‘Legacy’ ইংরেজি ভাষার একটি ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ। সাধারণভাবে এর অনুবাদ করা হয়ে থাকে ‘উত্তরাধিকার’, ‘ঐতিহ্য’ ইত্যাদি। তবে ব্যাপক অর্থে লেগেসি বলতে বুঝায় পূর্ববর্তীদের যে সমস্ত কাজের ফলাফল যুগ যুগ ধরে পরবর্তী প্রজন্মকে বয়ে নিতে হয়। লেগেসি শব্দটা অত্যন্ত তাৎপর্যবহুল একটি শব্দ। কারণ এ শব্দটা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় আজকের মুসলিম উম্মাহর অবস্থার পুরোটার জন্যে আমরা দায়ী নই।

আজকের মুসলিম জাতিসত্তার যে করুণ দশা তার অন্যতম কারণ আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মগুলো এবং আমরা আসলে তাদের লেগেসি বহন করে চলেছি। এভাবে আমাদের সমাজে আপনি খেয়াল করে দেখবেন, যে কিশোরটি আজ দূরদর্শী চিন্তা না করে অলসতায় দিন কাটাচ্ছে এবং বাপের টাকায় ফূর্তি করে যাচ্ছে, অনেক বছর পর যখন তার সন্তানটি কৈশোরে পা দিবে তখন তাকে বাবার লেগেসি টানতে হবে। আজকের হতভাগা সন্তানটি যেভাবে চিন্তা করছে তার বাবা যদি ভাল কিছু করে যেতো তবে হয়তো তাকে এতো কঠিন সময় পার করতে হতো না, ঠিক এভাবেই আজ আমরা মুসলিম জাতি লেগেসি টানতে টানতে চিন্তা করছি পূর্ববর্তী প্রজন্মগুলো এভাবে হেলায় ফেলায় না কাটিয়ে অধ্যাবসায়ী হলে হয়তোবা এখনোও জ্ঞানের রাজ্যে ইবনে সিনা, ইবনে রুশদ, আল-খাওয়ারিজমি আমরাই সৃষ্টি করতাম।

IIRT Arabic Intensive

এখন প্রশ্ন হচ্ছে আজকে আমরা মুসলিম যুবকেরা কি আক্ষেপ করতে করতে করতেই সময় ক্ষেপণ করব? নাকি উম্মাহর দুরবস্থার কারণ ও এ থেকে উত্তরণের পথ গুলো কী কী তা জানার চেষ্টায় রত হব? অবশ্যই আমাদের সবারই মনের কথা হচ্ছে দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর। অর্থাৎ, আমাদের চিন্তা গবেষণায় লিপ্ত হয়ে পতনের কারণ অনুসন্ধান করতে হবে। আর উম্মাহ নিয়ে চিন্তা করা তো সকল নবীরই সুন্নাহ। যুগে যুগে যত নবী এসেছেন তাঁরা সবাই নিজ নিজ উম্মাহ নিয়ে ভেবেছেন। চিন্তায় লিপ্ত হয়েছেন এ নিয়ে যে কীভাবে এ জাতির মুক্তি আসবে। আমাদের রাসুল মুহাম্মাদ (সাঃ)ও নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বে হেরা গুহায় সাধনা করেছেন জগতকে চেনার ও সমস্যাগুলোকে বোঝার আশায়।

আজকের সমাজে আমাদের পতনের কারণগুলো কী এবং এ থেকে উতরানোর উপায়ই বা কী হবে তা আমরা কীভাবে জানতে পারি? নিশ্চয় অনেকের মাঝেই এ প্রশ্নগুলো এসে থাকতে পারে। আবার অনেকের হয়তো এ নিয়ে মাথা ব্যাথাই নেই। কিন্তু আমরা সবাই যদি ঐক্যবদ্ধভাবে আমাদের মূলে ফিরে না যাই এবং জানতে না পারি কিভাবে আমাদের জাতিসত্তার শেকড় উপরে ফেলা হয়েছিল তাহলে কখনোই এ অবস্থা থেকে উত্তরণের সম্ভাবনা নেই। তাহলে উপরোক্ত প্রশ্নগুলোর উত্তর কোথায় পাওয়া যাবে? একবাক্যে বলতে গেলে এ প্রশ্নগুলোর জবাব আমরা পাবো আল কোরআনে, আল হাদীসে এবং আত-তারীখে(ইতিহাস) ।

আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল বলেন,

لقد انزلنا اليكم كتابا فيه ذكركم افلا تعقلون

“নিশ্চয়ই আমি তোমাদের কাছে প্রেরণ করেছি এক কিতাব যেখানে তোমাদের কথাই বিদ্যমান, তবুও কি তোমরা চিন্তা করে দেখবে না?” [সূরা আম্বিয়া(২১): ১০]

