ধর্ম কী?
ইউরোপ ‘ধর্ম’ বলতে ভিন্ন একটা জিনিস বোঝে বা বুঝায়। তাদের কাছে ‘ধর্ম’ মানে হল দুনিয়ার সাথে নিঃসম্পর্ক আধ্যাত্মিকতা। যেজন্য খৃষ্টবাদ হল তাদের চোখে ‘পিওর ধর্ম’। ইসলাম ও ইহুদিবাদ ‘পিওর ধর্ম’ না। এতে পারিবারিক, সামাজিক, বিচারিক, রাষ্ট্রীয় কথাবার্তা আছে বলে। সেন্ট পলের খৃষ্টবাদ (ইউরোপীয় খৃষ্টবাদ) ইউরোপের চোখে ধর্মের যে ছবি এঁকে দিয়েছে তা হল—
১. দুনিয়া ও ধর্ম পৃথক জিনিস। একসাথে মেলানো যাবে না ‘Render unto GOD that is GOD’s. And render unto Caeser that is Caeser’s. কিংবা ‘My kingdom is not of this world’. ধর্ম দুনিয়া নিয়ে মাথা ঘামাবে না। সমাজ-রাষ্ট্র এগুলো ধর্মের টপিক না। বর্তমান সেক্যুলারিজমের জন্মের পিছনে খৃষ্টবাদের দায় অনেক।
২. দুনিয়ার কাজ আর ধর্মের কাজ আলাদা আলাদা। ধর্মের কাজ করতে হয় দুনিয়া থেকে বেরিয়ে। মঠবাসী সন্ন্যাসী হয়ে।
৩. ধর্মে কোনো যুক্তি নেই, যুক্তির স্থান নেই। মানবিক বুদ্ধিতে ধর্ম ধরে না। নিরেট বিশ্বাসে ধর্মের অস্তিত্ব।
৪. ধর্ম মানে অবৈজ্ঞানিক, অযৌক্তিক সাধনা। দুনিয়ার সম্পর্ক-সম্পদ-মোহ ত্যাগ, মঠবাসী জীবন, লাগাতার উপবাস, নিজেকে নানাভাবে অকারণ কষ্ট দেয়া, অবৈজ্ঞানিকভাবে মানবিক চাহিদাকে বঞ্চিত করা। এগুলোই ধর্ম।
এই চোখে ইসলামকে দেখলে তাই পছন্দ হয়না। বরং রুমীর ‘সুফিজম’ এই চোখে বেশ। ধর্ম যে যৌক্তিক হতে পারে, মানবীয় যুক্তিকে পরাস্ত করতে পারে, ধর্ম যে বিজ্ঞানসম্মত হতে পারে, চোখের দেখা-অন্তরের যুক্তিবোধ-পর্যবেক্ষণ দিয়ে যে ধর্মের সত্যতা অনুভূত হতে পারে— এটা ইউরোপীয় ধর্মের সংজ্ঞায় পড়ে না। ধর্ম ও বিজ্ঞান, ধর্ম ও যুক্তি, ধর্ম ও দুনিয়ার এই সেপারেশন খাঁটি ইউরোপীয় এনলাইটেনমেন্টীয় দৃষ্টিভঙ্গি।
এজন্যই ইসলামকে কখনও ইউরোপীয় দার্শনিকেরা বলেছে ‘বস্তুবাদী ইহুদিবাদের আধ্যাত্মিক সংস্করণ’, কখনও বলেছে ‘এটা কোনো ধর্ম না, এটা একটা socio-politico-economic system’। কেননা ইসলাম তাদের পরিচিত ‘পিওর ধর্ম’ খৃষ্টবাদের মত না। এখানে যুক্তির জায়গা আছে (কিয়াস)। এখানে পর্যবেক্ষণের স্থান আছে। এখানে মানবীয় আকল/ জ্ঞানবোধ খাটানোর তাগিদ আছে। ইন্দ্রিয়-বেক্ষণের উৎসাহ আছে, না খাটালে ভর্ৎসনা আছে। তোমরা কি আক্কেল কর না? তোমরা কি দেখো না? তোমরা কি চিন্তাভাবনা করো না? চিন্তাভাবনা করে, আকল খাটিয়ে, বীক্ষণ করে মানে দেখে (সেটা হতে পারে দূরবীক্ষণ, হতে পারে অণুবীক্ষণ) এই ধর্মে সৃষ্টিকর্তাকে চিনে নেয়া যায়। ফিতরাতের এই দ্বীন মানবীয় আকলী ফিতরাতের সাথে যায়। জোর করে যুক্তিবুদ্ধি-হিসাব অস্বীকার করে ‘একে তিন, তিনে এক’ মেনে নিতে হয় না।
যুক্তি ও অভিজ্ঞতার মূল্য
অদৃশ্যে বিশ্বাসের বিষয়গুলো (গায়েব) নিপাট চোখ বুজে বিশ্বাসের জিনিস। কেননা এখানে জ্ঞানতত্ত্ব একমাত্র ‘ওহী’। এখানে না যুক্তি খাটে, না পর্যবেক্ষণ। কিন্তু কুরআনে আল্লাহ বার বার নিজের অস্তিত্ব জানান দিয়েছেন পর্যবেক্ষণের ভিতরে। বলছেন, বিশ্বজগতের সৃষ্টির ভিতর আমার চিহ্ন রয়েছে, দিবারাত্রির পরিবর্তনে আমার আয়াত রয়েছে। জীবজগতের ভিতর, তোমার নিজ শরীরের ভেতর, দিগন্তে উদয়াস্তের ভিতর, পানিবণ্টনের ভিতর আমার নিদর্শন, আমার চিহ্ন রয়েছে। তোমরা কি দেখো না? তোমরা কি ভাবো না? এগুলো চিন্তাশীলদের জন্য, যারা ভাবে। আর নবীজীর সত্যতা বুঝার ব্যাপারেও আল্লাহ আকল-যুক্তিকে ভর্ৎসনা করেছেন— তাদের জন্য তাদেরই মধ্য থেকে তাদেরই ভাষায় একজন নিরক্ষর নবী পাঠিয়েছি। যে তাদেরই মাঝে