গদ্যের চেয়ে পদ্য যেমন বেশি আকর্ষণীয়, তেমনই স্বাভাবিক কথার চেয়ে গানের প্রতি মানুষ বেশি টান অনুভব করে। শব্দ তরঙ্গের খেলায় সাধারণ কথাও শ্রুতিমধুর হয়ে ওঠে। গুরুগম্ভীর সত্য ও শিক্ষণীয় কথা শোনার প্রতি মানুষের তেমন আগ্রহ না থাকলেও, গানের জন্য ঠিকই একটা আকর্ষণ থাকে। এভাবে গান-বাজনা যেন আমাদের জীবনের অংশ হয়ে পড়েছে। কিন্তু গান-বাজনা সম্পর্কে ইসলাম কী বলে তা কি আমরা জানি?

গানের একটা বড় সমস্যা হলো, অধিকাংশ গানের ক্ষেত্রেই ইসলামের মূলনীতির দিকে খেয়াল করা হয় না। গানের মধ্যে এমন কিছু কথা থেকে যায়, যেগুলো ইসলামে মোটেও সমর্থিত নয়। আমাদের কানে আসা অধিকাংশ গানেই নারী-পুরুষের বিবাহবহির্ভূত প্রেমের কথা থাকে; অথচ ইসলামে এটি মারাত্মক গুনাহ হিসেবে বিবেচিত। অনেক গানে নারীদেহের বর্ণনা থাকে, ফলে গান হয়ে পড়ে অশ্লীলতার মাধ্যম। অশ্লীল কথা বাদ দিলেও অনর্থক কথা থাকে; অথচ ভালো মুসলিমের বৈশিষ্ট্যই হলো অনর্থক কথা-কাজ থেকে বেঁচে থাকা। আবার ইসলামী গান হিসেবে পরিচিত কিছু গানেও মারাত্মক ভুল থেকে যায়। অনেক নাতের মধ্যে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রশংসায় বাড়াবাড়ি করা হয়ে যায়, যা স্পষ্ট বিদআত। সবচেয়ে ভয়াবহ হলো, গান গাইতে গিয়ে এমন কথাও বলা হয় যা আল্লাহর মর্যাদার সাথে সাংঘর্ষিক। ফলে আল্লাহ তা’আলার সাথে বেআদবি হয়ে যায়। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে শির্কও হয়ে পড়ে, যা অমার্জনীয় গুনাহ।

IIRT Arabic Intensive

এখন প্রশ্ন আসতে পারে, অশ্লীলতা না থাকলে কি গান গাওয়া যাবে? গুনাহকে প্রমোট করে না এমন গান কি গাওয়া যাবে? শির্ক-বিদআত বাদ দিলে কি গান-বাজনায় অংশ নেওয়া যাবে? এ ব্যাপারে ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথা না বলে সহজ জবাব পাবার জন্য সরাসরি কুরআনের দিকে চলে যাই।

আল্লাহ তা’আলা বলেন, “আর একশ্রেণীর লোক আছে, যারা (বান্দাকে) আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করার জন্য অজ্ঞতাবশত অসার বাক্য ক্রয় করে।” [সূরা লুকমান (৩১): ৬]

কিন্তু এখানে তো গানের ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি, তাই তো? আসুন দেখি, যারা সবচেয়ে ভালোভাবে কুরআন বুঝতেন, সেই সাহাবীরা এই আয়াতটি থেকে কী বুঝেছিলেন। আয়াতটিতে ‘অসার বাক্য’ দ্বারা কী বোঝানো হয়েছে সে প্রসঙ্গে আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, “তা হলো গান।” আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) এবং আব্দুল্লাহ ইবন উমারও (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) অনুরূপ কথা বলেছেন।

আরো স্পষ্টভাবে জানতে এই হাদীসটি দেখা যাক। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “আমার উম্মতের মধ্যে এমন কিছু লোক সৃষ্টি হবে, যারা ব্যভিচার, রেশম, মদ ও বাদ্যযন্ত্রকে হালাল সাব্যস্ত করবে।” (সহীহুল বুখারী)

‘হালাল সাব্যস্ত করবে’- কথাটুকু থেকেই স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে, বাদ্যযন্ত্র সন্দেহাতীতভাবে হারাম। (বলে রাখা ভালো, রেশম শুধু পুরুষদের জন্য হারাম। আর নারী-পুরুষ সবার জন্য ব্যভিচার, মদ ও বাদ্যযন্ত্র হারাম।)

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একবার চলার পথে বাজনার শব্দ শুনতে পেয়ে কানে আঙুল দেন। কিছুদূর যাওয়ার পর যখন আর শব্দ শোনা যাচ্ছে না বলে নিশ্চিত হয়েছেন, তখন তিনি আঙুল সরিয়েছেন। (আবু দাউদ) অর্থাৎ বাজনার শব্দ কানে আসুক- এমনটাও তিনি বরদাশত করতেন না। এই বাজনাকে আমরা পছন্দ করি কীভাবে? আমরা কি সত্যিই রাসূলকে ভালোবাসি? তবে তাঁর অপছন্দের বিষয়কে কেন পছন্দ করি?

