যাক্তি যখন দুনিয়া ত্যাগ করে এবং আখিরাতের দিকে যেতে থাকে তখন ফেরেশতারা উজ্জ্বল মুখে আসমান থেকে অবতীর্ণ হয়, তারা জান্নাত থেকে কফিন এবং সুগন্ধি নিয়ে আগমন করে তার পাশে বসে তাকে বলে, “হে পবিত্র আত্মা! আল্লাহর ক্ষমা আর সন্তুষ্টির দিকে ছুটে আসো”। এরপর মৃত্যু ফেরেশতা খুব কোমলস্বরে আত্মাকে দেহ থেকে বের হয়ে আসতে বলে এবং তার কাছে আল্লাহর ক্ষমা এবং সন্তুষ্টির প্রতিশ্রুতি দেয়।

রাসূল (সাঃ) বলেছেন, এই পবিত্র আত্মা খুব সহজে দেহ থেকে বের হয়ে আসবে, যেমনটা করে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে।
আর যারা পাপাচারী ব্যাক্তি এবং অবিশ্বাসী, সে যখন দুনিয়ার জীবন ত্যাগ করে আখিরাতের দিকে যেতে থাকবে, তখন মৃত্যুর অন্ধকার ফেরেশতা খসখসে কফিন নিয়ে আগমন করবে যেটা আমদানি হয়েছে জাহান্নাম থেকে। তার পাশে এসে বসে মৃত্যুর ফেরেশতা বলবেন,“হে পাপী আত্মা! আল্লাহ সুবহানু ওয়া তা’আলার ক্রোধ এবং রোষের দিকে ছুটে আসো।” তাকে বলা হবে যে, তোমাকে এখনই আসতে হবে এবং তোমার জন্য আল্লাহর ক্রোধ অপেক্ষা করছে।
যখন মৃত্যুর ফেরেশতা এই ঘোষণা করবে, তখন তার আত্মা দেহের মধ্যে ছুটে বেড়াবে আর সে বের হয়ে আসতে চাইবে না। মৃত্যুর ফেরেশতারা তখন তার আত্মাকে খপ করে ধরে টানতে টানতে নিয়ে যাবে, ভেজা পশমের মধ্য থেকে কাটাঁযুক্ত কিছুকে টেনে আনতে যেমন অবস্থা হয় তেমন। ভেবে দেখুন, আপনার কাছে কাটাঁময় কিছু একটা আছে, যেটাকে আপনি ভেজা পশমের মধ্য থেকে টেনে বের করে আনতে চাচ্ছেন! এটা সবকিছু ছিড়েই ফেলবে।তাই রাসূল (সাঃ) বলছেন, “যখন এই আত্মাকে টেনে বের করা হবে তখন যেন এটা মাংস এবং স্নায়ুকে ছিড়ে ফেলবে, কারণ এই আত্মা শরীর থেকে সহজে বের হতে চাইবে না।” এমনই কষ্টের হবে পাপাচারী আত্মার শেষ পরিণতি।

এই অন্তিম মুহূর্তটাতে মু’মিন ব্যাক্তিরাও খুব চিন্তিত থাকবে। তবে আল্লাহ সুবাহানুওয়া তা’আলা তাদেরকে প্রশান্তি দেবেন এবং তাদের সুসংবাদ দেবেন। ফলে তাদের শেষ নিঃশ্বাসটাও হবে অনেক কম কষ্টের। পক্ষান্তরে অবিশ্বাসী ও পাপাচারীদের সেই মূহর্তটা হবে অনেক কষ্টের ও আক্ষেপের। অথচ তখন মাত্র তারা সেই অনন্ত পথে যাত্রা শুরু করেছে। তাহলে তাদের সামনে অপেক্ষমান সময়গুলো আরও কতই না দুঃখ-কষ্টের হবে। তখন সবাই আক্ষেপ করবে যদি একটু পেছনে ফিরে যাওয়া যেত। তাহলে নিজের মন্দকর্মগুলোর জন্য অনুতপ্ত হতাম, অনেক ভালো কাজ করতাম, কখনো কারো হক্ব নষ্ট করতাম না। কিন্তু এগুলো এখন আক্ষেপের বিষয় ছাড়া আর কিছুই না। কারণ প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা তাদেরকে এসব বিষয় ভুলিয়ে রেখেছিল। আর এ অবস্থাতেই তাদের অন্তিম মুহূর্ত আমাদের সামনে হাজির হয়ে গেছে। যা উপেক্ষা কিংবা বিলম্বিত করার কোন সুযোগ ছিলো না। যে আল্লাহ্ তা’আলা বলেন-

প্রাচুর্যের লালসা তোমাদেরকে ভুলিয়ে রেখেছে, এমনকি তোমরা কবর পর্যন্ত পৌঁছে যাও। এটা মোটেই ঠিক নয়, তোমরা সত্ত্বরই জানতে পারবে। অতঃপর এটা মোটেই ঠিক নয়, তোমরা সত্ত্বরই জেনে নেবে। [সূরা তাকাসূর: ১-৪]

অর্থাৎ দুনিয়ার প্রতি অধিক ভালোবাসা, দুনিয়া পাওয়ার অত্যাধিক প্রচেষ্টা আমাদেরকে আখিরাতের প্রত্যাশা এবং সৎকাজ থেকে বেপরোয়া করে দিয়েছে। এমনকি এসব ঝামেলায় থাকতেই হঠাৎ মৃত্যু এসে আমাদেরকে কবরে পৌঁছে দিচ্ছে। আর তা কখনোই কল্যাণকর নয়। কারণ প্রস্তুত বিহীন পরীক্ষার ফলাফল খারাপই হয়।

পরিশেষে এতটুকুই বলবো যে- মৃত্যুকে ভয় পাওয়া মানে এ থেকে পালিয়ে বেড়ানো নয় বরং এর জন্য প্রস্তুতি নেয়া। আর মৃত্যুর স্মরণ আপনাকে দুনিয়ার সাময়িক ভোগ-বিলাসিতায় কিছুটা বাধাগ্রস্ত করলেও আখিরাতের চিরস্থায়ী ভোগ-বিলাসিতা এনে দিতে পারে খুব সহজেই। যেমনটি মৃত্যু সম্পর্কিত কুরআনের আয়াত ও হাদীসগুলোতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কুরআনুল কারীমে আল্লাহ্ তাআ’লা বলেন-

বলুন, তোমরা যে মৃত্যু থেকে পলায়নপর, সেই মৃত্যু অবশ্যই তোমাদের মুখামুখি হবে, অতঃপর তোমরা অদৃশ্য, দৃশ্যের জ্ঞানী আল্লাহর কাছে উপস্থিত হবে। তিনি তোমাদেরকে জানিয়ে দিবেন সেসব কর্ম, যা তোমরা করতে। [সূরা আল জুমুআহ : ৮]

রসুলুল্লাহ (স) বলেন-

হে মানব সম্প্রদায়! সুখ বিনাশকারী মৃত্যুকে বেশি বেশি করে স্মরণ করো। [তিরমিজি, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ]

রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হলো- হে আল্লাহর রসুল! সবচাইতে বুদ্ধিমান লোক কে? তিনি (স) বললেন-

যে ব্যক্তি অধিকহারে মৃত্যুকে স্মরণ করে এবং মৃত্যু পরবর্তী জীবনের প্রস্তুতি গ্রহণে ব্যস্ত থাকে। [ইবনে মাজাহ]

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive