অনেক বৈবাহিক আর্গুমেন্টেরই কারণ যে শ্বশুর-শাশুড়ি এবং শ্বশুরবাড়ির লোকজন, তা তো সবারই জানা আছে।
বউ আর তাদের শাশুড়ির মধ্যে দ্বন্দ্ব হচ্ছে অনেক বিয়েতে টানাপোড়নের একটি স্বাভাবিক উৎস। অধিকাংশ পরিবারেই নতুন বউদের তাদের স্বামীর পরিবারের সাথে প্রথমদিকের অভিজ্ঞতা খুব সুখকর হলেও সেটা বেশি দিন স্থায়ী হয় না। কিছু সময় বা কয়েক বছর পরে সংঘর্ষ তৈরী হয়।
বিবাহিত জীবনে পরবর্তী কালে ইন ল’সদের সাথে মানিয়ে নেয়াটা অনেকটাই চ্যালেঞ্জিং। হতে পারে আপনাকে একজন বদমেজাজি শাশুড়ির সাথে থাকতে হচ্ছে, যিনি বিশ্বাস করেন যে তাঁর মতামতের গুরুত্ব আপনার চেয়ে বেশি, তিনিই সবসময় সঠিক। অথবা এমন কেউ, যিনি কি না যেকোনো ব্যাপারে আপনাকেই দোষী সাব্যস্ত করেন। এসব পরিস্থিতিতে অন্যকে বলে বেড়ানো, নীরবে ক্ষোভ ধরে রাখা, আলাদা হয়ে যাওয়া বা বিরক্তিকর ইন ল’সদের সাথে সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়াটা সাময়িক সমাধান হলেও এতে প্রায়ই পরবর্তীতে সমস্যা আরো বেড়ে যায়।
এমতাবস্থায়, ডিফিকাল্ট ইনল’সদের সাথে মানিয়ে চলার কিছু টিপস শেয়ার করছি:
একজন মুসলিম নারীর বুঝতে হবে যে, সবাই একরকম হবে না। আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে সেভাবেই সৃষ্টি করেছেন; একেকজন মানুষের মনোভাব, দ্বীনদারি, যুক্তিবোধ এবং আচরণ একেকরকম। আর বয়সের সাথে সাথে মানুষের যুক্তিবোধ হ্রাস পেতে থাকে এবং তাঁরা অনেক ক্ষেত্রেই শিশুদের মতো আচরণ করেন। একজন মুসলিম নারীকে আরও মনে রাখতে হবে যে, কখনো কখনো শাশুড়িরা তাঁদের ছেলেদের স্ত্রীদের প্রতি ঈর্ষা বোধ করেন ।
অতএব, ধৈর্য সহকারে সহ্য করতে হবে। আপনার স্বামীর পরিবারের সঙ্গে আপনার আচরণের ক্ষেত্রে আপনাকে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে হবে, বিশেষ করে আপনার স্বামীর মায়ের সঙ্গে। আপনি তাঁর সাথে সুন্দরভাবে কথা বলুন, তাঁর প্রশংসা করুন, তাঁর জন্য মন থেকে দু’আ করুন, তাঁর ডাকে সাড়া দিন এবং তাঁর সেবায় উদ্যোগী হোন। উদাহরণস্বরূপ, ঔষধ খেয়েছেন কি না, বা ডাক্তার অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকলে মনে করিয়ে দেওয়া ইত্যাদি। তাঁর মন জয় করার ক্ষেত্রে উপহার আদানপ্রদান একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কখনও কখনও বউরা এসব করার পরও শাশুড়ি কনভিন্সড না হয়ে সবসময় সমস্যা তৈরি করতে চেষ্টা করেন। এই ক্ষেত্রে বোনেদেরকে সবর করতে হবে এবং আল্লাহ সুবহানাহুু ওয়া তা’আলার কাছে সাহায্য চাইতে হবে তার অবস্থা সহজ করার জন্য। সম্ভব হলে স্বামীর মনে মায়ের প্রতি বিরূপ ধারণা না দিয়ে সমস্যা সমাধানের জন্য এ বিষয়ে দুজনে পরামর্শ করতে পারেন।
“যে ব্যক্তি ধৈর্যধারণ করতে পারবে, সে কখনো সফলতা থেকে বঞ্চিত হবে না। হয়তো বা সফল হবার জন্য তার একটু বেশি সময় লাগতে পারে।” – আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু)
আপনার নিজের পরিবারের সাথে তাদের পরিবারের তুলনা করে শুধু শুধু নিজের কষ্ট বাড়াবেন না। একেক পরিবারের কালচার একেক রকম। কিছু কথা, কিছু আচরণ আপনার কাছে অস্বাভাবিক মনে হলেও তাদের কাছে হয়তো এটাই স্বাভাবিক।