এর বিপরীতেও কিছু কথা উল্লেখ করা হয়। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদীনায় যাওয়ার সময় সেখানকার মেয়েরা গান গেয়েছিলেন, ঈদের দিন দুজন বালিকা দফ বাজিয়ে গান গেয়েছিলো ইত্যাদি। এসব উল্লেখ করে অনেকেই গান-বাজনাকে জায়েজ করতে চায়।

অথচ বাস্তবতা হলো, এই ঘটনাগুলো দিয়ে গান-বাজনাকে জায়েজ প্রমাণ করা যায় না। কেননা এসব ঘটনায় শ্রুতিমধুর বাজনার ব্যবহারের কথা নেই। যেসব বাদ্যযন্ত্রে সুরেলা ও মনমাতানো আওয়াজ আসে, সেসব ব্যবহার করা জায়েজ নয়। সেটা গিটারই হোক, আর বাঁশি বা হারমোনিকাই হোক। উইন্ড ইন্সট্রুমেন্টই হোক, আর স্ট্রিং-ভিত্তিকই হোক।

হাদীসে উল্লিখিত ঘটনাগুলো থেকে বড়জোর দুই-একটা ব্যতিক্রমী অনুমতি পাওয়া যায়। যেমন- ঈদের দিন স্বাভাবিক আনন্দের উদ্দেশ্যে, বিয়ের দিন বিয়ের খবর ঘোষণার উদ্দেশ্যে, কিংবা কোনো সম্মানিত ব্যক্তি দীর্ঘ সফর শেষে ফিরে আসার সময় তাকে স্বাগত জানানোর জন্য বাজনা বাজানো যেতে পারে। কিন্তু কোন বাজনা? অবশ্যই এমন কোনো বাজনা যা মানুষকে আকৃষ্ট ও মুগ্ধ করে দেয় না। এরকম বাদ্যযন্ত্র হলো দফ। দফের একপাশ খোলা থাকে। এটি বাজালে অনেকটা প্লাস্টিকের মতো ড্যাব ড্যাব আওয়াজ আসে। এর সুর আকর্ষণীয় নয়। শ্রুতিমধুর নয়।

কখনো কখনো দুই-একবার (বাজনা ব্যতীত) নির্দোষ কথা দিয়ে গান গেয়ে ফেললে আশা করা যায় সমস্যা হবে না ইনশা-আল্লাহ। কিন্তু এমনটা অভ্যাসে পরিণত করা উচিত হবে না। ইসলামী গানের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। কুরআন তিলাওয়াত ও যিকর-আযকারের মাধ্যমে আল্লাহর প্রশংসা করতে হবে, আল্লাহর স্মরণ বাড়াতে হবে। কখনো কখনো গানের মাধ্যমে করে ফেললেও সমস্যা নেই ইনশা-আল্লাহ, তবে নিয়মিতভাবে না করাই ভালো। কেননা উম্মাহর শ্রেষ্ঠ সদস্য ছিলেন যারা, সেই সাহাবীগণের গানের অভ্যাস ছিলো না। ইসলামের শত শত বছরের ইতিহাসে আলিমরা গান গাওয়া ও দফ বাজানোকে ভাবগাম্ভীর্যের পরিপন্থী হিসেবেই জেনে এসেছেন। সুতরাং আমাদেরও উচিত তাঁদের অনুসরণ করা। হালাল-হারাম ফতোয়ার জটিলতায় না গেলেও তাকওয়ার দাবী অনুযায়ী গান-বাজনা থেকে আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত।

গান গাওয়া ও শোনার বেশ কিছু ক্ষতিকর দিক আছে। সবচেয়ে ভয়াবহ ক্ষতিটি হলো, এটি অন্তরে নিফাক্ব তৈরি করে। এছাড়াও অনর্থক কাজে সময় নষ্ট হওয়া, ইবাদাতে মনোযোগ কমে যাওয়া, গুনাহর প্রতি আগ্রহ তৈরি হওয়া, আল্লাহর স্মরণ কমে যাওয়া, কুরআনের প্রতি আকর্ষণ কমে যাওয়া ইত্যাদি অপকার রয়েছে। আপনি গান-বাজনায় ডুবে থাকলে এ সমস্যাগুলো টের পাবার কথা। কিন্তু আপনি যদি মনে করেন যে, গান-বাজনা করার পরও ইবাদাতে আপনি যথেষ্ট মনোযোগী, তাহলে আপনি আরো বড় সমস্যায় আছেন।

যা হোক, সহজভাবে বলতে গেলে, গান-বাজনা হারাম হওয়ার ব্যাপারে সকল মাযহাবের ইমামগণ একমত। যদিও ক্ষেত্রবিশেষে শর্তসাপেক্ষে বাজনাবিহীন গান জায়েজ হওয়ার পক্ষে আলিমদের মত আছে, তবুও বাদ্যযন্ত্র হারাম হওয়ার ব্যাপারে কারো কোনো দ্বিমত নেই।

হে আমার ভাই, আপনি আল্লাহর কাছে ফিরে আসুন। গান-বাজনা ছেড়ে দিন। আপনি গানের মধ্যে সাময়িক শান্তি পেতে পারেন, কিন্তু প্রকৃত শান্তি পেতে হলে আল্লাহর আদেশের কাছে আত্মসমর্পণ করাই একমাত্র উপায়। আল্লাহ তা’আলা যদি দয়া করে আপনাকে ও আমাকে জান্নাতে জায়গা দেন, তাহলে আপনার যত ইচ্ছা গান শুনতে চাইবেন, আমি শোনাবো। কিন্তু জান্নাতে যেতে চাইলে দুনিয়ার গান-বাজনা ছেড়ে দেওয়ার বিকল্প নেই। আল্লাহ তা’আলা আমাদের সবাইকে গান-বাজনার ফিতনা থেকে রক্ষা করুন। আমীন।

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive