কোটা সংস্কার আন্দোলনের শুরু থেকেই যেই বিষয়টা লক্ষ করে আমার মজা লেগেছে, তা হলো বাংলাদেশ একটি ভীতি-ভিত্তিক সমাজ। মোট সুযোগের অর্ধেকের বেশি পরিমাণ (পরিমাণটা যৌক্তিক কি অযৌক্তিক, সে আলোচনায় যাচ্ছি না) কোটা থেকে কমিয়ে আনার দাবি করবে একদল মানুষ। যারা যারা একমত, তারা এর সাথে একাত্মতা পোষণ করবে। কিন্তু এই নিরীহ দাবিটি কেউ নৈর্ব্যক্তিকভাবে তুলে ধরছে না। তার সাথে রাজনৈতিক নেতাদের নাম সংযুক্ত করছে। “বঙ্গবন্ধুর বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই।” এই স্লোগানটাই ভীতির একটি প্রকাশ।
এখানে যদি আপনি মনে করে থাকেন যে, বঙ্গবন্ধুর “স্বাধীনতার স্থপতি”, “জাতির পিতা”, “বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনক” ইত্যাদি পরিচয়ের কারণে তাঁকে ভালোবেসে তাঁর নাম দিয়ে স্লোগান বানানো হয়েছে, তাহলে আপনি ভুল করছেন। স্পষ্টতই এখানে বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোবাসাটা মূল পয়েন্ট না। এর জের ধরে আসা অন্যান্য শব্দের (যেমন- মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা) প্রতি আপাত ভক্তিটাও নির্ভেজাল না। মূল পয়েন্ট হলো – আন্দোলনকারীরা যেই কর্তৃপক্ষের সাথে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়াতে চলেছে, সেই কর্তৃপক্ষের কাছে বঙ্গবন্ধু পরম পূজনীয় একটি ফিগার। স্লোগানে বা ব্যানারে বঙ্গবন্ধু বা প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিকে রীতিমতো তাবিজের সাথে তুলনা করা যায়। আসন্ন কিছু বিপদ থেকে বাঁচতে আন্দোলনরত গোষ্ঠীগুলো এই তাবিজ গলায় পরে মাঠে নেমেছে।
এখন প্রশ্ন হলো, কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে এই তাবিজ কেন দরকার হচ্ছে? একদম জানা উত্তর হলো, এই কর্তৃপক্ষ ক্ষেত্রবিশেষে মারাত্মক হিংস্র। এজেন্ডা মিলে যাওয়ায় আজকের আন্দোলনকারীদের অনেকেই নিকট অতীতে এই হিংস্রতায় ঘি ঢেলেছে। এই তো পাঁচ বছর আগে শাহবাগ যখন তুঙ্গে, এক একটা শব্দকে কে কতটা ভক্তিভরে বা ঘৃণাভরে উচ্চারণ করছে – এর ভিত্তিতে তখন মানুষের জীবনের মূল্য নির্ধারিত হয়েছে। এখন সেই একই কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে শব্দচয়নে তাই আন্দোলনকারীদের শুরু থেকেই সাবধান থাকতে হচ্ছে।
