সুমাইয়া বাবা-মা’র একমাত্র মেয়ে। ছোটবেলা থেকেই তার মধ্যে কিছু এক্সট্রা-অর্ডিনারি গুণ রয়েছে। তাই বাবা-মা’ও তাকে একটু বেশি আদর করে এবং তার চাওয়া-পাওয়ার কোন কমতি রাখেনা। আর মেয়েকে নিয়ে তাদের রয়েছে অনেক স্বপ্ন, অনেক আশা। সুমাইয়ার বয়স হওয়ার সাথে সাথে বাবা-মা’র ভালোবাসা ও স্বপ্ন দুটিই যেন বেড়ে চলছে। তাদের মেয়ে শহরের সেরা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করবে, সুনাম অর্জন করবে, সবাই মেয়েকে চিনবে এবং তার প্রশংসা করবে এগুলোই তাদের চাওয়া।
এদিকে তাদের মেয়ে আজ শহরের প্রথম সারির একটি প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করছে, আত্মীয়-স্বজনরাও তার প্রশংসা করে বেড়াচ্ছে। আর এসব ভাবতেই বাবা-মা’র দিন চলে যায় এবং মেয়ের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য আল্লাহর নিকট দু’আ করতে থাকে। আরেকটি বিষয় যে সুমাইয়াকে তাদের বাবা-মা ছোটবেলায় ইসলামের প্রাথমিক শিক্ষা দিলেও এর প্রভাব সুমাইয়ার উপর কতোটা পড়েছে তা এখন বুঝা যাচ্ছেনা। তবে সে কুরআন তিলাওয়াত করতে পারে, রমাদানে সিয়াম রাখে, এবং মাঝেমধ্যে সালাতও আদায় করে।
দেখতে দেখতে সুমাইয়া কলেজ পেরিয়ে নামকরা এক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো। এদিকে বাবা-মা’র স্বপ্নটাও অনেকদূর এগিয়ে গেল। আর সুমাইয়ার জীবনের এই নতুন অধ্যায়ের (ভার্সিটি লাইফের) শুরুতেই বন্ধু-বান্ধবীদের নিয়ে একটি বন্ধু সার্কেল তৈরী হলো এবং তারা একসাথে হেসে-গেয়ে ভার্সিটি লাইফ উপভোগ করতে শুরু করলো। ভার্সিটির বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও তাদের অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো। প্রতিদিনের ন্যায় একদিন তারা যখন ভার্সিটির লাইব্রেরীতে পত্রিকা দেখছিল তখন তাদের চোখে পড়লো- ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’ প্রতিযোগিতা নামে এক শিরোনাম। যেখানে সুন্দরী মেয়েদের প্রতিযোগিতা হয় এবং অনেকের মধ্য থেকে একজনকে বিজয়ী ঘোষনা করে ‘বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগিতায়’ অংশগ্রহনের জন্য মনোনীত করা হয়। যদিও বাংলাদেশে এ প্রতিযোগিতাটা সবে মাত্র শুরু হয়েছে, তবুও এর জনপ্রিয়তা বেশ ছড়িয়ে পড়েছে। তাই সুমাইয়া ও তার বান্ধবী সার্কেল থেকে কে অংশগ্রহণ করবে তা নিয়ে চলছে নানা জরিপ। সবাই ঠিক করলো তাদের মধ্য থেকে দুজন সুন্দরী রেজিস্ট্রেশন করবে। আর এ দুজনের মধ্যেও স্থান করে নিয়েছে সুমাইয়া। সুমাইয়া প্রথমে সংশয়ে থাকলেও বন্ধু-বান্ধবীদের সমর্থনে রাজি হয়ে গেল। এখন শুধু বাবা-মা’র সম্মতির পালা। সুমাইয়া ভালো করেই জানে তার বাবা-মা তার ইচ্ছায় অমত পোষণ করবে না। সত্যিই তাই সুমাইয়ার বাবা-মাও মেয়ের এই ইচ্ছার পাশে দাড়ালো এবং এই প্রতিযোগীতায়ও সেরা হওয়ার জন্য দু’আ করতেও শুরু করলো।
এসে গেল সেই কাঙ্খিত দিন। প্রায় ৫০০ জন পার্টিসিপেন্ট এর মধ্য থেকে সর্বোচ্চ ১০০ জন পাবে ইয়েস কার্ড। সুমাইয়া ও তার বান্ধবীও আসলো, সাথে তাদের সেই বন্ধু সার্কেলও খুব আগ্রহের সাথে অপেক্ষা করতে থাকলো। সিরিয়াল পেছনে থাকায় একটু বেশি অপেক্ষা করতে হলেও এবার সুমাইয়াকে ডাকা হলো। স্টেজে আসতেই সুমাইয়ার একটু শালীন ড্রেসআপ দেখে জাজদের মেজাজ অনেকটা হট হয়ে গেল। তার উপর উচ্চতা, ওজন এসব প্রশ্নের উত্তরে সুমাইয়া একটু সংকোচ ফিল করতেই জাজদের সিদ্ধান্ত হয়ে গেল তাকে আর ইয়েস কার্ড দেয়া যাচ্ছে না। তাই সুমাইয়াকে ফিরতে হলো ওয়েটিং কার্ড নিয়েই। কিন্তু সে আর ওয়েট না করেই বাসায় চলে গেল, আর ভাবতে থাকলো সে বুঝি হেরে গেল। অন্যদিকে সুমাইয়ার বান্ধবী ইয়েসকার্ড পেয়ে রীতিমতো খুশিতে ডুবে যাচ্ছে এবং বন্ধু সার্কেলের সবাইকে নিয়ে পরদিন পার্টি দেয়ারও ঘোষনা দিলো। এদিকে সুমাইয়ার চোখ অশ্রুতে ভেসে যাচ্ছে। আর মেয়ের এ কষ্টে বাবা-মা’ও কষ্ট পাচ্ছে এবং মেয়েকে সান্ত্বনা দিয়ে চলছে।
