“আমি কখনোই ওইরকম পোশাক পরতে পারব না!” – হিজাবে আবৃতা মুসলিম নারীকে দেখে (ইসলাম গ্রহণের আগে) এমন মন্তব্য করেছিলেন সারা বকার।
সারা বকার একজন প্রাক্তন অভিনেত্রী, মডেল, শরীরচর্চা প্রশিক্ষক এবং (এখন) একজন সক্রিয় কর্মী। তিনি একজন আমেরিকান নারী যিনি ফ্লোরিডা এবং মায়ামীর সাউথ বীচে বাস করতেন। তিনি যে বিকিনিকে উনার স্বাধীনতার প্রতীক বলে মনে করতেন সেটা পরিত্যাগ করে নিক্কাব পরা শুরু করেছেন।
একজন লুথারের অনুগামী প্রোটেস্ট্যান্ট হিসাবে বড় হওয়া সত্ত্বেও তিনি চার্চে যেসব কাজ করা হতো যেমন গান-বাজনা, ক্রুশ ও যীশুর প্রতিকৃতিকে পূজা করা এবং “যীশুর শরীর ও রক্ত খাওয়া” ইত্যাদি আনুষ্ঠানিকতায় বিশ্বাস করতেন না। “আমার কাছে এগুলো অর্থহীন মনে হতো,” তিনি বলেন।
একসময় তিনি নিজেকে আবিষ্কার করলেন ভুল পথের যাত্রী রূপে। সেই সময় উদ্বেগ ও বিভ্রান্তি ছিল তার সেরা দুই সহচর। নিজের প্রতি ছিল উনার চরম বিতৃষ্ণা ও ঘৃণা। তিনি মদের প্রতি ঝুঁকলেন, কলেজ ছেড়ে দিলেন এবং যেখানে বড় হয়েছিলেন সেই সাউথ ডাকোটা ছেড়ে ১৯ বছর বয়সে একাই ফ্লোরিডা পাড়ি দিলেন।
বিষাদ উনাকে সেখানেও তাড়া করে ফিরতো এবং একসময় তিনি মনোবিজ্ঞান, সেলফ-হেল্প বই, টেপ ও ব্যয়ামের দিকে ঝুঁকলেন। ফ্লোরিডার জীবন ব্যবস্থার সাথে মানিয়ে নিতে গিয়ে উনি দেখলেন যে নিজের সৌন্দর্যের দাসে পরিণত হয়েছেন তিনি। চুল সাজানো, ম্যানিকিউর করা, জীমে যাওয়া, কেনাকাটা করা এবং সুন্দর দেখানোর জন্য আরও নানা খরচের পেছনে উনার বেশিরভাগ অর্থ ব্যয় হয়ে যেত। “সুন্দর দেখানোর জন্য প্রচুর সময় ও অর্থ ব্যয় হতো,” তিনি বলেন। এমনকি নতুন সম্পর্কে জড়ানোর পরও উনার বিষাদ ও উদ্বিগ্নতা দূর হয়নি।
এরপর তিনি সব ধরণের ধর্ম নিয়ে জানতে শুরু করলেন। তিনি মেটাফিজিক্যাল পড়াশোনা এবং প্রাচ্যদেশীয় মেডিটেশন ও যোগ ব্যয়ামের প্রতি মূলত আগ্রহী হয়ে উঠলেন। তিনি ওইসবের চর্চা করতে লাগলেন কিন্তু দেখলেন যে উনার মন এর চেয়েও আরও বেশি কিছু চাইছে।
শেষ পর্যন্ত উনি আবার কলেজ জীবনে ফিরে গেলেন এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়টার প্রতি প্রবল আগ্রহ অনুভব করলেন। সেখানেই তিনি “আমেরিকার ইতিহাস” ও “আমেরিকার বিদেশ নীতি” নিয়ে কুৎসিত সত্যগুলো জানতে পারলেন। “এত সব অবিচার, বর্ণবাদ ও অত্যাচার নিয়ে জানতে পেরে আমি আতংকগ্রস্থ হয়ে পড়েছিলাম। পৃথিবীর মানুষের এত দুর্ভোগের কথা জানতে পেরে আমার হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে গিয়েছিল। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমাকে কিছু একটা করতে হবে।”