জন্ম নিয়েছে, ৪০টা বছর তাদেরই সাথে ওঠাবসা করেছে, ৪০টা বছর তারা তার মুখ থেকে একটাও মিথ্যে শোনেনি, তারাই তার নাম দিয়েছে আল-আমীন, তাদেরই ভাষায় পাঠালাম যাতে তারা ভাষাশৈলীর মুজিযা বুঝে হয়রান হয়ে যায়, তাদের বড় বড় কবিরা স্বীকারও করেছে ‘এটা কোনো মানুষের কথা না’। আর তারাই এখন তাকে মিথ্যেবাদী বলছে, স্রেফ স্বার্থে আঘাত লেগেছে বলে। আরবদের যুক্তিকে-বোধকে আল্লাহ ভর্ৎসনা করলেন। আল্লাহ নিজের আর রাসূলের সত্যতার ব্যাপারে মানুষের জ্ঞানতত্ত্বকে দায়িত্ব দিয়েছেন, ফিতরাতগতভাবেই মানুষ এই দুই বিষয়ে ঈমান আনতে পারে, যদি ফিতরাত দূষিত না হয় । আর এই বিশ্বাস এসে গেলে গায়েবের বিষয়ে বিশ্বাস আপনাতেই এসে যায়, কেননা বাকিগুলো unthinkable।
আর বিধিবিধানের ব্যাপারে আমরা সব মেনে নিই আল্লাহর হুকুম বলে। কিন্তু এখানে যুক্তি ও অভিজ্ঞতার স্থান আছে। আল্লাহ-রাসূলের টেক্সট ধরে নতুন বিধান নির্ধারণের ক্ষেত্রে যুক্তি ও অভিজ্ঞতার মূল্য রয়েছে। এবং আল্লাহর হিকমাহ (প্রজ্ঞা) বুঝার ক্ষেত্রে যুক্তি-পর্যবেক্ষণ প্রয়োজনীয়, যা ঈমানের উপর আরও ঈমান বৃদ্ধি করে। আল্লাহর একেকটা বিধানের অন্তর্নিহিত প্রজ্ঞা অনুধাবন আমাদেরকে আরও আল্লাহর সর্বব্যাপী জ্ঞান, ভবিষ্যতের প্রজ্ঞার ব্যাপারে দৃঢ়বিশ্বাস (ইয়াকীন) প্রদান করে। যেমনটি পিতা[১] ইবরাহীম আলাইহিস সালাম চেয়েছিলেন আল্লাহর কাছে। তিনি আল্লাহকে প্রশ্ন করলেন—
– রাব্বী, মৃত্যুর পর দেহ তো বিশ্লিষ্ট হয়ে যাবে। পোকা মাকড়ের পেটে। পানি-মাটি-বাতাসে মিশে কোথায় কোথায় চলে যাবে। সেগুলোকে আবার তুমি একত্রিত করে পুনর্জীবন দেবে। পুনর্জীবনে তো আমি বিশ্বাস করিই, কিন্তু কীভাবে তুমি সব একখানে আবার গুছিয়ে পুনর্জীবন দেবে সেই ‘প্রক্রিয়া’টা দেখতে সাধ হয়। দেখাবে?- বন্ধু, তবে কি তুমি আমার খবরে বিশ্বাস কর না।- না না মালিক, বিশ্বাস তো আলবৎ করি। কিন্তু কেমন করে তুমি করবে সেইটা দেখতে চাইছি। আর স্বচক্ষে দেখার সাথে তুমি অন্তরের যে তৃপ্তি রেখেছো, সেটা চাইছি, মালিক। বেয়াদবি নিও না।
এরপর আল্লাহর আদেশে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম যেটা করলেন, সেটাকে এক্সপেরিমেন্ট বললে কি ভুল হবে? ৪ প্রজাতির ৪ টি পাখি নিলেন। তাদেরকে পোষ মানালেন। এতটাই ন্যাওটা করে তুললেন যাতে ডাকলেই ছুটে আসে। এরপর তাদেরকে জবাই করলেন, টুকরো টুকরো করলেন, কিমা বানালেন। সেগুলো কে ভালোভাবে মিশালেন একসাথে। এরপর সেই মিশানো কিমা পাহাড়ে পাহাড়ে রেখে আসলেন। এবার আল্লাহর আদেশমতো পাখিগুলোকে নাম ধরে ডাক দিলেন। পাখিগুলো উড়ে উড়ে নয়, বরং মাটি দিয়ে ‘দৌড়ে’ এলো, যাতে তাদের পুনর্গঠন প্রক্রিয়াটা ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে নিলেন।[২]
অর্থাৎ ঈমান আনার পর আল্লাহর প্রজ্ঞা বুঝে ঈমানকে আরও দৃঢ় করতে মানা নেই। তবে কেন ইউরোপীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে ধর্ম আর পর্যবেক্ষণকে আলাদা করা কথা বলি আমরা? একটা হুকুম তো আমরা মানি ‘আল্লাহর হুকুম’ বলেই, বিনা প্রশ্নে। কিন্তু যদি বিজ্ঞানের গবেষণা আমাদেরকে সেই হুকুমটার ব্যাপারে, আল্লাহর ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়ার ব্যাপারে, আল্লাহর সর্বজ্ঞানের ব্যাপারে আমাদেরকে অন্তরের তৃপ্তি জোগায় পিতা ইবরাহীম আ. এর মত, তাহলে তাকে কেন আমরা পৃথক রাখতে বলি? কেন পশ্চিমা সভ্যতার সুরে সুর মিলিয়ে আমরা ইসলামকেও খৃষ্টবাদের পর্যায়ে নামাই?
সমস্যাটা কোথায়?
তবে সমস্যা আছে, সেটা হল বর্তমান বিজ্ঞান ‘পশ্চিমা বিজ্ঞান’। এর সমস্যা দুটো —
১. বর্তমান বিজ্ঞানের লক্ষ্য ‘চূড়ান্ত সত্যে পৌঁছানো’ নয়। এর লক্ষ্য সব ঘটনার একটা বস্তুবাদী দুনিয়াবি ব্যাখ্যা দেয়া, যা দ্বারা ঘটনাটাকে বুঝা যায়। ফলে এই বিজ্ঞানের দ্বারা ‘চূড়ান্ত সত্যে’ পৌঁছানো সম্ভব না। যদি কেউ এই বিজ্ঞানের দ্বারা চূড়ান্ত সত্যে যেতে চায়, তাকে আগেই বিশ্বাস করতে হবে ‘এই বস্তুগত জগতের বাইরে কোনো সত্য থাকতে পারে না’। এই অন্ধবিশ্বাস আগে করে নিয়ে এরপর বিজ্ঞানের ফলাফলকে সে চূড়ান্ত সত্য ভাবতে পারে। সুতরাং বর্তমান পশ্চিমা বিজ্ঞান চূড়ান্ত সত্যে পৌঁছোবার রাস্তা নয়।
২. বিজ্ঞান এই সমাজেরই অংশ, সমাজের বাইরে না। বিজ্ঞানের জ্ঞানও একটা সামাজিক জ্ঞান। সুতরাং এই বিজ্ঞান পশ্চিমা সমাজ প্রভাবিত। পশ্চিমা কৃত্রিম অ-ফিতরাতী সমাজ-ধারণার বাইরে এমন কোনো গবেষণা, এমন কোনো ফলাফল তারা এলাউ করবে না, যা তাদের সংস্কৃতিকে, তাদের চিন্তাজগতকে, তাদের অনুভূতিকে আঘাত করে। এমন কোনো রিসার্চ ফান্ডিং পাবে না, জার্নালে আসবে না, পিয়ার রিভিউয়ে টিকবে না, একাডেমিয়ায় ঝড় উঠবে, পশ্চাদপদ-সেকেলে বলে তাকে ডাউন করে দেয়া হবে। বহু উদাহরণ দেয়া যায়। (বইয়ে থাকবে ইনশাআল্লাহ) বিশেষ করে psychology academia-র scientific dishonesty তো পুরো একাডেমিয়াতে মশহুর। হস্তমৈথুন, সমকাম, নারীবাদের অধিকাংশ গবেষণা সাইকোলজিস্টরা করেছে। সাইকোলজিস্টদের এসব ‘এসি রুমে বসা’ থিওরির সাথে ডাক্তারদের (যারা ফিল্ডে কাজ করে) বহু বিষয়ে ইখতেলাফ রয়েছে। অনেক আর্টিকেল পাবেন যেখানে পরস্পর পরস্পরকে ধুয়ে দিচ্ছে।
যার কারণে আল্লাহর হুকুমের প্রজ্ঞা, আল্লাহর নিদর্শন এই পশ্চিমা বিজ্ঞানের দ্বারা বুঝা সম্ভব না। মুসলিমদের এই মেথডোলজি ঠিক রেখে স্বতন্ত্র বিজ্ঞান-কাঠামো, পৃথক বিজ্ঞান-দর্শন তৈরি করতে হবে। মধ্যযুগের মুসলিম বিজ্ঞান এক্ষেত্রে সামনে রাখা যায়। তারা গবেষণা করেই আল্লাহর পরিচয় দৃঢ়ভাবে পেতেন। [এমন একটা আলোচনার একটা নোট কমেন্টে। বইতেও বিস্তারিত থাকবে ইনশাআল্লাহ।] তবে এখন পশ্চিমা বিজ্ঞান থেকে আমরা কিছুই নেব না? হ্যাঁ, নেব। যা তাদের সমাজ-প্রভাবিত না, পুঁজিবাদকে পুষ্টিদাতা না, ফিতরাত-বিধ্বংসী না, সেগুলো। বুঝবেন কীভাবে কোনগুলো? যে গবেষণাগুলো আমাদের ওহীর সাথে যায়, আমরা শুধু সেগুলোকেই সঠিক বলে নেব। কেননা, ওহী নির্ভুল। পশ্চিমা বিজ্ঞান বায়াসড, ওহী বায়াসড না। ওহী সকল মানুষের কল্যাণে, আর পশ্চিমা বিজ্ঞান পুঁজিপতিদের কল্যাণে। এটুকু মাথায় রেখে পশ্চিমাবিজ্ঞান চর্চা, আল্লাহর হুকুমের হিকমাহ বুঝার জন্য উল্লেখ করা-কে অপরাধ কেন বলছেন? হুকুম মানা হবে বিনা প্রশ্নে, দৃঢ়বিশ্বাসের জন্য ব্যবহার করা হবে পর্যবেক্ষণলব্ধ বিজ্ঞান।
এটা কি প্রতারণার মাধ্যমে দীনপ্রচার? পুঁজিবাদের প্রতারণা চোখে পড়ে না, বিজ্ঞানীদের প্রতারণা চোখে পড়ে না। মুসলিম ভাইয়ের কর্মপদ্ধতি প্রতারণার ফিল্টারে ধরা পড়ে? জি না, এটা প্রতারণা না। শুরু থেকে পড়ে আসলে এটা বুঝার কথা। যেহেতু পশ্চিমা বিজ্ঞানের মাপকাঠি আমাদের মাপকাঠি না। ওদের মাপকাঠিকে যদি ইউনিভার্সাল মেনে নিতাম, এরপর যদি কিছু মানতাম কিছু মানতাম না, তাহলে হত প্রতারণা। আমাদের মাপকাঠি আমাদের শরীয়া। শরীয়ার সাথে যেটুকু মিলবে, সেটুকুই ঠিক আছে বলে গণ্য হবে ও আমাদের মাঝে চর্চিত হবে ঈমান বৃদ্ধির জন্য। বাকিটুকু হবে না। এটা মুসলিম মননে বুঝতে এতো কষ্ট কেন?
