ধরুন কাল থেকে সপ্তাহব্যাপী বিশেষ “ট্রাফিক আইন সপ্তাহ” শুরু হলো। এই সপ্তাহের জন্য মোড়ে মোড়ে পুলিশ থাকবে । দুই কারণে।

প্রথমত, আপনি যদি ঠিক মতো গাড়ি চালান, সুযোগ থাকা সত্ত্বেও অপ্রয়োজনে ওভারটেক না করেন, স্টিকার ব্যবহার করে উলটো দিক থেকে গাড়ি না আনেন, কিংবা মন্ত্রী হলে মানুষকে যন্ত্রণা না দিয়ে রাস্তার আইন মেনেই গাড়ি বের করেন, পথচারী হলে ওভার ব্রিজ ব্যবহার করেন, বাসের জন্য রাস্তায় না দাঁড়িয়ে যাত্রীছাউনিতে অপেক্ষা করেন- তাহলে রাস্তায় দায়িত্বরত পুলিশ পরের চেকপয়েন্টে সম্মানসূচক সব পুরস্কার দিয়ে আপনাকে “সচেতন ও সেরা নাগরিক” হিসাবে ভূষিত করবে। পরেরদিন পত্রিকায় নাম আসবে, টিভিতে সেগুলো পড়ে শোনানো হবে। রাষ্ট্রীয় সম্মানের সুযোগ হয়ে দাঁড়াবে পুরো ব্যাপারটি। আর মাস শেষে রাষ্ট্রপতি নিজে এই সাতদিন লাগাতার আইনকে সম্মান করে চলা নাগরিকদের সাথে বিশেষ সাক্ষাৎ করবেন।

IIRT Arabic Intensive

বলুন তো এই পুরো ব্যাপারটায় একবারও কি আপনার মাথায় এসেছে যে, কিভাবে আইন ভেঙে মিটার চেকে ধরা খাওয়া যায়, কিভাবে দুই বাস মিলে এক লেনে রেস করা যায় বা এই সপ্তাহে কিভাবে সর্বাধিক ফুট ওভার ব্রীজ উপেক্ষা করার রেকর্ড গড়া যায়? জেনে বুঝে?

স্বাভাবিকভাবেই এমন খেয়াল আসার কথা না। কারণ মানুষ সমাদর এবং কাজের মূল্যায়ন পছন্দ করে। একই কাজ এক রকমভাবে করে যেখানে খেতাব পাওয়া যায় সেখানে কেন উলটো বঞ্চিত হতে যাব? সুনাম কামাতে যদি নাও পারি এমন সময়ে দুর্নাম তো অন্তত কামাবো না তাইনা?

রাস্তার মোড়ে মোড়ে পুলিশ দাঁড়িয়ে থাকার প্রথম কারণ হলো আপনাকে পুরস্কৃত করা। আর দ্বিতীয় কারণ হলো কোনোরকম অনিয়ম দেখলেই তড়িৎ পাকড়াও করা। অন্য কোনো স্বাভাবিক দিনে যেখানে হয়ত কিছুই বলা হত না সেখানে আজকে গাফিলতি করলেই সোজা ধরে শিকের ভিতর নিয়ে যাওয়া হবে। কারণ পুরস্কারের দিনগুলোতেও যারা নিজেদের শুধরাতে পারল না তাদের জন্য কোনো ছাড় নাই। তারা যা চায় তা-ই তাদের প্রাপ্য।

কুরআনে আল্লাহ কসম করেছেন দশের। যিলহজ্বের প্রথম দশের। ঘোষণা হয়ে গেছে। রামাদ্বানের শেষ দশ যেরকম মহিমান্বিত, ঠিক তেমনি মহামূল্যবান জিলহজ্বের প্রথম দশটি দিন।

“দুনিয়ার সর্বোত্তম দিনগুলো হলো, যিলহজ্বের দশদিন। জিজ্ঞাসা করা হলো, জিহাদেও কি তার সমতুল্য নেই? তিনি(সা) বললেন, জিহাদেও তার সমতুল্য নেই। তবে ঐ ব্যক্তি ছাড়া যার চেহারা ধুলিযুক্ত হয়েছে। অর্থাৎ শাহাদাত লাভ করেছে।” [মুসনাদে বাযযার, হাদীস ১১২৮]

বুঝা যাচ্ছে কথার ভার? ফরয অবস্থায় যেই জিহাদ আল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয় সেই জিহাদ পর্যন্ত এই দশদিনের আমলের কাছে হার মেনে গেছে।

এতটা মহামূল্যবান যেই দিবসগুলো। যখন আমাদের সৌভাগ্যবান হাজী ভাইরা পবিত্র ভূমিতে আল্লাহর ডাকে সারা দিয়ে চলে যান তখন আমাদের জন্যও আল্লাহ তাদের খাতিরে এতটা সম্মান করেছেন!

প্রতিদিন তাই সিয়াম পালনে উৎসাহিত করা হয়েছে। আবার মনে করিয়ে দিচ্ছি এগুলো কিন্তু পুরস্কারস্বরূপ। এগুলোর জন্য বিনিময় অত্যন্ত চমকপ্রদ। আর নবম যিলহজ্বে রোযা রাখার ফলাফল হিসাবে আল্লাহ পাক বান্দার এক বছর আগের এবং এক বছর পরের- সকল গুনাহ মাফ করে দিবেন। [সহীহ মুসলিম ১১৬২] সুবহানআল্লাহি ওয়া বিহামদিহি। ভাবা যায় কত সম্মান?