তবে এই হিংস্রতার প্রয়োগ উল্টোদিক থেকেও সাময়িকভাবে হয়েছে। কোটার ব্যাপারে তখনও প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে কোনো বক্তব্য আসেনি। ছাত্রলীগের ক্যাডাররা তখনও বুঝে উঠতে পারছে না কোটা কি আসলে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তি না বিপক্ষ শক্তি। এদিকে জনমতের জোয়ার তখন কোটা সংস্কারের পক্ষে। একটা-দুইটা শব্দের উচ্চারণ হেরফের হলেই যে কাউকে “কোটাধারী” বলে ব্রাত্য করে দেওয়া হচ্ছে। ছাত্রলীগ ও শিক্ষকদের মধ্যে আওয়ামীপন্থীদের তখন আমি দেখেছি প্রতিটা কথা “আমি কোটা সংস্কারের পক্ষে। তবে…” দিয়ে শুরু করতে। এই যে কোটা সংস্কারের বিরুদ্ধে তারা নিজের বক্তব্য খোলাখুলি বলতে পারছিলো না, “আমি কোটা সংস্কারের পক্ষে” তাবিজ পরতে বাধ্য হচ্ছিলো – এটাও বাংলাদেশের ভীতিকেন্দ্রিক সংস্কৃতিরই প্রকাশ। এখন অবশ্য পাশার দান উল্টে যাওয়ায় এই পক্ষটা আর সেভাবে তাবিজ ব্যবহার করছে না।
দ্বিতীয় মজার বিষয়টা হলো, কোটা সংস্কার আন্দোলন কোনো আদর্শভিত্তিক আন্দোলন না। প্রথম পয়েন্ট থেকেই এটা অনেকটা ক্লিয়ার। আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় থাকায় আন্দোলনকারীদের ব্যানারে মুজিব-হাসিনার ছবি ছিলো। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন এ আন্দোলন হলে অন্য ছবি থাকতো। অর্থাৎ, আন্দোলনকারীরা কোনো নির্দিষ্ট আদর্শের কাছে নিজেদের দাবিদাওয়া জানাচ্ছে না। যেকোনো একটি কর্তৃপক্ষ তাদের দাবি আদায় করে দিলেই চলবে। ডক্টর জাফর ইকবাল এই কথাটিই বোঝাতে চেয়েছিলেন যখন তিনি বলেছিলেন এটা চাকরির জন্য আন্দোলন; মুক্তিযুদ্ধ বা ভাষা আন্দোলনের মতো আদর্শিক কোনোকিছু নয়।
আদর্শভিত্তিক আন্দোলনের সমস্যাটা হলো মানুষ এর ইন্সট্যান্ট ফলাফল চোখের সামনে দেখতে পায় না। তবে এ ধরনের আন্দোলনগুলো একটি অনাচারের উপর ফোকাস না করে সমগ্র অনাচারী সিস্টেমটাকে চ্যালেঞ্জ করে। এটাতে কষ্ট বেশি, দীর্ঘমেয়াদে কাজ করতে হয়, তবে ফলাফল হয় স্থায়ী।
হুজুররা কেন কোটাভিত্তিক যুলুমের বিরুদ্ধে আওয়াজ করেন না, আন্দোলনকারীদের উপর নিপীড়নের বিরুদ্ধে কথা বলেন না – এ নিয়ে অনেকের অনেক অভিযোগ। অথচ হুজুরদের একটি খুবই গভীর মেসেজ আমরা এখনও আত্মস্থ করার মতো পরিপক্বতাই অর্জন করিনি। তা হলো এই যে কোটা বানিয়ে নিজের লোকদের চাকরি দেওয়া, বিরোধিতাকারীদের পিটিয়ে ভর্তা করে ফেলা, রাতের বেলা বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া – এগুলো সবই যুলুমের কতগুলো আঙুল মাত্র। এর পেছনের সকল কলকব্জা নিয়ন্ত্রণকারী মগজটা হলো বিধানদাতা হিসেবে আল্লাহকে অস্বীকারকারী একটি সিস্টেম। আল্লাহকে আল্লাহর অধিকার প্রদান না করার অনিবার্য ফল হলো মানুষকে মানুষের অধিকার না দেওয়া। যুলুমের আঙুল মুচড়ে দিয়ে সাময়িক ফলাফল আসলেও স্থায়ী সমাধানে যেতে হলে ওই মগজটাকে ধুতে হবে সবার আগে।
হে আল্লাহ্! যুলুম করা থেকে এবং যুলুমের শিকার হওয়া থেকে আমরা আপনার কাছে আশ্রয় চাই।
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।