ফিকহের উসুল হল, আমভাবে সব জায়েয, যদি না হারাম করা হয়। হালাল জিনিসই বেশি, হারাম জিনিস হাতেগোণা। আল্লাহ যেহেতু আমাদেরকে একটা জীবন-বিধান দিচ্ছেন, তাই এটাই যুক্তির দাবি যে, জীবন-যাপনের জন্য ক্ষতিকর জিনিসই তিনি নিষেধ করবেন। নির্দোষ বা কল্যাণকর কিছু তিনি অহেতুক আমাদের নিষেধ করবেন, এটা তাঁর শানের সাথে যায় না। অনেকে বলবেন, কই, মিথ্যা বলে তো কোনো ক্ষতি হয় না। মিথ্যা বললে যদি ক্ষতি না হয়, আর কীসে ক্ষতি? পারিবারিক, সামাজিক, আর্থিক ক্ষতি কি হয় না মিথ্যায়? মিথ্যাবাদী নিজেও তো বেইজ্জতির মধ্যে পড়ে যায় মিথ্যার কারণে, আত্মমর্যাদা নষ্ট হয়। হারাম সবকিছুই আবশ্যিকভাবে ক্ষতিকর, কোনো না কোনোভাবে, ব্যক্তিক বা সামষ্টিক। এই ক্ষতি বুঝতে পারা আল্লাহর প্রজ্ঞার ব্যাপারে আমাদের ঈমানকে বাড়ায়।
সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়ে যারা মানদণ্ড হিসেবে পশ্চিমও নেয়, আবার ইসলামও নেয়। এই বেচারারা আছে মহাজ্বালায়। কী করবে, কী বলবে, এটা না ওটা। ইউরোপ ইউনিভার্সালি বলছে হস্তমৈথুন খারাপ না, নরমাল। আবার এদিকে দীন বলছে হারাম। বেচারারা আছে দোটানায়। অনেকটা মধ্যযুগের খৃষ্টবাদীদের মত। ব্রেন বলছে ‘একে তিন, তিনে এক’ হওয়া অসম্ভব। ওদিকে মানতে হচ্ছে চোখ বুজে। শরীর বলছে বিয়েশাদী করা উচিত, আবার উঁচা মাকাম পেতে চাইলে বিয়ে করা যাবে না। আগে মানদণ্ড ঠিক করেন ভাই। ওহী না পশ্চিম। দুটোই সত্য হতে পারে না। আর আমাদের দ্বীন দুর্বোধ্যও না। আলহামদুলিল্লাহ।
এটাও ইলম-ই বটে
আমি আপনাদের একটা ছোট্ট উদাহরণ দিয়ে শুরু করি। আমার বাস্তব জীবনের। আব্বা মুহতারাম বাজার থেকে ১২টা মুরগী কিনে আনলেন ড্রেসিং করা। এদিকে আগে থেকেই তাবলীগে বিভিন্ন সমবয়েসী আলিমদের সাথে উঠাবসা ও বেহেশতী জেওর পড়া থাকার সুবাদে জানা ছিল যে, ড্রেসিং করলে সেই গোশত হারাম হয়ে যায়। কারণ হিসেবে ওনারা যা বলেন এবং বেহেশতী জেওরে যা উল্লেখ আছে, সেটা হল: গরম পানিতে পেটের ভিতরের নাড়ি গলে মুরগির পায়খানা বা পায়খানার রসটস মিশে যায় গোশতের সাথে। ফলে পুরো গোশতটা নাপাক হয়ে যায়। আরও নিশ্চিত হবার জন্য পছন্দের একজন আলিমকে ফোনও করলাম: হযরত কী করণীয়। উনিও জানালেন, এটা নাপাক হয়ে গেছে, আর খাওয়া যাবে না। অগত্যা আব্বা-আম্মাকে অনেক বুঝিয়ে বাদানুবাদ করে ১২টা মুরগি ডাস্টবিনে ফেলার ব্যবস্থা করা হল।
বছরখানেক আগে ফেসবুকে একজন কওমি ঘরানার মুফতী সাহেবকে ফলো করতাম। তিনি একদিন স্ট্যাটাস দিলেন যে, তিনি সশরীরে বাজারে গিয়েছেন ড্রেসিং-এর প্রক্রিয়া দেখেছেন, পানির তাপমাত্রা দেখেছেন, কতক্ষণ মুরগিটা চুবিয়ে রাখে দেখেছেন। এবং তার ফতোয়া হল: ড্রেসিং-এ পানির তাপমাত্রা এতো বেশি থাকে না বা এতো বেশি সময়ও রাখা হয় না, যাতে ভিতরে সব গোশতের সাথে মিশে যাবে। সুতরাং ড্রেসিং-এর দ্বারা গোশত নাপাক হবার যে কারণ দেখানো হয়, বাস্তবে তা হয় না। অতএব ড্রেসিং-এর গোশত খাওয়া যাবে।
এই ঘটনাটা বলে আমি বুঝাতে চাচ্ছি: ইসলামী ইলমেও empirical knowledge বা ‘পর্যবেক্ষণ করে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা থেকে লব্ধ জ্ঞান’-এর মূল্য রয়েছে। এই জ্ঞানও ইলমেরই অংশ; ইলম চর্চা ও ইলম প্রয়োগে এর বিকল্প নেই। শুধু ঐতিহ্যগত ফিকহী কিতাবের ‘নাকেল’ (পুনরাবৃত্তিকারী) হয়ে নয়, বরং জাদীদ (নতুন ও আধুনিক) সমস্যাগুলোতে ইলমকে প্রয়োগ করতে ‘পর্যবেক্ষণ’, ‘পরীক্ষা-নিরীক্ষা’ ইলমেরই অংশ।
আরেকটা উদাহরণ দিই। ইসলামী বিচার-ব্যবস্থা কেমন হয়, এটা আমাদের চোখের সামনে নেই। বৃটিশ বিচার-ব্যবস্থাকে আমরা বিচার নামে চিনি। আল্লাহর শুকরিয়া যে, ইসলামের কয়েকটি ভূখণ্ড আল্লাহ মুসলিমদের হাতে আবার দিয়েছেন শরীয়া-ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য। সেই ভূখণ্ডগুলোর তথ্য উম্মাহর সামনে বেশি বেশি আসা দরকার, যাতে শরীয়া প্রয়োগের বাস্তব সুফল উম্মাহর সামনে থাকে। যেমন উদাহরণ হিসেবে নিকটবর্তী ভূখণ্ডটিতে বিচারিক ব্যবস্থার কথা পড়েছিলাম কোথায় যেন। সেখানে বিচারক ফুলবাবু সেজে চেয়ারে বসে থাকে না। আর পুলিশ যে রিপোর্ট দেবে সেটাই চোখ বুজে মেনে তার উপর বিচার করেন না। বরং নিজে অকুস্থলে যান, জিজ্ঞাসাবাদ করেন। অনূর্ধ্ব ১ সপ্তাহের ভিতর মজলুম বিচার পেয়ে যায়। শুনানির জন্য ডেটের পর ডেট দেয়া লাগে না। এটা হল empirical knowledge.
