১। আল্লাহ লাইলাতুল ক্বদরের মাধ্যমে রমাদানকে করেছেন মহিমান্বিত। এই রাত বছরের শ্রেষ্ঠ রাত এবং এই রাতে ইবাদাত করা সহস্র মাস ইবাদাত করার চেয়ে উত্তম। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
নিশ্চয়ই আমি ক্বদরের সম্মানিত রাতে কুর’আন অবতীর্ণ করেছি। আপনি কি জানেন, ক্বদরের রাত কী? ক্বদরের রাত হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। সে রাতে প্রতিটি কাজের জন্যে ফেরেশতা ও রূহ (জিবরাঈল) তাদের প্রতিপালকের আদেশে অবতীর্ণ হয়। শান্তি সে রাতে ফজর পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। [সূরাহ আল-ক্বদর (): ১-৫]
২। এই রজনীকে কুর’আন নাযিল শুরু হওয়ার রজনী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আল-লাওহে-আল-মাহফুজ (সংরক্ষিত ফলক) থেকে সম্পূর্ণ কুর’আনকে একবারে লাইলাতুল ক্বদরের রাতে (সম্মানিত রজনীতে) নিম্ন আসমানে পাঠানো হয়েছিল। এরপর ধাপে ধাপে ২৪ বছরে একে নাযিল করা হয়।
বর্ণিত আছে, ইবন ‘আব্বাস (রাঃ) এই আয়াতটির পরিপ্রেক্ষিতে বলেন,
নিশ্চয়ই আমি ক্বদরের সম্মানিত রাতে কুর’আন অবতীর্ণ করেছি।
লাইলাতুল ক্বদরের রাতে কুর’আনকে একবারে অবতীর্ণ করা হয়েছিল। এরপর আল্লাহ তায়ালা রাসূল (সাঃ) এর নিকট অল্প অল্প করে তা নাযিল করেন।[১]
বদর আদ-দীন আয-যারকাশী বলেন,
যদি প্রশ্ন করা হয়ে থাকে যে, কেন কুর’আনকে একবারে নিম্নাকাশে অবতীর্ণ করা হলো? তবে এর উত্তর হলো, কুর’আন এবং এর অবতীর্ণকারীর মহিমান্বিত অবস্থানকে দৃষ্টিগোচর করার জন্যে। সাত আসমানের বাসিন্দাদের এই ঘোষনা দেয়ার জন্যে যে, সর্বশেষ রাসূলকে এবং সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মতদেরকে সর্বশেষ কিতাবটি পাঠানো হলো।[২]
৩। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেন,
সে ব্যক্তি পূর্ণ ঈমানের সাথে সওয়াব লাভের আশায় লাইলাতুল ক্বদরের রাতে ইবাদত করবে, তার পূর্ববর্তী সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।[৩]
৪। রাসূল (সাঃ) অন্যান্য সময়ের তুলনায় রমাদানের শেষ দশদিনে অধিক ইবাদত বন্দেগীতে মশগুল থাকতেন।[৪]
আ’ঈশা (রাঃ) বলেন, “রমাদানের শেষ দশক উপস্থিত হলে, রাসূল (সাঃ) পার্থিব বিষয়াদি থেকে নিজেকে দূরে রাখতেন, রাত্রি জাগরণ করতেন এবং পরিবারের সকলকে ডেকে তুলতেন।”[৫]
আল-হাফিয বলেন, “রাত্রি জাগরণ করতেন” এর অর্থ হলো ইবাদত করার জন্যে রাত জেগে থাকতেন।[৬]
৫। ইবাদতের সবচেয়ে উত্তম উপায় হচ্ছে দু’আ। নবী করিম (সাঃ) বলেন,
দু’আ-ই হলো ইবাদাত। [৭]
আ’ঈশা (রাঃ) বলেন, আমি জানতে চাইলাম, “হে আল্লাহর রাসূল, আমাদের মধ্যে যদি কেউ লাইলাতুল ক্বদরের রাত পায়, তবে সে কী করবে?” তিনি উত্তর করলেন,
বলো, আল্লাহুম্মা ইন্নাকা ‘আফুঊন তুহিব্ব আল-‘আফওয়াফা’ফু ‘আন্নি (হে আল্লাহ, আপনি পরম ক্ষমাশীল এবং ক্ষমা করতে ভালোবাসেন। তাই আমাকে ক্ষমা করে দিন)। [৮]
৬। সারা বছরের তাক্বদীর এই রাতে নির্ধারিত হয়। আল্লাহ বলেন,
এই রাত্রিতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয়ে ফয়সালা করা হয়। [৯]
ইবন হাযার সহীহ আল-বুখারীর ব্যাখ্যাগ্রন্থে বলেন, “এর অর্থ হলো, সারা বছরের তাক্বদীর এই রাত্রিতে বির্ধারিত হয়।”
আর আল-নাবাবী বলেন, আলেমগণ এই রাত্রিকে লাইলাতুল ক্বদর বলেন কেননা ফেরেশতাগণ এই রাতে তাক্বদীর লিখে রাখেন (আক্বদার)। [১০]
আমাদের উচিৎ এই ১০ রাতে দু’আর পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়া কেননা একমাত্র দু’আই পারে ভাগ্যকে পরিবর্তন করতে এবং আমাদের দুশ্চিন্তা ও হতাশাকে দূর করে দিতে। আল্লাহ বলেন,