শ্বশুরবাড়ির লোকজন ছেলের বউয়ের ফ্যামিলিকে অনেক সময় অসম্মান করেন, সামনে বা তাঁদের পেছনে কটুকথা বলেন, যা যেকোনো মেয়ের পক্ষে মেনে নেয়া কষ্টকর। কিন্তু বোনেরা যদি এভাবে চিন্তা করেন যে, তাঁদের কটুকথার বিনিময়ে আপনার বাবা মা’র আমলনামায় বিনা পরিশ্রমে সাওয়াব লেখা হয়ে যাচ্ছে এবং আপনি যে এই কঠিন মুহূর্তে সবর করছেন তার জন্য আল্লাহ তা’আলা অবশ্যই আপনাকেও উত্তম প্রতিদান দান করবেন, তাহলে হয়তো সেই কষ্টটা কিছুটা কমতে পারে।
“কোনো মানুষের খারাপ আচরণে কষ্ট পাওয়ার কিছুই নেই। যেখানে সৃষ্টিকর্তা হওয়া সত্ত্বেও মানুষ আল্লাহর অবাধ্যতায় চরমভাবে লিপ্ত, তথাপিও তিনি তাদের রিযক দিয়ে লালন-পালন করেন। এটি মুসলিম উম্মাহর জন্য এক মহান শিক্ষা।
সুতরাং মানুষের আচরণে দুঃখ না করে ধৈর্য ধারণ করায় রয়েছে উত্তম পুরস্কার। কারো আচরণে কষ্ট পেয়ে থাকলে তাকে ক্ষমা করে দিতে চেষ্টা করুন, হয়তো আপনার এ আচরণে আল্লাহ্ তা’আলা সন্তুষ্ট হয়ে বিচারদিবসে আপনার অনেকগুলো কষ্ট দূর করে দিবেন।” -ড. বিলাল ফিলিপ্স
হাসবেন্ডের মা-বাবাকে দেখাশুনা/খেদমত করা ছেলের বউয়ের জন্য ফরয নয়, মুস্তাহাব। কিন্তু আপনার স্বামীর জান্নাতে যাওয়ার জন্য সাহায্য করার দায়িত্ব তো আপনার আছে, তাই না? আপনি হয়তো তাঁদের অনেক খেদমত করছেন, কিন্তু কোনো অ্যাপ্রিসিয়েশন পাচ্ছেন না। তাতে দুঃখিত হবেন না। মনে করুন, আপনি তাঁদের জন্যে যা করছেন, আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টির জন্যে করছেন।
“আপনি যতই চেষ্টা করেন না কেন, সকলকে সন্তুষ্ট করতে পারবেন না। এজন্য শুধুমাত্র আল্লাহকে সন্তুষ্ট করাকে আপনার লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করুন এবং মানুষজন কী বলবে বা কী ভাববে, এই চিন্তাকে অগ্রাহ্য করুন।” -শায়খ আহমাদ মূসা জিবরীল
তাঁদের কাছে প্রতিদান বা অ্যাপ্রিসিয়েশন আশা না করে আল্লাহ তা’আলার কাছে প্রতিদানের আশা করুন। অবশ্যই আল্লাহর প্রতিদান তাঁদের প্রতিদানের চেয়ে অনেক ভালো কিছু হবে। তাঁরা হয়তো আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে আপনার জন্যে পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় পাশ করে হয়তো আপনি আল্লাহ তা’আলার আরো নিকটবর্তী হয়ে যাবেন। কী পাননি, সেটা ভেবে আফসোস না করে যা পেয়েছেন, তার জন্যে মন থেকে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করুন।
আপনার স্বামীর বাবা-মাকে আপনি যতটা অপছন্দ করেন, তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি আপনার স্বামীকে ভালবাসুন। আপনার শ্বশুর-শাশুড়ির অপছন্দনীয় দিকগুলো তাঁকে সরাসরি না বলে (সেটা হয়তো তাঁকে তাঁর বাবা-মাকে ডিফেন্ড করার প্রবৃত্তিকে ট্রিগার করবে) তাঁদের সাথে কিছুটা কৌশলী হয়ে নিজেই কথা বলুন। এরকম তো হতে পারে আপনার স্বামী নিজেই হয়তো তাঁর ফ্যামিলির অনেক কিছু নিয়ে বিব্রত। কিন্তু এই ভয়ে প্রকাশ করছেন না যে, তিনি বললে আপনি হয়তো আরও বেশি পেয়ে বসবেন। তাই না ভেবেচিন্তে কোনোকিছুর জন্যে প্রকাশ্যে কিংবা মনে মনে তাঁকে দোষারোপ করবেন না। আপনার ইন ল’সদেরকে আপনাদের সম্পর্ক নষ্ট করার ক্ষমতা দিবেন না। একজন প্রতিহিংসাপরায়ণ পুত্রবধূর পরিবর্তে বরং একজন উত্তম স্ত্রী হওয়ার উপর ফোকাস করুন। এতে করে আপনি যেভাবে আপনার স্বামীর মন জয় করতে পারবেন, তেমনি আল্লাহ তা’আলাও আপনার উপর সন্তুষ্ট হবেন। এমনভাবে চলুন, যাতে আপনার স্বামীর আনুগত্য ও বিশ্বাস অর্জন করতে পারেন। যাতে যেকোনো কঠিন সাংসারিক পরিস্থিতির মোকাবিলা আপনারা দম্পতি হিসেবে একসাথে করতে পারেন।