অথচ এগুলো কি আমাদের আকলে এসেছে? এই যে বুঝে আসেনি এই দায়ভারটা কার? কোন পড়াশোনা আর পরিবেশে জীবন কেটেছে যে কুরআনে আল্লাহ কসম কেটে রেখেছেন যে সময়ের, সেই পুরস্কারের মৌসুমের খবরটা পর্যন্ত আমার জানা নাই? [৮৯ : ১-২]

আল্লাহ যেদিন আসমান জমিন সৃষ্টি করেছেন সেইদিন থেকেই মাসসমূহের গণনা আল্লাহ তাআলার নিকট তাঁর বিধান অনুযায়ী বারটি। তার মধ্যে হারাম বা সম্মানিত মাস চারটি। [৯: ৩৬] এই চার মহাপবিত্র মাসেরই একটি হলো যিলহজ্ব। এভাবে ধরে ধরে কুরআনে উল্লেখ করে দেওয়া। তাও গাফেল। কারা, অমুসলিমরা? না, খোদ মুসলমানই?

একটা হৃদরোগাক্রান্ত রোগী যার কিনা তৎক্ষণাত ইন্টেন্সিভ কেয়ার দরকার সে যদি এখন উলটো হুক্কা টানা শুরু করে তাহলে তার বিচার-বিবেচনার ব্যাপারে কী ধারণা করা যেতে পারে? কী তার ফলাফল? এটা হিসাব করতে কি রকেট সায়েন্স জানা প্রয়োজন? আহারে! কী কষ্টই না তার জন্য অপেক্ষা করে আছে! কী তুচ্ছ জিনিসের জন্য কী করুণ পরিণতি!

ঠিক তেমনি আমাদের একেকজনের জীবনের অবস্থা একেকভাবে করুণ হতে পারে। জীবনের তাল-লয় সব যাচ্ছে তাই হয়ে আছে, কোনো প্রকার নিয়ন্ত্রণ-উদ্দেশ্য কিছুই নাই। পারিবারিক-সামাজিক সম্পর্কগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। মন অশান্ত হয়ে রয়েছে। আমাদের কি হুঁশে ফেরা উচিৎ না? অথচ সমস্যা ঠিক করার জায়গায় আরো কিভাবে সমস্যায় নিজেকে জড়ান যায় সেই দিকে মনোযোগ আমাদের। সমস্যা শুরুটা করেছে কে আর কেনই বা হচ্ছে কোনো খেয়াল নাই। কিয়ামতের একটি ছোট আলামত হলো, তুচ্ছ দুনিয়াবি লাভের কারণে মানুষ দিনে-দুপুরে দ্বীনকে পরিত্যাগ করবে, একদম দিনে দুপুরে!

খুব সাবধান প্রিয় ভাইয়েরা। নিয়ামত যত বেশি, পবিত্রতা যত বেশি, নিজেকে একদম ঝালিয়ে নিয়ে সব পুরস্কার লুফে নেবার সুযোগ যত বেশি, ঠিক ততটাই বিকট এই সময়ে কৃত গুনাহের ফলাফল। শুভ পরিণতি যেমন একদম হাতের নাগালে ঠিক তেমনি আগুনের নিঃশ্বাসও।

এই দিনগুলোকে হেলায় না হারাই। পৃথিবীতে কাটানো কোনো সময়ই যেন কোনো নিকৃষ্ট কাজে ব্যয় না হয়, বিশেষ করে এই দিনগুলো তো একদমই না! ভুল করেও যেন জেনে-শুনে অবাধ্যতায় লিপ্ত না হই। আর প্রকাশ্য অবাধ্যতায় তো না-ই!

এই মহিমান্বিত দিনগুলোতেও যদি আমরা সজ্ঞানে নাফরমানের খাতায় স্বাক্ষর করি তাহলে প্রিয় ভাইয়েরা আমার, প্রচণ্ড ভয়ানক পরিণতি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। এগুলো এমন এমন সময় যখন কিনা সাথে সাথে আল্লাহর গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়ে যেতে পারে। খুব শক্ত-তীব্র একটা প্রলয়ের অপেক্ষা করতে হবে এই অযত্ন-অবহেলার কারণে। খুব বেশি বিলম্ব হবে না, একদম চোখের সামনে সব ভেস্তে যাবে। তখন যেন হা-হুতাশ না করি। জেনে-শুনে কেন এই করুণ পরিণতি আমরা গ্রহণ করতে যাব? জ্ঞান-বুদ্ধিতে অবশ্যই আমরা এতটা নির্বুদ্ধ নই।

হতে পারে এই সময়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাগ ডে, চাচাত ভাইয়ের জন্মদিন, প্রিয় বান্ধবীর গায়ে হলুদ। আসতেই পারে। দুঃখ পাবার কিছুই নেই। এজন্যই তো জান্নাত আছে! এই সামান্য না পাওয়ার স্বাদ আর সেদিন থাকবে না। সেদিন সবাই-ই জেনে যাবে কে কীসের বিনিময়ে কী কামালো! কার ঝোলায় কতটুকু থাকল আর সবটুকু কে হারাল!

আসুন আমরা দুআ করি সকলের জন্য যিলহজ্বের এই হীরামুক্তা ছড়ানো দশটি দিন থেকে কেউ যেন বঞ্চিত না হয়ে যায়। বাইতুল্লাহর প্রেমের দিনগুলোতে যেন কেউ অভাগা না থেকে যায়।

আল্লাহর একান্ত প্রিয় বান্দাদের খাতিরে আর তাঁর দেওয়া সম্মানের আমানতদারির উসিলায় একদিন যেন আমাদের কণ্ঠ দিয়েও উচ্চারিত হয়, ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক…’

সব প্রশংসা ও নিয়ামত শুধু তোমারই আর সব সাম্রাজ্যও তোমার।

মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।

নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Loading Disqus Comments ...
IIRT Arabic Intensive