আল্লাহ যা ইচ্ছা তা মিটিয়ে দেন বা বহাল রাখেন এবং তার কাছেই রয়েছে মূল কিতাব।[১১]
আবার রাসূল (সাঃ) বলেন,
দু’আ ব্যতীত আর অন্যকিছুই তাক্বদীরকে পরিবর্তন করতে পারে না।[১২]
৭। আল্লাহ তার অনুগত বান্দাদেরকে এই রাতে ইবাদত করতে যতোটা উৎসাহিত করেছেন, অন্য কোনো রাতের ব্যাপারে তেমনটা করেননি। আল্লাহ বলেন,
সহস্র মাস অপেক্ষা ক্বদরের রাত উত্তম।[১৩]
এই রাতে করা আমলকে ১০০০ মাস ধরে করা আমলের চেয়ে বেশি মূল্যায়ন করা হয়।
১০০০ মাস হলো ৮৩ বছর ৪ মাসের সমান এবং নবী করিম (সাঃ) বলেন,
আমার উম্মাহর জীবনকাল বড়জোর ৬০-৭০ বছর।[১৪]
তাই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা একটিমাত্র রাতের মাধ্যমে আমাদের এক জীবনকাল জুড়ে ইবাদাত বন্দেগি করার সওয়াব দিয়েছেন।
৭। আলেমগন বলেন, আপনি যদি আপনার আত্মীয় বা মুসলিম বন্ধুর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে থাকেন তবে এটাই ভালো কাজ করার জন্যে সর্বোত্তম রাত। একে অন্যের মধ্যকার কঠোর মনোভাবকে দূরে ঠেলে দিয়ে ভালোবাসার সম্পর্ককে পাকাপোক্ত করুন।[১৫]
৮। “সে রাতে প্রতিটি কাজের জন্যে ফেরেশতা ও রূহ (জিবরাঈল) তাদের প্রতিপালকের আদেশে অবতীর্ণ হয়।”[১৬]
অর্থাৎ, এই রাতে ফেরেশতা (জিবরাইল) – যিনি নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর নিকট কুর’আন নিয়ে উপস্থিত হতেন, তিনি অন্যান্য ফেরেশতাদের সাথে করে প্রতি বছরে এই রাতে পৃথিবীর বুকে নেমে আসেন। তারা আল্লাহর অনুগত বান্দাদের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্যে ব্যকুল হতে থাকেন।
শাঈখ সালমান আর-রা’ঈ বলেন, এ কথার অর্থ হলো, ফেরেশতাগণ পৃথিবীতে মুমিন বান্দাদের খোঁজ করতে থাকেন। তাই তারা এই রাতে নিচে নেমে আসার জন্যে তাদের প্রভু অর্থাৎ আল্লাহর অনুমতি প্রার্থনা করেন এবং আল্লাহ তাদেরকে অবতরণ করার অনুমতি প্রদান করেন। এরপর তারা শান্তির রাতে ইবাদাতরত মুমিন বান্দাদের সাথে সাক্ষাৎ করে তাদেরকে অভিবাদন জানান।[১৭]
ইবন কাসির বলেন, জিবরাঈলের সাথে একদল ফেরেশতা পৃথিবীতে নেমে আসেন। তারা মসজিদগুলোতে প্রবেশ করেন এবং ইবাদতরত প্রতিটি মুমিন বান্দার কাছে যেয়ে পৌঁছান ও সালাম জানান। এই দীর্ঘ পথ জিবরাঈল ও সাথীরা পাড়ি দিয়ে আসেন শুধুমাত্র মুমিন বান্দাকে সালাম জানানোর জন্যে। কতো সম্মান![১৮]
[১] আন-নাসাঈ।
[২] আল-বুরহান ফি উলুমুল কুরআন।
[৩] আল-বুখারি (১৯১০), মুসলিম (৭৬০)।
[৪] আহমাদ ও মুসলিম।
[৫] আল-বুখারি (২৪০১), মুসলিম (১১৭৪)।
[৬] http://islamqa.info/en/26753
[৭] আত-তিরমিযি, ২৮৯৫। সহীহ আত-তিরমিযি গ্রন্থে আল-আলবানি একে সহীহ বলেছেন (২৩৭০)।
[৮] আত-তিরমিযি, তিনি একে সহীহ বলেছেন।
[৯] সূরাহ আদ-দুখান ৪৪:৪-৩
[১০] সূরাহ আর রাদ ১৩:৩৯
[১১] http://islamqa.info/en/11722
[১২] আহমেদ,৫/৬৭৭; ইবনে মাজাহ, ৯০;আত-তিরমিযি, ১৩৯। সহীহ আল-জামি গ্রন্থে আল-আলবানি একে সহীহ বলেছেন (৭৬৬৮৭)
[১৩] সূরাহ আল ক্বদর ৯৭:৩
[১৪] আত-তিরমিযি, ভলিউম ৪, বই ১০,হাদীস ২৩৩১
[১৫] সূরাহ আল ক্বদর – মিরাকল ড্রিম তাফসির-নোমান আলী খান,পৃষ্ঠা ১২
[১৬] সূরাহ আল ক্বদর ৯৭:৪
[১৭] সূরাহ আল ক্বদর – মিরাকল ড্রিম তাফসির-নোমান আলী খান,পৃষ্ঠা ১৬
[১৮] সূরাহ আল ক্বদর – মিরাকল ড্রিম তাফসির-নোমান আলী খান,পৃষ্ঠা ১৮
উৎস: ইসলামিক অনলাইন ইউনিভার্সিটি ব্লগ (মূল আর্টিকেল লিঙ্ক )
অনুবাদক: শারিকা হাসান
অনুবাদ কপিরাইট © মুসলিম মিডিয়া
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।