যদি খুব প্রয়োজন হয়, তবেই শুধুমাত্র বিশ্বস্ত, জ্ঞানী ও ধার্মিক কারো কাছে পরামর্শের জন্য যান।
আপনার দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তন করুন। আপনি এবং আপনার শাশুড়ি দুজনেই প্রাপ্তবয়স্ক, তাই আপনি ছোট বাচ্চার ন্যায় আচরণ করবেন না। তিনি আপনাকে ততটাই প্রভাবিত করতে পারবেন, যে পরিমাণ প্রভাব বিস্তার করার ক্ষমতা আপনি তাঁকে দিবেন। আপনার উইক পয়েন্টগুলো কী, তা জানুন। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে আদবের সাথে গঠনমূলক ও সংশ্লিষ্ট ইসলামিক উপায়ে কীভাবে রিঅ্যাক্ট করবেন, সেটা নিয়ে ভাবুন। কোনো পরিস্থিতিতে যদি নীরবতা বজায় রাখা উত্তম বলে মনে হয়, তবে তা-ই করুন।
দৃঢ়ভাবে তাঁদের সাথে যোগাযোগ করুন। আপনার প্রয়োজনগুলি জানানোর জন্য গুরুতর বিরোধের প্রয়োজন নেই। কিন্তু যদি সুযোগ পান, তাহলে উদ্ধত-অহংকারী না হয়ে দৃঢ়ভাবে নিজের অবস্থান জানানোটা জরুরী। যদি আপনার স্বামী উদ্যোগী হয়ে নিজে থেকেই তাঁদের সাথে এগুলো নিয়ে কথা বলেন, সেটা তো আরও চমৎকার।
যুক্তিসঙ্গত সীমা নির্ধারণ করুন, প্রয়োজন হলে কিছুটা মানসিক দূরত্ব বজায় রাখুন। আপনি সম্পূর্ণরূপে আপনার শাশুড়ির আচরণ (বা অন্য যে কারোরই) নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। তবে তাঁর আচরণ আপনার উপর কী প্রভাব ফেলতে পারে, তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। এই সীমারেখার উদ্দেশ্য হবে নিজেকে এবং/অথবা আপনার বিয়েকে রক্ষা করা।
যদি এরকম হয় যে আপনার শাশুড়িকে কথা বলে বা পরামর্শ দিয়ে কোনো লাভ হয় না, এবং কোনো কারণ ছাড়াই তিনি উত্তেজিত হয়ে যান, তবে সবসময় নিজেকে দোষারোপ করবেন না। তিনি কষ্ট পেলে বা রাগ করলে ভাববেন না যে, আপনারই ভুলে সেটা হয়েছে। তাঁদের সাথে যথাসম্ভব ভালো ব্যবহার করুন। তিনি যখন দেখবেন যে, তাঁদের খারাপ আচরণ আপনাকে কোনোভাবেই এফেক্ট করছে না; তাঁরা যা-ই করুন, আপনি ভালো ব্যবহার করছেন; বিনয় প্রদর্শন করছেন; তখন আশা করা যায়, তাঁরাও আপনার সাথে ভালো ব্যবহার করা শুরু করবেন।
আমাদের অনেকের বাবা-মা’রাও তো এরকম আছেন, যারা সব কথায় রিঅ্যাক্ট করেন বা অল্পতেই উত্তেজিত হয়ে যান; ছেলেমেয়েদের গালমন্দ করেন। তাঁদেরও অনেক সময় অনেক বদভ্যাস থাকে। কিন্তু নিজের বাবা মা বলে আমরা কিন্তু মেনে নিই। তাহলে আপনার শ্বশুর–শাশুড়িকে তাঁদের স্থানে রেখে চিন্তা করুন তো! তখন নিশ্চয়ই তাঁদের ব্যবহারে আপনি ততটা কষ্ট পাবেন না, যতটা আগে পেতেন। তাঁদের জন্যে, নিজের জন্যে আন্তরিকভাবে আল্লাহর কাছে দু’আ করুন, যাতে আল্লাহ আপনাদের মধ্যকার সম্পর্ক সুন্দর করে দেন। আমীন।
সহায়ক প্রবন্ধের উৎস: আইডিয়াল মুসলিমাহ (মূল আর্টিকেল লিংক)
লেখক: তানজিদা আহমেদ
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।