মদীনাতে আগমনের প্রথম দিন জ্বর থাকায় হোটেল ছেড়ে বের হতে পারিনি, তাই দ্বিতীয় দিন প্রিয় নবী রাসূল ﷺ এর কবর যিয়ারত করেছিলাম। ভীড় এড়ানোর উদ্দেশ্যে এশার সালাতের পর, রাতের খাওয়া দাওয়া শেষে দশটার পর বের হয়েছিলাম। এত রাতে রাস্তা ও মাসজিদে লোকসমাগম বেশ কম থাকে। মাসজিদুল হারামে দিন রাত সবসময় লোকারণ্য থাকলেও, যেহেতু মসজিদে নববীতে রাত কাটাতে অনুমতি দেওয়া হয় না, তাই এখানে এশার পর থেকেই ভীড় হালকা হতে শুরু করে। শুধু রোজার সময় ইতিকাফকারীদের জন্য ও মুসল্লীদের জন্য সারা রাত মাসজিদে থাকার সুবিধা দেওয়া হয়। এত রাতে যেহেতু কোনো জামাত হয় না, তাই উনার কবর সংলগ্ন অংশটুকু ছাড়া মাসজিদের অন্যান্য অংশে মানুষ নেই বললেই চলে। হাজ্জের মৌসুমের মনে হয় চব্বিশ ঘণ্টাই কবর যিয়ারতের জন্য ভীড় লেগে থাকে।
মহিলাদের যিয়ারতের সময় সাদা চাদরের পর্দা দিয়ে পুরুষদের অংশ থেকে মহিলাদের অংশ আলাদা করে দেওয়া হয়। পুরুষরা কবরের যতটা কাছে যেতে পারে, মহিলাদের কবরের কাছে যাওয়া নিষেধ হবার কারণে ততটা নিকটে যেতে দেওয়া হয় না। এছাড়া মহিলারা এখানে এসে অত্যধিক আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন, অনেক বিদআতি ও হারাম কাজ করে ফেলেন। অনেকে রাসূলের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে উনার কাছে দু’আ করতে থাকেন, বা কিছু চাইতে থাকেন যেখানে আল্লাহ্ ছাড়া আর কারো আছে কোনো দু’আ করা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। নারী গার্ডরা তাই সর্বক্ষণ ব্যস্ত থাকেন দর্শনার্থী রমণীকুলকে শান্ত ও সুশৃঙ্খল রাখতে।
গার্ডরা ঘোষণা করতে থাকেন, বিভিন্ন অঞ্চলের মহিলাদের আলাদা আলাদা ডাকেন, তখন বাকিরা অপেক্ষা করতে থাকেন। একদলের যিয়ারত ও রিয়াদুল জান্নাতে সালাত পড়া শেষ হলে, অন্য দলকে যেতে বলা হয়। ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মানুষদের দেখলাম এক সাথে ডাকা হয়।
সত্যি কথা বলতে কি, আমি খুব সাবধানতার মনোভাব নিয়ে মাসজিদে এসেছি, পাছে কোনো বিদআতি বা শির্কি কিছু করে ফেলি, এই আতঙ্কে। আমি সত্যি সত্যি কার কবর যিয়ারত করতে যাচ্ছিলাম, তাঁর বিশেষত্ব আমার মাথায় তখনো ঠিকমতো কাজ করছিলো না। কোনো ভুল না করে যেন শরিয়ত মোতাবেক সম্মান প্রদর্শন করতে পারি, আমার পুরো মন কেবলমাত্র সেই চিন্তাতেই মগ্ন ছিলো।
কিন্তু ধীরে ধীরে যখন উনার কবরের দিকে এগোতে লাগলাম, নিজেও জানি না কখন হঠাৎ করে আমার সমগ্র হৃদয় প্রচণ্ড আবেগে আলোড়িত হয়ে উঠলো। কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ হয়ে চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। আমি কোথায় এসেছি, এ কথা ভেবে আমার সমস্ত অস্তিত্ব কেঁপে উঠলো। আমাদের প্রাণপ্রিয় নবী মোহাম্মদ ﷺ এঁর কবরের পাশে আসলে একজন কঠোর হৃদয়ের অধিকারীও নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারবে না। যে মানুষটি সারা জীবন তাঁর উম্মতদের জন্য, অর্থাৎ আমাদের জন্য দু’আ করেছেন, রাতের পর রাত চোখের পানি ফেলেছেন, আমি এখন তাঁর পবিত্র মাসজিদে তাঁরই কবরের সামনে দাঁড়িয়ে আছি!! এক অসম্ভব ভালোবাসার জোয়ারে যেন প্লাবিত হলাম, এই তীব্র ভালোবাসা এতদিন আমার অন্তরের কোন গহীনে লুকিয়ে ছিল জানি না।
