আচ্ছা, আমরা কি কখনও ভেবে দেখেছি যে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আমাদের কাছে কী চান? আল্লাহ কি আসলে এক্সপেক্ট করেন যে তাঁর প্রতিটা বান্দা পারফেক্টলি দ্বীন পালন করবে? একশতে একশ প্রতিটা ফরজ-ওয়াজিব পালব করবে আর কখনও কোনো হারাম কাজ করবে না? আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কি একটি পারফেকশনিস্ট উম্মাহ বানাতে চান? চাইলে কি পারতেন না? আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার কাছে কি পারফেকশনিজম খুব গুরুত্বপূর্ণ? (আসলে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা-ই ভালো জানেন তিনি কী এক্সপেক্ট করেন। আমি যা বলছি, তা বুঝার সুবিধার্থে।)
আসুন, মানব সৃষ্টির শুরুতে যাই। তখন, অলরেডি মালাইকাগণ আছেন, তাঁরা সবসময় আল্লাহর ইবাদাত বন্দেগী করেন। জ্বীন জাতিকেও আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন, তারও এক সদস্য ইবলিস লক্ষ বছর আল্লাহর ইবাদাত করে যাচ্ছে। তো যা-ই হোক, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা মানুষ সৃষ্টি করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি এই ব্যাপারে মালাইকাগণের সাথে আলোচনা করলে মালাইকাগণ বলেন যে, ইবাদাত করার জন্য তো তাঁরাই আছেন। মানুষ করাপশন করবে, রক্তারক্তি করবে, ঠিক মতন ইবাদাত হয়তো করবেনা, ঠিক মতন আল্লাহকে মানবেনা। জবাবে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা মালাইকাগণকে বলেছিলেন, “নিশ্চয়ই আমি যা জানি, তোমরা তা জানো না।”
যা-ই হোক, আসুন দেখি আদম (আঃ) এমন কী করেছেন যা জ্বীন জাতি করেনি। আদমের এমন এক্সট্রা কোন কোয়ালিটি আছে, যা আর কারো নেই? কেন আদমকে আল্লাহ এত মর্যাদা দিলেন? আলহামদুলিল্লাহ।
আসুন ফিরে যাই অতীতের ঘটনায়:
আল্লাহ আদমকে তৈরি করার পর সব মালাইকা এবং ইবলিসকে নির্দেশ করলেন আদমকে সম্মানসূচক সিজদাহ করতে। যথারীতি মালাইকাগণ নির্দেশ সাথে সাথে পালন করলেন। কিন্তু ইবলিসের বিষ উঠলো, ইবলিস সিজদা করবে না। কারণ কী? কারণ আদম হলো মাটির তৈরি, আর সে হলো আগুনের তৈরি। আগুনের তৈরি হয়ে মাটির তৈরি মানুষকে সম্মান দেখাইতে ইজ্জতে ঘা লাগে না? আফটার অল সে এত মর্যাদাসম্পন্ন একটা কুতুব।
যা-ই হোক, আল্লাহ যখন ইবলিসকে জিজ্ঞেস করলেন যে সে কেন আদমকে সিজদা করবে না, ইবলিস ঠুসঠাস একটা যুক্তিতর্ক দেখিয়ে দিলো। এবং আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করার পরও সে ছিল সম্পূর্ণ ভাবলেশহীন …
খেয়াল করুন, ইবলিস কিন্তু আল্লাহকে সিজদাহ করতে অস্বীকৃতি জানায়নি, সে আদমকে সিজদাহ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
যা-ই হোক, এবার আদমের পালা। দেখা যাক আদম কী করেন।
আদমকে আল্লাহ নির্দেশ দিলেন, জান্নাতে থাকো, কিন্তু একটি গাছের কাছে যাওয়াও নিষেধ। স্ত্রী হিসেবে আদম (আঃ) হাওয়া (আঃ)-কে পেলেন। কিন্তু যেভাবেই হোক, প্ররোচিত হয়ে আদম (আঃ) সেই গাছের ফল খেয়ে ফেললেন।
ইবলিস ভুল করার পর তাকে যেভাবে আল্লাহ ধরেছিলেন, আদমকেও সেভাবে ধরলেন। কিন্তু আদম-হাওয়ার রেসপন্স ছিলো ভিন্ন। দেখুন আমাদের বড়পিতা আদম (আঃ) কীভাবে রেসপন্ড করলেন,
”হে আমাদের রব। আমরা তো ভুল করে ফেলেছি। যদি আপনি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন এবং আমাদের প্রতি দয়া না করেন, আমরা নিশ্চিতভাবেই ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবো।” [সূরা আরাফ (৭): ২৩]
এবার এটার সাথে ইবলিসের রেসপন্সটা মিলান। আল্লাহ যখন ইবলিসে জিজ্ঞেস করেন যে সে কেন আদমকে সিজদাহ করলো না, সে জবাবে এটা বলেছিলো,
”আমি তার থেকে উত্তম। আপনি আমাকে আগুন থেকে আর তাকে কাদামাটি থেকে তৈরি করেছেন।” আস্তাগফিরুল্লাহ। একটু খেয়াল করুন তো পার্থক্যটা। ইবলিস কি বলতে পারতো না, “হে আমার প্রভু। আমি ভুল করে ফেলেছি, আমাকে মাফ করে দিন”?