মধ্যপ্রাচ্যে যে অন্যায় চলছে সেটা নিয়ে স্থানীয় হাই স্কুল ও কলেজ শিক্ষার্থীদের জানাতে তিনি স্ব-উদ্যোগে কাজ করতে শুরু করলেন। এমনকি তিনি স্থানীয় কিছু সক্রিয় কর্মীদের নিয়ে ওয়াশিংটন ডিসি গিয়েছিলেন আসন্ন ইরাক যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে। তিনি যখন এসব করছিলেন তখন একজন মুসলিম পুরুষের সাথে উনার পরিচয় হয় যিনি ন্যায় ও মানবাধিকারের জন্য লড়াই করতে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। সেই মানুষটি তার নিজের একটি সংস্থা নিয়ে কাজ শুরু করেছিল যেখানে আরও জানার জন্য ও এই লড়াইতে সাহায্য করার জন্য সারা একজন স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে কাজ করতেন। একসাথে কাজ করার সময় এই মুসলিম ভদ্রলোক সারাকে নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), তাঁর সাহাবী ও ইসলামী সভ্যতা নিয়ে নানা ঘটনা শোনাত।
“এইসব ঘটনা শুনে আমি ভীষণ অবাক হতাম, কারণ ইতিহাসের এই দিকটা সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না। আমি ইসলামের ব্যপারে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম এবং এই নিয়ে যা পারতাম পড়ে ফেলতাম। শেষ পর্যন্ত আমি কুরআনও পড়ি,” তিনি বলেন।
অবশেষে ইসলামের মাঝে তিনি সত্যকে খুঁজে পান। ইসলাম নিয়ে উনার যত প্রশ্ন ছিল সেই সব কিছুর উত্তর উনার কাছে মনে হয়েছে “অত্যন্ত যৌক্তিক ও আশ্চর্যরকম বাস্তবমুখী”। তিনি আবিষ্কার করেন যে ইসলাম একটা পূর্ণাংগ জীবন ব্যবস্থা যেখানে কিভাবে খেতে হবে, কিভাবে ঘুমাতে হবে ইত্যাদি ছোট ছোট বিষয়ের প্রতিও দিকনির্দেশনা দেয়া আছে।
২০০৩ সালের জানুয়ারিতে ২৯ বছর বয়সে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। সারা সেই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, “প্রশান্তির এক চাদর যেন আমাকে ঢেকে দিয়েছিল। আমি খুবই শান্ত, নিঃসংশয় ও আনন্দিত অনুভব করছিলাম। হঠাতই যেন আমি জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে পেয়েছিলাম।”
একটা নতুন মসজিদের উদ্বোধনের সময় সারা উনার শাহাদাহ গ্রহণ করেছিলেন। এবং মজার ব্যপার হচ্ছে উনি শাহাদাহ গ্রহণ করার পরপরই আকাশে দুইটি রংধনু উঠেছিল! উপস্থিত মুসলিম বোনেরা গিয়ে উনাকে জড়িয়ে ধরেছিল। “আমি এত খুশি হয়েছিলাম যে কেঁদে দিয়েছিলাম,” তিনি বলেন।
পরদিন, সারা বিশ্বকে উনার নতুন ধর্ম গ্রহণের চিহ্ন দেখাতে একটা মধ্যপ্রাচ্যদেশীয় দোকানে গিয়েছিলেন মাথার স্কার্ফ ও মুসলিম নারীর উপযোগী পোশাক কেনার জন্য। সেইদিন থেকে সারা শালীনভাবে পোশাক পড়া শুরু করেন। তিনি সেই একই এলাকা ও একই রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতেন যেখানে আগে উনি শর্টস, বিকিনি ও অন্যান্য অশালীন পশ্চিমা পোশাক পরে হাঁটতেন। “স্বাধীন হয়েছিলাম অবশেষে!”, তিনি বলেন। “এক অন্তঃসারশূন্য সমাজের তৈরি ফ্যাশনের শেকল ও শারীরিক দাসত্ব থেকে আমি বেরিয়ে এসেছিলাম। সত্যি বলছি, আমার মনে হয়েছিল যেন এক বিশাল ভার আমার কাঁধ থেকে নেমে গিয়েছে। সাজগোজ করে সবার চেয়ে বেশি সুন্দর দেখানোর জন্য আমি নিজের মাঝে আর কোন চাপ অনুভব করতাম না।”