এভাবেই কোরআনের পাতায় পাতায় আমাদের লেগেসি রয়ে গেছে। কুরআনের পাতায় পাতায় আল্লাহ বলেছেন আমাদেরই কথা, আমাদের বাবা আদমের কথা, আমাদের জাতির পিতা ইবরাহিমের কথা এবং বিপথগামী কওমের কথা। এবং আমাদের ভুলগুলোর কারণেই যে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বাজে লেগেসিগুলো বহন করতে হয় তারো ইঙ্গিত রয়ে গেছে। এগুলো নিয়ে কি আমরা চিন্তা করেছি? অথচ কোরআনে কি আল্লাহ বলেননি, “নিশ্চয়ই এর (কুরআন) মধ্যে নিদর্শন রয়েছে তাদের জন্য যারা চিন্তাশীল”? কুরআন কি শুধু সাওয়াব হাসিলের কিতাব হিসেবেই নাযিল হয়েছিলো যে সপ্তাহান্তে বা ফি বছর একবার খতম করলেই এর অধিকার খতম(!) হয়ে যাবে? অথচ কোরআন খতমের নামে আমরা এর আসল উদ্দেশ্য ভুলে গিয়ে নিজেদের অস্তিত্বকেই খতম করছি। কুরআন পড়ে কি আমাদের কখনোই মনে হয়নি যে আমাদের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাহিনিগুলোও জানা উচিৎ? যদি মনে না হয়ে থাকে আবার কুরআন পড়ুন এবং এ নিয়ে তাদাব্বুর এবং তাফাক্কুর করুন।

একটি জাতি যখন আত্মবিস্মৃত হয়ে যায় তখন তার অধঃপতন নেমে আসে। এমনই একটি জাতি ছিল বানি ইসরাইল। তারা যখন নিজেদের কথা ভুলে গেলো তখন অধঃপতনের অতল গহবরে নিমজ্জিত হলো। তাই আল কোরআনে আল্লাহ তাদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন, يا بني إسرائيل الذكروا. অর্থাৎ “হে বনি ইসরাইল! স্মরণ কর।” [সূরা বাকারা(২): ১১২]  অর্থাৎ আল্লাহ তাদেরকে পূর্বপুরুষদের কথা স্মরণ করতে বলেছেন।

মুসলমান জাতিও আজ আত্মভোলা ও উচ্ছন্নে গিয়ে নিজেদের ঐতিহ্যগুলোকে হারিয়ে এক বল্গাহারা মেষের মত আচরণ শুরু করছে। অথচ আমরা যদি আমাদের গৌরবজ্জ্বল অধ্যায়গুলোর কথা না জানি তবে কী করে আমাদের মাঝে আত্মবিশ্বাস এবং নতুন কিছু করার উদ্যম আসবে? নিজেকে ভুলে গিয়ে আজ আমরা অন্য জাতির গোলামে পরিণত হয়েছি এবং তাদের সকল কথাই ‘জো হুকুম মহাশয়’ রূপে গ্রহণ করছি। তাছাড়া আজকের মুসলমানদের তথাকথিত শিক্ষিত ও সচেতন শ্রেণীরও অন্যতম একটি সমস্যা হচ্ছে তারা যখনই কোন লেখনী বা বক্তৃতা বিবৃতিতে কোন মহৎ ঘটনার উদাহরণ দিতে চায়, তখন অবচেতন মনেই ইউরোপীয় খ্রিষ্টান কোন মনীষীর নাম চলে আসে। অথচ ইসলামের ইতিহাসে এদের চেয়ে হাজার গুণ উঁচু মনীষীদের সন্ধান মেলে। কিন্তু আমরা সে সম্পর্কে অজ্ঞ।

বিখ্যাত লেখক মাওলানা আকবর শাহ খান নজিবাবাদি বলেন , “মুসলমানদের এই অজ্ঞতা ও উদাসীনতার কারণ হচ্ছে প্রথমত এমনিতেই অন্যান্য জাতির তুলনায় মুসলমানদের জ্ঞানস্পৃহা কম। দ্বিতীয়ত, জ্ঞানান্বেষণের সুযোগ ও অবকাশও তাদের নেই। তৃতীয়ত, সরকারী কলেজ ও স্কুলগুলো ইসলামী শিক্ষায়তনগুলোকে ভারতবর্ষে প্রায় অস্তিত্বহীন করে দিয়েছে। চতুর্থত, মুসলমানদের যে শ্রেণীটিকে সাধারণত শিক্ষিত বলা হয়ে থাকে এবং মুসলমানদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় বলে গণ্য করা হয় তাদের প্রায় সকলেই এমন শিক্ষায়তনমূহে লেখাপড়া করে এসেছেন, যেগুলোতে ইসলামের ইতিহাস পাঠ্যভুক্ত নয়। আর থাকলেও ইসলামের ইতিহাস পদবাচ্য নয়, অন্য কিছু। অথচ তাকে ইসলামের ইতিহাস বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে।”[]

