বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
মুসলিম সমাজ কেমন হবে, কার ভূমিকা কী হবে এটা নিয়ে আমরা নানা মত দেখে থাকি। বিষয়টা একটু নেড়েচেড়ে দেখা যাক।
আলোচনার একপাশে আছেন আধুনিক যুগের বিভিন্ন মূল্যবোধকে ধারণকারী গোষ্ঠী। এরা নারী-পুরুষের অভিন্ন অধিকারে বিশ্বাসী। রান্নাঘর থেকে গণভবন সব জায়গায়। যেহেতু আলোচনার পটভূমি ইসলামী সমাজ, তাই বিভিন্ন ইসলামী উৎস থেকে এরা কিছু তথ্যপ্রমাণ দেন।
অপরপাশে আছেন, ইসলামের সামাজিকভাবে পরিচিত মূল্যবোধকে ধারণকারী গোষ্ঠী। এরা নারী-পুরুষের ন্যায্য অধিকারে বিশ্বাসী তবে তা অভিন্ন নয়। বক্তব্য প্রতিষ্ঠায় তথ্যপ্রমাণ এরাও নিয়ে আসেন।
দুপক্ষের বক্তব্য থেকে প্রথমেই যেটা স্পষ্ট হয়ে উঠে সেটা হলো রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং। অর্থাৎ সিদ্ধান্ত থেকে প্রমাণের দিকে যাওয়া। প্রথমে পক্ষগ্রহণ করা, তারপর সে পক্ষে তথ্যপ্রমাণ খোঁজা। তার সাথে সঙ্গী হয় কনফার্মেশান বায়াস অর্থাৎ মতকে জোরালো করে এমন প্রমাণ গ্রহণ করা আর এর বিপরীতের প্রমাণগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া। কিছু উদাহরণ দেখে নেওয়া যাক।
প্রথম পক্ষ থেকে দুটি জনপ্রিয় উদাহরণের একটি হচ্ছেন মা আইশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা), অপরটি হচ্ছেন মা উম্মু সালামাহ (রাদিয়াল্লাহু আনহা)।
গোড়া থেকে শুরু করলে দেখা যায় মা আইশার (রাদিয়াল্লাহু আনহা) অল্পবয়সে বিয়ে হয়। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। যার ফলে তিনি নবীজির (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহচর্যে ইসলামী শরীয়তের গভীর জ্ঞান লাভ করেন এবং পরবর্তী সময়ে সেই জ্ঞান শিক্ষা দেন। প্রথমপক্ষ উনার এই বিদ্বান জীবনের উপসংহারটুকু নেন এবং পারিপার্শ্বিকতা সযত্নে এড়িয়ে যান।
দ্বিতীয়ত, উম্ম সালামাহর (রাদিয়াল্লাহু আনহা) রাজনৈতিক পরামর্শদাতা ভূমিকার যে উপস্থাপন দেখা যায় সে ঘটনাটিকেও নৈর্ব্যক্তিকভাবে দেখা যাক। প্রতিটি সফরের আগেই নবীজির (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্ত্রীদের মধ্যে কে নবীজির সফরসঙ্গী হবেন সেটা নির্ধারণের জন্য লটারি হতো। হুদাইবিয়ার সন্ধির সেই সফরে উম্ম সালামা নির্বাচিত হন। তাই ঘটনাস্থলে তাঁকে দেখা যায়। অর্থাৎ তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা তাঁর সফরসঙ্গী হওয়ার কারণ ছিল না। এখানেও রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং এবং কনফার্মেশান বায়াসের জয়গান গেয়ে এই ঘটনা থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে মুসলিমাহদের অংশগ্রহণকে জেনারালাইজ করার শিক্ষা নেওয়া হয়।