অন্য কোনে ধর্মের মানুষ তাদের পথ প্রদর্শকদের এতটা গভীরভাবে, এতটা পবিত্রভাবে ভালবাসতে পারে, এ কথা আমি বিশ্বাস করি না। যে কারণে আমাদের নবীকে কেউ অসম্মানের চেষ্টা করলে মুসলিমরা আক্রোশে পাগল হয়ে যায়। নিজেদের মা-বাবাকে অপমান করলেও লোকে এত রাগান্বিত হয় না, উনার নামে যেকোনো বিরূপ কথায় যেরূপ উত্তেজিত হয়ে পড়ে। হয়তো অন্তরের অন্তঃস্থলে লুকিয়ে থাকা এই প্রবল ভালোবাসার তাগিদে মুসলিমরা এমন করেন। যদিও এই আবেগ আমাদের যেন ভুল পথে নিয়ে না যায় সেই বিচার-বিবেচনা বোধ আমাদের রাখতে হবে।
রাগের মাথায় যেকোনো পদক্ষেপ নেবার আগে সে জায়গায় নবীজী জীবিত থাকলে স্বয়ং তিনি কী করতেন, সেই অনুযায়ী কাজ করতে হবে। যে ধরনের ঘটনায় উনি ধৈর্য ধরতেন, সেখানে আমাদেরও ধৈর্য ধরা; আবার যেসব ক্ষেত্রে উনি আদেশ দিয়ে গেছেন কঠোর হতে, সেক্ষেত্রে আমাদেরও উনার নির্দেশ অনুযায়ী চলা দায়িত্ব। কিন্তু আবেগের আতিশয্যের সময় যুক্তি দ্বারা চিন্তা করাও যেন এক পরীক্ষা হয়ে দাঁড়ায়।
ভীড় ঠেলে যতদূর যাওয়া যায় উনার কবরের সামনে দাঁড়িয়ে সালাম দিলাম, জানি উনি আমার সালাম সরাসরি শুনতে পাবেন না। কারণ আমি মদীনা অথবা বিশ্বের যে প্রান্ত থেকেই সালাম দেই না কেন, ফেরেশতারা আমার সালাম তাঁর কাছে পৌঁছে দেবে। পৃথিবীতে প্রচুর ফেরেশতা নিয়োজিত আছেন, যাদের কাজ হলো যখন উনার উপর কেউ সালাম বর্ষণ করবে, সেই সালাম তাঁকে পৌঁছে দেওয়া। উনার কবরের পাশে যথাক্রমে আবু বকর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) ও উমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) এঁর কবর। উনাদেরকেও সালাম দিলাম।
আগে জানতাম নবীজির কবরের স্থানকে রওজা বলে। এখানে এসে দেখলাম রওজা অর্থ কবর নয়। বরং আমরা যাকে রিয়াদুল জান্নাত বা জান্নাতের বাগান বলি, সেই অংশটিকে রওজা বা রাওদাহ বলা হয়। রিয়াদ শব্দটির একবচন হল রাওদাহ, যার অর্থ বাগান। রাসূল ﷺ বলেছেন, উনার ঘরের ও মিম্বারের মধ্যখানের স্থানটি জান্নাতের বাগানগুলোর একটি।
“জান্নাতের বাগান” শব্দটির সঠিক অর্থ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। যেমন মতিউর রাহমান মাদানীর লেকচারে শুনেছি, অনেকে বলেন কিয়ামতের পর এই বাগান জান্নাতের সাথে জুড়ে দেওয়া হবে। আবার কেউ বলেন জান্নাতের বাগান এখানে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। আবার islamqa website এ বলা আছে, জান্নাতের সাথে রিয়াদুল জান্নাত লাগিয়ে দেওয়া হবে, অথবা “জান্নাতের বাগান” শব্দদ্বয় একধরনের metaphor বা রূপক অর্থে ব্যবহৃত। যে যা-ই বলুক, এ সম্পর্কে নির্ভুল তথ্য একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা জানেন। যেহেতু রিয়াদুল জান্নাতে সালাত আদায় করাকে আলাদা করে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, তাই সকলে প্রাণপণ চেষ্টা করেন অন্তত একবার হলেও এখানে দু রাকাত নফল সালাত আদায় করতে। এই নশ্বর পৃথিবীতে থেকে জান্নাতের অংশে সালাত আদায়ের সৌভাগ্য কে হাতছাড়া করতে চায়?
