ইকোনমিতে ব্যাংকের রোলটা আসলে কী? মূলত ব্যাংক যেই কাজটি করে সেটা হলো, যাদের কাছে টাকা আছে (সারপ্লাস ইউনিট) তাদের থেকে যাদের টাকা দরকার (ডেফিসিট ইউনিট) তাদেরকে সরবরাহ করে।
মুসলিম বিশ্বে ব্যাংকিং ব্যবস্থা ছিলো না, ব্যাংক মুসলিম বিশ্বে এসেছে কলোনিয়ালাইজেশনের হাতে হাত ধরে। সুদের বিনিময়ে অর্থায়নের সিস্টেম সেই প্রাচীন কালের। বনী ইসরাঈলকে আল্লাহ্ সুদ নিতে নিষেধ করেছেন, কিন্তু তারা নিলো।
“আর এ কারণে যে, তারা সুদ গ্রহণ করতো, অথচ এ ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিলো এবং এ কারণে যে, তারা অপরের সম্পদ ভোগ করতো অন্যায় ভাবে।” [সূরাহ আন-নিসা ৪:১৬১]
ইসলামিক ব্যাংকিং এখন বাস্তবতা, অনেক বছর ধরে মুসলিম বিশ্বের স্কলারদের গবেষণার ফসল। অনেকেই একটা ক্লেইম করে তা হলো ইসলামে ব্যাংকের কোনো ধারণা নেই এবং এর দরকার নেই। যেহেতু এটা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সময় ছিলো না, তাই এটা হারাম। প্রথমত ব্যাংকের দরকার আছে কি নেই সেটা পরেই আলোচনা করা যাক। দ্বিতীয়ত রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সময় বা মুসলিম বিশ্বে পূর্বে কোনো সিস্টেম না থাকলে তা হারাম হবে ব্যাপারটা এমন নয়। এমন হলে ইজতিহাদ বলে কোনো শব্দের দরকার ছিলো না, স্কলারদের গবেষণা আর তাহলে কীসে হবে? মু’আমালাতের বা ট্রাঞ্জেকশনের মূল রুলিং হচ্ছে সব পদ্ধতি বা সিস্টেম হালাল, যদি না তা হারাম হয়। এখানে শরী’আহ টেক্সট দ্বারা হারাম প্রমাণিত হতে হবে।
মূল টপিক ইসলামিক ব্যাংকিং না। টপিক হচ্ছে সারপ্লাস ইউনিট থেকে ডেফিসিট ইউনিটে টাকা সরবরাহ করতে ব্যাংক কি লাগবেই? টাকা সরবরাহে কোনো সমস্যা নেই, সমস্যা হলো টাকার সাথে সুদ যোগ করে দেওয়া, এটাই ব্যাংকের মূল আয়। ব্যাংক বলতে এখানে সুদী ব্যাংককে বুঝাচ্ছি। ব্যাংকের সাথে তাই দু’টি শব্দ জড়িত। এক হলো ঋণ আর আরেকটা সুদ। কারো ঋণ থাকলে রাসূল ﷺ তার জানাজা পড়াতেন না যদি না এই ঋণ পরিশোধের কোনো ব্যবস্থা হয়। এমনকি শহীদদের বিষয়েও ঋণের ব্যাপারে কোনো ছাড় নেই। এসব বিষয়ে প্রচুর হাদীস আছে। এসব হচ্ছে হালাল ঋণের কথা, যেটাতে সুদ থাকে না। তাই স্বভাবতই একজন মুসলিম এক্সট্রিম প্রয়োজন ছাড়া ঋণ নিবে না। এখানেই হচ্ছে পার্থক্য। পাশ্চাত্য ইকোনমি যেখানে সম্পূর্ণটাই ঋণের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। আচ্ছা ঋণ যদি সোসাইটিতে এইরকম ব্যবহার না হয়, তবে কি সুদ থাকবে? উত্তর না! সুদ কী? যেই ঋণ কোনো বেনিফিট আনে, তা-ই সুদ। আমি আপনাকে ১০০ টাকা দিলাম। পরের দিন আপনি আমাকে এক কাপ চা খাওয়ালেন যা আগে আমার আপনার মধ্যে প্রচলিত ছিলো না। আমি আর আপনি সুদে জড়িয়ে গেলাম।
রাসূল ﷺ বলেছেন, “যখন তোমাদের কেউ ঋণ মঞ্জুর করে এবং ঋণগ্রহীতা তাকে একটি থালা দেয়, তার সেটা গ্রহণ করা উচিত নয় এবং ঋণগ্রহীতা যদি (ঋণদাতাকে) উটের ওপর চড়ার প্রস্তাব দেয়, তার চড়া উচিত নয় যদি না তারা (ঋণ নেয়ার) পূর্ব থেকেই এই রকম বিনিময়ে অভ্যস্ত থাকে।” (বায়হাকী, কিতাবাল বুয়ু, বা’ব কুল্লি কারদিন জাররা মান’ফাআতান ফা হুয়া রিবাহ)