অপরদিকে দ্বিতীয়পক্ষের তথ্যপ্রমাণের বড় অংশ জুড়ে থাকেন ফাতিমা (রাদিয়াল্লাহু আনহা)। সেই সাথে কুরআন ও হাদিস থেকেও অন্যান্য দলীল প্রমাণ থাকে। কিন্তু এই পক্ষেও মা আইশার জ্ঞানচর্চা কিংবা নুসাইবা বিন্ত কাবের (রাদিয়াল্লাহু আনহা) জিহাদে অংশগ্রহণের মতো বিষয়গুলোকে কনফার্মেশান বায়াসের করাতে ছেঁটে ফেলা হয়। বিশেষ করে ইসলামী ইতিহাসে বিদূষী মুসলিমাহদের অবদানকে এড়িয়ে যাওয়া হয়। তারচেয়েও দৃষ্টিগ্রাহ্যভাবে ফাতিমার (রাদিয়াল্লাহু আনহা) আদলে মুসলিমাহদের ভূমিকা কঠোরভাবে সংজ্ঞায়িত ও সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয়।
উভয়পক্ষের ব্যবচ্ছেদ তো হলো। তাহলে ভারসাম্য কোথায়? ওই যে, উৎসের নৈর্ব্যক্তিক পর্যালোচনায়। যেখানে মত থেকে প্রমাণের দিকে নয়, বরং প্রমাণ থেকে মতের দিকে যাওয়া হবে। ফলে মতের বিপরীতের প্রমাণসমূহ ছেঁটে না ফেলে সেগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে ভারসাম্যপূর্ণ মতের দিকে এগোনো সহজ হবে। সেভাবে এগোনোর একটা প্রয়াস নেওয়া যাক। ঠিক-ভুল বিজ্ঞজনেরা আলোচনা করবেন। আর সর্ববিষয়ে আল্লাহই তো অধিক জানেন। আমরা সেই জ্ঞানের অনুগামী হওয়ার চেষ্টা করতে পারি মাত্র।
এই বিতর্কের মূল বিষয় হচ্ছে নারী-পুরুষের ভূমিকা। প্রথম প্রজন্মের ইসলামী সমাজের দিকে তাকালে আমরা এধরনের বিতর্কের অস্তিত্ব দেখতে পাই না। উপরন্তু, বিবাদমান দুই পক্ষের তথ্যপ্রমাণই প্রথম প্রজন্ম থেকে নেওয়া। তাই এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্যর ভিত্তিতে যদি আমরা ধরে নেই যে, ইসলাম আসলে সমাজে নারী-পুরুষের ভূমিকা কঠোরভাবে সংজ্ঞায়িত করে দেয় না – তাহলে দুই কূলই রক্ষা পাচ্ছে। কিন্তু সেক্ষেত্রে নারী-পুরুষের দায়িত্ব সংজ্ঞায়িত করে দেওয়া অনেক আয়াত এবং হাদিস আপাতদৃষ্টিতে আমাদের এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে চলে যায়।
আসলেই কি তাই? নারী-পুরুষের দায়িত্ব সংজ্ঞায়িত করে দেওয়া এই তথ্যপ্রমাণগুলোকে আমরা এভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে পারি: ইসলামের দৃষ্টিতে সমাজ একটা শরীরের মতো। এই শরীরের কঙ্কাল হচ্ছে কুরআন হাদিস থেকে আসা নারী-পুরুষের দায়িত্ববিষয়ক এই তথ্যপ্রমাণসমূহ। অর্থাৎ নারী-পুরুষের প্রাথমিক দায়িত্বগুলো অনেকটাই কঠোরভাবে সংজ্ঞায়িত। ঠিক যেমন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের তুলনায় কঙ্কাল অনেকটাই দৃঢ়। যেমন পরিবারের ভরণ-পোষণের ভার পুরুষের উপর। কিন্তু সে ফসল ফলিয়ে সেই দায়িত্ব পালন করবে নাকি কলেজে ফিলোসফি পড়িয়ে, সে ব্যাপারে প্রশস্ততা রয়েছে। অর্থাৎ ভূমিকার ব্যাপারে প্রশস্ততা রয়েছে তবে তা মূলনীতির উপর ভিত্তি করে। যেমন- ভূমিকার মাধ্যমে মূল দায়িত্ব পালন করতে হবে এবং ভূমিকাটি হারাম হতে পারবে না। ঠিক যেমন মাংসপেশী কঙ্কালের গায়ে লেগে শরীরকে চলনশীল করে তোলে কিন্তু কঙ্কাল ভেঙ্গে যেতে পারে এমন কার্যক্রমে ব্যথার জানান দেয়।