রাওদাহ বা রিয়াদুল জান্নাতে সালাতের চেষ্টা করা যেন যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার সমতুল্য!!! মাত্রাতিরিক্ত ভিড়ে চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যাবার আশঙ্কা এখানে অমূলক নয়। একে অন্যকে ধাক্কা দিয়ে, যে যেভাবে পারে সালাত আদায়ের প্রয়াস নিতে গিয়ে মনে হয় সালাতের আসল উদ্দেশ্যেই গণ্ডগোল লেগে যায়। যেমন, আমি আমার অভিজ্ঞতার কথাটুকুই বলি।
বহুকষ্টে খালি জায়গা পেয়ে দাঁড়ালাম। নিজেদের অজান্তেই আমার সামনে পিছনে সবাই আমাকে ঠেলা দিয়ে ফেলে দেবার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলো। আমিও নাছোড়বান্দার মত দাঁড়িয়ে সূরাহ পড়তে লাগলাম। জামাত ছাড়া একাকী সালাতের সময় সামনে আড়াল/সুতরা রাখা বাধ্যতামূলক। কিন্তু এখানে আড়াল রাখা তো দূরের কথা, আমি সেজদা করার জায়গাও পাচ্ছিলাম না। রুকু করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হলো। আমার সামনে ভিড় কিছুটা হালকা হলে সেজদায় গেলাম। সবাই এমনভাবে ধাক্কাধাক্কি করতে লাগলো যেন আমার মাথার উপর দিয়ে হাঁটা দেবে! এভাবে অতি কষ্টে সেখানে সালাত শেষ করলাম। যদিও অন্য মুসল্লিকে কষ্ট দেওয়া নিষিদ্ধ। এবং রিয়াদুল জান্নাতে সালাতের জন্য এমন ধাক্কা-ধাক্কি, ঠেলা-ঠেলি সম্পূর্ণরূপে অনাকাঙ্ক্ষিত! তারপরও এই ভীড়ে লোকে জেনে, না জেনে, ইচ্ছায়, অনিচ্ছায় অন্যের কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আল্লাহ্ যেন আমাদের সবাইকে তৌফিক দেন বিবেচকের মতো ব্যবহার করার। সেদিন আমার বাকি দুজন সঙ্গী সমেত রিয়াদুল জান্নাতে সালাত পড়ে ও কবর যিয়ারত করে গভীর রাতে হোটেলে ফেরত আসলাম।
দুইপরবর্তীতে অন্য এক রাতে নববীতে যাচ্ছিলাম রওশন আপা ও পারুল আন্টি সহ। এমন সময় নববীর চত্বরে দেখি অপূর্ব চেহারার ৮/৯ বছরের এক আরব বালক হাপুস নয়নে কাঁদছে। তার ভাষা না বুঝলেও বেশ বুঝলাম বেচারা হারিয়ে গেছে। আমার মতো বয়স্করা যেখানে হারিয়ে যেতে পারে, সে তুলনায় এ তো নিতান্ত দুগ্ধপোষ্য শিশু। এত রাতে একে ফেলে চলে যাওয়া সম্ভব নয়, আবার বেচারার একটি কথাও আমরা বুঝতে পারছি না। মহা মুশকিলে পড়ে গেলাম। শেষে তাকে নিয়ে গেলাম নববীর মহিলা গার্ডদের কাছে, তাদের বহু কষ্টে ইশারায় বোঝালাম বাচ্চাটি হারিয়ে গেছে, ওর মায়ের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। আশা করি ছেলেটিকে সহি সালামতে মায়ের কাছে পৌঁছানো হয়েছিলো।
এদেশের শিশুরা দেখতে অসামান্য রূপবান হয়। অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা তাদের সারল্য দিয়ে খুব সহজেই মানুষের মন জয় করে ফেলে। শুধু এর এক ব্যতিক্রম দেখলাম একদিন মাসজিদের অজুখানায়। এত ধুরন্ধর বালিকা জীবনে কমই দেখেছি। এস্কেলেটর দিয়ে নিচে নেমে গেলে মাটির নিচে সারি সারি ঝকঝকে পরিষ্কার টয়লেট ও অজুখানার ব্যবস্থা রয়েছে। আমি অন্য মহিলাদের সাথে ওযু করছিলাম, এমন সময় অতি করুণ চেহারার রূপসী এক বালিকার আগমন ঘটলো। কিছু কিছু মানুষের রূপ এমন মোহনীয় হয় যে তাদের দিকে তাকালে সাধারণ বিবেক বুদ্ধিলোপ পায়, তাদের সব কথাকেই তখন যুক্তিযুক্ত মনে হয়। এই মেয়েও সেই প্রজাতির। এই অল্প বয়সেই সে তার মাসুম চেহারা ব্যবহার করে ফায়দা লোটা শিখে গেছে।
আমার দিকে তাকিয়ে হাত পা নেড়ে জিজ্ঞেস করলো আমি কি ইংরেজ নাকি। আমি ভাবলাম সে জানতে চাইছে আমি ইংরেজি পারি কি না। আমি সম্মতিসূচক মাথা নাড়লাম। সে ধরে নিল আমি ইংরেজ!! ভাষা না জানার কী হাস্যকর বিপত্তি!! এই পিচ্চি জীবনে নিশ্চয় ইংরেজ দেখেনাই। তা না হলে আমার মতো শ্যামল বর্ণের কাউকে ইংরেজ ভাবার কোনো কারণ এ ত্রিভুবনে নাই। মেয়েটি আমার জাতীয়তার (!) পরিচয় পেয়ে যারপরনাই কৃতার্থ হবার ভান করলো। দুই একটা ইংরেজি শব্দ, কিছু আরবী শব্দ আর ইশারা দিয়ে যা বোঝালো তার মর্মার্থ হলো, ইংরেজ হওয়া ‘বিশাল’ ব্যাপার।
এইটুকুন এক মেয়ে এত তোষামোদি কোথা থেকে শিখলো, তা ভেবে আশ্চর্য হতে হয়। অনেক তৈলমর্দনমূলক কথাবার্তা বলে, করুণ স্বরে সে আসল কথায় আসলো। তা হলো বেচারি হারিয়ে গেছে। তার মাকে খুঁজে পাচ্ছে না। আমি যদি অনুগ্রহ করে আমার মোবাইল খানি তাকে দেই, তাহলে সে তার মাকে ফোন করে নিজের অবস্থান জানাতে পারবে। এত সুন্দরী বালিকার সকরুণ আকুতিতে গলে না যাওয়া কার সাধ্য! আমিও প্রায় গলেই যাচ্ছিলাম। তখন আমার পাশে পাকিস্তানী এক মহিলা বললেন, এখানে অনেক ছোট ছেলেমেয়ে ফোন ও টুকিটাকি জিনিস চুরি করে। তাই আমার ফোন দেবার আগে যেন আমি সাবধানে দেই।
ততক্ষণে এই পিচ্চির ভাব ভঙ্গিমায় কেমন যেন মন খচখচানি শুরু হয়ে গেছে। আমি মেয়েটিকে বললাম, চলো তোমাকে গার্ডের কাছে নিয়ে যাই, তারা তোমাকে অবশ্যই মায়ের কাছে পৌঁছে দেবে। উল্লেখ্য, আমি আরবী জানি না। মেয়েটি ইংরেজি, বাংলা, উর্দু কিছুই জানে না। তারপরও ইশারা ও ভাঙা ভাঙা শব্দ দিয়ে দুজনেই দুজনের কথা বুঝতে পারছিলাম। গার্ডের নাম শুনেই মেয়ের চেহারায় চোর চোর ভাব ফুটে উঠলো। নানাভাবে আমাকে বুঝাতে চেষ্টা করলো সে কিছুতেই গার্ডের কাছে যাবে না। আমি যেই ওকে ধরে ফেলতে গেলাম, মেয়ে দিলো দৌড়। এক দৌড়ে এস্কেলেটরের উপর।
ধরা খেয়ে তার পুরো চেহারা পাল্টে গেলো, এখন তার চোখে হিংস্র শ্বাপদের চাহনি। সেই তোষামোদি চেহারা মুহূর্তে গায়েব। হতে পারে তার পরিকল্পনা ছিলো আমার ফোন নিয়ে দৌড় দেবার। দৌড়ে ওর সাথে আমি অবশ্যই পারতাম না। মেয়েটির শীতল দৃষ্টি দেখে মানুষের বুক কেঁপে উঠবে। এ বয়সী মেয়ে এত চালাক হতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। যা-ই হোক, আমি আর তাড়া করলাম না মেয়েটিকে। যাক যেখানে খুশি। কিন্তু সেই বালিকার চোখের অশরীরী ভূতুড়ে চাহুনি আমি এখনো ভুলতে পারিনি।