আমি আলিম নই। বিজ্ঞ আলিমগণ যারা একাধিক তাফসীর পড়েছেন, তারা আরও ভালো উপলব্ধি করতে পারবেন। বিচ্ছিন্নভাবে যে দুয়েকটা তাফসীর পড়েছি, বিশেষ বিশেষ আয়াতের ব্যাখ্যায় ‘অভিজ্ঞ হেকিমরা বলেন…’ এভাবে চিকিৎসকদের গবেষণা ও অভিজ্ঞতা উল্লেখ হয়েছে। সংক্রামক ব্যাধি-কেন্দ্রিক হাদিসের ব্যাখ্যায় ইবনে হাজকার আসকালানি রহ. তৎকালীন চিকিৎসকদের মতামতও উল্লেখ করেছেন, যতদূর মনে পড়ছে। আমজনতার মাসয়ালার কিতাব ‘বেহেশতী জেওর’-এও হেকিম-ডাক্তারদের মতামত জায়গায় জায়গায় উল্লেখ ছিল বলে মনে পড়ছে। তার মানে কুরআনের ব্যাখ্যায়, হাদিসের ব্যাখ্যায়, ফিকহের আলাপে ‘মূলসূত্র’ তো কুরআন-হাদিস-আছার। কিন্তু সহকারী বা সম্পূরক হিসেবে ওহীর সাথে ‘সংগতিপূর্ণ’ empirical knowledge বা পেশাদারদের ‘অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ প্রসূত জ্ঞান’ (বিজ্ঞান)-এর মূল্য শরীয়া রেখেছে ও দিয়েছে। এবং আমার বক্তব্য হল, ‘ওহীর সাথে সংগতিপূর্ণ বিজ্ঞান’ ইলমে-দ্বীনেরই অংশ। সেটা ‘ওহীকে যাচাই করার জন্য নয়, ওহীকে বুঝার জন্য’।
ঠিক এই সাইকোলজির কারণেই মধ্যযুগে ইসলামী জ্ঞানবিজ্ঞান ফ্লারিশ করেছিল। বিজ্ঞানীরা বিজ্ঞানকে বুঝাতেও ‘ইলম’-শব্দটিই ব্যবহার করতেন। ধর্ম ও বিজ্ঞান আলাদা করা হয়নি শুরুতে। ইমাম শাফিঈ রাহিমাহুল্লাহ বলেন: “العلم علمان: علم فقه الأديان، وعلم طب الأبدان”[১] ইলম দুই প্রকার: দ্বীনী ফিকহের ইলম, দেহের চিকিৎসার ইলম। ‘ইলম’ আলাদা করার প্রয়োজন পড়ল তখন, যখন বিজ্ঞান দিয়ে ওহীকে যাচাই করে ওহীর বিরোধিতা শুরু হল; আল্লাহর সিফাত অস্বীকার, তাকদীর অস্বীকার। তখন মানবিক জ্ঞান থেকে ওহীর জ্ঞান ও পৃথক মর্যাদা পাবলিককে বুঝাতে ‘ইলমুদ্দীন’-এর পুনরুজ্জীবন এর দরকার হল। এর আগে যতদিন ‘পর্যবেক্ষণ প্রসূত জ্ঞান’ (বিজ্ঞান) শরীয়ার অধীনে চলেছে, তা ছিল ইলমেরই অংশ এবং ইবাদত।
নিঃসন্দেহে ‘ফারায়েয শাস্ত্র’ সহজীকরণের জন্য যে ‘বীজগণিত’ তা ইবাদত-ই। জমি মেপে শরঈ খারাজ নির্ধারণের জন্য যে ‘পরিমিতি-জ্যামিতি’ তা ইলমেরই অংশ। ‘সকল রোগেরই চিকিৎসা রয়েছে’-হাদিস শুনে তা বের করার যে গবেষণা, হাদিসকে সত্য প্রমাণের প্রচেষ্টা— তা ইলম না হবার কোনো কারণ নেই। কিবলা ঠিক করার উদ্দেশ্যে যে ‘গোলীয় ত্রিকোণমিতি’ তা তো দ্বীনেরই অংশ। ওহীর তাবে’ (অধীনে) যে বিজ্ঞান, তাও দ্বীনী ইলম। ফিকহে এরও মূল্য দেয়া হয়েছে। কুরআন-হাদিস থেকে উৎসারিত প্র্যাকটিক্যাল এগুলো।
এখন করণীয় কী?
সমস্যা একটাই। সমস্যা হল মুসলিমদের হাতে মেইনস্ট্রীম ‘পর্যবেক্ষণলব্ধ (বি) জ্ঞান’ নেই। মানে এটা করলে পশ্চিমা বিজ্ঞানের অধীনে করতে হবে। ‘জাগতিক ব্যাখ্যার ভিতরেই সীমাবদ্ধ থাকার পণ’ করে। এনলাইটেনমেন্টীয় সেক্যুলারায়নের সুবাদে বর্তমান বিজ্ঞানও সেক্যুলার। পশ্চিমা বিজ্ঞান প্রতিটি প্রশ্নের জাগতিক উত্তর দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। মহাবিশ্ব সৃষ্টি, জীবনের উৎপত্তি-সহ সকল ঘটনার একটা বস্তুগত ব্যাখ্যা সে দেবে, তা যতই হাস্যকর হোক। মুসলিমরাও নিজেদের পর্যবেক্ষণে চেতনে-অবচেতনে পশ্চিমা একাডেমিয়ায় গৃহীত হবার জন্য একই নিয়মে মাঠে নামে। এটা জ্ঞানের সেক্যুলারায়নের ফল।
১.