একটি সমাজ হচ্ছে বিভিন্ন রকম মানুষের সমষ্টি। এর অন্তর্গত মানুষদের দাবা বোর্ডের গুটির মতো কিংবা ফ্যাক্টরির কলকব্জার মতো বিবেচনা করলে কিংবা সেই ছাঁচে ফেলতে গেলে ভুল হবে। কারণ, কোনো দুইটি মানুষ একরকম নয়। তাদের দোষ-গুণ, দক্ষতা-দুর্বলতা ভিন্ন। তাই একটি সমাজ তখনই সুন্দরভাবে পরিচালিত হবে যখন এর উপাদানদের ভূমিকা কঠোরভাবে সংজ্ঞায়িত করা থেকে এর উপাদানেরা বিরত থাকবে এবং ফ্রেমওয়ার্ক বা কঙ্কালের সংরক্ষণের ব্যাপারে অধিক মনোযোগী হবে। অর্থাৎ একটি আদর্শ মুসলিম সমাজে নারী-পুরুষ তাদের ইসলাম কর্তৃক অর্পিত দায়িত্বগুলোকে প্রায়োরাটাইজ করে তাদের দক্ষতার দিক থেকে ভূমিকা রেখে সেই দায়িত্বগুলো পালন করবে। সমাজে মমতাময়ী মা যেমন প্রয়োজন তেমনি দক্ষ মহিলা চিকিৎসক, শিক্ষিকা এবং অন্যান্য পেশাতেও তাদের প্রয়োজন আছে। তাই বলে সবাইকেই কোনো পেশা বেছে নিতে হবে এমন কোনো কথা নেই। আবার বিশেষ ক্ষেত্রে মেধাসম্পন্ন নারীকে জোরপূর্বক গৃহিণীর ভূমিকাতেও আটকে রাখার প্রয়োজন নেই। গৃহিণীদের সাহায্য করতেও গৃহপরিচারিকার প্রয়োজন হয়। সমাজের প্রয়োজনেই নারী-পুরুষকে বিভিন্ন ভূমিকা পালন করতে হয়। সে অনুযায়ী তাদের দায়িত্বগুলোও পরিবারে ভাগাভাগি করে নিতে হয়। সার্বিকভাবে সমাজ হিসাবে দায়িত্বের প্রতি অধিক মনোযোগী এবং ভূমিকার ব্যাপারে অধিক সহনশীল ও প্রশস্ত হলেই কল্যাণকর। তাই আমরা এমন কোনো ঘটনা দেখতে পাই না যে, ফাতিমাকে (রাদিয়াল্লাহু আনহা) ঘরের কাজ করার জন্য হেয় করা হয়েছে কিংবা মা আইশাকে (রাদিয়াল্লাহু আনহা) দারস দেওয়ার জন্য দুকথা শুনিয়ে দেওয়া হয়েছে। বরং সবাইকেই নিজের মতো ভূমিকা পালনের সুবিধা দেওয়া হয়েছে কিন্তু সাধারণভাবে সমাজে নারী-পুরুষের প্রধান দায়িত্বের বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করা হয়েছে।
এই বিতর্কের শ্রোতাসমাজ যে সামাজিক স্তরের বাসিন্দা সেখানে এই বিষয়টি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বস্তুবাদের মোহে এই স্তরে যেমন প্রধান দায়িত্বগুলোকে অবহেলার চল আছে তেমনি সামাজিক প্রথার চাপে স্বতঃস্ফূর্ত ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে বাধাদানকারী উপাদানও আছে। তাই এক্ষেত্রে পরিবার পর্যায়ে নারী-পুরুষের ভূমিকা বৈচিত্র্যময় হওয়া সময়ের দাবি। উদাহরণস্বরূপ, একজন মহিলা চিকিৎসকের স্বামীকে তাঁর স্ত্রীর ভূমিকাকে বুঝে নিতে হবে। আবার স্বচ্ছল পরিবারে সন্তান প্রতিপালনের স্বার্থে চিকিৎসক মায়ের কর্মজীবন স্থগিত রাখাটাও সময়ের দাবি হতে পারে। সমষ্টিগতভাবে আমাদের দায়িত্ব হলো উভয়লিঙ্গের মূল দায়িত্বগুলো সমাজে প্রোথিত করে দেওয়া যেন পরিস্থিতির দাবি অনুযায়ী তারা নিজেদের ভূমিকা বদলে নিতে পারে। আর এ পথে প্রথম ধাপ হলো, সমাজে উভয় লিঙ্গের ভূমিকার প্রশস্ততাকে মেনে নেওয়া এবং কারখানার কলকব্জার মতো কঠোরভাবে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা থেকে বিরত থেকে দায়িত্বের ব্যাপারে আল্লাহর প্রতি জবাবদিহি করতে সচেতন মানসিকতা গড়ে তোলা।
অত্যন্ত জটিল বিষয়ে অনেক কথা হয়ে গেলো। আসলে তো এসব বিষয়ে আল্লাহ তা’আলাই সর্বাধিক জ্ঞাত। আমরা তাঁর কাছে সঠিক পথের সন্ধান আশা করি।
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।