একজন প্র্যাক্টিসিং মুসলিম হতে গিয়ে আমাকে প্রায়ই ইসলাম এবং দুনিয়াবী শিক্ষা নিয়ে দোটানায় পড়তে হয়। এটা বুঝতে কারো সমস্যা হওয়ার কথা না যে একজন তাওহীদে বিশ্বাসীর কাছে স্বাভাবিকভাবেই প্রথমটার প্রতিই পরেরটার তুলনায় বেশি আগ্রহ থাকবে।
এর অবশ্যই কিছু কারণ আছে। এর মধ্যে অন্যতম সুস্পষ্ট কারণ হলো ইসলামী জ্ঞানার্জনের সাথে সাথে অসংখ্য নেকি লাভের সুযোগ রয়েছে যা পবিত্র কুরআন এবং নবীজীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সুন্নাহ’য় বর্ণিত হয়েছে। আমার ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও বলতে পারি, ইসলামী জ্ঞান মনের মধ্যে একটা প্রশান্তির জন্ম দেয় যা আমি কখনও মুনাফা কিংবা আনুপাতিক হার বিশ্লেষণ করে পাইনি (আমি বাণিজ্যের ছাত্র)। ইসলামকে জানতে যেরকম আনন্দ পাই, যেরকম উৎসাহ কাজ করে আমার মধ্যে, তা আমার নিজের পড়াশোনার ব্যাপারে কখনোই কাজ করে না। আসলে এই দুই ধরনের শিক্ষার মধ্যে তুলনামূলক বিচার করতে যাওয়াটাই ভুল। তদুপরি, সাধারণ শিক্ষা শেষ বিচারের দিনে আমাদের জন্য এক চুল পরিমাণ উপকারও বয়ে আনবে না (আবার আনতেও পারে … পড়তে থাকুন!)
যা-ই হোক, সম্প্রতি আমার প্রিয় একজন স্কলারের ছোট্ট একটা ক্লিপ দেখেছি। আমার নিজের ভেতরকার এই দ্বিধা-দ্বন্দ্বের ব্যাপারে তিনি সেখানে একটা চমৎকার উপলব্ধির কথা বলেন। ক্লিপটা থেকে আমি যা শিখেছি তার সারাংশ এখানে তুলে দিলাম:
সবাই-ই কিছু না কিছু করতে পারে
সব মুসলিম কিন্তু আল-আযহার কিংবা মদীনা ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে ইসলামী জ্ঞান শিক্ষা করা এবং ইসলামী ক্যারিয়ার গড়ার জন্যে তৈরি হয়নি। আমাদের যে যেই বিষয়ে বিশেষভাবে দক্ষ, সেই কাজে নিযুক্ত থেকে এবং সেই নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে সফল হয়ে আমরা মুসলিম উম্মাহর উপকারে আসতে পারি। এজন্যে আমাদের ব্যক্তিগত সামর্থ্য এবং দুর্বলতাগুলো খুঁজে বের করতে হবে।
নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সময়ে সাহাবীরা সবাই ‘সব বিষয়ে’ পারদর্শী ছিলেন না। উদাহরণ দিলে আরো পরিষ্কার হবে, চলুন একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরি। খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ) ছিলেন যুদ্ধবিদ্যায় অভিজ্ঞ আর আবু হুরায়রা (রাঃ) এর দক্ষতা ছিলো হাদীস বর্ণনায়। উম্মাহ দুজনেরই ভিন্ন ভিন্ন দক্ষতার থেকে উপকৃত হয়েছিলো। যা আমাদেরকে আজও স্মরণ করিয়ে দেয় যে, বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের একটা সুষম সমন্বয় বর্তমান সময়েও উম্মাহর জন্য প্রয়োজন।
এসত্ত্বেও, এটাই সবকিছু না। আবার একেবারে কিছুই না, তা-ও না। কিছু লোক বলতে পারে, “খুতবাহ দেওয়ার যোগ্যতা তো আমার নেই।” ঠিক আছে, এ কথা সত্য হতে পারে, কিন্তু আপনি তো আপনার এলাকায় একটা খুতবাহর আয়োজন করতে পারেন। ইসলামী বয়ানের জন্য মঞ্চ সাজাতে অথবা মাল্টিমিডিয়া সেট করতে আপনি পারেন না? এমন অনেক কিছুই আছে যা আপনি করতে পারেন।
সুতরাং, আমার মুসলিম ভাই ও বোনেরা, আপনারা যারা আমার মতো করে নিজের মনের সাথে বিতর্ক করছেন, এজন্য হতাশ হয়ে যাবেন না যে আপনি হয়তো আলিম হতে পারবেন না। এটুকু জেনে রাখুন এই উম্মাহ’র অনেক কিছুই করার আছে আর আপনি বর্তমানে যে ক্ষেত্রে আছেন সেখান থেকেই তা করতে পারেন, ইনশা আল্লাহ! যদি আপনি একজন ডাক্তার হয়ে থাকেন তাহলে অসংখ্য অসুস্থ মুসলিমদের এবং আরো বড় পরিসরে অমুসলিমদেরও সেবা দিতে পারবেন। যদি আপনি প্রকৌশলে পড়াশোনা করে থাকেন, তাহলে আপনি বিনা পয়সায় নতুন নতুন মসজিদ বানাতে সহযোগিতা করতে পারেন বা নতুন মসজিদের ডিজাইন করে দিতে পারবেন। ব্যবসার ক্ষেত্রে যদি আপনি সেরা হয়ে ওঠেন, অনেক বেকারকেই আপনি চাকরি দিতে পারবেন। আসলে আমাদের ধারণার থেকেও বেশি সুযোগ রয়েছে কাজ করার! নিঃসন্দেহে মনে কোনো রকম সংশয় না রেখে সঠিক নিয়তে এরকম কোনো কাজের সাথে যুক্ত হলে দুনিয়া এবং আখিরাত দু’ক্ষেত্রেই আমরা লাভবান হবো, ইনশা আল্লাহ।
দুনিয়াবী শিক্ষারও দরকার আছে
অধিকন্তু, আমি আরও একটি বিষয় এর সাথে সংযুক্ত করতে চাই। আমি প্রায়ই এই কথা শুনতাম যে, সাধারণ বিজ্ঞান শিক্ষা যেমন রসায়ন, গণিত ইত্যাদি নিশ্চিতভাবেই বিচার দিবসে কোনো উপকার বয়ে আনবে না। এ ধরনের জ্ঞান অর্জন করে আমাদের কোনো নেকিও হবে না, কারণ এই সাধারণ শিক্ষাগুলো দুনিয়াবি বিষয়াদির (মু’আমালাত) মধ্যে পড়ে। হ্যাঁ, এ কথা সত্যি। কিন্তু এখানে একটা ‘যদি’ রয়ে গেছে। আমার মুসলিম ভাই ও বোনেরা, এটা বুঝতে হবে যে দুনিয়াবি বিষয়াদি স্বতন্ত্রভাবে পাপ-পুণ্যের কারণ নয়। কিন্তু আপনার নিয়ত এই ব্যাপারটাকে পাল্টে দিতে পারে। ঠিক এই মুহূর্ত থেকেই যদি আপনি আন্তরিকভাবে নিয়ত করেন যে, আপনার দুনিয়াবি জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্য হচ্ছে শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন, যেমন ধরুন উম্মাহর উপকার করা, তাহলে এই জ্ঞান লাভের জন্যই ব্যয় করা প্রতিটা সেকেন্ড আপনার ইবাদত হিসেবে গণ্য হবে। আপনি এসব দুনিয়াবি কাজের জন্যও আল্লাহর কাছ থেকে পুরষ্কার পাবেন। কারণ মূলত আপনি আল্লাহর জন্যই কাজগুলো করছেন। সুতরাং, দ্বীনী ভাই ও বোনেরা! আপনার নিয়তকে এখনই সঠিক দিকে পরিচালিত করুন। এই অভাবনীয় সুযোগ হাতছাড়া করবেন না।
দুনিয়াবী শিক্ষা আর ইসলামী শিক্ষার মধ্যে কোনো বিরোধ নেই
সবশেষে, আমার ভাই ও বোনেরা, ইসলামের জ্ঞান অর্জন করা আর দুনিয়াবী জ্ঞানার্জনের জন্য কাজ করার মধ্যে আদতে কোনো বিরোধিতা নেই, এটা বুঝতে হবে। ঈমানদার হিসেবে আমরা সর্বান্তকরণে বিশ্বাস করি যে, ইসলামী শিক্ষা নিঃসন্দেহে দুনিয়াবী শিক্ষার পেছনে ছোটার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সমস্যা সৃষ্টি হয় যখন কট্টর নিন্দুকেরা আমাদেরকে বুদ্ধিবৃত্তিক দ্বন্দ্বের ফাঁদে আটকানোর চেষ্টা করে। ইসলামিক জ্ঞানার্জনের মানে এটা নয় যে, চব্বিশ ঘণ্টা মসজিদের ভেতরে বসে থাকতে হবে। ইসলামকে জানার মানে এটাও নয় যে, দুনিয়া সম্পর্কে উদাসীন হয়ে যেতে হবে।