তাই ঋণ দানের মাধ্যমে অর্থ সাপ্লাইয়ের সিস্টেমটা বাদ দিতে হবে। না হলে সুদ থেকে বের হওয়ার কোনো সিস্টেমই কাজে দিবে না। সত্যি কথা বলতে ক্রেডিট ফাইনান্সিং থেকে ইসলামিক ব্যাংকগুলোকে বের হতে হবে, টুডে অর টুমোরো। হ্যাঁ, কীভাবে বের হবে সেটা গবেষণার বিষয়।
একটা আইডিয়াল মুসলিম সোসাইটিতে, ক্রেডিট ফাইনান্সিংয়ের প্রয়োজনীয়তা এমনিতেই অনেক কমে যাবে। মানে ব্যাংকের প্রয়োজনীয়তা অনেক কমে যাবে, ক্রেডিট নাই তো ব্যাংক নাই। মূলত ব্যাংক যেই কাজটা করে (অর্থাৎ সারপ্লাস ইউনিট থেকে ডেফিসিট ইউনিটে অর্থ সাপ্লাই), এর জন্য ইসলামে কিছু ইনবিল্ট মেকানিজম আছে।
প্রথমটাই হলো যাকাত। এটা হলো বাধ্যতামূলক। এটা ভলান্টারি সাদাকাহ নয়, এটা কিছু মানুষের অধিকার। যাকাত সম্পর্কে প্রথম ভুল ধারণা হলো, এটা শুধু গরীবদের দেওয়া যায়। আসলে যাকাত মোট ৮ শ্রেণীর লোকদের দেওয়া যায়। আল কুর’আনে সূরা তাওবার ৬০ নং আয়াতে এর লিস্ট দেয়া আছে। যাকাত কী করে? সম্পদ রিডিস্ট্রিবিউট করে দেয়। সারপ্লাস ইউনিট থেকে ডেফিসিট ইউনিটে অর্থ সরবরাহ হয়। আমাদের বর্তমান মুসলিম সোসাইটি কি যাকাতকে বাধ্যতামূলক মনে করে? উত্তর না। তারা মনে করে এটা অপশনাল। যাকাতের একটা দিক হলো এটা মানুষের মনকে, সম্পদকে পরিশুদ্ধ করে। আরেকটা দিক হলো, মানুষকে সম্পদ জমিয়ে না রেখে ইনভেস্ট করতে উৎসাহিত করে। কারণ জমিয়ে রাখা মানেই ঐ সম্পদের ওপর যাকাত দিতে হবে। সত্যি কথা বলতে ক্রেডিট ফাইনান্সিং আর গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্র ঋণের বিপরীতে মুসলিম সোসাইটিতে যাকাত হচ্ছে একটা স্ট্রং অস্ত্র। সবাই যদি যাকাত দেয়, অটোমেটিক্যালিই ঋণের প্রয়োজনীয়তা কমে যাবে।
সাদাকাহ হলো আরেকটি। আরো আছে ওয়াকফ, ইনহেরিটেন্স এর সুন্দর সিস্টেম এগুলো সবই ক্যাপিটালের সরবরাহ দেয়। ইসলামে আরেকটা সিস্টেম হলো কারদে হাসানা বা বিনোভোলেন্ট লোন, যা কারো জরুরী প্রয়োজনে দেওয়া হয়।
“তোমরা সালাত কায়েম কর, যাকাত দাও এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ (কারদে হাসানা) দাও।” [সূরাহ আল-মুযযাম্মিল ৭৩:২০]
ইসলামিক সিস্টেমে পাবলিক সেক্টর, প্রাইভেট সেক্টর এর পাশাপাশি ভলান্টারি সেক্টর নামেও একটা সেক্টর আছে। যা সারপ্লাস ইউনিট থেকে ডেফিসিট ইউনিটে অর্থ সরবরাহ করে।
“তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে, তারা কী ব্যয় করবে। বলে দাও-যে বস্তুই তোমরা ব্যয় কর, তা হবে পিতা-মাতার জন্যে, আত্মীয়-আপনজনের জন্যে, এতীম-অনাথদের জন্যে, অসহায়দের জন্যে এবং মুসাফিরদের জন্যে। আর তোমরা যে কোনো সৎকাজ করবে, নিঃসন্দেহে তা অত্যন্ত ভালোভাবেই আল্লাহর জানা রয়েছে।” [সূরাহ আল-বাকারাহ ২:২১৫]
এই আয়াতে কী জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো? কোথায়, কীভাবে, কী ব্যয় করবে। কীভাবে ইনকাম করবে তা বলা হয়নি। আমি বলছি না যে, কুর’আনে কোথাও ইনকামের কথা বলা নাই। আমি বলতে চাইছি, হাশরের মাঠে কোথা থেকে ইনকাম করেছো তা যেমন জিজ্ঞেস করা হবে, কোথায় ব্যয় করেছো তাও বলা হবে। আপনি যদি বলেন আপনি সুদী ঋণ দিয়ে, বন্ড, কমার্শিয়াল পেপার কিনে ব্যয় করেছেন, তবে কিন্তু আপনার খবর আছে!