এসমস্ত কারণে আমাদের শিক্ষিত মুসলিমদের বিকৃত ও ইসলামের শত্রু কর্তৃক রচিত বইগুলোর উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। অথচ মুসলমানদের পূর্বে অন্য কোন জাতির সৌভাগ্য হয়নি যে, ইতিহাসকে একটা শাস্ত্র হিসেবে দাঁড় করাবে। ইতিহাস রচনায় মুসলিমদের প্রথম কীর্তি ছিল ইলমে হাদীসের বিন্যাস সংকলন। এর জন্যে তৎকালীন মুসলিমরা ‘উসূলে হাদীস’ ও ‘আসমাউর রিজাল’ শাস্ত্রের উদ্ভব ঘটান। সেসব নিয়মের ভিত্তিতেই মুসলিম উম্মাহর আমীর উমারাহ ও মনীষীগণের জীবনচরিত লেখা হয়েছিল। আর আজ আমরা আমাদের গৌরব সম্পর্কে সম্পূর্ণ অনবগত হয়ে শেকড়কাটা হিসেবে পরিগণিত হচ্ছি।

মাওলানা আকবর শাহ বলেন, “আজ ইউরোপীয় ঐতিহাসিকদের ইতিহাস শাস্ত্রের অনেক খুঁটিনাটি তত্ত্ব নিয়ে নাড়াচাড়া করতে দেখা যায়। মুসলমানরা তা দেখে অনেকটা হচকচিয়ে যান এবং পূর্ণ আন্তরিকতার সাথে তাদের স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন। কিন্তু তাঁদের একথাটিও জানা নেই যে, উত্তর আফ্রিকায় বসবাসকারী জনৈক স্পেনীয় আরব বংশোদ্ভুত মুসলিম ঐতিহাসিক ইবন খালদূনের ইতিহাসের ভূমিকা ‘মুকাদ্দামায়ে তারীখ’ এর উচ্ছিষ্ট ভোগই গোটা ইউরোপ তথা গোটা বিশ্বকে ইতিহাস শাস্ত্র সম্পর্কে এমনই জ্ঞান দান করেছে যে ইউরোপিয় ঐতিহাসিকদের সমস্ত ঐতিহাসিক গবেষণাকর্মকে ইবনে খালদূনের মাজারের ঝাড়ুদারকে অর্ঘ-স্বরুপ বিনীতভাবে পেশ করা চলে।”[২]

ইতিহাস পাঠের গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা পূর্ববর্তী প্রজন্মের প্রেরণা জাগানিয়া কাহিনিগুলো আমাদের মন ও মননে এক শুভ উদ্দীপনার সঞ্চার করে। ইতিহাস পাঠে সাহস ও আত্মপ্রত্যয় বৃদ্ধি পায়। জ্ঞান ও প্রজ্ঞার বিকাশ ঘটে। এবং যুগে যুগে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর বিশ্লেষণ করে বুঝতে পারি কী কারণে আজ আমাদের এই অবস্থা। এবং এসব সমস্যার সমাধানই বা কী।

প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনে খালদুন তার ‘আল মুকাদ্দিমায়’ বলেন, “ইতিহাসই আমাদের সামনে সৃষ্টিজগতের অবস্থা বর্ণনা করে যাতে আমরা অনুধাবন করতে পারি যে, কীভাবে (কালচক্রের আবর্তনে) সকল বস্তু ও বিষয় নিয়ত পরিবর্তিত হয়। কীভাবে একটি রাষ্ট্রশক্তির উত্থান ঘটে এবং কীভাবে এর পতন অবধি পৃথিবীতে সমৃদ্ধি আনয়ন করে এবং কীভাবে কালের অমোঘ বিধানে তা ধ্বংস হয়ে যায়।”[৩]

কোরআনের পাতায় পাতায় বিভিন্ন জাতির পতনের কারণ বলা হয়েছে। এগুলো কেন বলা হয়েছিল? মা যাতে শিশুকে ঘুমপাড়ানি গান হিসেবে এগুলো বলে এই কারণে কি এসব বলা হয়েছে? অবশ্যই নয়। বরং আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিন আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন কোন পথে গেলে ধ্বংস অনিবার্য আর কোন পথে রয়েছে জান্নাতে যাবার সোপান।

তাই আজ মুসলিম উম্মাহর সন্তানদের সময় এসেছে  নবোদ্যমে ইতিহাস পাঠ করার, নিজেদের মূল কোথায় তা খুঁজে বের করার, যেন আগামী প্রজন্মগুলোকে আমাদের কারণে বাজে লেগেসি বহন করতে না হয়।


গ্রন্থসূত্র:

[১] ইসলামের ইতিহাস(প্রথম খন্ড)-পৃঃ ২৩,৩৪

[২] প্রাগুক্ত-পৃঃ ২৫

[৩] মুকাদ্দিমা-পৃঃ১৩

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive