যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি, তখন থেকেই আমাকে পরিপূর্ণ স্বাক্ষর একজন মানুষ বলা যায়। বাংলা, ইংরেজি ও আরবি ভালোভাবেই পড়তে ও লিখতে জানতাম। জানতাম ঠিকভাবে ক্যালকুলেশান করতে। ধুমিয়ে নানান কিসিমের কমিক্স পড়ার শুরুটা হয়েছিলো ক্লাস ওয়ানেরও বেশ আগে। ক্লাস ফাইভে এসে সেই অভ্যেস নানান কিসিমের বইতে গিয়ে ঠেকে। তখন আমার বয়স ৯। এক গম্ভীর, কৌতুহলী ঝাঁ চকচকে কিশোর।
স্বাক্ষরতার গল্পটা অতটুকুতেই শেষ হয়ে যাওয়া বাঞ্ছনীয় ছিলো। আজ যখন হিসেব মেলাতে বসলাম, দেখি কিছুই মিলছে না। এলজেবরা, ক্যালকুলাস, ত্রিকোণমিতি, বিচ্ছিন্ন গণিত, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, বায়োলজি, কৃষি শিক্ষা আরো কত কী পড়তে হয়েছে হাবিজাবি। শেষে বায়োলজির একটা শাখায় অনার্স শেষ করে এখন মাস্টার্স শেষ করার পথে। বাহ! ২৪ বছর তো শেষ করে ফেলেছি।
কী অর্জন করেছি?
কয়েক টুকরো একটু ভালো মানের কাগজে ছাপানো ডিগ্রি নামের হাস্যকর কিছু কৌতুক, যা আমার প্লাস্টিকের ফাইলে জমা হয়েছে সময়ের সাথে। এইতো! তো কী? হয়েছেটা কী? সমাজের ফালতু অন্ধ মানুষগুলো কাগজগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে বেশ তালি বাজাতে জানে, তাতে আমার লাভটা কোথায় বাপু? আমার জীবনে এর প্রভাবটা কোথায়? এগুলো না থাকলে মানুষ হিসেবে কি কম কিছু হতাম? নাকি এগুলো পেয়ে মানুষ হিসেবে আমার ‘আমিত্বের’ কোন উন্নতি হয়েছে? বলি, ফলাফলটা কী হলো দিন শেষে?
সত্যি বলি?
শুন্য।
স্রেফ জঘন্য একটা শুন্য।
আমার প্রাপ্তি হলো বি-শা-ল একটা ঘোড়ার আণ্ডা। যেটা না যায় ভাজা, না যায় খাওয়া। ৯ বছর বয়সের পর থেকে এই ১৫ বছরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আর তার সিলেবাসের পাঠ্যগুলো আমাকে এমন কিছু শেখায়নি যাতে আমি বদলে যাবো, উন্নত একজন মানুষ হয়ে যাবো। মানুষ হওয়া দূরে থাকুক, অন্তত কিছু একটা হতেও শেখায়নি। কিচ্ছু না।
শুধুমাত্র, হ্যাঁ, শুধুমাত্র সামাজিকতা রক্ষার জন্যে অমূল্য সময়, শ্রম আর অর্থের (=জীবনের) কি বিপুল অপচয়!!!
হ্যাঁ! এটা ঠিক যে, তিন বছর আগে আমি বদলেছি। কীভাবে? তিনটা সাবজেক্ট আমার লাইফকে আমূল বদলে দিয়েছে।
১. দর্শন
২. যুক্তিবিদ্যা
৩. ইতিহাস
এই তিনটা বিষয়ের একটাও আমার পাঠ্য সিলেবাসের অন্তর্ভুক্তি হতে পড়া হয়নি (ভাগ্যিস)! র্যান্ডমলি এটা সেটা পড়তাম বলে এই বিষয়গুলোও কীভাবে কীভাবে যেন ফালতু বিনোদন দেওয়া উপন্যাসের বস্তার ফাঁক ফোকর গলে আমার সামনে এসে গিয়েছিলো। এই তিনটা বিষয়ই নানান সময়ে, নানান আঙ্গিকে আমার সামনে এসে আমাকে দেখতে সাহায্য করে, তুলে ধরে আয়না। ২০ বছর বয়সে আমি জীবনে প্রথম একটু একটু করে উপলব্ধি করতে শুরু করি,
“কোথাও কোনো একটা ভুল হচ্ছে। ভয়ংকর কোনো ভুল। নিশ্চয়ই এমন হওয়ার কথা না।”
-প্রাইমারি স্কুল, হাই স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে একজন উন্নত স্বাক্ষর ব্যক্তি হওয়া ছাড়া আর কোনো সাহায্যই করেনি।
-মানুষ হতে সাহায্য করেনি? সত্যি সত্যি উন্নত হতে সাহায্য করেনি?
-না। একটুও না।
আমরা কি নিজেকে প্রশ্ন করবো না এখনো? আমরা কী করছি? সত্যিই কেন করছি?
আমরা কি উন্নত মানুষ হওয়ার চেষ্টা করছি আসলেই? নাকি সমাজ বলে দিয়েছে এভাবে এভাবে চললে টাকা আসবে, সাচ্ছন্দ্য আসবে, খেয়ে পরে আরামে বেঁচে থাকবে, আর তাই আমরা সেই পথ বেছে নিয়েছি? সত্যি করে কি আমরা ভাবতে পারি না? নিজের কাছে সৎ হয়ে? আরে, শুধু খেয়ে পরে বাঁচে তো পশু। হ্যাঁ, পশু হিসেবে তাই আমাদেরকেও খেয়ে পরেই বাঁচতে হয়। কিন্তু আমরা তো পশুর চাইতেও বেশি কিছু, তাই না? আমাদের বিবেক আছে, আত্মা আছে, বুদ্ধি আছে। আমাদের ভিতরের সেই অন্তর-আত্মা আর বিবেক-বুদ্ধির যত্ন আত্তি, খাবার দাবারের প্রয়োজন কিন্তু এই সমাজ মিটাচ্ছে না। এটা কি আমরা খেয়াল করেছি? এই মুহূর্তেও কি খেয়াল করতে পারছি? থামো। ভাবো প্লিজ। আস্তে আস্তে পড়ো লেখাটা। দৌড়িও না আর। অনেক তো দৌড়ালে জীবনে। অনেক দূরে এসে গেলে তো, দেখো না। আজ একটু বসে বসে ভাবলে কিচ্ছু হবে না। খাবারের অভাবে, যত্নের অভাবে আমাদের ভেতরে সবচেয়ে দামি সেই গুণগুলো, যেগুলোর জন্যেই আমরা একেকজন উন্নত বিবেকবান মানুষ হয়ে ওঠার কথা সময়ের স্রোতে, সেগুলো শুকিয়ে, বিকলাঙ্গ হতে হতে আজ মৃতপ্রায়। কিছুতেই আর আমাদের বোধোদয় হয় না, কিছুতেই আমরা জাগি না। আমরা কিছুই বুঝি না আর চারিপাশ থেকে। কিভাবে জাগতে হয় আমাদের তা-ই মনে নেই। আমরা যে ঘুমুচ্ছি আমাদের তো তা-ই জানতে দেওয়া হয় না, জাগবো কীভাবে? আমাদের যা গেলানো হয়, আমরা তা-ই গিলি আর ঢেকুর তুলে ঘুমুতে যাই। এই তো আমাদের জীবন।
বলতে পারো পশুর জীবন যাপনের সাথে তোমার জীবন যাপনের সত্যিকার বিভেদটা আসলেই কি আছে?
তুমি কে?
কোথা থেকে তোমার উৎপত্তি?
আর কোথায় তোমার সর্বশেষ ঠিকানা?
তোমার করণীয় কী মানুষ হিসেবে?
এই মৌলিক প্রশ্নগুলোর গভীরতম উত্তর আজও জানা হয়নি বলে কখনো, কোনোদিন কি অস্থিরতায় ছটফট করেছো? সব বাদ দিয়ে, সব ভুলে গিয়ে পাগলের মতো এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানার সুতীব্র ক্ষুধা কি তোমার ভেতরের আত্মাটাকে জ্বালিয়ে, কষ্ট দিয়ে ভুগিয়েছে? বুকে হাত দিয়ে বলো তো।
তোমার উত্তর যদি “না” হয়, তাহলে তোমাকে অভিনন্দন।
হ্যাঁ। তোমার আত্মা মরে গেছে। অনেক আগেই মরে গেছে। টেনশানের কিছু নেই। এই মৃত্যুতে তোমার কোন অনুভূতিই হবে না। যাদের আত্মা মরে গেছে, তাদের এসব কথায় কিছুই আসবে যাবে না। তুমি তোমার আগের জীবনে ফিরে যাও, এই লেখাটা পড়ে সময় নষ্ট করার কোনো মানেই হয় না তোমার। কেটে পড়ো এবং লাইফ এনজয় করতে ঝাঁপিয়ে পড়ো। বেস্ট অফ লাক। 😀
আর তোমার উত্তর যদি “হ্যাঁ” হয়, তাহলে আমি তোমাকে ঠিক কী বলবো ভেবে পাচ্ছি না। খুব বেশি সম্ভাবনা হচ্ছে তোমার আত্মা মৃতপ্রায়। প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ, একে বাঁচিয়ে তোলো। যেভাবেই পারো, প্লিজ। তুমি হয়তো একটু একটু করে বুঝতে পারছো, আমাদের আত্মাগুলোকে মেরে ফেলে আমাদেরকে শুধু ছুটে চলার এক নিস্প্রাণ যন্ত্রমানবে পরিণত করার ভয়াবহ চক্রান্ত করা হয়েছে। এবং সেই চক্রান্ত ইতিমধ্যে অনেকটাই বাস্তবায়িত হয়ে গেছে। প্লিজ, আড়মোড়া ভাঙো। উঠে বসো এখনই। ঠিক করো, জীবন থেকে এতোগুলো হারিয়ে যাওয়া বছরকে কীভাবে পুনরুদ্ধার করা যায়। প্ল্যান করো। সিরিয়াস প্ল্যান। এগোও সামনে। আর সময় নেই। বড্ড দেরী হয়ে গেছে। মৌলিক প্রশ্নগুলোর উত্তর নিশ্চিতভাবে খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত থামবে না। জাগো, জাগো এক্ষুণি। আর দেরী না। এক সেকেন্ডও না।
জীবন তো মাত্র দুইটাই।
অন্তরটা মরে গেলে তোমার আর জেগে ওঠা হবে না। এখনো দেরী হয়ে যায়নি। যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ। জেগে ওঠো প্লিজ। আত্মার সাথে সাথে শরীরটাও লাশ হওয়ার আগেই ঝাঁকি দিয়ে উঠে বসো।
ভুলে যেও না।
তোমার আর আমার টাকা দিয়ে বিলাসিতা কিনতে ছুটে চলা একটা মেশিন হবার কথা ছিলো না কোনোদিন। আমার আর তোমার বুকে এক মহাকাশ ভালোবাসা থইথই করার কথা ছিলো। কথা ছিলো সেই ভালোবাসার মহাকাশ থেকে স্বপ্নের মেঘ ঝরিয়ে ঝুম বর্ষা নামানোর। সব চরাচর ভিজিয়ে দেওয়ার।
আমাদের যে মানুষ হবার কথা ছিলো।
সত্যি সত্যি মানুষ!
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।