এখন যদি কোনো মুসলিম বিজ্ঞানী এভাবে মাঠে নামে যে, আমি জাগতিক ব্যাখ্যার ঠুলি চোখ থেকে খুলে ফেলব। আগেই এক পা বেঁধে দৌড়ে কেন নামব? পা খোলা থাকবে, দেখি কতদূর দৌড়োতে পারি। আমার গবেষণার ফল যদি ওহীর সত্যতা স্বীকার করে সেটা আমি বলব। আমার গবেষণা যদি ইঙ্গিত করে একজন স্রষ্টা আছেন, সেটাই আমি সাহস করে বলব, বস্তুবাদী ব্যাখ্যা দিতে আমি বাধ্য না। বিশ্বাস করেন আবার সেই মধ্যযুগ ফিরিয়ে আনা সম্ভব। (উম্মাহর রাজনৈতিক স্বাধীনতা থাকার শর্ত প্রযোজ্য)। এমন একটা জ্ঞানতাত্ত্বিক বিপ্লব আসা খুব দরকার। জ্ঞানের কেবলা পশ্চিমা একাডেমিয়া থেকে সরিয়ে নিজস্ব ‘মুক্ত বিজ্ঞান’, নিজস্ব একাডেমিয়া, নিজস্ব জার্নালের দিকে নিতে হবে। ফান্ডিং অবশ্যই বড় ইস্যু। কীভাবে করা হবে সেটা আমার আলোচ্য না। আমি বলতে চাই, কিছু মুসলিম রিসার্চার পশ্চিমা একাডেমিয়ার পাশাপাশি বিকল্প বিজ্ঞানচর্চার দিকে আস্তে আস্তে এগোনো প্রয়োজন। আমার জানা মতে ইরাক-মালয়েশিয়া-ইরান-সৌদি-পাকিস্তানের বিজ্ঞানীরা ওহীর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা করছেন, নিজস্ব জার্নালে ছাপছেন। তবে পশ্চিমা বিজ্ঞানের সেই স্বতঃসিদ্ধ বিশ্বাস মেনেই।
সেই একই হিসেবে পশ্চিমা গবেষণা যা আমাদের ওহীর সাথে মেলে, ওহীর সামনে এসে মুখ থুবড়ে পড়ে। সেগুলো উল্লেখ করতেও কোনো সমস্যা নেই। এবং আমার মতে করা উচিত। এর ফলে দুটো জিনিস হবে—
ক. পশ্চিমা সভ্যতা যা প্রচার করে, সেটাই যে অবিসংবাদিত সত্য না, সেটা উঠে আসবে। তারা অনেক রিসার্চ ধামাচাপা দিয়ে নিজেদের সমাজ-চিন্তার পক্ষেরটুকুই প্রচার করে, বাকিটুকু করে না যা ওহীকে সত্যায়ন করে। যদিও পশ্চিমা গবেষণায় ওহীর সত্যায়ন হল কি হল না, তা আমাদের ধর্তব্য না। কিন্তু পশ্চিমকে ধোয়া-তুলসী পাতা মনে করা মুসলিমরা সচেতন হবে। বিজ্ঞান যে নিছক একটা পশ্চিমা সামাজিক জ্ঞান তা প্রচার হবে।
খ. কাফের-ফাসেকের আনা সংবাদ (রিসার্চ) যদি মুসলিম রিসার্চার ‘ওকে’ বলে দেয়, সেক্ষেত্রে সেটাও মুসলিমের আনা সংবাদের মতই মেনে নেয়া চলে। তাও মুসলিমের করা রিসার্চের মতই আমরা ঈমান বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে পারি, পিতা ইবরাহীম আ. যা ইয়াকীন বাড়াতে করেছিলেন।
২.
আপনারা যারা বিভিন্ন সাবজেক্ট পড়ছেন সেক্যুলার প্রতিষ্ঠানে, ভার্সিটিতে; গভীরভাবে পড়ুন। দ্বীনকে সামনে নিয়ে পড়ুন। দ্বীনকে আরও বুঝার জন্য, আল্লাহর আহকামের পারফেকশন বুঝার জন্য পড়ুন। এই পড়াটাও দ্বীন হবে, ইবাদত হবে। আর যতটুকু সম্ভব গবেষণা করুন, যাদের সামর্থ্য আছে। ছোট ছোট গবেষণা করুন। পশ্চিমা রিসার্চ মেথডোলজি ভালো করে জেনে, সেটা অনুসরণ করে করুন, এটা বেশ পোক্ত। তবে ফলাফলে গিয়ে ওহীর সত্যায়ন করুন। বলুন, যে ফলাফল পেলাম, তা ১৪০০ বছর আগের ওহীকে সত্যায়ন করে। কারও কাছে গ্রহণযোগ্য হবার দরকার নেই, আপনি দ্বীনী ইলমের ভাণ্ডারে, ফিকহের ভাণ্ডারে একেকটা empirical knowledge যুক্ত করুন। এটাই অনেকের ঈমানকে ইয়াকীনে রূপ দিবে ইনশাআল্লাহ, পিতা ইবরাহীম আ. এর মত। বিশ্বাস করুন এগুলো ইলম-ই হবে। কোনো তাফসীরে কোনো হাদিসের ব্যাখ্যাগ্রন্থে হয়ত হাদিস-আছার-সালাফ মুফাসসিরদের মতের শেষে গিয়ে থাকবে, ‘বাস্তবে বিজ্ঞানীগণও এমনই পেয়েছেন’। আপনার এই গবেষণা তাফসীর-শরাহের অংশ হয়ে যাবে বিইযনিল্লাহ।
৩.