ইবলিস কি জানে না আল্লাহ সমগ্র বিশ্বের রব? সে কি জানে না আল্লাহ সব বাদশাহর বাদশাহ? আল্লাহ পরাক্রমশালী, আল্লাহ প্রতাপশালী? আল্লাহই খালিক, আল্লাহই মালিক?
অথচ ইবলিস তার নিজের যুক্তিতর্ককে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার আদেশের উপরে স্থান দিলো। এবং আদেশ লঙ্ঘনের পরও তা নিয়ে লজ্জিত না হয়ে উল্টা যুক্তিতর্ক দেখালো। মাটির তৈরি হলে মর্যাদা কম হবে, আর আগুনের তৈরি হলে মর্যাদা বেশি হবে, এটা তাকে কে শিখালো? আসলে ইবলিসের মধ্যে যা ঢুকে গিয়েছিলো, তা হলো অহংকার। সম্ভবত সে নিজেকে বহুত বড় কেউকেটা মনে করা শুরু করেছিলো।
বাট, বাট আদম (আঃ) কী করলেন? আদম কি বলতে পারতেন না, ১. “ফল দেখে এত লোভ হয়েছে, যে সামলাতে পারিনি। খেয়েছি তো কী হয়েছে?”, ২. ”আসলে আমি খেতে চাইনি, ইবলিসের প্ররোচনায় পড়ে খেয়ে ফেলেছি।” ৩. ”সব হাওয়ার দোষ, হাওয়ার কারণে আমি খেয়ে ফেলেছি” … যুক্তি তর্কের কি অভাব ছিলো?
কিন্তু না, আদম (আঃ) সরাসরি দোষকে নিজের কাঁধে নিয়ে নিলেন। ইভেন হাওয়া (আঃ)-কে দুষলেন না।
এমনকি ক্ষমা চাওয়ার সময় হাওয়া (আঃ)-কে সাথে নিয়ে ‘আমরা’ শব্দটি ব্যবহার করলেন, যাতে মাফ পেলে দু’জন একসাথে পেয়ে যান। যদিও উনি ‘আমি’ বলতে পারতেন, হাওয়াকে exclude করতে পারতেন, সেক্ষেত্রে হাওয়া (আঃ) হয়তো একটু বিপদে পড়তেন।
That is the talent of our father! মাটির তৈরি আদম, আলহামদুলিল্লাহ। নিজের ভুলকে স্বীকার করে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার সামনে কাঁচুমাচু মুখে ক্ষমা চাইতে পারা। যেটা ইবলিস করতে পারেনি। যদিও বুজুর্গিতে ইবলিস কম ছিলো না। আমলের দিক থেকে ইবলিস কম ছিলো না, ইবলিসের চেয়ে আমলদার আর কয়জন আছে? আদম অহংকার না করে বিনয়কে বেছে নিলেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলাও আদম (আঃ)-কে মাফ করে দিলেন।
আসলে ইবলিস ও আদম (আঃ) দুজনই কিন্তু ভুল করনেওয়ালা। কিন্তু ভুল করার পর কীভাবে রেসপন্স করা হলো, তার উপর ভিত্তি করে ইবলিস হেরে গেলো …
তার মানে এতে কী বুঝা গেলো? বুঝা গেলো, আপনি মাটির তৈরি নাকি আগুনের তৈরি সেটা বড় কথা নয় … আপনি কালা না সাদা, আপনি পুরুষ না মহিলা, আপনি রাশান, না ইংরেজ, না বাংগাল, এগুলা কোনোটাই বড় কথা নয়। বড় কথা হলো আপনি আল্লাহর কী রকম ওবিডিয়েন্ট। আপনি কি আদেশ শুনা মাত্রই পালন করেন? নাকি তর্ক বিতর্ক শুরু করে দেন? ভুল হয়ে গেলে কি আপনি মাফ চান? নাকি ভুলের উপরই বসে থাকেন?