মক্কা-মদীনায় বসবাস করার ফলে সবাই এখানে ভালো মানুষ, এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। এখানে চোর-ছ্যাঁচড়ের কোনো অভাব নেই। এমনকি তওয়াফের সময় পর্যন্ত লোকে ব্যাগ কেটে চুরি করে নিয়ে যায়, সেখানে এই মেয়ে তো কোন ছাড়!! আমার এক আত্মীয় একবার হাজ্জ করতে এসে প্রায় লাখখানেক টাকা নিয়ে হারাম শরীফ গেছেন এবং পথিমধ্যে কোনোভাবে ব্যাগ হাত থেকে পড়ে যায়। যখন উনি টের পান ব্যাগ হারিয়ে গেছে, ততক্ষণে সেই টাকার থলে অন্যের হাতে চলে গেছে। শেষমেশ মানুষের নিকট থেকে ধার কর্জ করে চলতে হয়েছে উনাকে। তাই হাজ্জে এসে প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থ বা মূল্যবান জিনিসপত্র সুটকেসে তালা দিয়ে অথবা হোটেলের লকারে রেখে আসা উত্তম। যতটুকু প্রয়োজন তার অধিক টাকা-কড়ি নিয়ে হোটেল থেকে বের না হওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
মাসজিদে নববীতে “lost and found” নামের একটি কক্ষ রয়েছে। উপযুক্ত প্রমাণ দেখালে হারানো জিনিস ফেরত পাওয়া যায়। অবশ্য এক্ষেত্রে শর্ত হলো, হারানো সেই বস্তু যদি চুরি না হয়, এবং কোনো সহৃদয় ব্যক্তি যদি খুঁজে পেয়ে এই বিভাগে জমা দিয়ে যায়। তাই আমাদেরও উচিত পথেঘাটে কারো গুরুত্বপূর্ণ সামগ্রী পড়ে থাকতে দেখলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেওয়া। আমাদের সামান্য এই প্রয়াস কোনো হাজ্জ যাত্রীর বিপুল উপকার হতে পারে।
তিনমদীনার দিনগুলো ভালোই কাটতে লাগলো। দেখা গেলো, আমাদের রুমের ম্যাজেন্টা বোরকা পরিহিতা মহিলা হবিগঞ্জ হতে আগত। তাঁর স্বামী সৈনিক ছিলেন, এখন অবসরপ্রাপ্ত। তাঁদের কন্যা জামাতা মদীনায় থাকে। সেই জামাই, শ্বশুর শ্বা শুড়ির জন্য নানা সময়ে ফলমূল নিয়ে দেখা করতে আসে, তখন স্বামী-স্ত্রী মহানন্দে ফলাহার করেন। আবার কখনো বুড়া মিয়া বুড়ি বিবির জন্য নাস্তা নিয়ে আসেন এবং দুজনে মিলে একত্রে ভাগ করে সেই নাস্তা খান। বৃদ্ধ এই চাচা মিয়া তাঁর স্ত্রীর জন্য ভালবাসা দেখাতে কোনো কমতি করেন না। স্ত্রীকে নিয়ে ইচ্ছামতো কেনাকাটা করেন। দিনে দিনে দেখি এদেশ থেকে সোনার চেইন থেকে শুরু করে কম্বল পর্যন্ত কিনে বাক্স ভরিয়ে ফেলেছেন। এত কেনাকাটার স্থান সংকুলান কল্পে রুমের একমাত্র আলমারিটা তাই হবিগঞ্জ নিবাসিনীর দখলে চলে গেলো। আমাদের সুটকেস ও ব্যাগেই আমাদের মাল সামানের জায়গা হয়ে যাচ্ছিলো বিধায়, আমরা বাকিরা এতে কোনো আক্ষেপ দেখালাম না। বরং চোখ বড় বড় করে উনাদের বাজার করা দেখতাম। অন্যের আনন্দ দেখতে খারাপ লাগতো না।