তবে এজন্য শর্ত আছে। দ্বীনের মোটা মোটা বিষয় জানা থাকতে হবে। দ্বীন-আকীদা-উসুল-তাফসীর সম্পর্কে মিনিমাম ধারণা থাকতে হবে। যেটা মধ্যযুগে সবাই পার হত। কেননা সেটাই ছিল মেইনস্ট্রীম শিক্ষা। রিলিজিয়াস স্টাডির পূর্ণ জ্ঞান নিয়েই তাঁরা বিজ্ঞান করতেন। আলিমগণের কাছে আবেদন ‘নূরানী’ কোর্সের মত ব্যাপকভাবে জেনারেলদের জন্য একটা কারিকুলাম তৈরির, যেখানে দাঈ তৈরি হবে, তাদেরকে নূরানীর মত ইজাজত দেয়া হবে। যাতে তারাও অন্যদের এই সাবজেক্টগুলো শেখাতে পারে। ফলে ব্যাপকভাবে জেনারেল শিক্ষিতদের মধ্যে একটা ইলমী যোগ্যতা তৈরি হবে। যেটা তারা দাওয়াতের ফিল্ডে বা রিসার্চের ফিল্ডে কাজে লাগাবে।
৪.
আর রাফান, সাঈদ ভাই, শ্যামল ভাই, সাইফুর ভাইসহ যেসব দ্বীনী ভাইয়েরা রিসার্চের কাজে আছেন তাদের কাছে দরখাস্ত— আপনারা একটা গ্রুপ করুন ফেসবুকে। সব সাবজেক্টের ভাই-বোনদের রিসার্চ মেথডোলজি শেখান ছোটো ছোটো পোস্ট দিয়ে। হাইপোথিসিস বানানো, কোয়েশ্চেনেয়ার বানানো, পি-ভ্যালু/ অড-রেশিও, রিস্ক রেশিও, বিভিন্ন সাবজেক্টের বিভিন্ন সূত্র বা মেথড শেখানো। যাতে তারা নিজেরা ছোট ছোট স্যাম্পলের উপর অনুশীলন করে। একদিন এটাও আলাদা একটা একাডেমিয়া হয়ে যেতে পারে। আমার যোগ্যতা থাকলে আমি করতাম। এটা কিছুই না, হয়ত একটা ইতিহাসের অট্টালিকা হবার আগে সে জায়গায় এক পথশিশুর আঁকিবুঁকির মত। কিন্তু আমার মন বলছে, কিছু একটা হতে পারে।
ঈমানের সাথে যুক্তির সম্পর্ক
আমি আপনাদের একটা ‘চিন্তা’ বলি। আমি নিজেও নিশ্চিত না। আবু বকর রা. নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সব কথা মেনে নিয়েছেন। যা বলেছেন, সব। মি’রাজের মত অবিশ্বাস্য কথা শুনে বলেছেন: ‘যদি মুহাম্মদ এ কথা বলে থাকে, তবে তা-ই সত্য’। এটাকে কি আপনি অন্ধ-বিশ্বাস বলবেন? সাহাবীরা কি নবুওয়াতে অন্ধবিশ্বাস করতেন? সামি’না ওয়া আত্ব’না— এর আগে কি কিছু ছিল? নাকি ‘মাথায় আসুক, না আসুক, গিলতেই হবে ট্রিনিটির মত’— ইসলামের বিশ্বাসগুলো এমন? আমি বলি ‘না’। আবু বকর রা. ঈমান আনার আগে তাঁর সামনে ৪০ বছরের একটা empirical knowledge ছিল। স্বয়ং মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ছিলেন সেই ‘অভিজ্ঞতালব্ধ ও পর্যবেক্ষণপ্রাপ্ত জ্ঞান’। আবু বকরের ৪০ বছরের রিসার্চ। রিসার্চের ফলাফল হল: ‘এই ব্যক্তি ৪০, বছর যাকে আমি মিথ্যা বলতে দেখিনি, এখনও মিথ্যা বলছে না’। মক্কার সব সাহাবীর ক্ষেত্রে একই empirical knowledge প্রযোজ্য। আল্লাহ কুরাইশদের ‘রিসার্চ-অসততা’-কে ভর্ৎসনা করেছেন কুরআনে বারবার। তোমরা দুনিয়াবি স্বার্থে তোমাদের ৪০ বছরের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানকে বিসর্জন দিতে পারলে? তোমরা তাঁকে চেনো-জানো-মেনে এসেছো এতকাল। তোমরাই তাঁর নাম দিয়েছো আল-আমীন। তোমরা তাঁর মুখে কুরআন শুনলে, তাও তো আরবি ভাষায়ই ছিল, তোমাদেরই ভাষায়। শুনে বুঝলেও যে এটা তার পক্ষে বানানো অসম্ভব, কোনো মানুষের পক্ষেই অসম্ভব। এতো এতো ডেটাকে তোমরা তুচ্ছ দুনিয়ার লোভে এখন অস্বীকার করছো। ও ইহুদিরা, তোমাদের কী হল? নিজেদের কিতাব থেকে তোমরা তো তাঁকে নিজ সন্তানের চেয়েও বেশি চেন। এতো এতো ডেটা দেয়া ছিল তোমাদের কিতাবে। আজ সব ডেটা পিছনে ফেলে দিলে, যেন তোমরা জানোই না। প্রত্যেক সাহাবীকে ঈমান আনার আগে ‘লজিক এন্ড রিজনিং’এর ভিতর দিয়ে যেতে হয়েছে।