আপনি কি শুনলাম-মানলাম গোত্রের লোক, নাকি ‘ইসলাম কেন এইটা বলেছে, এইটাতো ইসলাম ঠিক বলেনি … ইসলামের এই আইনটা এমন না হয়ে অমন হলে কেমন হয়?’ — এই গোত্রের লোক? চিন্তা করেন ইবলিস কার নিকটবর্তী।
এ থেকে শিখার আরও অনেক কিছু আছে। সেটা হলো ইবলিস কিন্তু পারফেকশনিস্ট টাইপ জ্বীন ছিলো। কিন্তু তার পারফেকশনিজম কোনো কাজে আসেনি। কারণ সে বিনয়ী হতে পারেনি, সে অহংকার করেছে।
অথচ , আদম শুধুমাত্র বিনয় অবলম্বন করেই আল্লাহর প্রিয়ভাজন হয়েছেন।
তার মানে আল্লাহ এটা খুব পছন্দ করেন যে, আপনি গুনাহ করার পর লজ্জিত হয়ে কাঁচুমাচু হয়ে আল্লাহর দরবারে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলেন এবং মাফ চান। আপনি তওবা করেন, বারবার তওবা করেন।
আল্লাহ এটা পছন্দ করেন না যে আপনি একজন পারফেক্ট ইবাদাতকারী হোন, আপনার কোনো ভুল না থাকুক, অথচ অতিরিক্ত পারফেক্ট ইবাদাত বন্দেগী করে আপনি অহংকারী হয়ে আল্লাহর সামনে নিজেকে নত করতে না পারেন, আপনার এটিচুড হয় এমন যে “আমি জীবনে এত ইবাদাত করছি, এখন আমারে এইটা দিতে হবে, ওইটা দিতে হবে, আল্লাহ আমারে এইটা দেয় না কেন? ওইটা দেয় না কেন? ধুর … এত ইবাদাত করে কী লাভ?”
এজন্য একটা কথা প্রচলিত আছে যে অহংকারী আমলদার থেকে বিনয়ী তওবাকারী গুনাহগার ভাল।
তাই আসলে আল্লাহ আমাদের এমন করে বানাননি যে ইবলিসের মতন অনেক পারফেক্টলি আমল করতে পারে। বরং আল্লাহ আমাদের ইচ্ছা করেই এমনভাবে বানিয়েছেন যে আমরা খালি ভুল করে ফেলবো, অনিচ্ছাকৃতভাবেই। এরপর আমরা মাফ চাইবো। আবার ভুল করবো, আবার মাফ চাইবো। আর আল্লাহ মাফ করবেন।
আল্লাহ চান, আমরা আল্লাহর সামনে নিজেকে ছোট যেন করতে পারি, নিজেকে যেন বড় না ভাবি। কারণ বড় হলেন একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা । আপনি আল্লাহর সামনে নিজেকে যত ছোট করতে পারবেন, আল্লাহ আপনার মর্যাদা তত বৃদ্ধি করবেন।
মর্যাদা আসে আল্লাহর কর্তৃত্বকে বিনা দ্বিধায় মানার মাধ্যমে এবং আল্লাহর সামনে নিজেকে ছোট করার মাধ্যমে। শুধু ইবাদাত বন্দেগী করেই মর্যাদা আসে না।
আসুন আজই নিজ নিজ ভুলের জন্য আমরা তওবাহ করি এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই … আমরা যত বড় গুনাহই করি না কেন, আল্লাহর ক্ষমা ও দয়া আমাদের গুনাহ থেকে বড় …
পুনশ্চ: তার মানে এই নয় যে আপনি পারফেক্টলি ইবাদাত বন্দেগী করবেন না, বা আপনি ইচ্ছা করেই গুনাহে লিপ্ত হবেন । তা নয়। মূল কথা হলো আপনি পারফেক্টলি ইবাদাত বন্দেগী করেন বা না করেন, শেষ মেশ আপনাকে বিনয়ী থাকতে হবে। … শয়তানের মতন বেয়াদব ইবাদাতকারী হলে হবে না। আমাদের চেষ্টা থাকবে যত বেশী সম্ভব ফরজ-ওয়াজীব-নফল পালন করা এবং কোনো হারামে লিপ্ত না হওয়া। কিন্তু এট দি এন্ড, আমরা ভুল করে ফেলবো। তাই যখন ভুল হয়ে যাবে, তখন বিনয়ী হয়ে, কাঁচুমাচু হয়ে চোখের পানি ফেলে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া।
একই সাথে , অন্য মুসলিম ভাইদের ভুল নিয়ে পড়ে না থাকা। ব্যাসিকালী এটাও এক ধরনের অহংকার। আপনি অন্যদের ভুল নিয়ে সারাদিন পড়ে থাকেন এর মানে হলো, আপনি নিজেকে খুব শুদ্ধ মনে করেন। এটা সঠিক পলিসি নয়। বরং আয়নায় নিজের ভুল দেখা, অন্যদের গুণ দেখা। নিজেকে ছোট মনে করা, অন্যদের বড় মনে করা।
আমরা হলাম সেই আদমের সন্তান, আমাদের কি আদমের মতন নিজ ভুলের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী হওয়া উচিত, নাকি ইবলিসের মতন নিজের ভুলের উপর অটল থাকা উচিত? সিদ্ধান্ত আমাদেরই নিতে হবে …
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।