যেসকল নারীরা সত্যিকার স্বাধীনতা চায় তাদের প্রতি উনি বলেন:
“একজন প্রাক্তন অমুসলিম হিসাবে আমি জোরাল দাবী জানাই যে নারীদের হিজাব নিয়ে, এর উপকারিতা নিয়ে এবং একজন নারীর জীবনে এটা যে শান্তি ও সুখ নিয়ে আসে, যেমনটা আমার জীবনে এনেছে, তা নিয়ে জানার সমান অধিকার তাদের রয়েছে। আগে বিকিনি ছিল আমার কাছে স্বাধীনতার প্রতীক, যেখানে সত্যিকার অর্থে এটা শুধু আমাকে মুক্ত করেছিল আধ্যাত্মিকতা এবং একজন সম্মানিত মানুষ হিসাবে সত্যিকারের মূল্যায়ন পাওয়া থেকে। সাউথ বীচে আমার বিকিনি ও “চাকচিক্যময়” পশ্চিমা লাইফস্টাইল পরিত্যাগ করে এসে নিরিবিলিতে আমার স্রষ্টা ও অন্যান্য সাধারণ মানুষদের মাঝে একজন মূল্যবান মানুষ হিসাবে বসবাস করতে পেরে আমি অত্যন্ত খুশি। এই কারণেই আমি নিক্কাব পরা বেছে নিয়েছি এবং এই কারণেই এটা পরার আমার যে অবিচ্ছেদ্য অধিকার তার পক্ষ নিয়ে আমি লড়ে যাব। আজকে আমার কাছে নিক্কাব হচ্ছে নারী স্বাধীনতার নতুন প্রতীক যা তাকে বুঝতে সাহায্য করে সে কে, তার জীবনের উদ্দেশ্য কী এবং সে তার স্রষ্টার সাথে কী ধরণের সম্পর্ক গড়তে চায়। হিজাবের মতো ইসলামি শালীনতার বিরুদ্ধে যে কুৎসিত বাঁধাধরা ধারণা প্রচলিত আছে তার কাছে যেসব নারীরা নিজেদের সঁপে দিয়েছে তাদের আমি বলতে চাই, তোমরা জান না তোমরা কী হারাচ্ছ।”
শাহাদাহ গ্রহণের ঠিক এক মাস পর যে মানুষটি সারাকে ইসলামের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল তিনি তাকে বিয়ে করেন। একসাথে তারা বিশ্বজুড়ে ঘটে চলা অন্যায়ের বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছেন। তারা পুরো মধ্যপ্রাচ্য ভ্রমণ করেছেন এবং বর্তমানে ইসলামি পরিবেশে থাকার জন্য আমেরিকা ছেড়ে এসে মিশরে বাস করছেন। “আমার হৃদয় পূর্ণতা পেয়েছে। সেই বিষাদ ও একাকীত্ব আর নেই। এখন আমার মনে হয় আমার কেউ আছে, আমার অস্তিত্ব আছে,” তিনি বলেন।
বর্তমানে, সারা The March for Justice-এ যোগাযোগ পরিচালক, The Global Sisters Network এর সহপ্রতিষ্ঠাতা এবং Shock and Awe Gallery-তে, যেখানে আমেরিকা ও ব্রিটেনের এই শতাব্দীতে পরিচালিত অপরাধের ঐতিহাসিক দলিল ও প্রমাণ নিয়ে কাজ করা হয়, সেখানে প্রডিউসার হিসাবে কাজ করছেন।
উৎস: Save our souls. blogpost.com ( মূল আর্টিকেল লিন্ক)
অনুবাদক: রাবেয়া রওশীন
অনুবাদ কপিরাইট © মুসলিম মিডিয়া
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।