ইসলামে বিশ্বাসের ভিত ছিল এটা— নবীজির সত্যতার ব্যাপারে মক্কাবাসীদের empirical knowledge আর মদীনাবাসীদের logic and reasoning. যখন কেউ বুঝে ফেলল, ইনি যা বলছেন তা মিথ্যে হতে পারে না। যা তিলওয়াত করছেন, তা মানুষের হতে পারে না। এবার বাকি সব সামি’না ওয়া আত্ব’না। তিনি যা বলছেন, সব মেনে নিলাম। এটার এখনকার সুরত কি হবে, আমি জানি না। তবে আমার কথা হল, খৃষ্টবাদের মত আমরা মুসলিমরা জোর করে ব্রেনের বিপরীতে গিয়ে মেনে নিই, বা অন্ধবিশ্বাস করি— ব্যাপারটা মোটেই তা না। বরং আমরা বিশ্বাস করি, এরপর অন্ধ হই। আর বিশ্বাস করার জন্য বিশ্বাস করি না। বরং আমরা বিশ্বাস করি, কারণ আমরা জানি। Epistemology ক্লাসে Prof Duncan Pritchard বলেছিলেন: We don’t merely believe, We believe because we know it’. ইয়েস উই নো ইট বিফোর উই বিলিভ। জানি বলেই, এটা আমরা শাহাদা দেই, সাক্ষ্য দেই। যা জানিনা, তার সাক্ষ্য দেব কীভাবে? আমরা মনে প্রাণে জানি, মুহাম্মাদে আরাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, জীবনে ৪০ বছরে কোনোদিন মিথ্যা বলেননি, শত্রু আবু সুফিয়ানও হেরাক্লিয়াসকে বলতে বাধ্য হয়েছে, সে ইতিপূর্বে কোনোদিন মিথ্যা বলেনি।
ফৌজদারী আদালতে বিচারক প্রথম দেখেন cui bono — মানে এই অপরাধের দ্বারা কার লাভ? বাচ্চাটাকে যে হত্যা করা হল, হত্যা করে কে কে লাভবান হয়েছে? কে কে সম্পত্তি পাচ্ছে বাচ্চাটার? যার লাভ তাকে সাঁড়াশি দিয়ে ধরো, সত্য বেরিয়ে আসবে। মিথ্যা যে তিনি বলবেন, লাভ কি কি? ক্ষমতা-নারী-মর্যাদা-সম্পদ? এগুলো সব তাকে আবু তালিব বেঁচে থাকতেই অফার করা হয়েছিল। মেনে নিলেই আরবের সর্দার হয়ে যেতেন তায়েফ-বদর-উহুদ-খন্দক ছাড়াই। মেনে নিলেই আরবের টপ-টেন সুন্দরী কুমারী ১০ জন একসাথে পেতেন স্ত্রী হিসেবে। বিধবা আম্মাজানদের পেতাম না তখন আমরা। মেনে নিলেই মক্কার সবচেয়ে ধনী বনে যেতেন এক নিমেষেই। খেয়ে-না খেয়ে, পেটে পাথর বেঁধে, পা মেলা যায় না এতটুকু খুপরিতে শুয়ে জীবন পার করতে হত না। সেসময় যিনি এগুলো নেননি, তাঁর মিথ্যা বলার আর কোনো কারণ থাকতে পারে না। মানবযুক্তি মানে না, সুস্থ মগজ সায় দেয় না। সুতরাং তাঁর কোনো কথাই মিথ্যে হতে পারে না। আরোহ বা অবরোহ— কোনোভাবেই না।
একবার বিশ্বাস করে ফেলেছি, এখন বার বার প্রতিটা আহকাম নিয়ে ঘষার কিছু নেই। জেনেই ঈমান এনেছি, এখন ঈমানের দাবি নবীজী থেকে প্রমাণিত সবকিছু মেনে নেয়া। বার বার বিজ্ঞানে-লজিকে ঘষার মানে শুরুর জানাটাই ঠিক নেই। ঈমানই আনা হয় নি। ঈমান হতে হবে ইয়াকীনী (চোখে দেখার মত দৃঢ়বিশ্বাস)। সেজন্য ঈমানের পর যতটুকু empirical knowledge বা অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ ঈমানের সাথে জোড়া যায়। আল্লাহ তাউফিক দিন।
বিজ্ঞানকে ধর্মের সাথে না মেলানোর কিচ্ছু নেই। ঐ কথা খৃষ্টবাদের জন্য তুলে রাখুন ভাই। ঈমান আনার পর তা বৃদ্ধির জন্য বিজ্ঞান-কে টানতে কোনো দোষ নেই, নেই কোনো হীনম্মন্যতা। ওসব সোকল্ড সুশীলতা ইউরোপ-আমেরিকায় রেখে আসুন। বিজ্ঞান আমাদের স্ট্যান্ডার্ড না, সুতরাং ডাবল-স্ট্যান্ডার্ড বলারও সুযোগ নেই। আমাদের স্ট্যান্ডার্ড সিঙ্গেল— ওহী। যা মিলবে নেব, যা মিলবে না নেব না। ওভার এন্ড আউট। কেন বিজ্ঞানকে (পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান, পশ্চিমাটা না) ধর্মের সাথে মেলাবো, মোহাম্মদ আসাদ রাহিমাহুল্লাহর (Leopold Weis) কথায়—
ধর্ম হিসেবে ইসলাম ভাববাদী মতবাদের ভিত্তিযুক্ত নয়। বরং সেখানে যুক্তি ও সমালোচনা-মূলক অনুসন্ধানের পথ সদা উন্মুক্ত। এজন্য আমরা গর্বিত এবং সংগতভাবেই গর্বিত। সুন্নাহ পালনের যে দায়িত্ব আমাদের উপর রয়েছে, আমাদের যে কেবল সুন্নাহর তথ্যটুকুই জানবার অধিকার আছে, তাই নয়। বরং সেই সুন্নাহ আমাদেরকে শরীয়া হিসেবে দেবার মৌলিক যুক্তি উপলব্ধি করবারও অধিকার রয়েছে। [ইসলাম এট দ্য ক্রসরোড]
[1] “তোমরা তোমাদের পিতা ইব্রাহিমের মিল্লাতের উপর প্রতিষ্ঠিত থাক। তিনিই তোমাদের কে ‘মুসলিম’ নাম রেখেছেন পূর্বেও আর পরেও”। [সূরা হাজ্জ, ২২:৭৮]
[2] সূরা বাকারার ২৬০ নং আয়াতের তাফসীর, তাফসীরে মাআরেফুল কুরআন, মুফতী মুহাম্মদ শফী রহ. (ইফা)
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।