ইয়েস কার্ড এর পর্ব পেরিয়ে সুমাইয়ার বান্ধবী এখন ফাইনাল রাউন্ডের খুব নিকটে। বন্ধু সার্কেলের সবাই খুব আগ্রহ নিয়ে এ প্রতিযোগিতা দেখে চলছে। কেবল সুমাইয়াকে এ নিয়ে তেমন কৌতূহলী আর দেখা যাচ্ছে না, বন্ধু সার্কেলেও সে তেমন একটা বেশি সময় দিচ্ছে না। হয়তো সেই ইয়েস কার্ড না পাওয়াই এর মূল কারণ। এদিকে সুমাইয়ার বান্ধবী জয়ী হয়েও জয়ী হতে পারলো না। অর্থাৎ টপ টেন থেকে ছিটকে পড়েছে সে। তাই সেও একটু দুঃখিত। তবে সে যতটুকু এগিয়েছে এতেই সে এখন একপ্রকার সেলিব্রিটি হয়ে গেছে। ভার্সিটিতে ঢুকতেই বড়-ছোট সবাই তাকে অভিনন্দন দিতে মরিয়া হয় উঠেছে, এমনকি শিক্ষকরাও। অন্যদিকে সুমাইয়া বিষয়টাকে একরকম বিরক্তকরই মনে করছে এবং বন্ধু সার্কেল থেকেও সুমাইয়া নিজেকে একপ্রকার আলাদা করে নিয়েছে।
এদিকে বছর শেষ না হতেই আগামী বছরের জন্য রেজিস্ট্রেশন করতে বিজ্ঞাপন চলে আসছে। বন্ধু সার্কেলের দু-একজন সুমাইয়াকে আবার রেজিস্ট্রেশন করতে উৎসাহ দিতে লাগলো। কিন্তু এবার সুমাইয়া তাদের মুখের উপর রিএক্ট করে বসলো, যা শুনতে তারা একদমই অপ্রস্তুত ছিল। সুমাইয়া বলতে লাগলো- এ কেমন প্রতিযোগিতা যেখানে ন্যূনতম শালীনতা থাকতে নেই, যেখানে বডি স্ট্রাকচার এ্যানালাইজ করা হয়, যেখানে নিজের পছন্দ বলে কিছু নেই সবই জাজদের পছন্দে হবে! এটাতো আমার ব্যাক্তি স্বাধীনতাও কেড়ে নিতে চায়! আমি এমন ইয়েস কার্ড চাই না যার ফলে নিজেকে বিক্রি করে দিতে হয়! তাই আমি আর এতে অংশ নিতে চাচ্ছি না।
সুমাইয়ার এরকম রিএক্ট দেখে ইয়েসকার্ড পাওয়া বান্ধবীও একটু পেছনে ফিরে তাকালো। সে এবার সুমাইয়াকে সাপোর্ট দিয়ে বলতে শুরু করলো- আসলেই এমনটা হয়, এমনকি এর চেয়েও বেশি হয়! তুই ইয়েস কার্ড না পেয়ে ভালোই আছিস। মানুষ ভাবছে আমি কতোকিছু পেয়েছি! অথচ আমি এমন কিছু হারিয়েছি, যা কখনো ফেরত পাওয়ার নয়! অথচ ইয়েস কার্ড পাওয়ার পূর্বে ভাবতাম এটাই বুঝি হবে আমার সেরা পাওয়া। কিন্তু এটা পেয়ে বুঝতে পারলাম এটা ছিলো আমার হারানোর শুরু মাত্র!
দ’জনের মুখে এমনকিছু শুনতে পেয়ে বন্ধু সার্কেলের সাবই নিরব হয়ে গেল এবং আগামী সুন্দরী প্রতিযোগিতা নিয়ে সবাই আগ্রহ হারিয়ে ফেলল। এমনকি কেউ এই অজানা সত্য জানতে পেরে পরবর্তী প্রজন্মকে এমনকিছুতে অংশগ্রহণ করা থেকে যেকোন প্রকারে বিরত রাখার প্রতিজ্ঞাও করে ফেলল। আর এই সত্য উন্মোচনের মাধ্যমেই বন্ধু সার্কেলের আড্ডা আজকের মতো সমাপ্তি হলো। এদিকে সুমাইয়া তার দিক পরিবর্তনের দিকে আরেক ধাপ এগিয়ে চললো। এখন সে ঠুনকো ইয়েস কার্ডকে পেছেন ফেলে পরবর্তী ইয়েস কার্ডের জন্য মরিয়া হয় উঠলো। যেখানে প্রতিযোগিতা হবে হাজারো কোটি মানুষের সাথে, যেখানে জাজ হবেন মাত্র একজন। আর তিনি দেখেন না কে বিশি সুন্দর, কে বেশি লম্বা! তিনি দেখেন শুধু মানুষের অন্তর ও আমল।
পরিশেষে এতটুকুই বলবো- ‘সুমাইয়া এখানে শুধু নিজের নয় হাজারো সুমাইয়ার প্রতিনিধিত্ব করছে। সে তাদের সামনে স্পষ্ট করে দিতে চাচ্ছে যে, এ জাহেলিয়াত থেকে নিজেকে দূরে রাখো এবং জান্নাতে নিজের একটুকরো জায়গা পাবার জন্য ইয়েস কার্ড খুঁজে বেড়াও। যেখানে হারানোর মতো কিছুই থাকবেনা, সবই হবে আনন্দের ও উপভোগের।’
আল্লাহ আমাদের জন্য সহজ করুন (আমিন)।
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।