না! যদি তা-ই হতো, তাহলে নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবনের একটা সময় ব্যবসা করতেন না। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রাষ্ট্রপ্রধান হতেন না, আরো নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, তিনি প্রথম ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হতেন না। এই দুই ধরনের শিক্ষার মধ্যে সংঘর্ষ সৃষ্টি করা কখনোই উচিত না আমাদের। অধিকন্তু, এই প্রবন্ধটি এমন মুসলিমের উদ্দেশ্যেই লেখা, যে ইতোমধ্যেই ইসলামের মূল বিষয়গুলো সম্পর্কে জানে, যার তাওহীদের ধারণা আছে, তারপরে ফিকহের মূল বিষয়গুলো জানে। অবশ্যই, একজন মুসলিমকে ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো জানার জন্যে পর্যাপ্ত সময় দেওয়াটা অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ।
নিজের কাজের ক্ষেত্রে সেরা হোন
এই শেষ লাইনগুলোতে আমি নিজেকে এবং প্রিয় পাঠক আপনাদেরকেও নিজের বর্তমান পড়াশোনার প্রতি মনোযোগ দেওয়ার এবং সেই ক্ষেত্রে অন্যদেরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার ব্যাপারে বিশেষভাবে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। নিজের ক্ষেত্রে হয়ে উঠুন সবার সেরা! কিন্তু যদি সেই অখণ্ড মনযোগ তাওহীদের মৌলিক বিষয়গুলো না জানার বিনিময়ে অর্জিত হয়, যদি সেই তথাকথিত শিক্ষা আকীদাহ, ফিকহ এবং অন্যান্য বিষয় জানার চেষ্টা না করার বিনিময়ে অর্জিত হয়, তাহলে বুঝে নিন, ইসলামী পাণ্ডিত্য অর্জনের ব্যাপারে আপনি কিছুই করছেন না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, নিয়তের এই বিস্মরণের কারণে শেষ বিচারের দিনে চরম মূল্য দিতে হবে। প্রকৃতপক্ষে, সব ধরনের জ্ঞানই আসে মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার কাছ থেকে।
আসুন, আমরা দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করি, ইনশা আল্লাহ, এখন থেকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই আমরা আমাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে নিজের সেরাটাই দেবো, এবং কোনো ব্যতিক্রম নয় – অবশ্যই আমরা সবাই ঈমানের মৌলিক বিষয়গুলোর জ্ঞান অর্জন করবো!
আর আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন।
উৎস: ইসলামিক অনলাইন ইউনিভার্সিটি ব্লগ (মূল আর্টিকেল লিংক)
অনুবাদ: উম্মে আফরাহ, মুসলিম মিডিয়া প্রতিনিধি
অনুবাদ কপিরাইট © মুসলিম মিডিয়া
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।