এই আন্টি সম্পর্কে বলতে গেলে সবার আগে বলতে হয়, তাঁর অত্যধিক সরলতার কথা। উনার ব্যবহারে এখনো গ্রাম্য ধাঁচ আছে, শহুরে চাতুর্যের ছোঁয়া সেখানে লাগেনি। যেকোনো কথাই সহজে বিশ্বাস করে ফেলেন। উনার গল্প তাঁর এক অতি সরলতার কাহিনী দিয়ে শেষ করি। অন্য অনেকের মতোই ইনিও ধরে নিয়েছেন আমি অবিবাহিত, অল্প বয়সী এক মেয়ে, কোনো না কোনোভাবে হাজ্জে চলে এসেছি। আমার রুমের রমণীদ্বয় উনাকে যতই বলেন আমার বিয়ে হয়েছে, উনি ততই অবিশ্বাস করেন। আমার বর্ণচোরা চেহারা দেখে আমাকে বিবাহিতা হিসাবে কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না। তাঁকে কিছুতেই যখন বিশ্বাস করানো গেলো না, তখন সবাই তাঁকে নিয়ে এক মজার খেলায় মেতে উঠলো। (যদিও আমি এভাবে কাউকে বোকা বানানো একদমই পছন্দ করি না, কিন্তু এই ঘটনার উপর আমার কোনো হাত ছিলো না।)
রওশন আপা আর পারুল আন্টি তখন তাঁর কথা মেনে নিয়ে বললেন, আসলেই তো অল্প বয়সের মেয়ে, বিয়ে শাদি না করে হাজ্জে চলে এসেছে (কি সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার!!)। এই মেয়ের জন্য তো এখন পাত্র দেখতে হয়!! এত উত্তম প্রস্তাব উনার খুব মনে ধরলো। হাজ্জ করতে এসে সম্ভাব্য ঘটকালির মতো আনন্দদায়ক ঘটনা চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করার অভিপ্রায়ে তাঁর মন আনন্দে নেচে উঠলো। বিবাহিতা মহিলারা হলো লেজ কাটা শেয়ালের ন্যায়। লেজ কাটা শেয়াল যেমন নিজের লেজ কেটেছে বলে অন্যের লেজটিও কাটানোর জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে, ঠিক তেমনি মহিলারা নিজে বিবাহিতা হবার সাথে সাথে আশেপাশের তাবৎ কুমারীদের বিবাহ ক্রিয়া সম্পাদন লক্ষ্যে অস্থির হয়ে পড়েন।
উনার আনন্দিত চেহারা দেখে পারুল আন্টি আর রওশন আপা চাপা আনন্দ উপভোগ করতে লাগলেন। মদীনাতে এসে এমন বিনোদনপূর্ণ ঘটনা ঘটবে কে ভেবেছিলো! প্রতিদিন তারা এই নিয়ে নানারকম হাস্যরস করতো, আর আমিও এসবে মনে মনে আমোদিত হতাম। ঘটনা আরো উত্তেজক অবস্থায় পৌঁছলো, যখন আমার জন্য সত্যিকারের পাত্র যোগাড় হয়ে গেলো!! রওশন আপা সবাইকে জানালেন একজন পাত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। পাত্র বেশি দূরে নয়, আমাদের এই হোটেলেই উঠেছেন। বর্তমানে আমাদের সামনের কক্ষে অবস্থান করছেন। পাত্র দীর্ঘকায়, গৌরবর্ণের যুবক। আমার সাথে নাকি বয়সেও মিলে যায়!! এত তাড়াতাড়ি পাত্র যোগাড় হওয়াতে হবিগঞ্জ নিবাসিনীর আনন্দ আর ধরে না। এখানে আর উল্লেখ না করে পারছি না, পাত্র আর কেউ নয়, আমাদের অতি পরিচিত, থুক্কু আমার অলরেডি বিয়ে করা বর “সাফির চৌধুরী”।
পাত্র-পাত্রীর দেখা করানো অথবা বিয়ে শাদী সংক্রান্ত কথা বার্তা নিয়ে আমার রুমের সকলের যথেষ্ট আনন্দেই দিন কেটে যাচ্ছিলো। বেচারিকে সবাই মিলে এমন বোকা বানাচ্ছিলেন, যা দেখে মায়াই লাগবে যে কারো। কিন্তু বোকা বানানোর এই সুখ তাদের কপালে বেশিদিন সইলো না। একদিন রাতে আমি আর সাফির রাতের খাবার খেয়ে রুমে ফেরত যাচ্ছিলাম, আমাদের ফ্লোরে যেই এলিভেটর থামলো, এলিভেটরের দরজা খোলার সাথে সাথে দেখি আমাদের ঠিক সামনে সেই আন্টি দাঁড়িয়ে আছেন। একেবারে