আরেকটা সিস্টেম হলো প্রফিট লস শেয়ারিং। আল্লাহ্ বলেছেন, “কেউ কেউ আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধানে দেশে-বিদেশে ভ্রমণ (ইয়াদরিবুনা) করবে” [সূরাহ আল-মুযযাম্মিল ৭৩:২০]। এখানে ভ্রমণ মানে ব্যবসায় করতে ভ্রমণ। প্রফিট লস শেয়ারিংয়ের দু’টো প্রধান পদ্ধতি হলো মুদারাবা, আরেক টা মুশারাকা। আমাদের কাছে টাকা থাকলে আমরা কী করি? ব্যাংকে জমা রাখি। কেন? আমাদের সোসাইটিতে অনেকেই আছে যারা টাকার অভাবে অনেক ভালো বিজনেস প্লান নিয়ে এগুতে পারছে না। আপনি তাকে টাকা দিন প্রফিট লস শেয়ারিং সিস্টেমে। আপনি কি দিবেন? না কেন? কারণ ট্রাস্ট, বিশ্বাসের অভাব। যেহেতু ট্রাস্ট নাই, সেহেতু প্রফিট লস শেয়ারিং ও নাই। যা আছে তা হলো ঋণ। এইবার ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে চলো।
অনেক কথা বললাম। সব সামারাইজ করি। সুদ হচ্ছে ক্রেডিট ফাইনান্সিংয়ের অবধারিত ফল। সুদ থেকে সত্যিকার অর্থে মুক্তি পেতে হলে দরকার ক্রেডিট ফাইনান্সিং থেকে মুক্তি, ঋণ থেকে মুক্তি। এর জন্য দরকার আইডিয়াল মুসলিম সোসাইটি যারা যাকাত দিবে বাধ্যতামূলকভাবে, যারা আবু বকর (রাঃ), উসমান (রাঃ) এর মতো সাদকাহ করবে, যারা কারদে হাসানা দিবে, যারা ওয়াকফ করবে, যারা প্রফিট লস শেয়ারিংয়ে বিজনেস করবে। যারা শুধুমাত্র সম্পদ বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় মত্ত থাকবে না। যাদের নিজের পকেটে পর্যাপ্ত টাকা না থাকলেও ঘরে এয়ার কন্ডিশনিং করার জন্য লাখ টাকা ঋণ নিবে না। যারা সিম্পল লাইফ লিড করবে, অহেতুক খরচ করবে না। তাই একটা আইডিয়াল মুসলিম সোসাইটিতে আসলে ক্রেডিট ফাইনান্সিংয়ের তেমন দরকার পড়ে না, মানে ব্যাংকের রোল অনেক কমে যায়। আর যতদিন ক্রেডিট ফাইনান্সিং চলবে, আমরা ঠিক না হবো, ততোদিন সর্বোচ্চ বর্তমান ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের মতো একটা বাইপাস সিস্টেমে চলতে হবে, সুদ থেকে বাঁচার জন্য, কিন্তু সুদ আর সমাজ থেকে নির্মূল হবে না।
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।
১. ক্রেডিট ফাইন্যান্সিং কি?
২. ভলান্টারি সাদাকাহ টার্মটা বলতে কি বোঝায়?
৩. ওয়াকফ সিস্টেমটা কি?
৪. প্রফিট লস শেয়ারিং এর দুটি প্রধান পদ্ধতি: মুদারাবা ও মুশারাকা বলতে কী বোঝায়?
কাউকে ঋণ দেয়াকেই ক্রেডিট ফাইনান্সিং বলে। এখানে ক্রেডিট ফাইন্যান্সিং বলতে মুরাবাহা চুক্তিকে বোঝানো হয়েছে যেটি মূলত ক্রয় বিক্রয়ের চুক্তি হলেও, বর্তমানে এটার সর্বশেষ ফলাফল হলো ক্রেতা বিক্রেতা ঋণগ্রহীতা ও ঋনদাতাতে রুপান্তর হয়। মুরাবাহা সম্পর্কে জানতে এই (https://www.muslimmedia.info/2016/03/21/islamic-banking-murabaha-and-time-value-of-money) আর্টিকেট পড়তে পারেন।
ভলান্টারি সাদাকাহ মানে দান করা যা আবশ্যিক নয়। ওয়াকফও কোন কিছু আল্লাহ’র সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে দান করাকে বুঝায়। তবে ওয়াকফ সেসব সম্পত্তিকে করা হয় যা ব্যবহার এর ফলে মূল সম্পত্তি নিঃশেষ হয়ে যায়না। যেমনঃ কেউ মসজিদ এর জন্য নিজের জায়গা-জমি’র কিছু অংশ ওয়াকফ করে দিল। মুদারাবা আর মুশারাকা হলো অংশীদারিতব। যেখানে দুই বা এর বেশী মানুষ একসাথে হয়ে ব্যবসায় শুরু করে। মুশারাকাতে দুইজনই মূলধন সরবরাহ করে, আর মুদারাবাতে একজন মূলধন দেয় অন্যজন শ্রম দেয়।