যাকে বলে “পড়বি তো পড় মালীর ঘাড়ে”। এত রাতে দুই বিবাহযোগ্য তরুণ তরুণীকে, তাও আবার যাদের বিবাহের কথাবার্তা চলছে, তাদের একত্রে দেখে উনার কী ধারণা হয়েছিল জানি না। তবে মুখে না বললেও, তাঁর বাকরুদ্ধ চেহারাই যা বলার বলে দিয়েছিলো। বেচারি নিশ্চয় মনে দারুণ দুঃখ পেয়েছিলেন। অবশেষে এই দৃশ্য দেখার পর উনাকে বিশ্বাস করানো গিয়েছিলো আমি অবিবাহিতা নই এবং আলহামদুলিল্লাহ্ বরের সাথে হাজ্জে এসেছি।
চারমদীনাতে মাসজিদে নববীতে সালাত পড়ার সাথে সাথে ছোটখাটো হাস্যরসাত্মক ঘটনা ও টুকিটাকি কেনাকাটার মাঝে আমাদের দিন ভালোই কেটে যাচ্ছিলো। রাস্তাঘাটে যখন চলাচল করতাম, তখন মানুষদের রীতিনীতি, সংস্কৃতি ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করতাম। সৌদি আরবে এলে সকলেই খেয়াল করবেন, এদেশে নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশা একেবারেই চোখে পড়ে না। নারীরা সাধারণত মাহরাম পুরুষ ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের সাথে বের হন না। এখানে রেস্টুরেন্টেও মহিলা ও পুরুষদের আলাদা বসার ব্যবস্থা।
একদিন রাতে আমরা আল-বাইকে (কেএফসি ধরনের ফুড চেইন) খেতে গেলাম। সেখানে ছেলেদের বসার স্থান নিচতলায় ও মেয়েদের ওপর তলায়। অবশ্যই একে ভালো ব্যবস্থা বলা চলে। কিন্তু আমরা দুজন একসাথে খেতে এসে আলাদা আলাদা স্থানে খাবার খাবো, এই ব্যাপারটা আমার কিছুতেই হজম হচ্ছিলো না। খাবার হজম হওয়া তো দূরের কথা। নিচতলায় প্রথমে প্রবেশ করতে গেলাম। সেখানে দেখি সাফিরকে ঢুকতে দেবে, কিন্তু আমাকে দেবে না। কী যন্ত্রণার কথা! এত রাতে ক্ষুধার্ত অবস্থায় এই ঝামেলা কার ভাল লাগে! এদের ভাষাও ছাই বোধগম্য হয়! অনেকক্ষণ পর বোঝা গেলো উপরের এক ফ্লোরে যারা পরিবার নিয়ে খেতে আসেন, তাঁদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা রয়েছে। উপরতলায় গিয়ে দেখি বিশাল এক কক্ষে চারদিক ঘেরা প্রচুর কিউবিকল এবং সেই কিউবিকলের মাঝে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে আরাম করে খাবার ব্যবস্থা। সেখানে পরিবারের নারীরা নেকাব খুলে শান্তিমতো খেতে পারবে ও আশেপাশে অন্যরা তাদের দেখতেও পাবে না।
আরবে আসার পর থেকে দেখছি মহিলারা সকলে বোরকা পরেন। আর যারা হাজ্জে এসেছেন বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে, তাঁরাও নিঃসন্দেহে যথেষ্ট পর্দা অবলম্বন করেন। বোরকা পরলে এখানে অন্যরকম সম্মান পাওয়া যায়। এত পর্দানশীন মহিলাদের দেখতে দেখতে এসব অত্যন্ত চোখ সওয়া হয়ে গেলো। মনে পড়ে যেদিন বাংলাদেশে ফেরত এসেছিলাম, ঢাকা বিমানবন্দরে মাথায় কাপড় ছাড়া মহিলাদের অস্বাভাবিক ও বেমানান মনে হচ্ছিলো। নিজের পরিচিত দেশের পরিচিত আবহেও আমার চরম অস্বস্তি লাগছিলো, এমনকি সহজে চোখ তুলে তাকাতেও পারছিলাম না। একেই হয়তো বলে সৎসঙ্গে স্বর্গবাস!
মক্কা-মদীনাতে এলে আল্লাহ্কে গভীরভাবে উপলব্ধি করার সুযোগ পাওয়া যায়। এখানে এসে পাপ পঙ্কিলতাময় এই পৃথিবী হঠাৎ অতি তুচ্ছ বোধ হয়। তাই অনেকেই হাজ্জ যাত্রায় অন্যসময়ের চেয়ে অনেক খালেস অন্তরে আল্লাহ্র ইবাদাত করতে পারেন, তাঁর কাছে দু’আ করতে পারেন। সারা জীবন আমরা দুনিয়ার পেছনে ছুটে বেড়াই। দুনিয়াবি শিক্ষা-দীক্ষা ও ধন-সম্পদ অর্জনের মোহ মায়াতে আমরা চোখে ঠুলি পরা কলুর বলদের মতো সমাজের বেঁধে দেওয়া দুষ্ট চক্রে ঘুরে ঘুরে পার করে দেই এই মূল্যবান জীবন। পার্থিব মোহজালে আবিষ্ট হয়ে পাপিষ্ঠ হতেও দ্বিধা হয় না আমাদের। আমরা ভুলে থাকতে পছন্দ করি আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য।
আল্লাহ্ আমাদের তৈরি করেছেন কেন, তার জবাব আমরা ক’জন দিতে পারবো? আল্লাহ্ পাক কুরআনে উল্লেখ করেছেন তিনি মানবজাতি ও জীন জাতিকে তাঁর ইবাদাত করার জন্য সৃষ্টি করেছেন। অথচ আল্লাহ্র সৃষ্ট এই আমরা তাঁরই দেওয়া শরীর, মন, সামর্থ্য দিয়ে ক্রমাগত তাঁর নাফরমানি করে যাই। সারাদিনের সবচেয়ে ক্ষুদ্র অংশ হয়তো ব্যয় করি তাঁর ইবাদাতের জন্য, অনেকে তো তাও করি না। যেখানে আমাদের পৃথিবীতে আসার আসল উদ্দেশ্য কিন্তু এই ‘ইবাদাত’, অন্য কিছু নয়।
আমাদের জীবনের সকল অর্জন, উপার্জন ধূলিকণার ন্যায় উড়ে যাবে, যদি আমরা আল্লাহকে না মানি, তাঁর দেখানো পথে না চলি। আল্লাহ্ যেন আমাদের উনাকে সজ্ঞানে মানার তৌফিক দান করেন।
আগামী পর্ব: মদীনার ঐতিহাসিক স্থানসমূহ
মুসলিম মিডিয়া ব্লগের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সহ তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। ব্লগ পরিচালনায় প্রতি মাসের খরচ বহনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত কাম্য। বিস্তারিত জানতে এখানে ভিজিট করুন।
নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনাদের মতামত জানান। ভালো লাগবে আপনাদের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারলে। আর লেখা সম্পর্কিত কোন জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্যই "ওয়ার্ডপ্রেস থেকে কমেন্ট করুন"।